JustPaste.it

 

আল্লাহর সাহায্য আমি স্বচক্ষে দেখেছি

কমাণ্ডার আমজাদ বেলাল

======================================================

 

        প্রথম ক্রেক ডাউনের পরও আমি এই গ্রামে রয়েছি এ খবর ভারতীয় সৈন্যরা জানতে পেরে দু'দিন পর পূনরায় গ্রামে ক্রেকডাউন করে। এবার তারা রাত সাড়ে বারটায় গ্রাম ঘিরে ফেলে। পাঁচ হাজার ফৌজের এক বড় গ্রুপ এই তল্লাশীর অভিযানে অংশ নেয়। রাত দুটার সময় আমার কাছে ক্রেক ডাউনের খবর পৌছে। তখন গ্রাম থেকে বের হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। কোন উপায় না দেখে আল্লাহ আল্লাহ্ করতে থাকি। এর মধ্যে আমার সেই কাশ্মিরী দু'বোন এসে হাজির। শলাপরামর্শের পর তারা বল্লেন, আমাদের ঘরের এক পাশে ঘাসের স্তুপ রয়েছে তার মধ্যে লুকানো ছাড়া এখন আত্ম রক্ষার দ্বিতীয় কোন পথ নেই।  অন্য কোন উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত তাদের পরামর্শে রাজী হলাম। তারা দুবোনে অনেক যত্নসহকারে এক পাশের ঘাস সরিয়ে আমাকে তার মধ্যে রেখে পুনরায় ঘাস পূর্বের মত সাজিয়ে রাখে।

 

        ভোরে সৈন্যরা গ্রামে প্রবেশ করে। ঘসে ঘরে তল্লাশী চালায়। যেখানে যা পায় ভেংগে চুরমার করে ফেলে এবং মূল্যবান জিনিসগুলো তুলে নেয় এবং কোন কোন জিনিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। অবশেষে তাদের একটা গ্রুপ ঘাসের স্তুপের কাছে এসে দাড়ায়। একজন সৈন্য অফিসারকে লক্ষ্য করে বল্লো, স্যার! এই ঘাসের স্তুপে তল্লাশী নিয়ে দেখবো? অফিসার ধমক দিয়ে বল্লো, “এর মধ্যে কিছুই নেই। প্রথম প্রথম ( দুস্কৃতকারীরা ) এ সবের মধ্যে অস্ত্রপাতি লুকিয়ে রাখতো। আমরা তা টের পেয়ে এতে আগুন লাগাতে থাকি। এখন সাবধান হয়ে গেছে। এখন ওরা এর মধ্যে কিছুই রাখে না।” তবুও স্যার একটু দেখে নেই? অনুরোধের সুরে সিপাহী অফিসারকে বল্লো। এবার বিরক্ত হয়ে অফিসারটি পকেটের দিয়াশলাইটি হাতে তুলে দিয়ে বল্লো। “যাও আগুন ধরিয়ে দাও।”

 

        তাদের কথপোকথন আমি কান লাগিয়ে শুনছিলাম। বোন্ড করা ক্লাসিনকভ আমার হাতেই ছিল। এক লাফে বের হয়ে কয়েকজন সৈন্যকে জাহান্নামে পাঠানো আমার পক্ষে অতি সহজ। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র গ্রাম ধ্বংসস্তুপে পরিণত হত। তাই তা করলাম না। সৈন্যটি স্তুপের এক পাশে দাড়িয়ে দিয়াশলাই জ্বালানোর চেষ্টা করছে। আমার মনে হল, স্তুপের ওপাশে আগুন লেগে গেছে। এবার সে অন্য পাশে দাড়িয়ে ম্যাচের কাঠি ঘষছে। মনে মনে ধারণা করলাম, সে একসাথে দুপাশে দিয়ে আগুন লাগাতে চাচ্ছে যাতে তাড়াতাড়ি এটি জ্বলে শেষ হয়ে যায়। এর পর তৃতীয় কাঠি জ্বালাবারও আওয়াজ পেলাম। মনে মনে ভাবলাম, আগুন হয়ত আমার কাছাকাছি পৌছে গেছে। এক লাফে বাইরে বেড়িয়ে এই দুই ইণ্ডিয়ান প্রথমে জাহান্নামে পাঠাবো, তারপর যা হবার হবে। তৃতীয় কাঠি জ্বালাবার পর পরই অফিসারের কর্কস, আওয়াজ শুনতে পেলাম।

 

        হারামখোর কোথাকার! একটা ম্যাচও জ্বালাতে পার না! সৈন্যটি বিনয়ের সাথে বল্লো, “স্যার! দিয়াশলাইর কাঠি জ্বলছে না, একটি কাঠি বাকী আছে। আপনি নিজ হাতে সেটা জ্বালান।” অফিসার রাগে গোস্বায় জ্বলতে জ্বলতে দিয়াশলাই হাত থেকে টেনে নিয়ে খোঁচা মারলো। আমিও এক লাফে বের হতে তৈরী হলাম। এমন সময় শব্দ পেলাম, অফিসার ম্যাচটিকে স্বজোরে নিচে ফেলে বুট দিয়ে পিষে দেয়। লজ্জায় গোস্বায় জ্বলতে জ্বলতে সেপাইকে বল্লোঃ “যাও, ঐ ঘর থেকে ম্যাচ নিয়ে আসো” ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন সৈন্য সেখানে এসে পৌঁছে। সারা ঘরের মালপত্র নিচে ফেলে দলাই করছে। কিন্তু কোথাও ম্যাচ খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ ম্যাচ তাদের চোখের সামনে চুলার পাশেই রাখা ছিলো। আল্লাহ তাদেরকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন তাই দিবালোকেও ম্যাচ খুঁজে পেলো না। ইতিমধ্যে অফিসার ডাক পারলো, “আমি বলেছিলাম না, এর মধ্যে কিছু নেই খামাখা সময় নষ্ট করছো।” একথা শোনার পর সৈন্যরা ফিরে যায়। আল্লাহ রাবুল আলামীনের প্রশংসা করার মত ভাষা আমার নেই। তিনি ভাষার মোহতাজ নন, হৃদয়ের আবেগই তার জন্য যথেষ্ট।

 

        সমস্ত আবেগ সহ তার কাছে দোয়া করলাম। গাড়ী চলার শব্দ শুনতে পেলাম। ইন্ডিয়ান সৈন্যরা ক্রেক ডাউন তুলে ফিরে যাচ্ছে। তারা যাওয়ার পূর্বে গ্রামের মেয়েদের সাথে এমন অশালীন আচারণ করেছে যা বর্ণনাদিতেও লজ্জাবোধ হয়। সৈন্যরা চলে যেতেই আমার দু’বোন এসে ঘাস থেকে আমাকে বের করলো। আমাকে দেখে তারা আনন্দে কাঁদতে লাগলো। তাদের সশব্দ কাঁন্না দেখে আমি হতবাক হলাম এবং আমি বেঁচে যাওয়ায় তারা যে মহত আনন্দ প্রকাশ করলো তাতে লজ্জিত না হয়ে পারলাম না। আমি বার বার ভাবতে লাগলাম, এরা আমাদের কাছে কত বড় আশা রাখে। অথচ আমরা কত গাফেল। তাদের আজাদীর জন্য আমরা কতটুকু কি করতে পারছি। দেখতে দেখতে গ্রামের সকল লোক এসে আমার চার পাশে জড়ো হয়। পুরুষ-মহিলা, বৃদ্ধ-শিশু সবার চোখ থেকে খুশিতে আনন্দাশ্রু বের হচ্ছে। আমি নিরাপদে বেঁচে যাওয়ার জন্য তারা একে অপরকে মোবারকবাদ জানাচ্ছে। জানতে পারলাম, য়েরাওয়ের সময় কয়েকজন মহিলা একাধারে নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করেছে। আমাকে জীবিত ও সুস্থ দেখে তাদের আনন্দের কথা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই গ্রামে আমি এগারো দিন ছিলাম।

 

        বার বার ক্রেক ডাউন হওয়ায় রাতে গ্রামে থাকা ঠিক নয় ভেবে দিনের বেলা গ্রামে কাটিয়ে রাতে পাহাড়ে চলে যেতাম। আমার সাথে গ্রামের তিনটি কিশোর রাত কাটাতে পাহাড়ে যেতো। তারা মোর্চা খুড়ে সেখানে আমাকে ঘুম পাড়াতে ও নিজেরা পালা করে পাহাড়া দিত। তাদের জিহাদী জজবা ও ভারতের প্রতি প্রবল ঘৃণা দেখে আমি আশ্চাৰ্য্যান্বিত হতাম। আমার কাছে একটি ক্লাসিনকভ ও দুটি পিস্তল ছিল। তারা ক্লাসিনকভ ও পিস্তল নিয়ে মোর্চার আসে পাশে পাহারা দিত আর আমি নিরাপদে ঘুমাতাম। তারা আমার কাছে অস্ত্রের ট্রেনিং নিত এবং সর্বদা বলতো, কাশ্মীর আমাদের, আমরা মুসলমান, আমরা কাশ্মীরের আজাদী ছিনিয়ে আনবোই। আমার কারণে এই গ্রামে দুই বার ক্রেক ডাউন হয়েছে। আবারও হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ভারতীয়রা আফগান মুজাহিদদের যমের মত ভয় করে। আর করবেই বা না কেন? তাদের আদর্শিক গুরু রুশদের, নাকানিচুবানি খাইয়েছে এই শক্ত পেশী ও ইস্পাত কঠিন ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান আফগানীরা। অতএব যত দিন তারা গ্রামে কোন আফগান মুজাহিদদের অবস্থানের কথা শুনবে ততদিন ক্রেক ডাউন চলতে থাকবে।

 

        আমি অন্যত্র চলে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করতে লাগলাম। এই কথা দুই একজনের কাছে প্রকাশ করতেই গ্রামের সকল লোক আমার নিকট এসে অনুনয় বিনয় করে বলতে লাগলো, “আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন না।” যদিও তারা আমার কোন যুদ্ধের প্রােগ্রাম দেখেনি। শুধু লোক মুখে আফগান মুজাহিদদের বীরত্বগাঁথা শুনে আমাকেও একজন বীর মুজাহিদ বলে ধারণা করে নিয়েছে। তারা বার বার বলতে থাকে, আমরা বহুদিন ধরে হয়ত আপনারই প্রতিক্ষায় ছিলাম। আমরা এই আশা নিয়ে জিহাদ শুরু করেছি যে, আফগান ভাইরা এসে আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুলতান মাহমুদ ও আহম্মদ শাহ আবদালীর মত এই পবিত্র ভূমি থেকে মূর্তিপুজারী হিন্দুদের চিরতরে বিতাড়িত করবে। আজ আমরা আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়েছি। এতদিন মুখে মুখে শুধু আফগানীদের কেরামতের কথা শুনেছি। এবার তা চাক্ষুষ দেখলাম। আমরা গ্রামের সকলে শহীদ হয়ে যাব, নিজেদের সব কিছু কোরবান করে দিব, তবুও আপনার হেফাজতে বিন্দুমাত্র গাফলতী করব না। আপনি আমাদের এখানেই থাকুন। আমরা আশা করি, যতদিন আপনি এই গ্রামে থাকবেন ততদিন আল্লাহর রহমাত আমাদের উপর বর্ষিত হতে থাকবে।”

 

        তাদের বারংবার অনুরোধে আমি এই গ্রামে থেকেই আমীর সাহেবের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু কোন প্রকার যোগাযোগ সম্ভব না হওয়ায় অগত্যা গ্রাম ছেড়ে শ্রীনগর যাওয়ার প্রস্তুতি নেই।

 

        গ্রামের সকল পুরুষ মহিলা আবাল বণিতা জড়ো হয়ে আমাকে ‘আলবিদা’ জানায়। তারা আমার সাথে সাথে গ্রাম থেকে দুই কিলোমিটার পথ দূর পর্যন্ত হেটে আসে। সকলের চোখে অশ্রু দেখে আমার চোখেও ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু জমা হয়। অনেক দুর পর্যন্ত আমার দুই বোন দোপাট্টা উড়িয়ে আমাকে বিদায় জানায় আর তাদের মা দুহাত উচু করে আল্লাহর কাছে আমার হেফাজতের জন্য দোয়া করতে থাকে। যে শিশুরা পাহাড়ে আমাকে পাহারা দিত বাস লাইন পর্যন্ত তারা আমার সাথে সাথে আসে। আমার সব কিছু গ্রামে রেখে শুধু ক্লাশিনকভ, পিস্তল, গ্রেনেড ও চাকু সাথে নিয়ে বাস স্ট্যাণ্ডের দিকে চললাম। ক্লানিস কভ কাঁধে ঝুলিয়ে তার উপর কাশ্মীরী আলখেল্লা পড়ে নিলাম। বাসে উঠার সময় কনট্রাক্টর আমাকে সহযোগিতা করতে যেয়ে হাত বাড়াল। তার হাতের নিচে ক্লাসিন কভ পড়ে।

 

        সে বিস্ময় হতবাগ হয়ে আমায় জিজ্ঞাসা করলো, “মৌলভী সাব আপনি কোথা থেকে এসেছেন এবং যাবেন কোথায়?” তার কাশ্মিরী ভাষার প্রশ্নের জবাবে আমি উর্দুতে বললাম, আমি শ্রীনগর যাব। সে বল্লো আপনি এ বাসে যেতে পারবেন না। আমি বল্লাম, কেন পারবো না? আমার ভাষা শুনে ও চেহারা সুরত দেখে সে ধারণা করেছে আমি কাশ্মিরী নই। আফগানী কিংবা পাকিস্তানী হব। আবার সে বল্লো, এখন পর্যন্ত কোন স্বশস্ত্র লোককে এই বাসে করে শ্রীনগর নেই নি। তাছাড়া এখান থেকে শহর পর্যন্ত দশটি চেক পোষ্ট আছে। প্রতিটি পোষ্টে তন্ন তন্ন করে তল্লাশী করা হয়। সকল যাত্রীকে নিচে নামিয়ে দেহ তল্লাশী করা হয়। আপনি কোন সাহসে এভাবে শ্রীনগর রওয়ানা করেছেন? যাত্রীদের মধ্যেও আমার বিষয়ে গুঞ্জন শুরু হয়। সবাই বললো, “আপনি এপথ সম্পর্কে খবর রাখেন না। নেমে যাওয়াই আপনার জন্য নিরাপদ”। তাদের মধ্য দিয়ে কেউ কেউ ধমকীও দিতে লাগলো। “ভালোয় ভালোয় নেমে পড় নইলে……।”

 

        আমিও রুঢ় ভাবে জবাব দিলাম, “নিজ নিজ সিটে চুপচাপ বসে থাকুন। আমার প্রাণ আমার নিকট কম প্রিয় নয়। কিছুই হবে না। ঠিকমত পৌছে যেতে পারবো।” আর ধমকী ও অনভিজ্ঞতার কথা ভেবে তারা আস্তে আস্তে চুপ হয়ে যায়। আমি বল্লাম, “আমাকে যেতে দাও, পরে যা হবার হবে। সেজন্য চিন্তা করি না।”

 

        বাস ছাড়তেই আমি ছিটে বসে দুহাত তুলে আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের কাছে মুনাজাত করতে লাগলাম, “হে খোদা! আমি তোমার রাস্তায় তোমার দ্বীনকে বিজয় করতে, লাঞ্চিত মা বোনদের ইজ্জত রক্ষা করতে মাতৃভূমি ছেড়ে সুদূর প্রবাসে একাকী পথ চলছি। তুমিই আমার একমাত্র সহায়, আমাকে হেফাযত কর এবং নিরাপদ পথ প্রদর্শন কর। তুমি ছাড়া আমার দ্বিতীয় কোন সহায় ও সাহায্যকারী নেই।”

 

        আমি কায়মনবাক্যে আল্লাহর নাম স্মরণ করছি। বাস দ্রুত বেগে এগিয়ে চলছে। কন্ট্রাক্টরসহ সকল যাত্রী আমার ব্যাপারে আলোচনা-সমালোচনা করছে। ইতিপূর্বে আমি অনেকবার আল্লাহর সাহায্য প্রত্যক্ষ করেছি। অতএব নিশ্চিন্ত মনে খোদাকে স্মরণ করতে লাগলাম।

 

        আর মাত্র এক কিলোমিটার দূরে ইণ্ডিয়ান সৈন্যদের চেক পোষ্ট। যাত্রীদের চেহারা ভয় ও আতঙ্কে পাণ্ডর। একটু আগেও আবহাওয়া ছিল সুন্দর, আকাশও ছিলো পরিষ্কার। এরি মধ্যে হঠাৎ বরফপাত শুরু হয়। দেখতে না দেখতে সাদা বরফে সব ঢেকে যায়। শীত মওশুমের এটাই প্রথম বরফপাত। ইন্ডিয়ান সৈন্যরা রাস্তার ওপরে তাবু ফেলে রেখে নিরাপদ আশ্রয়ে কোথাও চলে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম, আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে। বিনা তল্লাশিতে আমরা চেক পোষ্ট পার হলাম। প্রথম বাধা ভালোয় ভালোয় অতিক্রম করায় যাত্রীদের ঠোঁটে হাসির আভা ফুটে উঠে। তারা আমাকে নানা প্রশ্ন শুরু করলো। আপনি কোথা থেকে এসেছেন? কোন সংগঠনের সাথে আপনার সম্পর্ক? ইত্যাদি। কন্ট্রাক্টর কাছে এসে বল্লো, “আজ পর্যন্ত এমন সাহসী মুজাহিদের দেখা পাই নি যে, অস্ত্র নিয়ে এভাবে নির্ভয়ে শ্রীনগর প্রবেশ করার সাহস পেয়েছে। আমি সকলকে বল্লাম, আল্লাহর সাহায্য আমাদের সাথে অবশ্যই আছে। আমরা সকলে নিরাপদে শ্রীনগর পৌছে যাব-ইনশাআল্লাহ।”

 

        আল্লাহর অপার রহমতে শ্রীনগর পর্যন্তপথের সকল পোষ্টের সৈন্যরা বরফপাতের জন্য রাস্তায় এসে তল্লাশী করার সুযোগ পায়নি। শ্রীনগর এসে বাস থেকে নেমে দেখলাম, চারিদিক সাদা বরফে ঢাকা।

 

        আজমল নামক মুজাহিদের নাম ঠিকানা আমার জানা ছিল। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সেই দিকে রওয়ানা হলাম। পথে ড্রাইভার কাশ্মিরী ভাষায় আমাকে নানা কথা বলতে লাগলো। আমি সবকিছু না বুঝেও তার কথায় হাঁ না করে তাকে আমার ব্যাপারে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি। মহল্লায় পৌছার পর সে আমার অস্ত্র দেখতে পেয়ে নিচে নেমে হেটে হেটে আমার কাছে এসে অনেক প্রশ্ন করতে থাকে। আমিও কোথার লোক, কোন সংগঠনের, কোথায় যাব ইত্যাদির ব্যাপারে সামান্য ধারণা দিয়ে তাকে বিদায় করে দেই।

 

        বরফপাতের জন্য রাস্তা জন মানব শূন্য। চারিদিক নিরব নিস্তব্ধ। আমি সড়কের কিনারা ধরে একা একা হাটছি। এর মধ্যে একটি ফৌজি জীপ এসে আমার কাছে থামে। তারা আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করতে থাকে। আমি সে দিকে মোটেও দ্রুক্ষেপ না করে পথ চলতে থাকি। কিছুক্ষণ পর জীপটি তার পথধরে চলে যায়। এবার আরও একটা জীপ এসে আমাকে দেখে চলে গেলো। এরপর একটি সাঝেয়া গাড়ি আসার শব্দ পেলাম। সাঝেয়া গাড়ি সম্পর্কে শুনা যায়, এরা বিনা প্ররোচনায় লোকের শরীরের উপর দিয়ে চালিয়ে যায়। আমি রাস্তা ছেড়ে কিনারায় নেমে পড়লাম। বরফ পড়ে আমার কোর্ট টুপি সব সাদা হয়ে গেছে। তারা আর আমাকে দেখতে পেল না।

 

        পথে কোন লোকজন নেই। কারো কাছে আজমলের ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতে না পেরে এক ঘরের দরজায় কড়া নাড়লাম। একটি বালিকা বের হয়ে বল্লো, “কাকে চান?” আমি বল্লাম, “আজমলকে, সে এই মহল্লায় থাকে।” আমি কাশ্মিরী ভাষা বলতে না পারায় সে মেয়েটি মনে মনে ভেবেছে, কোন পাহাড়ি এলাকা থেকে এসেছি। ( কাশ্মির উপত্যকার বাহিরের অধিবাসীরা কাশ্মিরী ভাষা জানে না। তাদেরকে পাহাড়ী বলা হয়। ) অতএব সে আমাকে আপদ মনে করে বল্লো, “এ পাড়ায় আজমল নামে কেউ থাকে।” বলেই ঝট করে দরজাটা লাগিয়ে দিল। আমি ভাবতে লাগলাম, এখন কার কাছে কি জিজ্ঞাসা করি। সবার কাছে জিজ্ঞাসা করাও নিরাপদ নয়। পঞ্চাশ গজ দূরে যেয়ে একটি দেয়ালের আড়ালে দাড়িয়ে বরফ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করলাম। তবে ঐ বালিকাটি জানালা দিয়ে আমাকে দেখছিল। আমার অসহায়ত্ব দেখে তার দয়া হল। সে জানালা দিয়ে আমাকে কাছে ডাকে। কাছে আসলে জানতে চাইলো, কোন আজমল! সে কি কাজ করে? আমি তার কিছু বিবরণ দিতেই দরজা খুলে ঘরে বসতে দিল।

 

        এবার তার বড় বোন ও মা এসে আমার পাশে বসলো। গরম অঙ্গার এনে আমার কাছে রাখলো। ছোট বোন নুন চা এনে আমাকে পান করালো। একটু গরম হওয়ার পর বৃদ্ধা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, আমি কেন আজমলের কাছে এসেছি। আমি বললাম, তার সাথে ব্যক্তিগত কাজ আছে। শুধু মাত্র তাকেই বলা যাবে। বৃদ্ধা বল্লো, সে এখন এখানে নেই। ইন্ডিয়ায় গেছে। আমি বললাম। তার ঘর পর্যন্ত আমাকে পৌছে দিন। আমি সেখানে থেকে তার অপেক্ষা করবো। এরপর তার এক বোন বল্লো, এটাই আজমলের ঘর। আর আমরা তার বোন। এ আমাদের মা। এদের প্রকৃত পরিচয় পাওয়ার পর আমিও বললাম, “আমি আফগানিস্তানের মুজাহিদ। পাকিস্তান থেকে এসেছি।” একথা শুনতেই তারা তিনজন কেঁদে ফেললো। আজমলের বৃদ্ধ মা বলতে লাগলো, “আপনি মা বাপ ভাই বোন ফেলে আমাদের সাহায্য করতে এতদূর এসেছেন। যতদিন আজমল না আসে ততদিন আপনি এখানে থাকবেন। আমরা যথা সাধ্য আপনার হেফাজতের ব্যবস্থা করবো।” [চলবে]

সৌজন্যেঃ আল্-ইরশাদ

অনুবাদঃ মনজুর হাসান