JustPaste.it

বিশেষ নিবন্ধন 

ইসলামঃ
সুশীল সমাজ ও কল্যাণময় প্রগতির রূপকার।
বিচারপতি মাওলানা তাকী উসমানী।


      আবারো সেই পুরনো কথা, আবার সেই চৌদ্দশত বছর পিছনে ফিরে যাওয়া। এ যে অসহ্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে দূর রহস্য লোকের সন্ধানে। উটের যুগ পেরিয়ে মানুষ এখন গতির যুগে প্রবেশ করেছে। আজকের সভ্য মানুষের জীবনের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কম্পিউটারের সাহায্যে। সভ্যতা ও প্রগতিই হচ্ছে বর্তমান মানুষের উপাস্য। আধুনিক থেকে আধুনিকতম-র সন্ধানে সে নিমগ্ন, নতুনের অভিসারী এই প্রগতিপাগল মানুষকে তুমি আটকে রাখতে পারবে না-হাজার বছরের পুরনো নীতি কথার ডোরে। অচল কিছু বচন শুনিয়ে। অসম্ভব!
      বেশ উষ্মার সাথে কথা গুলো ছুড়ে দিলেন প্রতিবাদী মুক্তবুদ্ধির এক উদ্যমী তরুণ।
      সত্যই বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রা, মানুষের এই বস্তুগত উন্নতি অস্বীকার করার জো নেই। মহাকাশের চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র আজ মানুষের হাতের মুঠোয়। সুগভীর সমুদ্র তলদেশ আজ মানুষের আয়ত্বে, দুর্বার গতিতে দুর্দম সাহসে তারা সম্মুখপানে ছুটে চলছে।
     কিন্তু ইসলাম মানুষের এই অজানাকে জানার ও অজ্ঞাতকে আবিস্কারের তীব্র পিপাসা নিবারণে কখনো বাধা সৃষ্টি করেনি বরং উৎসাহিত করেছে। কেননা ইসলাম স্বভাব ধর্ম, যে ধর্ম মানুষকে স্বভাব বা ফিতরাতের পথে পরিচালিত করে।
     শিল্পায়ন, প্রযুক্তি, বাণিজ্য, সমরকৌশল এসব রাসুলের জীবনালোতেই আমরা খুঁজে পাই। খন্দকের যুদ্ধে যখন সমস্ত আরব কবীলা একযোগে মদীনা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করলো তখন তার প্রতিরোধ কল্পে হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) সে যুগের এক অভিনব আধুনিক পরিকল্পনা পেশ করলেন যা ছিলো আরবদের অজানা-অকল্পনীয়। পরিকল্পনা মতে নগরীর চতুরপার্শ্বে গভীর এক পরিখা খনন করা হয়েছিল। যার কারণে কাফেরদের সকল পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
     তায়েফের যুদ্ধেও সালমান ফারসী (রাঃ)-এর পরামর্শে সে যুগের আধুনিকতম দু'টি অস্ত্র সাহাবারা ব্যবহার করেন। একটি দূরে নিক্ষেপন যোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, অপরটি ট্যাঙ্ক জাতীয় যাকে দাব্বাবা বলা হতো।
    হাফেজ ইবনে কাছীর (রাহ.) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উরওয়াহ বিন মাসউদ ও গাইলান বিন সালমান (রাঃ)-কে সিরিয়ার তৎকালীন শিল্প ও অস্ত্র তৈরীর বিখ্যাত শহর হাব্বাসে মিনজানিক, দাব্বাবা ও জান্দুরের (দাব্বাবার মত) উন্নত নির্মাণ পদ্ধতি ও উচ্চতর প্রযুক্তি প্রশিক্ষণের জন্যে প্রেরণ করেন। যে কারণে তারা হুনাইন ও তায়েফের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেন নি। 
     হাফেজ ইবনে জারীর বর্ণনা করেন, কৃষি-শিল্পের উন্নয়নে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনাবাসীকে উৎসাহিত করতেন এবং ফসল বৃদ্ধির জন্য (সারস্বরূপ) উটের বিষ্টা ব্যবহার করতে পরামর্শ দিতেন। (কানজুল উম্মাল, ২য় খণ্ড, ২১৯ পৃষ্ঠা)
     অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাপড়ের ব্যবসার পরামর্শ দিতেন। ব্যবসায় উন্নতি ও অভিজ্ঞতা লাভের জন্য কাউকে বিদেশে যাওয়ারও উপদেশ দিতেন। অন্য হাদীসে কৃষি ও খনিজ সম্পদাহরণে উৎসাহিত করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “তোমরা ভূগর্ভে লুকায়ীত সম্পদে রিজিক তালাশ করো।” (কানজুল উম্মাল, ২য় খণ্ড, ১৯৭ পৃষ্ঠা)।
     আরবরা সমুদ্রাভিযানে অনভ্যস্ত ছিলেন।তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদেরকে সমুদ্রাভিযানে উৎসাহিত করে বলেছিলেন, “আমার উম্মতের কিছু লোক জিহাদের উদ্দেশ্যে তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে এভাবে অভিযান করবে যেন বাদশাহ তার সিংহাসনে সমাসীন।” (বোখারী শরীফ)
     যার ফলে হযরত উসমান (রাঃ)-এর খিলাফত কালে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) সে যুগের এক অত্যাধুনিক শক্তিশালী নৌ বাহিনী গঠন করেছিলেন। যার প্রচণ্ড প্রতাপে ও ক্ষীপ্র আক্রমণে ভূমধ্য সাগরের সাইপ্রাস, রোডস, ক্রীট ও সিসিলি দ্বীপগুলো মুসলমানদের করতলগত হয়।
     সপ্তম হিজরীতে হযরত আমর ইবনে আস (রাঃ) গাজওয়ায়ে সালাসিলে সর্বপ্রথম অভিনব নিষ্প্রদীপ পদ্ধতি অবলম্বন করে রাতে সৈন্য শিবিরে আগুন জ্বালাতে নিষেধ করেন। মদীনায় পৌঁছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রশ্নের উত্তরে আমর ইবনে আস (রাঃ) বলেছিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার সৈন্য সংখ্যা ছিলো নগণ্য তাই রাতে আগুন জ্বালাতে নিষেধ করেছি যেন দুশমন আমাদের স্বল্প সৈন্য উপস্থিতি টের পেয়ে আক্রমণ করে না বসে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ অভিনব পদ্ধতিতে মুগ্ধ হয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
     রাসূল জীবনের কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা এ উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো যে, ইসলাম কোন নতুন বা আধুনিকতাকে শুধু নতুন হওয়ার কারণেই বর্জন করে না। বরং সুনির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে থেকে সাচ্ছন্দ্যের সাথে ইসলামী জীবন যাপনে সহায়তা করে।এমন নতুনকে বরণ করতে কোন বাধা তো দেয়-ই না বরং তা উদ্ভাবনে, ব্যবহারে ও প্রয়োগে ইসলাম বরাবর উৎসাহিত করেছে।
     কিন্তু একথাও সত্য যে, বর্তমান পাশ্চাত্যের বল্গাহীন প্রগতি ও অশালীন আধুনিকতা উৎকর্ষের শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছেছে। তারা বহু নতুন, অভিনব ও মনোমুগ্ধকর বিলাশ সামগ্রী  মানুষকে উপহার দিয়েছে। সুখ-সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন যাপনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ঠিক তেমনি তা মানবতা ও মানুষের সুকুমার বৃত্তিকে ধ্বংসের গহীনে নিক্ষেপ করেছে। মানুষকে হিংস্র হায়েনায় পরিণত করেছে। পরশ্রীকাতরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, লালসা প্রভৃতি মরণ ব্যাধিতে আজ মানব সমাজ ও মানবতা মৃত্যুর তীরে উপনীত। প্রগতির নগ্নতা ও অশ্লিলতার উত্তাল তরঙ্গ দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে আছড়ে পড়ছে। যেন এ প্রগতি আল্লাহর সৃষ্টি সুন্দর পৃথিবীটা ধ্বংস করে ক্ষান্ত হবে।
প্রগতি পূজারী পাশ্চাত্যের নারী পুরুষরা কুৎসিত অবৈধ মিলনকে বৈধ করে নিয়েছে। বৃটিশ ইউনিভার্সিটির অঙ্গনে তুমুল করতালীর মাঝে সমকামিতার মত জঘণ্য আচরণকেও বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ভ্রুণ হত্যার উন্মাদনা আজ পাশ্চাত্যের নারীদের পথে নামিয়েছে। মানুষ নামের কিছু নিকৃষ্ট জীবরা মা, খালা, ফুফু ও বোনদের মত নিকটাত্মীয়ার সাথেও বিবাহ বৈধ করার দাবী তুলছে। এ ধরণের আরো জঘন্য কার্যকলাপ আধুনিকতার নামে বৈধ হতে চলছে। এ অধঃপতনের যে শেষ কোথায় তা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য ব্যাপার।
    উপরের আলোচনায় একথা সুস্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আধুনিকতা ও প্রগতিবাদ একটি দু'ধারী তলোয়ার-যা মানবতার কল্যাণেও ব্যবহৃত হতে পারে আবার অকল্যাণেও ব্যবহৃত হয়। তাই কোন নতুন ও অভিনবকে শুধু নতুনত্বের কারণে গ্রহণও করা যায় না আবার বর্জনও করা উচিত নয়। সুতরাং যে কোন আধুনিক পদ্ধতি ও নিয়ম নীতির কল্যাণ-অকল্যাণের পরিমাণও বিচার করার জন্য প্রয়োজন একটি সঠিক ও নির্ভুল মাপকাঠির যার মাধ্যমে আমরা নতুনকে গ্রহণের বা বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতে পারি। 
      ধর্ম নিরপেক্ষ জীবন ব্যবস্থার ন্যায় যদি আমরা মানুষের বুদ্ধি ও বিবেচনাকেই এর মাপকাঠি নির্ধারণ করি তাহলে তা ধ্বংসের গতি আরো ত্বরান্বিত করবে বৈ কি! কেননা বুদ্ধির বড়াই করে মানবজীবনকে যারা বুদ্ধির নির্দেশে পরিচালনা করেছে তারাই মানবতার সকল প্রকার সুকুমার বৃত্তিকে ধ্বংস করেছে। তারা মানুষকে হিংস্রতা, নগ্নতা, নাশকতা ও পশুত্বের পথে টেনে নিয়েছে। অবশেষে সমস্যা সংকুল এই মানব সমাজ জীবন পরিচালনায় বার বার হোঁচট খাচ্ছে।
      কেননা, যে আকল বা বিবেক আল্লাহর নূর বঞ্চিত, সে আকল বিভ্রান্ত ও পথচ্যুত।সে আকল কখনও ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। তার জ্ঞানে ঘৃণ্য বিষয়গুলোও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের বিবরণ শুনে প্রত্যেক হৃদয়বান মানুষ অভিসম্পাত দেয় ঐ নির্দয় পশুদের যারা একাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু বোরনটিকের মত বিশ্বকোষে প্রাক্তন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী আইনষ্টাইন চার্চিলের মতামত শুনে সত্যই মন বিষিয়ে উঠে। তিনি বলেছেনঃ “এটমই দ্রুত বিশ্বযুদ্ধ বন্ধের একমাত্র কারণ যা দশ হাজার আমেরিকান ও আড়াই লক্ষ্য বৃটিশ সৈন্যের প্রাণ রক্ষা করেছে।" (বোরনটিক, ২য় খণ্ড, ২৪৭ পৃষ্ঠা)
    এভাবে যুক্তি দিলে কোন হত্যা যজ্ঞই আর অত্যাচার ও অন্যায় বলে বিবেচিত হবে না।
    ভ্রান্ত বাতেনিয়া ফেরকার নেতা ওবায়দুল্লাহ আল কিরনী লিখেন, “আশ্চর্য! এরা আবার বুদ্ধির দাবীদার। তন্বী, রুপসী বোন বা মেয়েকে ঘরে রেখে কুশ্রী অপরিচিত এক মহিলাকে বধু করে ঘরে তুলে আনে আর তন্বী বোন বা মেয়েকে তুলে দেয় অপরিচিত এক যুবকের হাতে। আশ্চর্য,এই মুর্খদের সামান্য জ্ঞান থাকলেও বুঝতে পারতো যে, তার মেয়েই তার যোগ্যতম পাত্রী ও যৌনতৃপ্তি নিবারণের সুন্দর ক্ষেত্র। এমন বোকামির কারণ হলো, তাদের নেতা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের জন্য এই উত্তম বস্তুকে হারাম করেছেন। (আল ফিরাকু বাইনাল ফিরাকে-২৭৭)
    ধিক এই কলুষতাকে, এই অশ্লিলতাকে। কিন্তু ওহীর নূর বঞ্চিত বিবেকের জন্য কি এ যুক্তির কোন সুস্পষ্ট জাওয়াব আছে? নেই। আজ পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলোতে বহু ওবায়দুল্লাহ কিরনী জন্ম নিচ্ছে যারা সহোদরা বিবাহের বৈধতার দাবীতে সোচ্চার।
   সার কথা, যদি ভাল-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণের মীমাংসার ভার নিছক মানব বুদ্ধির উপর ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে একদিকে যেমন নেমে আসবে মানব জীবনে ঘোর অমানিশা, তেমনি রাহুগ্রস্থ হবে সুখ-সমৃদ্ধি আর অনাবিল হাসি আনন্দের সুন্দর জীবনব্যবস্থা এবং এই পৃথিবীটা। অন্যদিকে,পরস্পর বিরোধ ও বৈষম্য চিন্তা ও মতাদর্শের গোপনলক ধাঁধায় অবতীর্ণ হবে এই বিরাট মানব সমাজ।
    তদুপরি আমরা যাকে স্বাধীন ও মুক্ত বুদ্ধি বলে থাকি প্রকৃতপক্ষে তা পাশব প্রবৃত্তির শৃঙ্খলে আবদ্ধ এমন এক জ্ঞান যার ভয়াবহতা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছেঃ “সত্য যদি তাদের কামনা বাসনার অনুসারী হয় তবে বিশৃঙ্খল হয়ে যাবে আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী এবং এসবের মধ্যবর্তী সকল কিছু।” (মুমিনুন-৭১)
খ্যাতনামা দার্শনিক ডঃ ফ্যাইদমীন একদল দার্শনিকের মতামত বর্ণনা করে বলেন, 'বুদ্ধি প্রবৃত্তির আজ্ঞাবহ থাকবে এটাই বাঞ্চনীয়, এছাড়া কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।'
দর্শন জগতে যদিও তাদের এ মত গ্রহণীয় নয়  তবুও তারা মুক্ত বুদ্ধির স্বরূপ যথার্থই তুলে ধরেছেন, যার অনুসরণে চরিত্র ও নৈতিকতার কোন অস্তিত্বই পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকতে পারে না। জীবনের সর্বত্র পাশব প্রবৃত্তিরই হবে জয়জয়কার। এ পৃথিবী হবে দ্বিপদ পশুদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। এই সব দার্শনিকরা হবে সেই দ্বিপদ পশুর পালের গোদা।
     এই তো বছর কয়েক আগেও বৃটেনের পার্লামেন্টে সমকামিতার মত ঘৃণ্য অপরাধবৃত্তিও সামাজিক বৈধতা লাভ করেছে। অথচ সেখানে জ্ঞানী-গুণী সমাজ ছিলো এর কঠোর সামলোচক। কিন্তু তাদের প্রাণপণ প্রতিরোধ চূর্ণ করে তা আইনগত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কেননা ব্যাপক জনগণ যখন কোন গর্হিত কাজকে ভাল মনে করতে থাকে তখন তা প্রতিরোধের আর কোন দলিল থাকে না। তখন তা সমাজে অন্যায় বলে আর বিবেচিত হয় না।
    মানবতার এই অপমৃত্যুর বিভৎস দৃশ্য দেখে কল্যানকামী, বুদ্ধি, জীবী, জ্ঞানী,গুণী, মনীষী ও গবেষক মণ্ডলী আবার সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। কিভাবে এই আধুনিকতার বাঁধ ভাঙা স্রোতের মুখে মানব সুকুমার বৃত্তিগুলো জীবিত রাখা যায়। কিভাবে মানুষ মানুষের মত বেঁচে থাকতে পারে পৃথিবীতে ।
      প্রখ্যাত মার্কিন আইনবিদ করডোজা লিখেছেন, “বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হলো এমন এক দার্শনিক আইন ও নীতির প্রবর্তন ও প্রচলন ঘটানো যা হবে স্থায়ী, কালের বিবর্তনে যা হবে অনড়, অপরিবর্তনীয়। যা সকল বৈষম্য দূর করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে এক চমৎকার ভারসাম্য সৃষ্টি করবে, যার কল্যাণে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। কিন্তু করডোজার এ আকাঙখা কখনো পূর্ণ হবার নয় কেননা মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধি পরিবেশ, পরিস্থিতিও কালের গণ্ডিতে আবদ্ধ। তার জন্য পরিবেশ পরিস্থিতি ও কালের উর্ধ্বে উঠে চিন্তা করে তদনুযায়ী জীবন বিধান রচনা করা একান্তই অবাস্তব ব্যাপার। তাই ওহী-এ ইলাহীই হতে পারে সকল মানব সমস্যা সমাধানের একমাত্র বিধান এবং সৃষ্টিকর্তা প্রনীত বিধানই হতে পারে মানব মুক্তির একমাত্র সুন্দর ও কল্যাণময় পদ্ধতি ও নিয়ম। কেননা যিনি সৃষ্টিকর্তা একমাত্র তিনিই পরিবেশ পরিস্থিতি ও কালেরও উর্ধ্বে মানুষের প্রয়োজন, চাহিদা, অভ্যাস ও দুর্বলতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত। তাই তার দেয়া জীবন বিধানই মানুষের ইহ ও পরলোকের সকল সুখ ও শান্তি বয়ে আনতে পারে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “যে তার প্রতিপালক প্রেরিত সুস্পষ্ট প্রমাণের উপর মযবুত রয়েছে সে কি তার মত হতে পারে যার কাছে মন্দই হলো উত্তম, যে অনুসরণ করে স্বীয় প্রবৃত্তির?" (মুহাম্মদ-১৪)
       সুতরাং চাকচিক্যময় বাহ্যিকতায় বিভ্রান্ত হয়ে যে কোন নতুনকে নির্বিচারে কিছুতেই গ্রহণ করা যাবে না। তা যাচাই করে দেখতে হবে। যদি আল্লাহর বিধানের সাথে সংগতিপূর্ণ হয় তাহলে তা সানন্দে গ্রহণ করতে হবে। কুরআনের মধ্যে বলা হয়েছে, “আল্লাহ বা তার রাসূল কোন বিষয়ের নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না।” (আহযাব-৩৩)
     আবার সেও অনুগত হিসেবে গণ্য হবে না যে  যুগের চাহিদা প্রয়োজনকে নিজের বুদ্ধির বিচারে উত্তম ভেবে কুরআন ও হাদীসকে তার সাথে খাপ খাওয়াতে চায় এবং সে ব্যাপারে দুর্বোধ্য ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয়। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আপনার রবের বাণী পূর্ণ সত্য, সুষম তার বাক্যের কোন পরিবর্তনকারী নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। যদি আপনি অধিকাংশ মানুষের কথা মেনে নেন তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে ও অনুমান ভিত্তিক কথা বলে। তিনি সবিশেষ অবহিত, কে তার পথ ছেড়ে বিপথগামী আর কে সৎ পথে আছে।” (আনআম-১১৫-১১৭)
      তাই যারা শত আবর্তন বিবর্তনেও আল্লাহর নির্দেশকেই আঁকড়ে ধরে থাকে আল্লাহ তাদের হিদায়াতের পথে পরিচালিত করেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ “যারা আমার পথে সচেষ্ট তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার পথ প্রদর্শন করি।” (আন-কাবুত-৬৯)
     আর যারা সুবিধাবাদী, স্বার্থপর ও সুসময়ের বন্ধু সাজে এবং বিপদে সরে পড়ে বা নিজের মিথ্যা মতের স্বপক্ষে অপব্যাখ্যার আশ্রয় নেয়, তারা ক্ষতিগ্রস্ত ইহলোকে ও পরলোকে। তাই আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন, “তারা দোটানায় দোদুল্যমান। না এদিকে না সেদিকে। আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তুমি তাদের জন্য কোন পথ খুঁজে পাবে না।” (নিসা-১৪৩)
      মোট কথা, ভাল-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণের একমাত্র মানদণ্ড হলো ইসলামী শরীয়াত বা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত জীবন বিধান। ইসলামী শরীয়াতের আলোকে প্রগতি ও আধুনিক সৃষ্টির গ্রহণযোগ্যতা বা বর্জনীয়তার বিচার হবে। এ নীতি প্রযোজ্য হবে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব, মাকরুহ ও হারাম সর্বক্ষেত্রে। কেননা এগুলো চিরদিন অপরিবর্তনীয় থাকে। মৌলিক এই আদেশ-নিষেধগুলোর পরিবর্তন ঘটে না। হ্যাঁ, তবে মুস্তাহাবের ক্ষেত্রে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে এবং তা পরিবর্তন যোগ্য এবং এর ক্ষেত্রও অনেক বিস্তৃত। ইসলাম এই বিস্তৃত ক্ষেত্রে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। যেখানে মানুষ স্বীয় মেধার দ্বারা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আবিস্কারের মঙ্গলজনক এক নতুন দিগন্ত উম্মোচন করতে পারে। পৌঁছতে পারে তারা প্রযুক্তি ও কারিগরি জগতের শীর্ষ চূড়ায়।
     তাই মুসলিম উম্মাহকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, প্রগতির বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারে যেন তার কোন কাজ খোদায়ী সীমা রেখা অতিক্রম করতে না পারে। যদিও বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি তাকে এর উল্টা পথে ডাকবে। আজকের মানুষ দ্বারা আল্লাহর আহকাম সবচেয়ে বেশী লংঘিত ও অবজ্ঞার শিকার হচ্ছে। যার ফলে আজ গোপনটা বিশ্ব দুর্যোগের শিকার। হানাহানি, মারামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার। সুখ শান্তির অবশিষ্ট রেশটুকুও এখন অপসৃয়মান। তাই এ মুহূর্তে একমাত্র কর্তব্য হলো, আবার পূর্ণ রূপে আল্লাহর বিধানকে গ্রহণ করা এবং তার আলোকে জীবন গড়ে তোলা। এরই মধ্যে নিহিত আছে ইহকাল ও পরকালের স্থায়ী শান্তি ও সুখ।


ভাষান্তরঃ নাসীম আরাফাত