JustPaste.it

রুশ কয়েদীদের জবানবন্দীঃ

 

আফগানিস্তানে আমরা কি দেখেছি?

সুলতান সিদ্দিকী

===================================================================

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

লাল বাহিনীর অযােগ্যতা

        রুশ বাহিনীর কাপুরুষতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতা সম্পর্কে সুলাইমানভের বক্তব্য হলাে, সমগ্র রুশ বাহিনী কয়েক ভাগে বিভক্ত। উৰ্দ্ধতন অফিসাররা কমুনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত এবং তারা রাশিয়ান। এজন্য অন্য গ্রুপের সৈন্যরা কোন অবস্থাতেই তাদের মােকাবেলা করতে সক্ষম হয়না। তারা রাজকীয় জীবন যাপন করে। অন্যরা যারা রাশিয়ান বা কম্যুনিস্ট কোনটাই নয় তাদের অনেকেই আফগানিস্তানে যুদ্ধ করার ব্যপারে মােটেই আন্তরিক নয়। যে কোন মুল্যে তারা আফগানিস্তান খেকে ফিরে যেতে আগ্রহী। সােভিয়েট ইউনিয়নের মুসলিম এলাকার সৈন্যরা কয়েকবারই নিজেদের গােলাবারুদ নিজেরাই নষ্ট করেছে এবং নিজেদের অস্ত্র বহুবার আফগানিদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে এবং পরে তারা ধরাও পড়েছে।

 

         আবার অনেকে তাে আফগানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে না বলে অফিসারকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে। তাদের কথা হল, আমরা আগে মুসলমান, পরে রাশিয়ান। আফগান মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করার অপরাধে ১৯৮২ র ফেব্রুয়ারী মাসে বুগরামের বিমান বন্দরে দশজন তুর্কিস্তানী মুসলি সেনাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর পর থেকে মুসলমান এলাকার অধিকাংশ সৈন্যকে সৌভিয়েট ইউনিয়নে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আফগানিস্তানকে বিদেশী আগ্রাসন থেকে মুক্ত করার নামে যাদেরকে আফগানিস্তানে পাঠানাে হয়েছিল তারা যখন একথা বুঝতে পারে যে, আগ্রাসী শক্তি মূলতঃ সােভিয়েত ইউনিয়নই এবং সােভিয়েত সরকারই তাদেরকে আগ্রাসন চালানাের জন্য আফগানিস্তানে পাঠিয়েছে। তখন থেকেই রুশ সৈন্যরা রাশিয়া সম্পর্কে বিরুপ মনােভাব পােষন করতে থাকে। সুযােগ পেলেই তারা বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র ও গােলা বারুদ আফগানিস্তানের মুজাহীদদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারা অস্ত্র বিক্রির অর্থ দ্বারা খাদ্য দ্রব্য, মদ ইত্যাদি খরিদ করতাে। অনেক রুশ সৈন্যকে মুজাহীদরা মাতাল অবস্থায় গ্রেফতার করেছে। মদ ও নেশার মধ্যেই তারা ডুবে থাকতাে। ঘরে ঘরে তল্লাশী চালিয়ে মূল্যবান জিনিষ পত্র তারা এ উদ্দ্যেশেই লুট করে নিত। অধীনস্তু সৈন্যদের সাথে সেনা, অফিসারদের ব্যবহার দেখলে মনে হতাে যে, এরা তাদের কেনা গােলাম। সাধারণ ব্যপারে এবং কারণে-অকারণে তাদেরকে নির্মম শান্তি দেয়া হত।

 

         যেমনঃ দায়িত্ব পালনের পর অবসর সময়ে হয়ত কেউ কোথাও শুয়ে আছে। কোন অফিসার তাকে দেখে ফেলে আর শুয়ে থাকা সম্ভব নয়। নির্দয়ভাবে লাথি মেরে তাকে তুলে দিত। সাধারণ সৈন্যরা অফিসারদের নির্দেশ অমান্য করার কল্পনাও করতে পারে না। অসাবধানতা বশতঃ যদি কারাে থেকে কখনাে এরূপ হয়ে যায়, তাহলে তার ওপর এমন নির্যাতন চালানাে হয় যে, অনেকে মরেই যায়। অনেকে শাস্তির ভয়ে আত্মহত্যা ও করেছে। বামিয়ানে সুলাইমানভের দু'জন সাথী অত্যাচারের ভয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে একজন সফল হয়, আরেকজনকে মারত্বক অসুস্থ অবস্থায় কাবুলের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সুস্থ হওয়ার পর তাকে কে, জি, বির হাতে সােপর্দ করা হয়। অবশেষে তার ভাগ্যে কি ঘটেছে তা আল্লাহই জানেন।

 

অনন্ত জীবনের অপেক্ষায়

         সুলাইমানভ-আব্দুল হাই স্বদেশে ফিরে যাবার জন্য ব্যকুল। হয়ে পড়ে। পিতা মাতা, ভাই, বােন আত্মীয়স্বজন খেলার সাথীদেরকে এক নজর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে সে। কিন্তু একটি দীর্ঘ নিশ্বাঃস ছেড়ে দুঃখের সাথে বলল-আমার এই পরিচয় ও নাম নিয়ে কিভাবে আমি দেশে যাব। কে, জি, বি এক মূহুর্তের জন্য আমাকে জীবিত থাকার সুযােগ দেবে না। রুশ বাহিনী থেকে পলায়নের পরিণাম ভালভাবেই জানা আছে তার। যে দু’জন সৈন্য তার সামনেই পালিয়ে গিয়েছিল এক বৃদ্ধ আফগান কম্যুনিস্ট তাদেরকে নিজ ঘরে লুকিয়ে রেখে কমান্ডারকে সংবাদ দেয়। এ সংবাদ শুনে রুশ কমান্ডারের মুখমন্ডল এমন রক্তিম হয়ে ওঠে যে, তার কপােল বেয়ে যেন রক্ত করছে। তৎক্ষনাৎ সে একদল সৈন্য নিয়ে গ্রামে এসে পালিয়ে আসা সৈন্যদ্বয়কে গুলী করে হত্যা করে। এরপর মৃত দেহগুলাে ক্যাম্পে সকলের সামনে ঝুলিয়ে রাখে। যেন অন্যরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। সুলাইমান আব্দুল হাই বলেনঃ আমি পরম আনন্দিত এজন্য যে, “আমি মায়ের আদেশ লংঘন করিনি। আরেকবার মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযােগ না পেলেও আমি মনে করব যে, তিনি আমার উপর সন্তুষ্ট রয়েছেন। অনন্ত জীবনের অপেক্ষায় রইলাম। যেখানে মা-ছেলের মাঝে বিরহ সৃষ্টিকারী কে, জি, বি-র সদস্য থাকবে না।”

 

এক গােলন্দাজ

         গারীগুরী ভিক্টর একজন রুশ সৈন্য। কয়েক মাস যাবত তাকে বিমান বিধ্বংসী তােপ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে। কাবুলের উত্তরে অবস্থিত জাবালুসসিরাজ ও পাঞ্চশীরের যুদ্ধ ক্ষেত্র গুলােতে রাতদিন শূন্যে তাকিয়ে তার সময় কাটতাে। শত্রুদের কোন বিমান ভুলেও সেদিকে আসতােনা। কিংবা অন্যজায়গা থেকে বিমান হামলার কোন সংবাদও তার কাছে কেউ কোনদিন বলেনি।

 

দুশমনদের কাল্পনিক হামলা

         গারীগুরী তখন মুজাহিদদের হাতে বন্দী। এবার সে বুঝতে পারে যে, তাকে বিমান বিধ্বংসী তােপের দায়িত্বে নিয়ােজিত করে এবং না দেখা বিমান হামলার অপেক্ষায় রেখে রাশিয়ানরা নিজ সৈন্যদেরকে ধােকায় ফেলেছিল। আফগানিস্তানে পাঠানাের আগে তাদেকে বলা হয়েছিল যে, আফগানিস্তানের ওপর বিদেশী শক্তির আগ্রাসনের মােকাবেলায় তাদেরকে পাঠানাে হচ্ছে। একথার সত্যতা প্রমান করার জন্য উল্লেখিত ধােকাবাজির আশ্রয় নেয়া হয়। যে কোন মুহুর্তে আমেরিকা, চীন কিংবা পাকিস্তানের জঙ্গী বিমানগুলাে হামলা করে বসতে পারে এ ভয় দেখিয়ে তাদেরকে সর্বদা সন্ত্রস্ত রাখা হত। আফগানিস্তানে পাঠানাের পূর্বে গারীগুরীকে এ কথাই বলা হয়েছিল। আর এ উদ্দেশ্যেই তাকে বিমান হামলার মােকাবেলা করার প্রশিক্ষন দেয়া হয়েছিল। কাবুলে পৌছার পর আকাশ পথ প্রতিরক্ষায় বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত এক দলের সাথে তাকে শামিল করা হয়।

 

২২শে মার্চ ১৯৮৫-এ ভিক্টর অন্যান্য সৈন্যদের সাথে আফগানিস্তানে এসেছে। জাবালুসশিরাজের লালকিল্লার রাশিয়ান ক্যাম্পে তিনি প্রথমে অবস্থান করেন। এখানে তাকে একটি এয়ারক্র্যাপ্ট গান পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। একমাস অতিবাহিত হওয়ার পরও শত্রুদের কোন বিমান আকাশে উড়তে না দেখে সে তার সিনিয়র সাথী ও অফিসারদের কাছে এর কারণ জানতে চায়। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তারা তাকে বুঝায়, এটা একটা ছােট ক্যাম্প। সামরিক গুরুত্বপূর্ণ বড় মারকাজটি পাঞ্জশীর উপত্যাকায়। সেখানে আকাশ পথে শত্রুদের হামলা হয়। কিছু দিনপর যখন তাকে পাঞ্জশীরে স্থানান্তর করা হয় তখনও সে বিদেশী বিমান হামলা দেখতে পেল না। প্রশ্ন করা হলে বলা হয় যে, এ এলাকা সীমান্ত থেকেই প্রতিহত করা হয়।

 

         স্থানীয় জনসাধারণ ও সৈন্যদের মাঝে মেলামেশা ও কথাবার্তা বলার ব্যপারে খুব কড়াকড়ি করা হতাে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই ভিক্টর প্রকৃত ঘটনা জেনে ফেলে যে, আফগানিদেরকে অস্তিত্বের পাতা থেকে মুছে ফেলার জন্যই তাদেরকে আফগানিস্তানে পাঠানাে হয়েছে। রাশিয়া ব্যতিত অন্য কোন দেশের সৈন্যই সেখানে নেই। বিমান হামলার তাে প্রশ্নই আসেনা। তারপর রুশ সেনা অফিসারদেরকে মনে মনে ঘৃনা করতে থাকে ভিক্টর। দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে এদিক ওদিক ঘুরাফেরা করেই সময় কাটাতে থাকে এবং অন্যদের দেখা-দেখি সামরিক গাড়ীর পেট্রোল ও অন্যন্য সরঞ্জাম গোপনে বিক্রি করা শুরু করে।

 

আহমদ শাহ মাসউদের অধীনে

         মুজাহিদরা তাকে কিভাবে গ্রেফতার করলাে এ প্রশ্নের উত্তরে গারীগুরী ভিক্টর জানায় যে, একদিন আমি সামরিক গাড়ী থেকে তেল নিয়ে বিক্রয়ের জন্য বাজারে নিয়ে যাই। তখন দু’জন মুজাহিদ আমাকে গ্রেফতার করে ফেলে। তারা ছিল সুপ্রসিদ্ধ গেরিলা কমান্ডার আহমদ শাহ মাসউদের দলের। তারা আমাকে ধরে তাদের সাথে যেতে বলল। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার কিছুই আমি জানতাম না। তবে আমি নিশ্চিন্ত হই যে, তারা আমার কোন ক্ষতি করবে না। কেন্দ্রে পৌছে তারা আমাকে আফগানিদের জামা, পাঞ্জাবি, জুতা ও টুপি পরতে দেয়। তখন আমাকে আর রুশসৈন্য বলার কোন উপায় ছিলনা।

 

         কিন্তু সমস্যা হলাে আমি তাে মুজাহিদদের ভাষা জানতাম না। যার ফলে তাদের কোন কথাই আমি বুঝতে পারছিলাম না। অবশেষে একজন আফগান ড্রাইভার আমাকে এ সমস্যা থেকে রক্ষা করেন। তিনি কাবুলে এক রুশ ট্রান্সপাের্ট কোম্পানির সাথে কাজ করতেন এবং রুশীভাষায় বেশ পারদর্শী ছিলেন। তিনি আমাকে যথেষ্ট উপকার করেছেন। আমাকে একটি রেডিও সেট এনে দেন, যার মাধ্যমে আমি রাশিয়ান রেডিও ষ্টেশন থেকে প্রচারিত খবরাখবর শুনতে পেতাম। দীর্ঘ দিন যাবত মুজাহিদদের সাথে থাকার ফলে আমি তাদের চরিত্র ও ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয়ার সৌভাগ্য লাভ করি। ইসলামের যে দিকটি আমার মনে স্থান করে নিয়েছে, তাহলে তাঁর অনুপম আদর্শ। চারিত্রিক শক্তিই মুসলমানদের মুল সম্পদ। ইসলামের অন্য যে বিষয়টি আমাকে অভিভূত করেছে, তাহলাে এর অনুসারিরা পার্থিব কোন শক্তিকেই ভয় করেনা। রাশিয়ার মতাে পরাশক্তির সাথে দীর্ঘ দিন যাবত লড়াই করে তারা একথা প্রমাণ করেছে যে, তারা কোন দিক থেকেই দুর্বল নয়।

 

আহতদের সেবা

         গারীগুরী ভিক্টর ইসলাম গ্রহণ করে এখন আব্দুর রহীম নামে পরিচিত। জালিমদের সংগ ত্যাগ করে তিনি এখন মজলুমদের সেবা করার পরম সুযােগ হাতে পেয়েছেন। যাদেরকে জখম করার জন্য তাকে আফগানিস্তানে আনা হয়েছিলাে। এখন তিনি দরদের সাথে নরমহাতে তাদের জখমেই পট্টী বেঁধে দেন।

 

        আবদুর রহীম এখন পাঞ্জশীর মুজাহিদদের একটি হাসপাতালে কাজ করেন তিনি একজন মওলানা সাহেবের নিকট কোরআন পড়তে শিখেছেন। এখন দ্বীনি পুস্তকাদী পাঠ করেন। হাসপাতালে একটি চেয়ারে বসে ডাক্তারদের ব্যবস্থাপত্র অনুসারে রােগীদের ঔষধ বিতরণ করেন। দীর্ঘদিন যাবত নির্দিষ্ট স্থানে বিমান বিধ্বংসী তােপ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়ােজিত থাকার কারণে আঃ রহীম আফগানিস্তানের রুশ সৈন্যদের কর্মতৎপরতা ও কর্মকৌশল সম্পর্কে তেমন একটা অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেনি। তা সত্বেও তিনি বলেন যে, রাশিয়া আফগান জনসাধারণের বিরুদ্ধে বিভিন্নস্থানে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করেছে। পাঞ্জাশীরে রাসায়নিক গ্যাস ব্যবহারের খবর রাশিয়ার সরকারী পত্রিকা ‘প্রাভদা’ ১১ ই জুন ১৯৮৩ সংখ্যায় স্বীকার করা হয়েছে। আব্দুর রহীম স্বচক্ষে এমন রােগীও দেখেছেন, যারা বিষাক্ত গ্যাসের শিকার এবং তাদের কয়েকজন শ্রবনশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি দুটোই হারিয়েছেন।

 

 ═──────────────═