JustPaste.it


প্রেক্ষিত আলোকপাত:


আফগানিস্তানঃ একটি সফল জিহাদ এবং বর্তমান হালচাল। দশ লক্ষ শহীদের সাজানো স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়ার স্পর্ধা
পর্যবেক্ষক


      আফগান, সিংহ পুরুষ আর বীর পুঃঙ্গবদের এক চারণ ভূমি। পৃথিবী কাঁপানো এক ভূ-খণ্ডের নাম। কালজয়ী ইতিহাস স্রষ্টা মহানায়ক আর দুঃসাহসী যোদ্ধা জাতির দেশ এই আফগানিস্তান। যুগে যুগে অসংখ্য শহীদের রক্তে রাঙ্গা এই আফগান ভূমি। এশিয়ার হৃৎপিণ্ড খ্যাত এই পবিত্র ভূমি এশিয়ার রাজনীতিতে বহুবার চালকের ভুমিকা পালন করেছে। ভূ-মণ্ডলীয় গুরুত্বের কারণে অনেক দ্বিগ্বিজয়ী ঘোড়া দাবড়িয়ে খাইবার গিরিপথ দিয়ে এ ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে, নিজ সাম্রাজ্যের সাথে একে যুক্ত করে সাম্রাজ্যের গুরুত্ব বাড়াতে সচেষ্ট ছিল তারা। এজন্য তারা বিশাল সেনাবাহিনী গড়েছে, তাদের লেলিয়ে দিয়েছে আফগানের পাথুরে জমিন দখল করতে। কিন্তু তাদের দ্বিগ্বিজয়ের নেশা শেরদিল আফগানদের প্রতিরোধের তোড়ে কেটে গেছে। দাম্ভিক রাজা-বাদশাহদের অজেয় বাহিনী এসেছে ঘোড়ার খুরের আঘাতে খাইবারের গিরি-কন্দর কাঁপিয়ে। কিন্তু দর্পচূর্ণ হয়ে যাবার পর বিপর্যয় আর পরাজয়ের দুঃসংবাদ নিয়ে বেঁচে থাকা গুটি কতেক সৈন্য কখন যে গিরি পথ পার হয়ে গেছে তা গিরি কন্দরের বাসিন্দা ক্ষুদ্র প্রাণীটিও বোধ হয় টের পায় নি। এ বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টির পেছনে রয়েছে ইসলাম। ইসলাম আফগানীদের হাড্ডি মজ্জায় মিশে গেছে বলেই তাদের দুনিয়ার মানুষ এক পরিচয়ে চিনে –“শির দেগা! নেহি দেগা" আমামা'র জাতি হিসেবে।
      শক্ত, পাথুরে জমিনে লালিত পালিত সরল-সহজ আফগানীরা বিদেশ-প্রীতি বা বিজাতির দালালীতে অভ্যস্ত নয় বলেই তাদের পক্ষে রেকর্ডের পর রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন ইতিহাস সষ্টি সম্ভব হয়েছে। এই তো সেদিনও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের বদ মতলব নিয়ে পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন হস্তক্ষেপ করে নিজেই কি করুণ পরিণতি না বরণ করে নিলো। আফগানীদের বীরত্বের প্রতিক্রিয়ায় বার্লিণ দেয়াল ভাঙ্গল, পূর্ব ইউরোপ মুক্তি পেল, সোভিয়েত সাম্রাজ্য ভেঙ্গে গেল, কমিউনিজমের নয়া ঠিকানা হল গোরস্থানে। এসবই এখন ঐতিহাসিকদের চিন্তার খোরাক। আফগানীদের জিহাদের চেতনা ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, বসনিয়া, আরাকান, মিন্দানাও,ইরিত্রিয়া ও পৃথিবীর অন্যান্য ভূ-খণ্ডের মজলুম মানুষের মনেও জ্বালিয়েছে জিহাদের আলো। সোমালিয়ায় আমেরিকা চরম মার খেয়েছে। আলজেরিয়া, মিশর জিহাদী চেতনার ধ্বজাধারীদের হাতে মোনাফিক চক্র মার খাচ্ছে। কাশ্মীরে মুজাহিদদের নামেই ভারতের ব্রাহ্মণ বাহিনী তটস্থ। বসনিয়ায়ও এক প্রকার অবরুদ্ধ থেকেও মুসলিম মুজাহিদরা ইসলামের শত্রুর মনে সৃষ্টি করেছে ভয়াবহ ত্রাস। ফিলিস্তিনে আফগান জিহাদের কমাণ্ডার আহমদ ইয়াসিন প্রতিষ্ঠিত হামাস সংগঠনের ভয়ে তো ইসরাইল পি,এল,ওর সাথে আপোষ করে অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মধ্য প্রাচ্যের রাজা-বাদশাহ থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের শাসকগোষ্ঠীর হৃৎপিণ্ডও সব সময় কম্পমান হচ্ছে মুজাহিদদের নাম শ্রবণে। আফগানে মার খেয়ে ১৫ খণ্ড হয়েও রাশিয়ার নেতাদের শিক্ষা হয় নি। তারা এবার তাজিকিস্তান ও চেচেনইঙ্গেশতিয়ায় মজলুম মুসলমানদের রক্ত ঝরাচ্ছে। আফগানীদের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেই এ দেশ দু'টির মুজাহিদরাও রাশিয়ার সাথে দেনা-পাওনার কারবার শুরু করে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা তো ভবিষ্যত বাণী করেই ফেলেছে যে, রাশিয়া যদি বেশী বাড়াবাড়ি করে তবে খোদ রাশিয়াই ত্রিশ খণ্ডে পরিণত হলেও আশ্চর্যের কিছুই থাকবে না। এ সবই আফগান ভূখণ্ডে ঘটে যাওয়া মহাবিপ্লবের প্রতিক্রিয়া। এর সিংহভাগ কৃতিত্বের দাবীদার আফগানের শেরদিল মুসলমানরা!
     কিন্তু এরূপ বিশ্ব কাঁপানো ঘটনার জন্মভূমি আফগান ভূমির বর্তমান পরিস্থিতি মোটেই সুখকর নয়। আফগান মুজাহিদরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে যে ঐতিহাসিক সাফল্য এবং সুনাম অর্জন করেছিল, মুজাহিদ নেতাদের বর্তমান ভ্রাতৃঘাতি রক্তাক্ত যুদ্ধ তাদের সে মর্যাদাকেই ক্ষুন্ন করে নি বরং আফগান জিহাদের সমর্থক অগণিত বিশ্ব মুসলিমকেও মর্মাহত করেছে ও করছে। ইসলামের দুশমনরা এ ঘটনার মাধ্যমে জিহাদ ও ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করার মওকা পেয়েছে। মুসলিম নামধারী মুনাফেক ও তাদের যুগপত প্রোপাগাণ্ডার তোড়ে মুসলমান বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী-নেতারা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।
     আমাদের অভিজ্ঞতা মতে, এদেশের যে সমস্ত আল্লাহর প্রিয় বান্দা দায়িত্ব বোধের তাগিদে আফগান জিহাদে শরীক হয়েছিলেন, এদেশে তাদের মত এত বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে হয়ত অন্য কেউ দিন কাটাচ্ছেন না। পাশ্চাত্যের প্রচার মাধ্যম বিশেষ করে বিবিসি, সিএনএন, ভোয়ার উদ্দেশ্যমূলক মুজাহিদ বিদ্বেষী প্রচারণার সয়লাবে সমাজের একশ্রেণীর আবেগ প্রবণ মানুষ ইতিমধ্যেই ভ্রান্তির অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তারা এ ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতকে জিহাদের সাথে একত্রিত করে ফেলে মনের সকল ভাবনা-চিন্তাকে পরিচালিত করছে। মূলতঃ আমরা পাশ্চাত্যের প্রচার মাধ্যমের বদৌলতে শুধুমাত্র মুজাহিদদের ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের খবরটুকুই জানছি, কিন্তু এটা কেন ঘটছে, এর আসল কারণ সম্পর্কে তাদের মাধ্যমে কিছুই জানতে পারছি না। তারা অত্যন্ত সুকৌশলে ক্ষমতা দখলের লড়াই' এই কথার শিরোণামে যুদ্ধে হতাহতের পরিসংখ্যান এবং যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ অত্যন্ত যত্নের সাথে উপস্থাপন করছে। অথচ জিহাদ চলাকালীন সময়ে তারা কিন্তু ময়দানে রুশ বা আফগান বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির খবরাখবর প্রচারে কার্পণ্য করতে মোটেই ভুল করে নি। সে যাই হোক, আমাদের চিন্তা-চেতনার অনুগামী আন্তর্জাতিক কোন সংবাদ প্রচার নেটওয়ার্ক না থাকায় আফগানের ন্যায় বহু ক্ষেত্রেই অজ্ঞ থাকছি, বিকৃত সংবাদ শুনে হতাশাকে সম্বল করছি। আফগানিস্তান সম্পর্কেও এমন চিত্র ছাড়া আর কিই বা আশা করতে পারি। শত্রু যদি প্রতিপক্ষের মধ্যে বিভেদের অস্তিত্ব খুঁজে পায় তবে তাকে বহু রং চড়িয়ে, ফুলিয়ে, ফাঁপিয়ে  প্রচার করে, এটা চিরন্তন সত্য। যে যাই প্রচার করুক, আমাদের মনে রাখতে হবে, আফগানিস্তানে রাশিয়ান বাহিনী হস্তক্ষেপ করার পর আফগানের আলিম সমাজ যে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন তা' বিশ্বের সকল আলিম সমাজ সমর্থন করেছেন, কেউ তার সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন নি। আলিমগণের ইসলামের মর্যাদা হেফাজতের ডাক দেয়ার পরই সর্বস্তরের জনগণ এবং বিশ্ব মুসলিম জিহাদে ঝাপিয়ে পড়েন। এ জিহাদের লক্ষ্য ছিল একটাই, রাশিয়ান বাহিনী এবং তাদের দোসর আফগান বাহিনীর হাত থেকে মুসলমানদের আজাদী আর ইজ্জত রক্ষা করা। ধর্ম পালনের অধিকার, কূলবধু আর মা-বোনদের ইজ্জত, মসজিদ, মাদ্রাসাকে রক্ষা করার জন্যই তারা বুকের রক্ত দিয়েছেন; শাহাদাৎ বরণ করেছেন। আফগানিস্তানের ক্ষমতার মসনদে আরোহন বা অন্য কোন বৈষয়িক প্রাপ্তির জন্য এত বড় কোরবানী যে তারা দেন নি সে ইতিহাস তো সবারই জানা। এই মহান লক্ষ্য তাদের সামনে থাকার কারণেই তারা কোনদিন ফলাফল সম্পর্কে ভাবেন নি বরং আল্লাহর ফয়সালার ওপর সবকিছু অর্পন করে নিজেদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে গেছেন। আল্লাহর কোন সাচ্চা বান্দা, কোন মুজাহিদ কোন দিন ময়দানে এক মুহূর্তের জন্যও ক্লাশিনকভ খানা পাশে রেখে ভাবেন নি যে, তাদের রক্তের সাগর পাড়ি দিয়ে ভবিষ্যতে আফগানের মসনদে রব্বানী বসবেন না গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার বসবেন। তারা প্রতিটি বুলেট ছোড়ার সময় একটাই চিন্তা করেছেন, 'মুসলমানদের আজাদী'। আর মনের এক কোণে যে সূখকর চিন্তাটি স্থান নিয়েছিল, তা হল জালিমের হাত থেকে মুক্তি পাবার পর আফগানিস্তান হবে ইসলামী রাষ্ট্র তার নেতা যে-ই হোক।
     রুশ সেনা আফগান ভূমি ছেড়ে চলে গেছে, তাদের বংশধরদেরও পতন ঘটেছে। অতএব, মুজাহিদরা অর্জন করেছে তাদের কাঙিখত লক্ষ্য এবং জিহাদের এখানেই ঘটেছে পরিসমাপ্তি যেহেতু নির্দিষ্ট কোন দল বা কোন নেতা ক্ষমতায় যাবে সে জন্য জিহাদ হয়নি, সুতরাং বর্তমানে হেকমতিয়ার-রাব্বানী দ্বন্দ্বের সাথে জিহাদকে গুলিয়ে ফেলা বোকামী নয় কি? জিহাদের ময়দানে মুজাহিদদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হেকমতিয়ার রাব্বানীরা লড়াই করেছেন, মুজাহিদদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মুজাহিদ হিসেবে তারা যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন বলেই মুজাহিদরা হয়েছেন বিজয়ী। এজন্য জিহাদের ময়দানে তাদের ভূমিকা গৌরবান্বিত। তখন উভয়ের কার্যক্রমের লক্ষ্য ছিল একটাই, মুসলমানদের শত্রুমুক্ত করা। কিন্তু জিহাদ শেষে একটা জাতির নেতৃত্ব প্রদানের রাজনৈতিক প্রশ্ন যখন উপস্থাপিত হয় তখন পারিপার্শ্বিক আরও বহু প্রশ্নের উদ্ভব হয়। আর এক সঙ্গে এতোগুলি সমস্যার হঠাৎ করে উদ্ভব ঘটে যে, তাঁর সমাধান কেউ কোন দিন কল্পনাও করে নি। মুজাহিদরা ভাবতেও পারে নি যে, হঠাৎ করে ১৫ দিনের মধ্যে আফগান শহর সমূহের যেভাবে দ্রুত পতন ঘটছিল তদ্রুপ দ্রুত গতিতে অসংখ্য সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে। এ দ্বারা আমাদের মনে রাখতে হবে, আফগান জিহাদের প্রথম ৫ বৎসরেই ঝরে গেছে ১০ লক্ষ্য প্রাণ।এদের অধিকাংশই ছিল শহর এলাকার রাশিয়ান সৈন্যদের টার্গেট বিচক্ষণ আলিম, প্রফেসর,শিক্ষক, রাজনীতিক, সমাজসেবী তথা বুদ্ধিজীবী।ফলে শিক্ষিত ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন মেধার দারুন ঘাটতি দেখা দেয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে তরুণ সমাজ পায় নি শিক্ষার আলো, নিজ বুদ্ধির বিকাশ ও গভীরতা লাভের আগেই চলে গেছে বন্দুক হাতে ময়দানে। এরাই ছিল জিহাদের প্রাণ ।এরা চৌদ্দ বৎসর ধরে শুধু অস্ত্র চালনা বিদ্যার সাথে সম্পর্ক রেখেছে, পায় নি দেশ পরিচালনা বা রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জন ও চর্চার কোন সুযোগ এবং সময়। অথচ বন্দুকের ভাষা আর রাজনীতির ভাষা এক নয়। একই জ্ঞান দিয়ে এ দুটোকে চালানো সহজ নয়। বন্দুক দিয়ে যত সহজে খেল খতম করা যায় রাজনৈতিক সমস্যা তত সহজে সমাধান হয় না। তাই নজিবুল্লাহ বাহিনীর দ্রুত পতনের সাথে সাথে যে সমস্ত রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয় মুজাহিদ নেতৃবৃন্দ দক্ষতার সাথে তা সামাল দিতে পারেন নি। যত দ্রুত সমস্যার উদ্ভব হচ্ছিল বিচক্ষণতার অভাবে তত দ্রুত তার যেমন সমাধান হয় নি, তদ্রুপ পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাবে এবং সমাধান চিন্তা করারও পর্যাপ্ত সময় তারা হাতে পান নি। তারা বাধ্য হয়ে জোড়াতালি দিয়ে কোন প্রকারে সমস্যার সমাধান করেছেন। এটা করতে গিয়েই তারা আটকে যান আরও জটিল অবস্থার মধ্যে। আজ পর্যন্ত তারা এ চোরাবালি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি বরং জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে তারা নিজ নিজ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন।
আমরা জানি, ইসলামে জিহাদ হয় মাত্র দুটি কারণে, এক-ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা, দুই-ইসলামের মর্যাদা রক্ষার জন্য। কিন্তু ইসলামের আদর্শ ও নীতি উপেক্ষা করে নেতৃত্ব বা ক্ষমতা দখলের জন্য যদি কোন লড়াই হয় তবে তা কখনো জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। ইসলামের ইতিহাসে এরূপ বহু ঘটনা বর্তমান যে, ইসলাম রক্ষা বা ইসলাম প্রচারের জিহাদে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদরা যখন বৈষয়িক কোন কারণে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছেন তখন তা আর জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
     তবে আফগানের বর্তমান পরিস্থিতি এর চেয়েও জটিল এবং এতই ঘোলাটে যে, এর উপর কোন স্পষ্ট মন্তব্য করার জন্য আমাদেরকে আরও অপেক্ষা করতে হবে। তবু সাহসের সাথে এ কথা বলা যায় যে, জিহাদ শেষে নেতৃত্বের প্রশ্ন নিয়ে দেখা দিয়েছে এক কূটিল রাজনৈতিক জটিলতা যা কখনই আফগান জিহাদের চেতনার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। উপসংহারে যাবার আগে দেখা যাক, কোন কোন পরিস্থিতির কারণে বর্তমান এই আফগান সংকটের সূচনাঃ
১। আমরা জানি, কোন সচেতন, বুদ্ধিমান মানুষ তার দক্ষতা ও মেধা অনুযায়ী কর্ম-তৎপরতা চালাতে না পারলে বা অলসভাবে সময় কাটাতে বাধ্য হলে হতাশা ও দায়িত্বহীনতা তার মনে বাসা বাঁধে, এমনকি বিকৃত চিন্তা-ভাবনায়ও সে আক্রান্ত হয়। ইতিহাস স্বাক্ষী, আলমগীর ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট। দীর্ঘ ৫০ বৎসর তিনি ভারত উপমহাদেশ শাসন করেন। তার রাজত্বের প্রথম ভাগেই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অজেয় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তিনি সমগ্র উপমহাদেশ বিজয় করেন। এর পর দীর্ঘ সময় তিনি সেনাবাহিনীকে কোন রাজ্য বিজয় বা ইসলাম প্রচার বা অন্য কোন তৎপরতায় ব্যস্ত না রেখে  নিষ্ক্রিয় করে রাখেন। ফলে তার মৃত্যুর পরই হঠাৎ করে বিশাল সাম্রাজ্য খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়, অসংখ্য সমস্যার উদ্ভব হয়। দীর্ঘদিন নিস্ক্রিয় অবস্থায় থাকায় সেনাবাহিনী ও আমির উমারাহদের মধ্যে কর্মে শৈথিল্য ও বিলাসিতা দেখা দেয় এবং বুদ্ধির নিপূনতায় যে চির ধরে এর ফলে তারা সে সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ থাকে। অথচ আলমগীরের উত্তরসূরী বাহাদুর শাহ তার চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন না। কিন্তু তার প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর মধ্যে দীর্ঘদিন যে স্থবিরতা ও বিলাস-প্রিয়তা দানা বেঁধেছিল।ফলশ্রুতিতে তারা বিভিন্ন অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিদ্রোহ ঘোষণা প্রভৃতির মাধ্যমে নিজেদের মেধার ক্ষয় সাধন করেন।
      অনুরূপ, বাগদাদে আব্বাসীয় খেলাফতের শেষার্ধের খলিফার সময় একমাত্র বাগদাদ রক্ষার জন্য ৩ লক্ষ্য সৈন্যের বিশাল এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনী ছিল। এর পূর্বে উমাইয়া বা আব্বাসীয় এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলেও এত বিশাল সৈন্য বাহিনী ছিল না, অথচ তারা একই সাথে চতুর্দিকে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে ইসলাম প্রচার কাজে তাদের নিয়োজিত করেছিলেন। আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে এই বিশাল সৈন্য বাহিনী রাজ্য বিস্তার বা ইসলাম প্রচার-প্রসারের নিয়োজিত না থেকে রাজধানীতে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ছিল। আমরা জানি, সেই সময় বাগদাদে তর্ক-বিতর্ক, আমীর উমারাহদের অন্তর্দ্বন্দ ও ক্ষমতার জন্য নৃশংস রক্তারক্তি কত ভয়ঙ্কর ছিল। সেনাবাহিনী আমির উমারাহদের রাজনৈতিক খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, বিদ্রোহের আশঙ্কায় খলিফারাও তাদের হাতের পুতুল ছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল ক্রুসেড বিজয়ী সেনাবাহিনী সালাউদ্দিন আইউবীর অজেয় বাহিনীতে। তার মৃত্যুর পর এই অজেয় বাহিনী রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায় তিন ভাগে। ইউরোপের ক্রুসেডার বাহিনীর পরাজয়ের পর তাদের যেন আর কিছু করণীয় ছিল না বলে এমন পরিস্থিতি উদ্ভব হয়। ইসলামের ইতিহাস ছাড়াও দুনিয়ার আরও বহু ইতিহাসে এর নজীর রয়েছে।যেমন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেনাবাহিনীর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও একের পর এক সামরিক অভুত্থান। ইতিহাসের শিক্ষা হল, কোন বিজয়ী  বাহিনীকে কর্মতৎপরতার মধ্যে ব্যস্ত না রাখলে তারাই দেশের জন্য বড় আকারের সমস্যার সৃষ্টি করে। ইরানে বিপ্লবের পর বিপ্লবী নেতারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বিপ্লবী বাহিনীকে দেশ পুনঃর্গঠনের কাজে লাগিয়ে তাদের মধ্যে কর্ম স্থবিরতা দানা বাঁধার বা কুচিন্তায় আক্রান্ত হওয়ার কোন সুযোগ দেন নি। আফগান নেতৃবৃন্দের জিহাদ শেষে বিপ্লবী বাহিনীকে পাশ্ববর্তী মুসলিম এলাকা সমূহের মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলেও তাদের সাহায্যে যেমন উদ্বুদ্ধ করেন নি তেমনি দেশ পুনঃর্গঠনে নিয়োগ করেও তাদের চিন্তার খোরাক যোগান নি। ফলে তারা এখন ভ্রাতৃঘাতি লড়াইয়ে মেধার অপচয় ঘটাচ্ছেন।
      ২। ১৯৯২ সালের ১৯শে মার্চ নজিবুল্লাহর পদত্যাগ করার কথা ঘোষিত হওয়ার পর তার জেনারেলদের মধ্যে 'ত্রাহি' অবস্থার সৃষ্টি হয়। তারা দ্রুত প্রভু বদল করে প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিজ নিজ নিয়ন্ত্রিত শহর মুজাহিদদের হাতে তুলে দিয়ে মুজাহিদদের বন্ধু বনে যায়। এর বিনিময়ে তারা সাধারণ ক্ষমা পাবার চুক্তি হাসিল করে নেন। ফলে দ্রুত আফগান শহরগুলির পতন ঘটে। তবে মুজাহিদ নেতৃবৃন্দ ১৪ বৎসর জিহাদ করার পর এই চরম মুহূর্তে যেন সংযমকে আর বেঁধে রাখতে পারেন নি। রাজনৈতিক কূটচালের কাছে হেরে গিয়ে তারা মৃত লাশদের দেহে প্রাণ সঞ্চার করেন। নজিবুল্লাহর পতনের সাথে সাথে তার সকল সাঙ্গপাঙ্গের মৃত্যু ঘন্টা বেজে উঠেছিল। মুজাহিদ নেতৃবৃন্দ তাদের আপোষ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আর একটু দৃঢ়তার পরিচয় দিলে এরা দল বেধে দেশ ছেড়ে পালাতে অথবা আত্মসমর্পন করত। এতে আফগানিস্তানে বিজয় ডঙ্কা বাজতে একটু দেরী হলেও মুনাফিক নামের জঙ্গল একেবারেই পরিষ্কার হয়ে যেত। কিন্তু তারা দ্রুত মুনাফিকদের সাধারণ ক্ষমা ও বন্ধুত্বের বিনিময়ে দ্রুত আরও বেশী এলাকা দখলের কৃতিত্ব হাসিল করতে প্রতিযোগিতায় নামেন। ফলে চুক্তি অনুযায়ী মুনাফিকরা যেমন প্রাণে বেঁচে যায় তেমনি তারা নিজ নিজ ক্ষমতায়ও প্রতিষ্ঠিত থাকেন। আহমদ শাহ মাসুদ কাবুলে প্রবেশের পূর্বে কাবুলের জেনারেলদের সাথে অনুরূপ চুক্তি করেছিলেন। ফলে কাবুলে মুজাহিদ সরকার গঠিত হলেও নজিবুল্লার সেনাপতি আসিফ দেলোয়ার এখনও সেনাবাহিনী প্রধান। নজিবুল্লাহর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেনারেল নজীব আযীমী এখন কাবুলের কোর কমাণ্ডার। নজিবুল্লাহর কু-কর্মের অন্যতম দোসর জেনারেল মোমেন ও জেনারেল বাবাজান এখনও স্বপদে বহাল। ডঃ আব্দুল ওয়াকিল ছিলেন নজিবুল্লাহর পররাষ্ট্র মন্ত্রী। তিনি এখনও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এছাড়া প্রশাসনের উচ্চ পদ সমূহে এখনও কম্যুনিষ্ট ও ধামাধরা আমলারা বহাল তবিয়তে আছেন। এদের জন্য প্রশাসন এখন স্থবির, কাবুলের নতুন সরকার সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে কোন পরিবর্তনের ছোয়া লাগাতে পারে নি। হেকমতিয়ার এসবের বিরোধিতা করছেন।পক্ষান্তরে, রাব্বানী পূর্ব চুক্তি অনুযায়ী তার ওয়াদায় অটল থাকছেন। তাছাড়া তিনি প্রতিপক্ষের চাপের মুখে নিজে দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং অন্তর্ঘাতিমূলক তৎপরতার আশংকায় তার ও তার বন্ধুদের ইচ্ছা থাকলেও ওদের অপসারণ করতে পারছেন না।
      ৩। পাশ্চাত্যের প্রচার মাধ্যমে প্রচারণার সয়লাবে আমরা জেনেছি যে, হেকমতিয়ার এবং মিলিশিয়া প্রধান রশিদ দোস্তাম একজোট হয়ে রব্বানীকে উৎখাত এবং ক্ষমতা দখলের জন্য লড়াই করছেন। মূলতঃ হেকমতিয়ার এবং রশিদ দোস্তামের মধ্যে কোন দোস্তি নেই। ভিন্ন ভিন্ন কারণে উভয়ের কার্যক্রম রব্বানীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হওয়ায় আপাতঃ দৃষ্টিতে তাদের মধ্যে দোস্তি রয়েছে বলে অনুমিত হচ্ছে মাত্র। কাবুলের পতনের সময় দোস্তাম বিমান বন্দরসহ কাবুলের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছিল। চুক্তি মোতাবেক সে তার নিয়ন্ত্রিত এলাকা আহমদ শাহ মাসুদের কাছে হস্তান্তর করে, নজিবুল্লাহকে দেশ ত্যাগে বাধা দেয় এবং আহমদ শাহ মাসুদকে কাবুলে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। তার এই কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিয়ে তাকে সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করেন। কিন্তু বোরহান উদ্দিন রাব্বানী ক্ষমতায় এসে আসিফ দেলোয়ারকে তার চেয়ে কম ধূর্ত এবং তার নিকট থেকে কম বিপদের আশংকা করে দোস্তামের স্থলে আসিফ দেলোয়ারকে সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করেন। একই সাথে জেনারেল বাবাজান, জেনারেল মোমেনকেও সেনাবাহিনীর মধ্যে পূনর্বাসিত করেন। তিনি গোপনয়েন্দা সংস্থা ‘খাদ' ও প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্ট বাহিনীও, সেই নজীবুল্লাহর নিযুক্ত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবীত করেন। কম্যুনিষ্ট আমলে জেনারেল আসিফ দেলোয়ার, মোমেন ও বাবাজানের সাথে ছিল দোস্তামের ব্যক্তিগত শত্রুতা। ফলে ক্ষমতালোভী দোস্তাম অপসারিত হওয়ায় এবং তার ব্যক্তিগত শত্রুরা ক্ষমতায পূনর্বাসিত হওয়ার ঘটনাকে সে সহজে হজম করতে পারে নি। অপরদিকে, বিশ্বব্যাপী মুজাহিদ তৎপরতায় আতঙ্কগ্রস্ত ইসলামের শত্রুরা যত্নের সাথে মুজাহিদদের দুর্বলতা খুঁজছিল। তার মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে দোস্তামকে লুফে নেয়। এক দিন হঠাৎ দোস্তাম পালিয়ে নিজ বাহিনী নিয়ন্ত্রিত মাজার-ই-শরীফ প্রদেশে পৌঁছে। এখানেই বানায় তার চক্রান্তের ঘাঁটি। প্রথমে কাবুলের অর্থনৈতিক অবস্থাকে বিপন্ন করার জন্য জাল টাকা ছাড়ে বিপুল পরিমাণে। ইরান সীমান্তে ইরান থেকে ট্রাক ভর্তি জাল টাকা বোরহান উদ্দিনের অন্যতম কমাণ্ডার ইসমাইল খানের বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর এ তৎপরতায় ভাটা পড়ে। এরপর, ১৯৯৩ তে দোস্তাম মক্কায় হজ্জ করতে গেলে আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা তাদের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। ১৯৯৩ এর ডিসেম্বরে সৌদি আরবের মাধ্যমে অজ্ঞাত দেশ থেকে ১০ কোটি ডলারের চালান দোস্তামের জন্য পাঠানো হয়। উজবেকিস্তানের কট্টর কমুনিষ্ট নেতা আসকার করিমের মধ্যস্থতায় দোস্তাম রাশিয়ার নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র ক্রয়ের পরই তদন্তে এ ঘটনা ধরা পড়ে।ফলে সৌদি সরকারের সাথে রাব্বানী সরকারের সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটে। জানুয়ারী ৯৪'তে দোস্তাম রাব্বানীকে উৎখাতের জন্য হামলা শুরু করে। কিন্তু হেকমতিয়ার রাব্বানীর প্রেসিডেন্ট নিযুক্তি এবং সরকার গঠনের শুরু থেকেই তার বিরোধী ছিলেন এবং কাবুলে গোপনলা-রকেট নিক্ষেপ করে মাঝে মাঝে কাবুলের জনজীবন বিপর্যস্ত করে দেন। তাদের উভয়ের টার্গেট রব্বানীকে উৎখাত করা। ফলে তাদের কার্যক্রম সমন্বিত এবং জোটবদ্ধ বলে মনে হয়। আমরা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে দেখেছি, হেকমতিয়ার স্বয়ং দোস্তামের সাথে দোস্তী হওয়াকে অস্বীকার
করেছেন।
     ৪। আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যে, হেকমতিয়ার-রাব্বানী দ্বন্দ্ব ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব। যদিও এ লড়াই নেতৃত্বের প্রশ্নে কিন্তু তা ইসলামী আদর্শকে প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন থেকে উদ্ভুত। হেকমতিয়ার চাচ্ছেন দেশের সর্বস্তরের জনগণের মনোনীত একটা বিজ্ঞ পরিষদ দেশের নেতৃত্ব নির্বাচিত করবে এবং প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করবে। পক্ষান্তরে, রব্বানী সর্বস্তরের জনগণের দ্বারা প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশের নেতৃত্ব ও সংসদ নির্বাচনের পক্ষে। তিনি যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন হেকমতিয়ার তা বর্জন করেছিলেন এবং পরবর্তিতে সে নির্বাচন অবৈধ দাবী করে তা বাতিল করে তার ঘোষিত পদ্ধতি অনুযায়ী পুনরায় নির্বাচনের দাবী করেন। রব্বানী তা' প্রত্যাখ্যান করায় ঘটনা সশস্ত্র হামলার রূপ নেয়। এরপর দোস্তামসহ রব্বানীর শত্রুর সারিতে শিয়ারাও স্থান নেয়। হেকমতিয়ারের দাবী অনুযায়ী তিনি পরবর্তিতে পদত্যাগ এবং নির্বাচন দেয়ার জন্য নমনীয় হলেও কাবুলে পূনঃর্বাসিত প্রাক্তন কমিউনিষ্ট জেনারেলদের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড চাপের সম্মুখীন হন। ফলে দোস্তামের ন্যায় আরও শত্রু সংখ্যা বৃদ্ধির আশংকায় তিনি আপাতত নীরব হয়ে যান। ফলে হেকমতিয়ার পুনরায় তার অস্ত্রে শান দেন যা দোস্তামের হামলা চালানোর সময়েই অনুষ্ঠিত হয়।
    ৫। সারা আফগানিস্তান গৃহযুদ্ধ কবলিত বলে যে গুজব রয়েছে তা সবই মিথ্যা। আফগানিস্তানের ১৯টি প্রদেশের মধ্যে মাত্র তিনটি প্রদেশে যেমন, রব্বানী নিয়ন্ত্রিত কাবুল, হেকমতিয়ার নিয়ন্ত্রিত লোগার এবং দোস্তাম নিয়ন্ত্রিত মাজার-ই শরীফে গৃহ যুদ্ধ চলছে। বাকী সবগুলো প্রদেশে মুজাহিদ কমাণ্ডাররা গর্ভনর হিসাবে কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক শাসন চালাচ্ছেন। সেসব এলাকায় পূর্ণ-শান্তি শৃঙখলা বিদ্যমান।
৬। সারা মুসলিম বিশ্বে মুজাহিদ তৎপরতা ছড়িয়ে পড়ায় পাশ্চাত্য যেমনি আতঙ্কিত তেমনই কতিপয় ধামাধরা মুসলিম সরকারও আতঙ্কিত। তারা একদা আফগান জিহাদের সমর্থক হলেও পরবর্তীতে যাতে মুজাহিদরা আফগানিস্তানে একটা স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করে বহির্বশ্বে তাদের জিহাদী চেতনার প্রভাব বিস্তার না করতে পারে সে জন্য সচেষ্ট হয়। তাদের সামনে ছিল ইরানের অভিজ্ঞতা। তারা তাই ইচ্ছেমত মুজাহিদদের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন এবং তাদের গৃহযুদ্ধে ইন্ধন যোগায়।এদের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় মাতব্বর দেশটি এবং এশিয়ার হৃদপিন্ডের সাথে ভূমিগত সম্পর্ক যার অপেক্ষাকৃত বেশী- এ দেশ দুটি। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় আরব মুজাহিদদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ধনকুবের উসামা বিন লাদান ছুটে যান বাদশাহর কাছে। তিনি বাদশাহকে জানান যে,আফগানিস্তানে জিহাদরত ১৪ হাজার আরবী মুজাহিদ সর্বাধুনিক গেরিলা যুদ্ধে শিক্ষিত। ইরাকের মোকাবিলায় তাদের নিযুক্ত করলেই যথেষ্ট, আমেরিকার কোন প্রয়োজন নেই। দেশের জন্য তাদের শহীদ হওয়ার অনুমতি চান তিনি। বাদশাহর জানা ছিল না, লাদেনের আর্থিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক পৃষ্ঠপোষকতায় এত বিপুল সংখ্যক আরব সংগঠিত হয়েছে। তিনি আসল বিপদটি ঠিকই বুঝতে পারলেন, দেশে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধুমায়িত অসন্তোষ যে এসব মুজাহিদদের সংস্পর্শে বারুদের ন্যায় বিস্ফোরিত হবে তা বুঝতে বেগ পেতে হলো না তার। তিনি তৎপর হলেন, তৎপর হল গোপনয়েন্দা বিভাগ। লাদেনকে অজ্ঞাত স্থানে বন্দি করা হল। অবশেষে আফগান লবীর অনুরোধে লাদেনের পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেয়া হল। এই শর্তে যে, তিনি আর কোন দিন দেশে ফিরবেন না। গোপনয়েন্দা বিভাগ সতর্ক হয়ে গেল যাতে কোন মুজাহিদ কোন দেশে সৌদী সরকারের বিরোধী তৎপরতা চালাতে না পারে। সেই থেকে আফগান জিহাদে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হলেই কোন আরবকে আর ভিসা দেয়া হচ্ছে না কিন্তু লন্ডন ও নিউইয়র্ক কেন্দ্রিক আরব মুজাহিদদের সংগঠন গড়ে উঠায় সৌদী আরব বিচলিত হয়ে ওঠে এবং পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ করে, মুজাহিদদের তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করে সৌদী সরকারের হাতে ন্যাস্ত করার জন্য। কিন্তু আরব মুজাহিদরা পেশোয়ার ত্যাগ করে আফগানিস্তানে আশ্রয় নেয় এবং তাদের সর্বাধুনিক গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্পগুলি রীতিমত চালু রাখে। আফগান জিহাদ শেষ হলে রাজতন্ত্রের যাঁতাকলে অতিষ্ঠ অনেক আরব তরুণ রাজতন্ত্র উৎখাত করার লক্ষ্যে এসব ক্যাম্পে ট্রেনিং গ্রহণ করতে থাকে। ফলে আফগান সরকারের ওপরও চাপ আসে তাদের বহিস্কার করার জন্য। কিন্তু আফগান জিহাদ সফল করতে যারা অপরিসীম অবদান রেখেছেন তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে রাজী হয় নি আফগান সরকার। ফলে দুই সরকারের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এরই জের হিসেবে দোস্তামের নিকট আসে ১০ কোটি ডলারের চালান। ফলে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। তাই রব্বানী বিরোধী ভূমিকায় সৌদি আরব বেশ সােচ্চার। অন্যদিকে, পাকিস্তানে বেনজীর সরকার ক্ষমতায় আসায় মুজাহিদদের সাথে তাদেরও সম্পর্কের অবনতি ঘটে। পাকিস্তান মনে করে যে, কাশ্মীর ভূখণ্ড আজাদ হয়ে পাকিস্তানের সাথে মিলে যাবে। আর এ ক্ষেত্রে কাশ্মীরে জিহাদরত আফগান মুজাহিদরাও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ : একটা ভূমিকা রাখবে বলে আশা করে। কিন্তু আফগান মুজাহিদরা কাশ্মীর প্রশ্নে শুধুমাত্র ভারত থেকে মুক্ত করা পর্যন্ত দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত সে দেশীয় মুজাহিদরাই নেবে, এটাই তাদের কর্মধারা। ফলে, পাকিস্তান সরকার তাদের ওপর কিছুটা বিরক্ত। এছাড়া অনেক আগে থেকেই রব্বানীর চেয়ে হেকমতিয়ার পাকিস্তান নেতৃত্বের কাছে বেশী গ্রহণযোগ্য এবং ঘনিষ্ঠ। রব্বানীর ক্ষমতা গ্রহণের পর এই দূরত্ব আরও বৃদ্ধি পায়! জিহাদ শেষেও হেকমতিয়ার পাকিস্তান থেকে সার্বিক সাহায্য পেতে থাকে। অন্য দিকে,দোস্তামের বিপুল অস্ত্র ক্রয়, শিয়া মোর্চা ও হেকমতিয়ারের শত্রুতার কারণে, রব্বানীর বাহিনীকে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলার প্রয়োজন দেখা দেয়। তিনি যুদ্ধে দখলকৃত রাশিয়ান বিমান, ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র মেরামত ও কার্যক্ষম করার পদক্ষেপ নেন। এর জন্য প্রয়োজন স্পেশাল পার্টস ও কারিগরি দক্ষতা। রাশিয়া থেকে কোন সম্ভাবনা না থাকায় রাশিয়ান অস্ত্রের দ্বিতীয় ডিপো ভারতের দিকে হাত বাড়ান। ভারতের কারিগরি দক্ষতা, পাইলট প্রশিক্ষণ প্রভৃতি সাহায্য গ্রহণ করার মাধ্যমে রব্বানী বাহিনী একটা পুরোদস্তুর সেনাবহিনীতে পরিণত হয়। ভারতের এই সাহায্য গ্রহণ পাকিস্তান সরকার সুনজরে দেখতে পারে নি,ফলে রব্বানী সরকারের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানে অবস্থানরত সকল আফগানীর বিশেষ পাসপোর্ট বাতিল করা হয়। তাদের পাকিস্তানে অবস্থান করতে হলে নতুন করে পাসপোর্ট ও ভিসা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের সীমান্ত চৌকির ওপর হামলা হয়, কাবুলে পাকিস্তান দূতাবাস তছনচ করা হয় এবং পাকিস্তান তার দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। ফলে বর্তমানে পাকিস্তান ও রাব্বানী সরকার বিরোধী তৎপরতায় ইন্ধন যোগাচ্ছে এবং অপপ্রচার চালিয়ে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে।
      ৭। কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরুহওয়ার পর থেকেই কাবুলে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের মদদে বিভিন্ন মুজাহিদ দলের নামে বিভিন্ন মৈত্রি জোট গঠিত হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে প্রাক্তন কম্যুনিষ্ট আমলা, যারা ক্ষমতা থেকে দূরে রয়েছে এবং মুজাহিদদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মোনাফিক ও পাশ্চাত্যের এজেন্টরা। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা উলামা জোট, প্রকৌশলী জোট, উপজাতি ঐক্য জোট, গোলন্দাজ জোট, জন ঐক্য ফোরাম প্রভৃতির মাধ্যমে জিহাদ ও মুজাহিদদের বিরুদ্ধে তারা সুকৌশলে কুৎসা রটনা করে এবং বিভেদে ইন্ধন যোগায়। এরা বিভিন্ন প্রকার অতিরঞ্জিত খবর জন্ম দিয়ে তা প্রয়োজন মাফিক বিবাদমান পক্ষ সমূহের মধ্যে সরবরাহ করে এক দলকে অন্য দলের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার চেষ্টা চালায়। এই চক্রের তৎপরতা অনেকটা ইসলামের প্রথম যুগে ইবনে সাবা চক্রের অনুরূপ।
     সর্বোপরি, আফগানিস্তানে বর্তমান সংঘাতের জন্য সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দও কম দায়ী নন। তারা এই বিবাদ নিরসনে মুজাহিদ সুলভ পরিচয় দিতে যেমন ব্যর্থ হয়েছেন। তদ্রুপ জাতিগত,কবিলাগত চিন্তা-চেতনা দ্বারাও খানিকটা প্রভাবিত হয়েছেন। একদিকে, হেকমতিয়ার রব্বানীকে উৎখাত করার জন্য রকেট হামলা চালিয়ে যেমম নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছেন, তদ্রুপ রব্বানীর বাহিনীও হেকমতিয়ারের হামলাকে কাপুরুষোচিত এবং নিরীহ মানুষের ক্ষতির অতিরঞ্জিত বর্ণনা করে বহিঃবিশ্বে হেকমতিয়ারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছেন। এই আত্মঘাতি প্রবণতা থেকে তারা উভয়েই যদি ফিরে না আসেন আফগানিস্তানে যে হিংসার অনল জ্বলছে তা অচিরেই যে নিভে যাবে সে আশা সুদূর পরাহত।