JustPaste.it

কাছে থেকে দেখা

ইরানের সুন্নীরা কেমন আছে?

ডা মো আব্দুস সালাম সিদ্দিক

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ইতিহাস ও বাস্তবতার চোখেঃ ইরানের সুন্নীদের ব্যাপারে বলতে গেলে এটা অবশ্যই উল্লেখের প্রয়োজন যে, দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারুক (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ইরান বিজয় হতে শুরু করে উপমহাদেশের মোঘলদের সমসাময়িক ইরানে সাকাভী রাজবংশের প্রতিষ্ঠা না হওয়া অবধি সেদেশ ছিল সুন্নী সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এ সাকাভী শাসকরা ছিল শিয়ামতাবলম্বী এবং তাদের বহুবিদ রাজকীয় অত্যাচার নির্যাতন ভীতি প্রদর্শন ও হত্যাকাণ্ডের ফলেই ইরান শিয়া অধ্যুষিত দেশে পরিণত হয়। সাকাতী শাসক শাহ ইসমাইল ইতিহাসে প্রথমবারের মত ইরানকে শিয়ারাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন। এর ফলে তৎকালীন তুর্কী-উসমানিয়া খেলাফতের দ্বিতীয় বায়েজীদের সঙ্গে তার সংঘর্ষও হয়। ইসলামের প্রাথমিক স্বর্ণ শতাব্দীগুলোতে ইরান সুন্নী অধ্যুষিত ছিল বলেই তথাকার ইতিহাস খ্যাত প্রায় সকল মনীষীই ছিলেন সুন্নী। মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী (রহঃ), শেখ সাদী (রহঃ), ইমাম গাজ্জালী (রহঃ), উমর খৈয়াম, ইমাম মুসলিম (রহঃ), কবি হাফিজ, কবি ফেরদৌসি, ইবনে সিনা, সুফীকুল শিরোমণি বায়েজীদ বোস্তামী (রহঃ), ফরিদুদ্দিন আত্তার এঁরা সবাই ছিলেন সুন্নী। কিন্তু রাজনৈতিক শক্তি যে সবচেয়ে বড় অস্ত্র তা আবারও প্রমাণিত হল ইরানে। এসব মনীষীদের প্রভাব প্রতিপত্তিকে শিয়া শাসকরা প্রায় নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে ক্রমান্বয়ে শিয়াবাদকে ইরানে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। একাজে তারা ইরানী জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছিল। আসলে ইরানী জাতীয়তাবাদ শিয়াদের মধ্যে তার কাংখিত হাতিয়ার খুঁজে পায়। কারণ ইরানী জাতীয়তাবাদ ইসলামের নিকট পরাজিত হয়ে সরাসরি ইসলামের মুকাবিলায় অলস হয়ে পড়েছিল। তাই এক ধরনের বিকৃত ইসলাম প্রকৃত ইসলামকে মুকাবিলার মওকা পেয়ে যায় শিয়াবাদকে হাতে পেয়ে। ইরানে শিয়াবাদ ব্যাপ্তিলাভের এ ব্যাখ্যা দিয়েছেন মনীষী মুহাম্মদ আসাদ তাঁর “মক্কার পথ” বইয়ে। শুনলে পাঠককুল খুবই আশ্চর্য হবেন যে, ইরানীদের মাঝে এখনও এরকম অভিযোগকারী শিয়ামতাবলম্বী পাওয়া যায়, যারা অভিযোগ করে থাকে, “অসভ্য আরবরা ইরানে ইসলামের বিজয় ঘটিয়ে সুসভ্য ইরানের ক্ষতি করেছে।” আমি ব্যক্তিগতভাবে এরকম বেশ ক'জন শিয়ার সাক্ষাত পেয়েছি অথচ সুন্নী এরকম অভিযোগকারী একজনও পাইনি। তাদেরকে যখন প্রশ্ন করেছি যে, তোমরা আরবদের ধর্মগ্রহণ করেছে, তোমাদের বার ইমামের সবাই আরব, তোমরা তোমাদের অনুন্নত পাহলবী (মাত্র চৌদ্দ অক্ষরের) বর্ণমালা ত্যাগ করে আরবী বর্ণমালা গ্রহণ করেছো, তোমাদের ভাষার অধিকাংশ শব্দই আরবী—যা ছাড়া তোমরা কথা বার্তা পর্যন্ত বলতে পার না-তারপরও তোমাদের এ অভিযোগ কেন? তারা এর উত্তরে এলোপাথারী আবোল তাবোল বকলেও কোন সদুত্তর খুঁজে না পেয়ে সত্ত্বরই চুপ মেরে যেত। একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার তো রাসূলে পাক (সঃ)-এর প্রথম কাতারের সাহাবী হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)-এর বিরুদ্ধেও বিষােদগার করে বসে, কারণ তিনিই নাকি মুসলমানদেরকে পথ দেখিয়ে ইরানে নিয়ে এসেছিলেন! অতীত ইরানীরা এ দাবীও করেছে যে, বেহেস্তের ভাষা আরবীর সাথে ফার্সীও থাকবে। এমনকি ইরানের বর্তমানকার শিয়া শাসকরাও ইরানের অতীত অনৈসলামিক ব্যক্তিগণকে খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। এর প্রমাণ পেয়েছি পূর্ব ইরানের সিস্তানের জাবেল শহরে বেড়াতে যেয়ে। সেখানে বছর কয়েক আগে অজস্র রিয়াল খরচ করে একদম শহরের দ্বারপ্রান্তে স্থাপন করা হয়েছে এক প্রকাণ্ড সোনালী ভাস্কর্য মূর্তি-কবি ফেরদৗসি রচিত শাহনামার নায়ক রুস্তমের। উল্লেখ্য যে, ফেরদৌসির শাহনামার সোহরাব রুস্তমের কাহিনীর জন্মস্থল এ সিস্তান এলাকা। ফেরদৌসি নিজেই বলেছেন, এক অখ্যাত কাহিনীর নায়ককে তিনি তার মহাকাব্যে ধারণ করে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অথচ ইসলামী সরকারের দাবিদার ইরানী শাসকরা তারই মূর্তি গড়াকে কিভাবে বেমালুম জায়েজ করে ফেললেন তা ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়। এসবই হচ্ছে রকমফেরে ইসলামী জাতীয়তাবাদের বহিপ্রকাশ।
যাক সুদূর অতীতে ইরান প্রকৃত ইসলামের জন্য এক উর্বর ক্ষেত্র বিবেচিত হলেও সাকভী রাজত্ব ও তৎপরবর্তী ইরান সুন্নী মুসলমানদের জন্য এক ভয়াবহ আজাবের স্থানে পরিণত হয় যা আজ অবধি বর্তমান বরং এখন তা বেড়েছে আরো। নিকট অতীতের ভোগবাদী শাসকরা ধর্মের ব্যাপারে খুব একটা নাক গলাতো না বিধায় সুন্নীরা কিঞ্চিৎ স্বাচ্ছন্দ বোধ করত। কিন্তু অধুনা কট্টর শিয়ারা ক্ষমতা দখল করে সুন্নীদেরকে ক্রমেই কোণঠাসা করে ফেলছে। বাইরের মুসলিম বিশ্ব কেবলমাত্র ইরানে সুন্নীরা সংখ্যালঘু এ খবরটুকুই রাখে। সুন্নীদের হাল হাকিকতের ব্যাপারে কোন আগ্রহ তাদের নেই। বাইরের সুন্নী জগৎ ইরানের অতীত মনীষীদেরকে সম্মানের সাথে স্মরণ করে এবং বর্তমান কালের ইরানের তথাকথিত ইসলামী বিপ্লবের প্রতি অজ্ঞতাপূর্ণ বাহবা দিয়ে তাদের কর্তব্য শেষ করেন। আর যেসব সুন্নী আলেম তাত্ত্বিকভাবে শিয়া বিরোধী তারা ইরানের বর্তমান শিয়াদেরকে কোন আমলই দেন না। তাদের ভাবখানা যেন এরকম যে, শিয়া রাষ্ট্রটি কোন ব্যাপারই নয় এর অতীতই সবকিছু। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের তাবেদার ইরানের বাহাইদের উপর কথিত নির্যাতন সম্পর্কে হৈ চৈ করলেও সুন্নীদের ব্যাপারে টু শব্দটি করতে নারাজ-কারণ তাদের বিবেচনায় ইরান বিকৃত ইসলাম শিয়াবাদ নিয়ে পড়ে থাকুক সেটাই ভাল নতুবা প্রকৃত ইসলামের উত্থান তো খুবই বিপদজনক। অন্যদিকে আধুনিক বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনকারীদের (পাশ্চাত্য প্রচার মাধ্যম যাদেরকে মৌলবাদী নাম দিয়েছে) এক অংশ এভুল ধারণা ও বিশ্বাস নিয়ে বসে আছেন যে, ইরান বিপ্লবই হচ্ছে খাটি ইসলামী বিপ্লব এবং ইরানের শিয়া সুন্নী সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান হয়ে গেছে কিংবা এখন এর কোনই গুরুত্ব নেই। কিন্তু প্রকৃত সত্য এমন ভুল ধারণা হতে অনেক অনেক দূরে। 
বর্তমানে ইরানে সুন্নী জনসংখ্যার হার কত এ প্রশ্ন প্রসঙ্গতই আসে। এর জবাব দেয়া মোটেই সহজ নয়। কারণ এ বিষয়ের কোন প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ আমাদের দেশের হিন্দু-খৃস্টান-বৌদ্ধদের বেলায় তা সম্ভব। ইরানের শিয়া কর্তৃপক্ষ তথাকার সুন্নীদের সংখ্যা যত পারে কম করে বলে। প্রকাশিত সরকারী নথিপত্রেও এর প্রমাণ রয়েছে। আসল তথ্য অবশ্যই তাদের কাছে আছে, কারণ আদম শুমারী ইরানেও হয় যদিও সে তথ্য তারা প্রচার করতে অনিচ্ছুক এবং সেটা যে উদ্দেশ্যমূলক তা সহজেই অনুমেয়। সরকারীভাবে প্রকাশিত 'Islamic Republic of Iran' নামক বইয়ে সুন্নীদের শতকরা হার উল্লেখিত হয়েছে মাত্র ৭.৮০%-যা অবিশ্বাস্য রকমের কম। ইরান সরকারের এরকম উদ্দেশ্যমূলক প্রচার হাস্যকরও বটে। ইরানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর অধিকাংশ অঞ্চলেই সুন্নীরা সংখ্যাগুরু। বেলুচিস্তান, কুর্দিস্থান, বন্দর তুকমান, বন্দর আব্বাস, খোরাসানের অংশ বিশেষ, পূর্ব আজারবাইজান সহ ইরানের আরো নানা স্থানে রয়েছে সুন্নীদের ব্যাপক বসবাস। এসব বিবেচনায় আনলে ইরানের সুন্নীদের সংখ্যা কোনক্রমেই ৭.৮০% হতে পারে না। এ ব্যাপারে আমি সচেতন ও শিক্ষিত সুন্নীদের সাথে আলাপ করেও বুঝেছি, তারা সরকার প্রদত্ত এ সংখ্যা হারকে জঘন্য মিথ্যাচার করে প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের ধারণায় ইরানী সুন্নীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার কম করে হলেও ২০%। এভাবে ইরানী শিয়ারা নিজেদের দেশে সুন্নীদের সংখ্যা কমিয়ে বলতে আগ্রহী হলেও অন্য মুসলিম দেশে শিয়াদের সংখ্যা কমিয়ে প্রচার করতে তাদের নেতৃত্বও আগ্রহী যতদূর মনে পড়ে, ইরান ইরাক যুদ্ধের প্রাক্কালে ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী ইরাকে শিয়াদের সংখ্যা ৬৫% বলে দাবী করেছিলেন তাঁর এক জুমার খুতবায়। এরকম অতিরঞ্চিত দাবী তাদের পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বেলায়ও রয়েছে যা পত্র-পত্রিকায় এসেছে। ইরানের বর্তমান সুন্নীদের আবাসস্থলের প্রতি ইংগিত করে অনেক ইরানী শিয়াই কথা প্রসঙ্গে মন্তব্য করে যে, অতীতের শিয়া শাসকরা সুন্নীদের উপর অত্যাচারের এমনই ষ্টীমরোলার চালিয়েছিল যে, ইরানের মধ্যাঞ্চলের সুন্নীদেরকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। জোরপূর্বক শিয়াকরণ কিংবা হত্যা করে ফেলেছে। বাকিরা জীবন ও ধর্ম রক্ষার্থে সীমান্তের দিকে পালিয়ে গিয়েছে। এ সীমান্ত অঞ্চলই সুন্নীদের প্রধান আবাসস্থল। সুন্নীরাও এ ব্যাপারে একমত তা জেনেছি তাদের সাথে আলাপকালে।
আমি ইরানের পাকিস্তান সীমান্তবর্তী সুন্নী অধ্যুষিত ইরানী বেলুচিস্তানে চাকুরী করেছি। তার আগে বছর আটেক চাকুরী করেছি মধ্য ইরানের শিয়া অধ্যুষিত সেমনান প্রদেশে। এর ফলে আমি উভয় সম্প্রদায়ের তুলনামূলক অবস্থার এক চাক্ষুষ চিত্র পেয়েছি। আমি আমার পর্যবেক্ষণে ইরানী সুন্নীদেরকে অবহেলিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত এক ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবেই দেখতে পেয়েছি।
বর্তমানে “সুন্নী” পরিচয় প্রদান সরকারী দৃষ্টিতে অযোগ্যতারই শামিল, যদিও তা অঘোষিতভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশেষ করে, রেজা শাহের পর কট্টর শিয়া মতবাদীদের ক্ষমতায় আসার পর এটা উল্লেখযোগ্যভাবেই লক্ষ্যনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ ও চাকুরীর ক্ষেত্রে প্রার্থীকে দরখাস্তের ফরমে ধর্মীয় পরিচয়ের কথা উল্লেখ করতে হয়। শিয়ারা “শিয়া” লিখে। সুন্নীরা “সুন্নী” লিখতে বাধ্য হয় কেবল মুসলমান লিখে পাড় পেতে পারে না; কারণ তাতেও সুন্নী হওয়া সাব্যস্ত হয়। এভাবে সুন্নীদের দরখাস্তগুরোর অধিকাংশ সতর্কতার সাথে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। 
এ ব্যাপারে আরেকটি বিষয় অবশ্যই উল্লেখের দাবীদার, তা হল এসব প্রার্থীর ব্যাপারে গোয়েন্দা রিপোর্ট হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিবেচিত বিষয়। গোয়েন্দা রিপোর্ট যদি প্রার্থীর বিরুদ্ধে যায় (সচেতন সুন্নী হলে তা যাওয়াই স্বাভাবিক) তাহলে প্রার্থীর আর কোন যোগ্যতাই কাজে আসে না। উক্ত গোয়েন্দা রিপোর্টে বিশেষভাবে যা দেখা হয় তাহল প্রার্থী সচেতন ও আমলী সুন্নী কিনা, লোকটি রাজনীতিতে সক্রিয় কিনা, শিয়া মতবাদের সমালোচক কিনা প্রভৃতি। বাংলাদেশী এক ডাক্তারের কাছে শুনেছি, কুর্দিস্তানের এক মেধাবী ছাত্র ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বোর্ডে স্ট্যান্ড করেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার অনুমতি পায়নি কেবল কুর্দী সুন্নী হওয়ার কারণেই। শিয়া প্রার্থীদের বেলায় কেবল সরকার বিরোধী সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীদেরকে বাদ দেয়া হয়। অন্যসব দোষ তাদের গুণে পরিণত হয়। এভাবে অতি নগণ্য সংখ্যক সুন্নী বিরলভাবে সরকারী চাকুরী ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে ইরানের অবস্থা হুবহু লৌহযবনিকাময় এক কম্যুনিস্ট দেশের মতই। আমার এক সহকর্মী যিনি ছিলেন সুন্নী তার সাথে আলাপকালে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এ প্রতিকুল অবস্থা তারা কিভাবে মোকাবিলা করে। উত্তরে সে জানায়, অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মীয় পরিচয় গোপন রাখে তারা। যেমন দরখাস্তের ফরমে ধর্মের জায়গায় খালি রেখেই ফরম জমা দেয়। এতে করে তাদের পরিচয় গোপন না থাকলেও শিয়ারা কিছুটা সন্তুষ্ট থাকে কারণ সুন্নীরা অন্ততঃ তাদের পরিচয় গোপন করতে রাজী—এভাবেই পরিচিতি লুকাতে-লুকাতে একদিন তাদের স্বকীয়তাই হারিয়ে যাবে। সুন্নীদের মতে “তাগুত” সাহেব রাজত্ব কালেও সুন্নীদের ব্যাপারে এতটা বৈষম্য ছিল না। কট্টর শিয়ারা ক্ষমতায় এসেই পরিকল্পিতভাবে সুন্নীদেরকে বৈষম্যের শিকারে পরিণত করেছে। বর্তমানে সুন্নীদের মধ্যেও যারা একটু ভাল চাকুরী করছে তাদের অধিকাংশই শাহের সময়ে রিক্রুটকৃত। অনেককে আবার নানা অজুহাতে বাদ দিয়েও দিয়েছে বর্তমান সরকার। এসব কারণেই দেখেছি, ইরানের যে কোন সুন্নীই ধার্মিক,অধার্মিক, শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাই শাহের সময়টাকেই তাদের জন্য অধিকতর অনুকুল ছিল বলে মনে করে— যদিও শাহের অনেক অনৈসলামিক কার্যকলাপের তারা সমালোচক ও। এ সমালোচনার পথ ধরেই অনেক সুন্নী শাহবিরোধী বিপ্লবের সমর্থন যুগিয়েছিলেন। কিন্তু সবই গুড়ে বালি। উত্তপ্ত কড়াই হতে সুন্নীরা জ্বলন্ত উনুনে পড়েছে। বঞ্চিত ও নির্যাতিত সুন্নীদের অভিযোগের বিস্তারিতরূপ কেবলমাত্র তাদের সাথে আলাপ করে ও পরিস্থিতি সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেই কেবল হৃদয়াঙ্গম করা সম্ভব; নতুবা ইরানীদের মিথ্যায় ভরপুর গালভরা শ্লোগান শুনে সঠিক অবস্থা আঁচ করা সম্ভব নয়! কিঞ্চিত হলেও ওরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল।
ইরানের সুন্নী অঞ্চলগুলি সেদেশের সবচেয়ে অনুন্নত ও বঞ্চিত অঞ্চল। কুর্দিস্তান, বেলুচিস্তান, বন্দর তুর্কেমান, বন্দর আব্বাস, খোরাসানের নানা সুন্নী এলাকা প্রভৃতি অঞ্চলগুলো যে-ই ঘুরে দেখেছেন তিনিই এ ব্যাপারে একমত হবেন। সুন্নীদের এ অবস্থা যে কেবল হাল আমলেই দৃশ্যমান তা নয় বরং শিয়া আধিপত্যের বিগত বহু কাল হতেই তাদের এ বঞ্চনার সূত্রপাত। তবে সুন্নীদের অভিযোগ, বিগত শাহের আমলের চেয়ে বর্তমানের কট্টর শিয়া শাসকদের আমলেই তারা বেশী বঞ্চিত ও মজলুম। এ ব্যাপারে তাদের ব্যাখ্যা হল শাহ শিয়া হলেও ঐ মতবাদের কট্টর অনুসারী ছিলেন না। তাই সুন্নীদের ব্যাপারে তার তীব্র দুশমনীও ছিল না। কিন্তু বর্তমানের শিয়া শাসককুল পরিকল্পিতভাবে সুন্নীদেরকে শিয়াকরণ (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রলোভন দিয়ে) নীতি অনুসরণ করেছে। অন্যথায় তাদেরকে চরম বঞ্চনার মধ্যে ফেলে রাখছে হীনবল করে আত্মসমর্থনে বাধ্য করতে। ইরানী বেলুচিস্তানের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে আট মাস চাকুরীকালে ব্যাপকভাবে তথাকার সুন্নী জনসাধারনের সঙ্গে মেলামেশার সময় শিয়াবাদীদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ গুলো কতটা তীব্র ও গভীর তা অনুধান করি। সুন্নী অধ্যুষিত বেলুচিস্তানের উত্তর পাশেই শিয়া অধ্যুষিত সিস্তান অঞ্চল। এ দু'অঞ্চলে মিলেই ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশ। সিস্তানে সংখ্যালঘু সুন্নীও রয়েছে। ওখানেও যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এ সিস্তানে সরকারী সুযোগ সুবিধাসহ রাস্তাঘাটের যে উন্নতাবস্থা দেখেছি তা সুন্নী অধুষিত বেলুসিস্তান অঞ্চলে কল্পনাতীত। সরকার পরিকল্পিতভাবে সিস্তানে শিক্ষিতের হার বাড়িয়ে পুরো প্রদেশে তাদের আধিপত্য বিস্তারের পাকা বন্দোবস্ত করেছে। আমি যে বেলুচ গ্রামাঞ্চলে কর্তব্যরত ছিলাম সে অঞ্চলে বেশ লোকের বাস। শাহের আমলে সে অঞ্চলে পাকা রাস্তা করার উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু হয় কিন্তু বিপ্লবের পর তা স্থগিত হয়ে যায় এবং আজ অবধি সে অবস্থায়ই আছে। নানা অজুহাতে বর্তমান সরকার তাতে আর হাত দিচ্ছে না। বিদ্যুৎ সরবরাহের খুঁটি তার বসিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে না, যদিও তার উদ্বোধন হয়ে গেছে অনেক আগেই। শিয়া অধ্যুষিত এলাকায় এসবের কল্পনাও করা যায় না। ইরানের তেল সম্পদে যেন সুন্নীদের কোন হিস্যা নেই, সবই শিয়াদের জন্য।
ইরানের কেন্দ্রীয় সরকারের কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে কোন সুন্নীর নামগন্ধ শুনিনি দশ বছরে। অথচ চরম সাম্প্রদায়িকতার দেশ ভারতেও মুসলমানদের ব্যাপারে এরকম আচরন হয় না হুবহু। এরই প্রতিফলন ঘটে প্রদেশ পর্যায়েও; এমনকি থানা পর্যায়েও-তা সুন্নী অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও। পুরো সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে থানা পর্যায়েরও কোন প্রশাসনিক পদে কোন বেলুটা সুন্নীর স্থান দেখিনি। সবই শিয়া এবং প্রায় সবই ঐ শিয়া প্রধান সিস্তান হতে আমদানিকৃত।বেলুচরা যাদেরকে বলে “জাবলী”, জাবল শহর হচ্ছে সিস্তানের কেন্দ্রীয় শহর। ছোটখাট কোন অফিসে কিছুটা দায়িত্বপূর্ণ পদে কোন সুন্নী থাকলেও তারা আছে শাহের সময়ে চাকুরীতে ঢোকার কারণে কিংবা তাদের অতিযোগ্যতা কিংবা সরকারের ধামাধরা হওয়ার সুবাদে। অতিযোগ্যরাও সরকারী অভিযোগের ভয়ে এতোটাই ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন যে তা অনুভবযোগ্য! সারা বেলুচিস্তানে সুন্নী নামের একজন ডাঃ ফাজেলীকে দেখেছি সারাভান জেলার (শাহরাস্তান) স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে ও মনমেজাজে শিয়াদেরই অনুরূপ ও সরকারের ধামাধরা এবং ড্রাগ আসক্ত বলে ভারসাম্যহীন। তদুপরি স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাকি তার সহপাঠী। আমার এলাকা ইরান শহরে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে পূর্বে বেলুচী সুন্নীরা ছিল কিন্তু বিপ্লবের পর তাদেরকে অপসারিত করা হয় এবং কাউকে কাউকে সরকার গুপ্ত হত্যার শিকার বানিয়ে দুনিয়া থেকেই বিদায় করেছে বলে অভিযোগ শুনেছি স্থানীয় লোকের কাছে। এসব গুপ্ত হত্যার কোন আমামীও ধরা পড়েনি এবং তদন্ত রিপোর্ট ও কাউকে জানতে দেয়া হয়নি আজ পর্যন্ত কাউকে কাউকে নাকি দেশ ছাড়াও করা হয়েছে, এরকম একজন বিখ্যাত চিকিৎসকের নাম ডাঃ সারাভানী, যিনি বর্তমান বি,বি,সি ফার্সী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা প্রশ্নের জবাব দেন। 
সিস্তান এলাকা বেলুচিস্তানের চেয়ে অনেক ছোট এলাকা এবং আগেই বলেছি, সিস্তান শিয়া অধ্যুষিত। সিস্তান শিয়া প্রধান হলেও সমগ্র প্রদেশের প্রেক্ষাপটে শিয়ারা সংখ্যালঘু এবং তারা জাবলী নামেই অধিক পরিচিত সমগ্র ইরানে। ইরানে বিপ্লবের পর বেলুচিস্তানের সর্বত্র এই সংখ্যালঘু জাবলীদেরকে শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের সর্বত্র বসিয়ে দেয়া হয়েছে, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ বেলুচি-সুন্নীরা নিজেদের অঞ্চলেই বিদেশ বিভুইয়ের মত বসবাস করছে কোনঠাসা হয়ে। স্কুল-কলেজের মত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ব্যাপক হারে জাবলী শিয়াদের প্রাধান্য ঘটিয়ে বেলুচদেরকে শিয়াকরণের পথ প্রশস্ত করছে এ সরকার। এভাবে আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও বাস্তবে সংখ্যালঘিষ্ঠের ন্যায় আচরণ পাচ্ছে সুন্নীরা নিজ অঞ্চলেও। শিয়া অঞ্চলে যাওয়ার প্রশ্নই উঠেনা তাদের পক্ষে। এ অবস্থা সুন্নী এলাকার ব্যাপারেই প্রযোজ্য। এককথায় ইরানের সুন্নীদের অবস্থা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের সাথেই তুলনীয় কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়েও ভয়াবহ! কুর্দী এলাকার এক বিখ্যাত গাইনোকোলজিস্টের ব্যাপারে শুনেছি, নিছক সুন্নী হওয়ার কারণেই তাকে সরকারী হাসপাতালের প্রশাসকের দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এমনকি তাকে বাইরে প্রাইভেট চেম্বার খোলার অনুমতিও দেয়া হচ্ছে না। ঐ এলাকার সাথে পরিচিত একজন বাংলাদেশী ডাক্তার আলাপ কালে এ তথ্য আমাকে জানিয়েছেন। ইরানী সুন্নীদের আরেকটি অসুবিধা হল কেবলমাত্র নাম শুনেই কে সুন্নী আর শিয়া তা সনাক্ত করা যায়। এর ফলে কর্তৃপক্ষের প্রতি সুন্নীদেরকে চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া সহজতর হয়েছে। ব্যাপারটি যেন বেনিয়া বৃটিশ আমলের হিন্দ পরীক্ষক কর্তৃক নাম দেখেই মুসলমান ছাত্রদেরকে কম নম্বর পাইয়ে দেয়ার মতই। অবিভক্ত ভারতে শেরে বাংলার প্রচেষ্টায় নাকি নামের বদলে শুধু রোল নম্বর উল্লেখ করার বিধান করে তিনি বাংগালী মুসলমানদেরকে সে জুলুম হতে রক্ষা করেছিলেন, কিন্তু সেরকম কোন শেরে বাংলার আবির্ভাব ইরানী সুন্নীদের ভাগ্যে এখনও জোটেনি।

(অসমাপ্ত)