ভূ-গোলময় পৃথিবী
আরাকানের কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিঃ
দলে দলে নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসছে
আব্দুল্লাহ ফারুক
বাংলাদেশ থেকে আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শেষ হতে না হতেই আরাকানে নতুন করে মুসলিম নির্যাতনের খবর পাওয়া গেছে। এবার আর গতানুগতিক পন্থায় নয়, এক অভিনব পৈশাচিক প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের আরাকান থেকে উৎখাত করার অভিযান শুরু করেছে মায়ানমারের সামরিক সরকার। এ পন্থাটি হলো, মুসলিম অধ্যুষিত আরাকানে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে মুসলমানদের দেশত্যাগে বাধ্য করা। জানা গেছে, এ অভিনব পন্থাটি উদ্ভাবনে চরম মুসলিম নিপীড়নকারী, মধ্য প্রাচ্যের বিষফোড়া ইসরাঈলী গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
১৯৪৮ সাল থেকে আরাকানকে মুসলিম শূন্য করার জন্য এ পর্যন্ত ১৩টি সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে না পেরে মায়ানমার সরকার গত বছরের শেষের দিকে ইসরাঈলী এজেন্টদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করে। ফিলিস্তিনী মুসলমানদের নিজ দেশে উদ্বাস্তের জাতিতে পরিণত করার ইসরাঈলী অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে ইসরাঈলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে আরাকানে নিযুক্ত করা হয়েছে। এ প্রতিবেদক আরাকান থেকে সদ্য আগত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সাথে আলাপ করে জানতে পেরেছেন যে, ইসরাঈলী এজেন্টরা উত্তর আরাকানের বিভিন্ন টাউনসীপে প্রকাশ্যে ঘোরাফিরা করে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। এ সময় বর্মী মিলিটারী ইন্টেলিজেন্সের সদস্যদের তাদের সাথে থেকে সহায়তা করতে দেখা গেছে।
আরাকানে ফসল ঘরে তোলার মওসুম শুরু হলে এ নতুন যৌথ চক্রান্তের স্বরূপ প্রকাশ পায়। সেনাবাহিনী ও নাসাক্কা (বার্মার সিকিউরিটি ফোর্স) বল প্রয়োগ করে রপ্তানী করার নাম করে মুসলমানদের উৎপাদিত ফসল বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করে। এর ওপর চাল বিক্রির উপর আরোপিত ট্যাক্স কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়। ফলে চালের মূল্যও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে আরাকানে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৬০ খিয়াট যা সাধারণ মুসলমানদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। ফলে আরাকানের সর্বত্র এখন হাহাকার চলছে, খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
পক্ষান্তরে, আরাকানের সংখ্যালঘু মঘ (রাখাইন) ও অন্যান্য উপজাতিরা বেশ সুখেই আছে। দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি থেকে তাদের বাঁচাবার জন্য সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত বিশেষ রেশন ব্যবস্থা চালু করেছে। মুসলমানদের থেকে কেড়ে নেয়া চালই রেশনের নামে তাদের বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সংখ্যালঘুদের আরাকানে অবাধ ব্যবসা- বাণিজ্য করার পারমিট রয়েছে। আরাকানের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে তাদের একচেটিয়া দখলদারিত্ব বিরাজ করছে। পক্ষান্তরে, ১৯৯১ সালের সামরিক অভিযানের সময় মুসলমানদের ব্যবসা-বানিজ্য করার পারমিট বাতিল করা হয়, সকল ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করা হয়। এখনও সে অবস্থা বহাল আছে। একমাত্র কৃষিকাজ ছাড়া মুসলমানদের জীবিকা অর্জনের আর কোন উপায় নেই। এর উপর রয়েছে সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক 'কুলি' কাজের বোঝা। সেনাক্যাম্প থেকে দেয়া তালিকা অনুযায়ী এলাকার মুসলমানদের নিজ খরচে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কাজ করে দিতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে বোঝা বহন, রান্না বান্নার পানি টানা, নতুন বাংকার খনন, তার স্থাপন, কাপড়- চোপড়, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ধোয়া প্রভৃতি।
একদিকে মুসলমানরা কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের কারণে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে, অন্যদিকে চলছে নিত্য নতুন নির্যাতন। মুসলমানদের এখন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হলেও স্থানীয় মোড়ল ও দায়িত্বশীল সেনা কর্মকর্তার পারমিটের প্রয়োজন হয়। আগে এ বাধ্যবাধকতার পরিধী এক থানা থেকে অন্য থানা পর্যন্ত সীমিত ছিল। এ ছাড়া যে সব মুসলমানকে আগে সাদা ন্যাশনালিটি কার্ড (দ্বিতীয় শ্রেণীর তথা ভাসমান নাগরিকের মর্যাদা সম্পন্ন) দেয়া হয়েছিল তাও এখন বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। কোন মুসলমান এর কারণ জানতে চাইলে বলা হয়, ‘তোমরা আরাকানে বিদেশী নাগরিক, তোমরা চট্টলার,(চট্টগ্রামের মানুষ) সেখানে চলে যাও।’
মুসলমানদের আরাকান ত্যাগে বাধ্য করতে মায়ানমার ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষও এক নতুন ফর্মুলা উদ্ভাবন করেছে। এ ফর্মুলার মূলনীতি হলো কবিতার ছন্দে বার্মিজ ভাষার দু’লাইনের একটি কবিতা।
‘মে মিউ মাং মিউ মঞ্চ
লু মিউ মাং লু মিউ ভ’
এর বাংলা তরজমা দাড়ায় 'জমিনে মানুষ গিলে ফেললেও মানুষ শেষ হবে না, যদিনা মানুষ মানুষেকে গিলে ফেলে। এতে মানুষ শেষ হয়ে যাবে।'
এ পলিসির আওতায় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ দুটি পন্থা ব্যবহার করছে।
১। পদে পদে নির্যাতন চালিয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা। মুসলমানদের বিদেশী প্রমাণ করে তাদের সহায়-সম্বল জোর করে বাজেয়াপ্ত করা! ধর্ম পালন, শিক্ষা গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। গত ঈদুল আজহার সময় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের এ ফর্মুলা অনুযায়ী আরাকানের মুসলমানদের যথা সময়ে ঈদের নামাজ আদায় ও কুরবানী করতে দেয়া হয়নি।
কুরবানীর আগের দিন মুসলমানদের বলে দেয়া হয়, এদেশে বসবাস করতে হলে আল্লাহর আদেশ মানা যাবে না, সরকারের আদেশ অনুযায়ী চলতে হবে। সরকারের আদেশ অনুযায়ী তোমরা ১৮ই এপ্রিলের পরিবর্তে ২১ শে এপ্রিল কোরবানী করবে এবং তা সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে মায়ানমার সরকারের নামে দিতে হবে। মুসলমানরা এ স্পষ্ট শিরকে লিপ্ত হতে অপরাগতা প্রকাশ করে ঈদের নামাজ আদায় ও কোরবানী করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়।
২। বিবাহ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা। এ পন্থায় মুসলিম যুবতীদের জোরপূর্বক মঘ ও অন্যান্য অমুসলিম যুবকদের সাথে বিবাহ দেয়া হয়। বিবাহের পর তাদের ইসলাম ত্যাগ করে মঘ (রাখাইন) ধর্ম ও কালচার গ্রহণে বাধ্য করা হয়। মুসলিম নারী যে সন্তান জন্ম দেয়, তাকেও পিতৃ পরিচয়ে লালন পালন করা হয়। এভাবে জোরপূর্বক বিবাহের মাধ্যমে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
আরাকানের মুসলমানদের উপর যে নির্যাতনের সয়লাব বয়ে যাচ্ছে, তা বিশ্বাস করাও কঠিন! বার্মা ইউনিয়ন কাঠামোর আওতায় আরাকান শাসিত হলেও আরাকানের মুসলমানদের মূল ভূখন্ডে যাবার কোন অধিকার নেই। জলে স্থলে সর্বত্র বিশেষ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। আরাকান থেকে দেশের রাজধানী রেঙ্গুন যাওয়ার একমাত্র বিমান বন্দরটি আকিয়াবে অবস্থিত। বিমানের ভাড়া মাত্র ৫২৫ খিয়াট। কিন্তু কোন মুসলমানকে বিমানের টিকিট পেতে হলে রাখাইনদের ধর্ম মন্দিরে পূজার চাঁদা হিসেবে এক থেকে দেড় লক্ষ খিয়াট দিতে হয়। এ চাঁদার রশিদ দেখালে তবেই বিমানের টিকেট মিলে। একই অবস্থা জলপথ ও স্থল পথের যানবাহনের টিকট প্রাপ্তির বেলায়।
আরও আশ্চর্যের বিষয়, এই আধুনিক যুগেও আরাকান এমন এক এলাকা, যেখানে কোন সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, বিদেশী নাগরিকের প্রবেশ নিষিদ্ধ। লৌহ যবনিকা সৃষ্টি করে মায়ানমার কর্তৃপক্ষ মুসলিম নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে পুনরায় দলে দলে রোহিঙ্গা মুসলমান চুপিসারে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। আরাকানে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে যে, মুসলমানরা তাদের সহায় সম্বল সব বিক্রি করে যেন স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে চলে আসছে। গত ৪ঠা মের বিবিসির সান্ধ্যকালীন প্রচারিত খবরে জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও ত্রাণকর্মীদের বরাত দিয়ে অনুরূপ আশংকা ব্যক্ত করা হয়।
সুতরাং ১৯৯১ সালের মতো আর একটি উদ্বাস্তু সমস্যা এড়াতে বাংলাদেশ সরকারকে এখনিই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে অভিজ্ঞমহল অভিমত ব্যক্ত করেছে।