ধারাবাহিক উপন্যাস
মরণজয়ী মুজাহিদ-৪১
মল্লিক আহমদ সারওয়ার
আম্মু অসহিঞ্চু ভাবে বললেন, ‘তোমরা কি শুধু শুধু গল্প করেই ক্ষান্ত হবে। আমার মেয়ের জীবন বাঁচতে কি করছো, তা বলো ।"
‘আমার পক্ষে যা সম্ভব ছিল তা আমি করেছি। এখন একটাই পথ আছে যে, যুবাইদা কোন ভাবে দেশের বাইরে চলে যাবে। এ চেষ্টাও আমি করেছি, কিন্তু ওকে বাইরে কোন দেশের ভিসা দেয়া হবে না।" অত্যন্ত অনুতাপের.স্বরে বললেন আব্বু।
আব্বুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আম্মু বললেন, "তাহলে তুমি যুবাইদাকে আব্দুর রহমানের কাছে আফগানিস্তান পাঠিয়ে দাওনা কেন?
‘মুজাহিদদের সাথে আমার কোন ধরনের যোগাযোগ থাকলে আমি নির্ধিধায় মেয়েকে আফগানিস্তান পাঠিয়ে দিতাম।' এ বলে আব্বু আমাকে গলায় জড়িয়ে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলেন। কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন, “মা তোরা জানিসনা আমি যে তোকে কতো স্নেহ করি। তুই নিজেও জানিসনা যে কত বড় মুসিবতে ফেঁসে গেছিস।'
আমি বললাম, 'আব্বু। আমি নিজ চেষ্টায় যদি আফগানিস্তান চলে যাই তবে আপনারা নাখোশ হবে না তো?'
‘বেটী! আব্দুর রহমান যদি তোমাকে আফগানিস্তান যাওয়ার জন্যে গাইড লাইন বলে গিয়ে থাকে, তাহলে যতো তাড়াতাড়ি পারো চলে যাও। বেটী! বলো, এ ব্যাপারে আমি তোমাকে কি সহযোগিতা করতে পারি। মা, তোমার নিরাপত্তার জন্যে আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত ।"
‘আব্বু, আম্মু! আপনাদের কিছুই করতে হবে না। আমার শুধু আপনাদের দোয়া দরকার। আমি নিজেই যাবার সব ব্যবস্থা করতে পারবো। আব্বু, আমি আগামীকাল সকালেই রওয়ানা হচ্ছি।”
একথা শুনে আব্বু ও আম্মু উভয়েই স্বগত চিত্তে বলে উঠলেন, "আলহামদুলিল্লাহ", আল্লাহ তোমার অশেষ শুকরিয়া। আমি বললাম, আব্বু! আপনি না কম্যুনিষ্ট, আল্লাহকে শুকরিয়া জানালেন'?
আব্বু বললেন, 'বেটী! জানো না গত তিন সপ্তাহ যাবত আমি যে নরক যন্ত্রণা ভোগ করছি। তুমি আমার কাছে নিজ জীবনের চেয়েও বেশী প্রিয়। এ পর্যন্ত প্রাণান্তকর চেষ্টা করে আমি তোমাকে কেজিবির গ্রেফতারী থেকে বাঁচিয়ে ছিলাম। কিন্তু সম্প্রতি কেজিবি কর্তৃপক্ষের সরাসরি নির্দেশ নিয়ে এসেছে তোমাকে গ্রেফতারের জন্যে। তোমার গ্রেফতারীর কথা ভাবলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। তোমাকে বাঁচানোর সম্ভাব্য সকল পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমি হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে একদিন ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুমে আমি ভয়াবহ স্বপ্ন দেখলাম যে, তোমাকে একদল হিংস্র কুকুর ক্ষত বিক্ষত করার চেষ্টা করছে। এ দৃশ্য দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে রাতে আমি প্রথম আল্লাহর কাছে করজোর প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ যদি তোমার অস্তিত্ব সত্য হয়ে থাকে তবে যে করেই হোক তুমি আমার মেয়েকে রক্ষা করো। আজ থেকে আমি ওয়াদা করছি মেয়ে যদি রক্ষা পায় বাকী জীবন আমি তোমার ইসলাম গ্রহণ করে তোমার নির্দেশ মেনে চলবো।
মুনাজাত করে আবার আমি শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম, এক বাঘ এসেছে, আর বাঘ দেখে তোমাকে আক্রমণকারী হিংস্র কুকুরগুলো দ্রুত পালিয়ে গেল। আর তুমি একটি সুন্দর বাগানে আড়াল হয়ে গেলে। এরপর আমার মনে একটু প্রশান্তি পেলাম। আমি নিশ্চিত, আব্দুর রহমানের কাছে বলে যেতে পারবে মা! আল্লাহ যেন সব সময় তোমাকে সুখে রাখেন। তুমি সুখে থাকলেই আমরা সুখী হবো।"
আমার চলে আসার কথা শুনে আম্মু কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আব্বু তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বললেন, এখন কান্নার সময় নয়; বরং তুমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর, যিনি তোমার আদুরে মেয়ের ইজ্জত বাঁচানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তুমি ভেঙ্গে পড়লে মেয়েটি সাহস হারিয়ে ফেলবে। ওকে সাহস দেয়া দরকার। যাত্রা খুবই কঠিন এবং বিপদসংকুল।
আব্বু আম্মুকে বললেনঃ আমার মনে হয়, আব্দুর রহমানের জিহাদ এবং ওর বাবা মার ত্যাগের কারণেই যুবায়দার প্রাণ বাঁচানোর একটা ব্যবস্থা হয়েছে। অন্যথায় আল্লাহর রহমত পাওয়ার যোগ্য তো আমরা নই। এখন কান্না থামাও । শান্ত মনে মেয়েকে বিদায় দাও। ওর মঙ্গলের জন্য দু'আ কর।
গভীর রাত পর্যন্ত কথা বলার পর আমরা সবাই বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। আম্মার সাথেই ঘুমাতে চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু বিন্দুমাত্র ঘুম হলোনা। আফগানিস্তান যাওয়ার আনন্দ উত্তেজনা আর আব্বা-আম্মাকে ছেড়ে আসার কষ্ট আমাকে অস্থির করে ফেললো ।
আব্বা-আম্মার অবস্থাও ছিল তাই। শেষ রাতে দেখি, আব্বু বিছানা ছেড়ে মেঝেয় একটা চাটাই বিছিয়ে কাঁদছেন। আম্মুও আব্বুর পাশে বসে দু'হাত তুলে মোনাজাত করছেন। তার গন্ডদ্বয় বেয়ে অশ্রুতে বুক ভিজে গেছে। সেদিনই আমি প্রথম অনুভব করলাম, আব্বা আম্মা আমাকে কতো ভালোবাসেন। আরো বুঝতে পারলাম, প্রকৃত অর্থে তারা নাস্তিক ছিলেন না। রুশ সরকারের নির্যাতনের ভয়েই তারা নাস্তিকতার ভান করতেন মাত্র।
পাঁচটার আগেই আমি বিছানা ছেড়ে আমার ঘরে গিয়ে যাত্রার প্রস্তুতি নিলাম। আব্বা আম্মা-আমার ঘরে এলেন। আমাকে পুরুষের বেশে দেখে আব্বা-আম্মা চিনতেই পারছিলেন না। ছদ্মবেশ ধারণের কৌশলটি তাদের বললে উভয়েই খুব বিস্মিত হলেন। আসার আগে আমি আপনার উপহার দেয়া কুরআন শরীফটি আব্বুকে দিলাম।
আব্বু আমার হাত থেকে কুরআন শরীফটি হাতে নিয়ে চুমু দিলেন, কপালে চোখে মুখে লাগালেন। স্বগত স্বরে বললেন, হায় আফসোস! আমরা যদি কম্যুনিজমের পিছনে জীবন বিসর্জন না দিয়ে এ পবিত্র কিতাব অনুধাবন করার চেষ্টা করতাম, তাহলে আজকের এ অবস্থা হতোনা। আসার আগে আলী ভাইও আফগানিস্তানের পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে যা বলেছিলেন সব আববা আম্মাকে বললাম। তারা এতে উৎসাহ বোধ করলেন এবং আমার সিদ্ধান্তের জন্য খুশী হলেন।
সকাল সাড়ে ছ'টার সময় আমার ঘর থেকে রওয়ানা হওয়ার কথা। সাড়ে ছ'টার সময় অবিকল আমার মতো চেহারা এবং একই পোশাক পরে একটা ছেলে আমাদের ঘরে প্রবেশ করল। ঘরে ঢুকেই সে একটি চাবি দিয়ে বললো, আপনার সময় হয়ে গেছে। ছেলেটি আরো বললোঃ আপনার মতো একই পোষাক পরে এজন্য এসেছি, যাতে কেউ মনে না করতে পারে যে, আপনি বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছেন।
আপনাদের বাড়ীর পিছনের রাস্তায় নীল রংয়ের গাড়িটিই আপনার। এটিই আমু দরিয়া পর্যন্ত আপনার বাহন।
আমু দরিয়ার কথা শুনে আব্বু বললেন, আমু দরিয়ার তীরেই আমার এক বন্ধুর বাড়ী, তার নাম ইসমাঈল সমরকন্দী। আবার আববু স্বগতোক্তি করলেনঃ অবশ্য বিপদে কোন বন্ধু কাজে আসেনা। ঠিক আছে তুমি নিজের মতো করেই যাও। এমনও তো হতে পারে যে, সে তোমার জন্য বিপদ ডেকে আনবে ।
আমি আব্বুকে বললাম, ইসমাঈল সমরকান্দী সাহেবই আমাকে আমু দরিয়া পার হওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
আমার কথা শুনে আব্বু একটি সোনার হার আমার হাতে দিয়ে বললেন, ইসমাঈল খুব স্বার্থপর মানুষ। তুমি এটা তাকে দিয়ে বলো, আমার পক্ষ থেকে তাকে উপহার দিয়েছি। আর একটি চিরকুট লিখে দিলেন। চিরকূটে আব্বু লিখলেন-
“প্রিয় বন্ধু,
এই প্রথম আমি তোমার কাছে একটা আবেদন করছি। আশা করি নিরাশ করবেনা। আমার কলিজার টুকরো মেয়েটিকে সযত্নে গন্তব্যে পৌঁছতে সাহায্য করো। তোমার এই অনুগ্রহ জীবনে কখনও বিস্মৃত হবোনা।"
রওয়ানা হওয়ার জন্য আমি ঘড়ি দেখলাম। আব্বু আদর ও স্নেহমাখা অশ্রু ঝরিয়ে আমাকে বিদায় দিলেন। আম্মুকে বিদায়ের কথা বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমার গলা ধরে বললেনঃ মা, আজকের এ বিদায়কেই মনে করো বিয়ের বিদায়। আব্বু বহু কষ্টে আম্মুকে শান্ত করতে চেষ্টা করলেন। আমি শেষ বারের মতো আব্বু-আম্মুকে চুমু খেয়ে বেরিয়ে এলাম। আমারো দু'চোখ ভিজে যাচ্ছিল। কোন মতেই অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলাম না।
গাড়ী সিটি হোটেলের সামনে দাঁড়াতেই দু'জন লোক এগিয়ে এসে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই গাড়ীতে উঠে বসল এবং আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে একটি নোট দিল। নোটটিতে লিখা, “এ দু'জন তোমার সফরসঙ্গী। ওরা তোমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে আইয়ুব বোখারীর কাছে চলে যাবে। তুমি নিঃসন্দেহে এদের সাথে চলে 'যাও।”
-আইয়ুব বুখারী।
আমি নিঃসংকোচে ড্রাইভিং করতে লাগলাম। শহর ছাড়িয়ে গাড়ি কয়েক মাইল নিয়ে এসেছি। একজন বললেন" “বোন যুবাইদা! তুমি পিছনের সীটে একটু আরাম করো। এখন থেকে আমরা পালাক্রমে গাড়ি চালাব। রাস্তায় কোন লোক কিছু জিজ্ঞেস করলে বোবার অভিনয় করবে। কথা বললে তারা প্রথমবারেই বুঝে যাবে যে তুমি মহিলা। তাতে সমস্যা হবে। কারণ, তোমার রোড পার্মিট সহ যাবতীয় পরিচয়পত্র পুরুষের নামে। পথে দু' তিনবার কাগজপত্র পুলিশ চেক করেছে। কিন্তু সবকিছু এতো নিখুঁত ও উভয় সাথীই এত হুঁশিয়ার ছিলেন যে, কেউ আমার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করার অবকাশ পেলোনা।
বেলা ডোবার আগেই আমরা ইসমাঈল সরমকন্দীর বাড়ীতে পৌঁছে গেলাম। ইসমাঈল সমরকন্দীর কাছে পৌঁছে আমার পরিচয় দিলাম । আপনার কথা উল্লেখ করলাম এবং আহমদ গুলখানের ওখানে পৌঁছে দেয়ার কথা জানালাম ।
আমি আব্বুর দেয়া চিরকুট ও হারটি তাকে দিলাম। চিরকুট পড়ে হারটি আমাকে ফিরিয়ে দিতে দিতে সমরকন্দী বললেনঃ “তোমার আব্বা মনে করেছেন, এখনও আমি আগের মতই স্বার্থপর রয়ে গেছি। হ্যাঁ, এক সময় আমি স্বার্থপর ছিলাম বটে, তবে মুজাহিদদের তোমরা যেমন ভালোবাসো, আমিও প্রাণাধিক ভালোবাসি।
তোমার বাবা এ হার উপহার দেননি, দিয়েছেন আমাকে ঘুষ হিসেবে, আমার অতীতের চরিত্রের উপর ভিত্তি করে। তোমার বাবা এটা জানেন না যে, স্মাগলারদেরও একটা নীতি আছে। আমরা আমাদের সুহৃদের উপকারে অনায়াসে নিজেদের জীবন দিয়ে দিতে পারি। যুবায়দা! তুমি তোমার বাবার কাছে যেমন আদরের কন্যা, আমার দৃষ্টিতেও তুমি কন্যার মতো। বেটী! তুমি জাহান্নাম থেকে পালিয়ে মুজাহিদদের আশ্রয়ে জান্নাতের পথে যাত্রা করেছো। জীবনে পুন্যকাজ খুব কমই করার সৌভাগ্য হয়েছে। আল্লাহ এবার একটু নেক কাজ করার সুযোগ দিলেন, আর সেটিও তুমি ছিনিয়ে নিতে চাও? বেটী! এ হার তোমার গলায় খুব মানাবে। তুমি এটি রেখে দাও।
যুবায়দা! যেদিন আফগানরা রুশ আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে গর্জে উঠলো; পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক বললেন, রাশিয়া সমরকন্দ বুখারাকেও অন্যায়ভাবে দখল করেছিল; সেদিন থেকেই আমাদের মনের গহীনে আযাদীর আগুন জ্বলছে, স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে একটা কিছু করার জন্য মনটা সব সময়ই সুযোগ খুঁজে ফিরছে। আফগান জিহাদের শুরু থেকে যথাসম্ভব সাহায্য করছি। আশা করি, এ পথ , ধরে আমাদের স্বাধীনতাও ফিরে পেতে পারি।
পর দিন আমার সফরসঙ্গী দু' মুজাহিদ বিদায় নিতে আইয়ুব বুখারীর ক্যাম্পে রওয়ানা হলো। তারা যাওয়ার সময় বললোঃ বোন যুবায়দা! তুমি সার্থক মুজাহিদদের দেশে যাচ্ছো। যারা একমাত্র ঈমানী, শক্তিতে আগ্রাসী রাশিয়াকে পরাস্ত করছে। তুমি তাদেরকে আমাদের অভিনন্দন ও সালাম জানিও। আর বলো, আমরাও তূর্কিস্তানে তাদের মতো জিহাদের সূচনা করছি, ইনশাআল্লাহ-অনতিবিলম্বে তুর্কিস্তান তাদের স্বাগত জানাবে।
আমি দু'দিন ইসমাঈল সমরকান্দীর বাড়ী থাকলাম। তার এক মেয়ে আছে. আমার মতো। মেয়েটি মুজাহিদদের সম্পর্কে জানে এবং জিহাদী তৎপরতাকে ভালোবাসে। আমি একদিন তাকে বললাম যে, তোমরা তাদের বাড়ীতে গিয়েছিলে, তখন সে খুব আফসোস করলো! বললোঃ দুঃখিত আমি জানতে পারিনি। যদি আব্বু মুজাহিদ আগমনের কথা জানাতেন, তবে আমি তাদের দেখে ভাগ্যবান হতাম। তাদের দু'আ নিতে পারতাম । (চলবে)
ভাষান্তরঃ শহীদুল ইসলাম