JustPaste.it

UM-5-usama bin laden o ajjom:parospor sakghorshik naki vinnodarmi

um5.jpg

দুই মুজাদ্দিদ:

উসামা বিন লাদেন ও আযযাম: পরস্পর সাংঘর্ষিক, নাকি ভিন্নধর্মী!

আধুনিক জিহাদের দুটি ধারা: বিন লাদেন ও আযযাম- শীর্ষক ধারাবাহিক প্রবন্ধের উপর কিছু আপত্তি

 

প্রথম আসর:

ইমাম আযযাম রহিমাহুল্লাহর ফিকহী ধারার মূলকথা

 

খাত্তাব বিন মুহাম্মদ আল-হাশিমী

 

 

 

 

 

সম্প্রতি ‘মাজাল্লাতু হক’পত্রিকা “আধুনিক জিহাদের দু’টি ধারা; ইবনে লাদেন ও আযযাম”- শিরোনামে তাদের জনৈক লেখকের একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ প্রকাশ করে। অতঃপর ‘মুনতাদাল উলামা’ ও ‘আল-মাহাদুল মিসরী লিদ-দিরাসাত’ সাইট দু’টি ইন্টারনেট জগতকে তার দ্বারা আলোড়িত করে ফেলে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও তাদের পরিচালিত নিয়মিত সাইটগুলোতে তা ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রসার করে।

 আমি শহীদ ইমাম আব্দুল্লাহ আযযামের আদর্শের একজন অনুসারী ও তাঁর ছাত্র, তাঁর সামনে উপস্থিত হয়েছি, তাঁর কিতাবের ছাত্রত্ব গ্রহণ করেছি এবং তাঁর অনেক ছাত্রদের সঙ্গে উঠা-বসা করেছি।তাই আমি গভীর মনোযোগ ও অনুসন্ধিৎসার সাথে প্রবন্ধটি পাঠ করলাম। আমি তার মধ্যে অনেকগুলো চিন্তাগত ভ্রান্তি, যৌক্তিক বিচ্যুতি ও ঐতিহাসিক ভুল দেখতে পেয়েছি।এগুলোর ব্যাপারে সতর্ক করা, সমালোচনা করা, সংশোধন করা ও পর্যালোচনা করা জরুরি। বিশেষ করে, যেহেতু তা দুই শায়খ ইমাম আব্দুল্লাহ আযযাম ও কমান্ডার উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ’র ব্যাপারে।

আর এখন তা প্রকাশের যথোপযুক্ত সময়ও বটে, যাতে পাঠকবৃন্দ এমনসব চিন্তাগত ভ্রান্তি ও যৌক্তিক বিভ্রাটে আটকে না পড়েন, যা ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য কর্মরত সমসাময়িক ধারা-পদ্ধতিগুলোর বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনার শাস্ত্রীয় নীতি থেকেই বহু দূরে।

সর্বপ্রথম, লেখকের বক্তব্যগুলোর পর্যালোচনায় মনোযোগ দেওয়ার পূর্বে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পেশ করা প্রয়োজন:

. ইমাম আযযাম রহিমাহুল্লাহ হলেন একজন আলিম, শরয়ী ফকীহ, দাঈ ও প্রশিক্ষক। পক্ষান্তরে, শায়খ উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ হলেন একজন সামরিক কমান্ডার, অর্থনীতি ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ, জিহাদী ফিকহের পণ্ডিত এবং আল্লাহর পথে জিহাদের একজন বিত্তবান অর্থায়নকারী ।

. শায়খ উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ ১৩৯৯ হিজরীতে আফগানিস্তানে পৌঁছেন। শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ ১৪০২ হিজরীতে সেখানে পৌঁছেন এবং বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যেগুলোতে শায়খ উসামাই ছিলেন মূল অর্থায়নকারী। তারপর, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে আরব মুজাহিদগণের পৃথক সাংগঠনিক সামরিক কার্যক্রমের ব্যাপারে উভয়ের মাঝে মতপার্থক্য দেখা দেয়।

অতঃপর, জাজির যুদ্ধজয়ের পর এ মতপার্থক্য শেষ হয়ে যায় এবং এভাবেই বর্তমান জিহাদী ধারার নীতিমালা প্রণীত হয়। অতঃপর, শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ ১৪০৯ হিজরীতে শহীদ হয়ে যান। তারপরে শায়খ উসামা বিন লাদেন রহিমাহুল্লাহ এমন একটি জীবন অতিক্রম করেন, যেটা শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ দেখেননি। আর তা হল শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ এর শাহাদাতের পর দীর্ঘ ২৩ বছরে পশ্চিমা সভ্যতার সাথে লড়াইয়ের বিস্তৃতি।

আমরা, আমাদের বর্তমান জাতির ইতিহাসে এ দুই মহান ব্যক্তির নীতি তুলনা করতে গেলে আমাদের জন্য এ দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরী। যেহেতু ‘এ দুই ব্যক্তি এক ব্যক্তিই, তাদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই’একথা বলাও মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি নিয়ে ঠাট্টা করার নামান্তর।

আমি বিগত কয়েক দশকে আমাদের উম্মাহর মহান ব্যক্তিদের জীবনীর প্রতি দৃষ্টি বুলিয়েছি, বিশেষ করে একই ধারার অনুসারীদের মাঝে, যাঁরা ইলমী, চিন্তাগত ও রাজনৈতিক দিক থেকে একই নীতির অনুসারী ছিলেন।কিন্তু, তাঁদের মধ্যে একজন শিষ্যের মাঝেও তাঁর শায়খের হুবহু সাদৃশ্য দেখিনি। এটা সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার নীতির পরিপন্থী। তিনি মানুষের মাঝে যে পদ্ধতিতে তাদের স্বভাব, প্রকৃতি, জ্ঞান-বুদ্ধি, ইচ্ছা-মনোবল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলো বণ্টন করেছেনতার বিরোধী।

আপনি চাইলে “আল-উরওয়াতুল উছকা” এর লেখক শায়খ জামালুদ্দীন আফগানী ও তার শিষ্য মাহমুদ আব্দুহুর প্রতি দৃষ্টি দিন, তাঁরা কি উভয়ে পরিপূর্ণ সাদৃশ্যপূর্ণ?

 আপনি মাহমুদ আব্দুহু ও তাঁর শিষ্য রশীদ রেজার দিকে দৃষ্টি দিন। আরো বলুন, মুহাম্মদ কুতুব কি হুবহু তাঁর ভাই ও উস্তাদ সায়্যিদ কুতুবের মত ছিলেন? বশীর ইবরাহীম কি হুবহু ইবনে বাদিসের মত ছিলেন? সায়্যিদ আহমাদ শহীদ রহিমাহুল্লাহ আর তাঁর স্থলাভিষিক্ত সায়্যিদ ইসমাঈল শহীদ রহিমাহুল্লাহ কি হুবহু তাঁদের দাদা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবীর মত ছিলেন?

আবুল হাসান আলী নদভী কি হুবহু তাঁর শায়খ কান্ধলভীর মত ছিলেন? একই কথা বলুন মুহাম্মদ খিযির হুসাইন, তাহির ইবনে আশুর, মালিক ইবনে নাবী আলকাওকাবী, আব্দুল কারী আল-খাত্তাবী, ওমর মুখতার ও অন্যান্যদের ব্যাপারে। চাই তাঁরা ইলমের ময়দানের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হোন, কিংবা গবেষণা, রাজনীতি, জিহাদ ও লড়াইয়ের ময়দানের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হোন।আপনি কাউকেই তার শায়খের হুবহু কপি পাবেন না। যেকোনো পাঠক ও অনুসন্ধানীর নিকটই ব্যাপারটি সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার।

মনস্তাত্ত্বিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও স্বভাবগত পার্থক্যগুলো বোঝার মাধ্যমেই কোনো ধরণের বে-ইনসাফী ও বৈষম্য ব্যতীত সঠিক তুলনা করা যায়। কারণ মানুষ তার পরিবেশের দ্বারা লালিত-পালিত হয়। স্বভাবগত ভাবেই মানুষ সামাজিক, যেমনটা ইবনে খালদুন তার মোকাদ্দামায় বলেছেন।

আমি উক্ত প্রাবন্ধিকের মাপকাঠির প্রতি দৃষ্টি দিয়েছি।তাতে আমি দেখেছি, তিনি তার পাল্লাকে উঁচু নিচু করেছেন, পাত্রে কম-বেশি করেছেন। সেই ইনসাফের সাথে তাকে সমান করেননি, যে ইনসাফের দ্বারা সপ্তাকাশ সপ্ত জমিন টিকে আছে। নিশ্চয়ই আল্লাহই লেখকের হিসাবরক্ষক। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনিই উত্তম কর্মবিধায়ক।

তবে, এসব কিছুর অর্থ এটা নয় যে, একজন মানুষ ভুল-ভ্রান্তি থেকে নিষ্কলুষ। কিন্তু সর্বাবস্থায়ই ইনসাফ কাম্য।

প্রথম আপত্তি: দুটি ধারা, নাকি একই ধারা?

লেখক তার বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধের শুরুতেই লিখেছে,‘কেউ কেউ মনে করেন যে, জিহাদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক জিহাদের ক্ষেত্রে ইবনে লাদেন ও আল-কায়েদার নীতিমালা মূলত আব্দুল্লাহ আযযামের দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ। কিন্তু অন্যরা মনে করেন, উভয় ধারার চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির মাঝে বিস্তর ব্যবধান। উভয়টা সম্পূর্ণ বিপরীত, পরস্পরের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই’।

এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হল, লেখক বর্তমান যুগের এ দু’টি জিহাদী ধারার গতিবিধির যৌক্তিক ও শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দু’টি ধারণা উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হলেন। অতঃপর, এ বিষয়ে আলোচনা করলেন যে, দ্বিতীয়টি কি প্রথমটিরই পূর্ণতা দানকারী ও প্রসারিত রূপ কি না? নাকি উভয়টার মাঝে বিস্তর ব্যবধান আছে? তথা লেখকের ভাষায়- নাকি উভয়টা সম্পূর্ণ বিপরীত, পরস্পরের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই।

আমি জানি না, লেখক কী কারণে তৃতীয় মতটি উল্লেখ করতে ভুলে গেলেন, যেটা অনেক বিশ্লেষক ও গবেষকদের নিকট অগ্রগণ্য ধারণা। তা হল - ইবনে লাদেনের জিহাদী আদর্শ হুবহু ইমাম আযযামেরই আন্দোলন ও সংস্কারমূলক আদর্শ। আযযাম হলেন এই আদর্শের প্রতিষ্ঠাকারী, শরয়ী আলেম এবং কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক নববী উত্তরাধিকারের বাহক। আর ইবনে লাদেন হলেন তাঁর আধ্যাত্মিক পিতার নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নকারী সামরিক কমান্ডার এবং সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়নকারী।

সে হিসাবে জিহাদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক জিহাদের ক্ষেত্রে ইবনে লাদেনের আদর্শ, আব্দুল্লাহ আযযামের দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশও নয়, কিংবা এমন বিপরীতমুখী দু’টি আদর্শও নয়, যাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই।

বিশেষ করে লেখকের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে সে সময়, যখন তার অল্প কয়েকদিন পূর্বে শায়খ উসামার মা ‘উলইয়া গানিম’ (আল্লাহ তাকে কল্যাণের সাথে সমাপ্তি দান করুন) সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, শায়খ আযযাম, ইখওয়ানুল মুসলিমীনের একজন সদস্য, যিনি তাঁর ছেলের বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তাগত দিকনির্দেশনা লাভের মাধ্যম ছিলেন। আর এটা হয়েছিল, যখন উসামা, জেদ্দা শহরে তাঁর তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেরপড়াশোনা করেছিলেন।

এটাই জোরালোভাবে প্রমাণ করে যে, শায়খ আযযাম ও তাঁর ছাত্রের মাঝে এমন মজবুত সম্পর্ক ছিল, যা ছিন্ন হবার নয়। অথচ, এই লেখক তার প্রবন্ধের শুরুতে এর বিপরীত সিদ্ধান্ত দিয়ে বলেছেন, উভয়টি পরস্পর-ভিন্ন দু’টি ধারা, আর পর্যালোচনার বিষয় হল; দ্বিতীয়টি কি প্রথমটির ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ? নাকি উভয়টি এমন বিপরীতমুখী যে, একটি হলে অপরটি হতে পারবে না আর একটি না হলে অপরটি অবশ্যই হবে!

প্রকৃতপক্ষে, সিংহভাগ প্রাচ্যবিদ বিশ্লেষক ও পশ্চিমা সাংবাদিকরা এ মত পোষণ করে যে, ‘ইবনে লাদেন ও আযযামের একই আদর্শ হিসাবে তাঁদের মাঝে এমন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল, যা বিভক্ত হওয়ার নয়’। আর এটিই বিশুদ্ধ ও সবচেয়ে যৌক্তিক। বিশেষ করে, যেহেতু আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের সময় তাঁদের উভয়ের যে জিহাদী ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা পরিচালনার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়জন প্রথমজনের কর্মগত অংশীদার ছিলেন। তাই, যখন শরয়ী আলেম চলে গেলেন আর কোনো নববী ওয়ারিস আলেম তার স্থলাভিষিক্ত হল না, তখন শায়খ উসামা বিন লাদেন ও তাঁর জিহাদী আন্দোলনের সাথীগণ নিজেদের জান-মালের মাধ্যমে সেই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেন, যার সবচেয়ে কঠিন দুর্ঘটনা ছিল উক্ত ধারার মহান শায়খ ইমাম আযযামের আকস্মিক নিহত হওয়া।

সহজে বোঝার জন্য মনে করুন, আমরা ইসলামের প্রথম জিহাদী বিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ পাঠ করছি- যদিও আমরা স্বীকার করি যে, সেটার মাঝে আর তার অনুষঙ্গ তথা বর্তমান জিহাদী ধারার মাঝে বিরাট পার্থক্য ও ব্যবধান আছে- তখন কেউ যদি লিখে-

‘কেউ কেউ মনে করেন, আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ও খালিদ বিন ওয়ালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু’র জিহাদী আদর্শ মূলত শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জিহাদী আদর্শের, বিশেষ করে তাঁর আন্তর্জাতিক জিহাদী আদর্শের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ। আর অপর একদল মনে করেন, উভয় আদর্শের চিন্তা ও কাজের মাঝে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। উভয়টা সম্পূর্ণ বিপরীত, পরস্পরের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই।

আগত লাইনগুলোতে উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মগত উত্তরাধিকারগুলো বিশ্লেষণ করা হবে। সেই সাথেউভয়ের মধ্যকার ঐক্যমত্য ও মত-ভিন্নতার বিষয়গুলোর উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে। উভয়ের পূর্ব-ঘটিত ও দুর্লভ বিষয়গুলো বাদ দিয়ে তাদের সর্বশেষ আদর্শের প্রতি অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে এ জট ছাড়ানোর ও বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হবে’।

তাহলে আমরা কি এটাকে ইচ্ছাকৃত উদাসীনতা ব্যতীত কিছু ভাবতে পারি?

একই নীতি-আদর্শের মাঝে জট ছাড়ানো ও বাস্তবতা তুলে ধরার ব্যর্থ ও অনর্থক চেষ্টার এমন দৃষ্টান্ত খুব কমই মিলে। বিশেষত, একজন প্রশিক্ষণ প্রদানকারী আলেমের মাঝে আর তাঁরই সঙ্গে যুক্ত প্রধান অর্থায়নকারী ও সামরিক কমান্ডারের মাঝে।

ধরুন,আমি শায়খ আহমাদ ইয়াসিন ও কমান্ডার ইয়াহইয়া আইয়্যাশ, এ দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মগত উত্তরাধিকারগুলো বিশ্লেষণ করলাম।তারপরউভয়ের মধ্যকার ঐক্যমত্য ও মত-ভিন্নতার বিষয়গুলোর উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলাম। সেইসঙ্গে উভয়ের পূর্ব-ঘটিত ও দুর্লভ বিষয়গুলো বাদ দিয়ে তাঁদের সর্বশেষ আদর্শের প্রতি অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে উভয়ের আদর্শের মধ্যকার জট ছাড়ানোর জন্য একটি প্রবন্ধ লেখলাম।আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান একই গর্ভাশয় থেকে নির্গত সিয়ামিজ যমজকে পার্থক্য করার ব্যাপারে বাকচাতুর্য ও ভাষার তীক্ষ্ণতার মাধ্যমে যে উন্নতিতে পৌঁছে গেছে(যেমন- জীবন্ত ডিম্বাণুতে সফলভাবে অস্ত্রোপচারের ফলে এই দৃশ্যমান ভাগ দেখা যাচ্ছে), তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসলামী ইতিহাসের একই জিহাদের আদর্শ পুরুষদের জোটে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করলাম, তাহলে এটাকে নিজের নির্বুদ্ধিতা ও চিন্তার দৈন্যতা ব্যতীত কী মনে করবো?

 

দ্বিতীয় আপত্তি: শায়খ আযযাম কি ফিকহী মাসআলাসমূহের ক্ষেত্রে কঠোরতাকারী, নাকি সংমিশ্রণকারী?

লেখক, উভয় শায়েখের মাঝে যৌথভাবে বিদ্যমান মৌলিক পাঁচটি নীতির মধ্যে একটি উল্লেখ করেন; প্রতিটি মুসলিমের উপর জিহাদ ফরজে আইন। এ মাসআলাটি হল, উভয়ের মাঝে কার্যত সাদৃশ্যগুলোর অন্যতম। এমনকি শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ এ মাসআলায় তার স্বভাবের বিপরীতে কঠোরতা করতেন এবং অনেক সময় যারা এটাকে ফরজে কিফায়া বলে ফাতওয়া দেন, তাদের ব্যাপারে কঠিন ভাষা ব্যবহার করতেন।

লেখকের এই কথাটা- ‘এ মাসআলায় তার স্বভাবের বিপরীতে কঠোরতা করতেন এবং অনেক সময় যারা এটাকে ফরজে কিফায়া বলে ফাতওয়া দেন, তাদের ব্যাপারে কঠিন ভাষা ব্যবহার করতেন’ এটা শায়খের প্রতি ও শায়খের ফিকহী আদর্শের প্রতি মন্দ ইঙ্গিত। তার কথার অর্থ দাঁড়ায়, শায়খ ফিকহী বিধানগত মাসআলায় কঠোরতা করতেন না, তিনি শুধু মুসলিমদের উপর জিহাদ ফরজে আইন হওয়ার মাসআলায় কঠোরতা করেছেন। মাঝে মাঝে নিজের স্বভাবের বিপরীতে, যারা এর বিপরীত ফাতওয়া দিত, তাদের উপর কঠোর হতেন যেমনটা উক্ত লেখক বর্ণনা দিলেন।

অথচ যারাই শায়খের কিতাবসমূহ পড়েছেন কিংবা তার সরাসরি শিষ্যত্ব অর্জন করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের নিকট এটি স্পষ্ট যে, শায়খ কুরআন-সুন্নাহর দলিল থেকে উদঘাটিত বিধি-বিধানের আযীমত তথা চূড়ান্ত রূপটি গ্রহণ করার ব্যাপারে কঠোরতা করার প্রতিই আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কারও পরওয়া করতেন না। শায়খ কখনো কোনোএকটি ফিকহী মাসআলায়ও ফিকহী সংমিশ্রণের পন্থা অবলম্বন করেননি, যেটা আজ তাঁর ব্যাপারে জোর করে প্রচার করা হচ্ছে।

মূলত, আধুনিক সহজ নীতির উপর চলার প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে হিজরী ১৩শ শতাব্দীতে এবং এই শতাব্দীর শেষ দশকে। কতগুলো স্লোগানের অধীনে, যেমন: ‘করতে পার, সমস্যা নেই’, ‘উদ্দেশ্য সন্ধানী ফিকহ’, ‘সংখ্যালঘু ও দুর্বল-বান্ধব ফিকহ’ এজাতীয় আরো কতগুলো স্লোগান, যেগুলো শায়খ কারযাবী ও আওদার মত লোকেরা বাজারজাত করেছে। আল্লাহ তাদের সকলকে মাফ করুন এবং সঠিক পথের দিশা দিন। আর বর্তমানে তার প্রচলন ঘটাচ্ছে “ফিকহী সংমিশ্রণ” ও “উদ্দেশ্য সন্ধানী ফিকহ”এর পতাকাবাহী রিসূনী ও ইবনে বীহ।

অনস্বীকার্য বাস্তবতা হল, শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ নতুন কিছু নিয়ে আসেননি, কারণ ‘জিহাদের বিধি-বিধানে নতুন কিছুই নেই’। বরং শায়খ রহিমাহুল্লাহ সর্বকালের ও সকল স্থানের উলামায়ে কেরামের ধারাবাহিক ইজমাগুলোই বর্ণনা করেছেন। আর তা হল, মুসলিম দেশের এক বিঘত জমিও যদি কাফের শত্রুরা জোর করে দখল করে নেয় কিংবা দখল করার ইচ্ছা করে, তাহলে প্রতিটি সক্ষম মুসলিম পুরুষের উপর জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত সকলে মিলে তা কাফেরদের হাত থেকে মুক্ত করতে না পারে, যদিও এ ফরজে আইন সমস্ত মুসলিমদেরকে শামিল করে নেয়। আর এ ফরজিয়্যাত কয়েক শতাব্দী পূর্বে স্পেন পতন হওয়ার পর থেকেই সাব্যস্ত হয়ে গেছে।

তাই লেখকের এ কথাটি ‘এ মাসআলাটি হল, উভয়ের মাঝে কার্যত সাদৃশ্যগুলোর অন্যতম। এমনকি শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ এ মাসআলায় তার স্বভাবের বিপরীতে কঠোরতা করতেন’- এটা অবিবেচনাপ্রসূত।

কারণ এ মাসআলা ইসলামের অনুসৃত সকল মাযহাবের সকল আলেমদের মাঝে বাস্তবিক, প্রায়োগিক, কার্যত ও দৃষ্টিভঙ্গিগত ঐক্যের অন্যতম ও প্রকাশ্যতম মাসআলা। শায়খ আযযাম ও তার সঙ্গী উসামা বিন লাদেন তো চৌদ্দশত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা অসংখ্য ফুকাহাদের বর্ণনাসমুদ্রের একটি ফোঁটা মাত্র। যার ব্যাপারে সর্বদাই ঐক্যমত্য চলে এসেছে। একমাত্র আমাদের বর্তমান যামানাই শুধু ব্যতিক্রম, যে যামানায় ‘আলেমদের শাসক’ এর অনুপস্থিতিতে ‘শাসকদের আলেমরা’ প্রভাবশালী হয়ে গেছে। আর ঐ সমস্ত বেতনভুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ফুকাহাদের কথাবার্তা ছড়িয়ে পড়েছে, শরয়ী রাজনীতি সংক্রান্ত মাসআলায় যাদের স্বতন্ত্র বক্তব্য ধর্তব্যই হতে পারে না। স্বার্থ, সুবিধা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়ার কারণে ওই সম্প্রদায় এমন কথাবার্তা লিখছে, যা অচিরেই বিচার দিবসে তাদের অনুতাপের কারণ হবে।

আর লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী শায়খ রহিমাহুল্লাহ এ মাসআলায় যে কঠোরতা করেছেন, তাও সেই কারণেই যা এই লেখক নিজ কলমেই লিখেছেন। আব্দুল্লাহ আযযামের ছিল শাস্ত্রীয় মন-মানসিকতার। অর্থাৎ তিনি বিধি-বিধান উদঘাটনের বিভিন্ন পন্থা ও নীতিমালা এবং তা থেকে যত শাখাগত মাসআলা বের হয়, যেগুলো গ্রহণযোগ্য সু্ন্নী মাযহাবসমূহের ইখতিলাফের বিস্তৃত গণ্ডির ভিতরে পড়ে, তা জানতেন। আর নিঃসন্দেহে রাজনীতি ও যুদ্ধ-জিহাদ সম্পর্কেও অনেক মাসআলা রয়েছে।

তাই, উসূলবিদ ও ফকীহ শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ ইসলামের নিকট-অতীতের ইতিহাস জানতেন।বিশেষ করে মুসলিম আলজেরিয়ার ইতিহাস, যখন বর্বর ফ্রান্স তা দখল করে নিয়েছিল এবং তার মাটিতে দশ লক্ষেরও অধিক মুসলিমকে হত্যা করেছিল। শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, কীভাবে ফ্রান্স ফিকহের কিতাবসমূহ হতে জিহাদের অধ্যায়গুলোকে উঠিয়ে দিয়েছিল এবং আলেমদেরকে হাদিসের কিতাবসমূহে জিহাদের অধ্যায়গুলো পড়াতে নিষেধ করে দিয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন, কীভাবে আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ও তাদেরকে মুসলিমদের দেশ থেকে বের করার আন্দোলনকে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ফেতনা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল এবং অধিকাংশ আলেমও এ মতের উপর একমত হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু এ আবরণ দূর হওয়ার সাথে সাথেই এবং এ ত্রাস ও লালসার অবসান ঘটতে ঘটতেই অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল। দরবারি আলেমরা ঐ সকল লোকদেরকে শহীদ বলে অভিহিত করতে লাগল, যাদেরকে তারা একসময় বিদ্রোহী এবং ফেতনাবাজ বলত। আজও পর্যন্ত আলজেরিয়াকে দশ লক্ষ শহীদের দেশ বলা হয়।

তাই এটি শায়খ আব্দুল্লাহ আযযামের দূরদর্শিতাই ছিল যে, তিনি সেইদিন আসার পূর্বেই এ মাসআলায় কঠোরতা করেছিলেন, যে দিনটিকে তিনি তাঁর চিন্তার দূরদর্শিতার মাধ্যমে দেখেতে পেরেছিলেন। আর আমরা এখন বাস্তবে দেখছি যে, ইবনে বীহের নেতৃত্বে ‘মুসলিমদের বিজ্ঞ সমাজ’ এবং তার ‘আধুনিক হিলফুল ফুযুল’ মুসলিম উম্মাহর জিহাদের অপরিবর্তনীয় বিধানগুলোর উপর আক্রমণ চালিয়েছে। এমনকি জিহাদি ফিকহের অবস্থা এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে যে, আমরা বেতনভুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ফুকাহাদের মুখ থেকে একথাও শুনতে পাচ্ছি যে, বর্তমান যুগের চাহিদা ও কথিত উদ্দেশ্য সন্ধানী ফিকহের আলোকে জাতিসঙ্ঘের সিদ্ধান্তগুলো এবং রাষ্ট্রীয় আইনের ধারাগুলো জিহাদের অনেক বিধি-বিধানকে রহিত করে দেয়। এই গাঢ় ফিতনা মুসলিম উম্মাহ থেকে এটাই দাবি করছে যে, তারা তাগুতি ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পরিষদ’ এর আইনগুলো এবং কথিত আন্তর্জাতিক শাস্তির নীতিগুলো মেনে নিবে!!

তাই একজন স্বাধীনচেতা লেখক হলে তার উপর আবশ্যক ছিল, শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ এ মাসআলায় কেন তাঁর স্বভাব বিরোধী কঠোরতা আরোপ করতেন, তা স্পষ্ট করে তোলা। ‘উদ্দেশ্য সন্ধানী সংখ্যালঘু বান্ধব ফিকহ’এর শায়খদের অনেকেই পরাজিত মানসিকতা ও চিন্তার কারণে যে তিক্ত বাস্তবতাটি প্রকাশ হওয়া পছন্দ করেন না, তা হল; আজ ইসলামের জিহাদী পরিভাষাগুলো সমূলে উৎপাটিত হওয়ার এক কঠিন যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছে। যেমন- গাদ্দাফী সরকারের সরকারি ফুকাহারা অনেকবার বলেছে যে, আত্মরক্ষামূলক ও আক্রমণাত্মক জিহাদের পরিভাষাগুলো নতুন পরিভাষা। এগুলো আমাদের আধুনিক যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে জিহাদ তখনই হত, যখন কোনো রাষ্ট্রীয় চুক্তি বা সমঝোতা না থাকত। পক্ষান্তরে, বর্তমানে এ সকল স্থায়ী চুক্তি ও সমঝোতার শর্ত ও নিয়মাবলী প্রণয়ন করেছে জাতিসঙ্ঘ পরিষদের পাঁচ উপাস্য।

আর জিহাদের ফিকহী মাসআলাসমূহের অন্যতম শাখাগত মাসআলা, দাস-দাসী করার মাসআলাগুলোকে তো শায়খ আযযাম ও উসামা বিন লাদেনের সামর্থ্যকালেই পাপিষ্ঠ হাতগুলো ফিকহের কিতাবসমূহ হতে মুছে দিয়েছে।

যে সকল কারণে শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ এ মাসআলায় কঠোরতা করেছিলেন, এটি হল তার মধ্যে অন্যতম। যা শায়খ রহিমাহুল্লাহর চিরাচরিত অভ্যাসেরই অংশ ছিল। অর্থাৎ তিনি ইসলামের ফিকহী বিধানগুলোতে কোনো ধরণের সংমিশ্রণ বা সুযোগ সন্ধান না করে তা পরিষ্কারভাবে বলতে গর্ববোধ করতেন।

তৃতীয় আপত্তি: নৈতিক জিহাদ ও মনস্তাত্ত্বিক জিহাদের মাঝে পার্থক্য করার বিদআত

লেখক বলেছেন (আল্লাহ তাকে মাফ করুন), যদিও উভয় ধারার মাঝে পূর্বোল্লেখিত একতা ও মিলগুলো আছে, কিন্তু তার সাথে এমন অনেকগুলো গুরুতর ও স্পর্শকাতর মত-বিরোধপূর্ণ বিষয়ও আছে, যেগুলো কিছুতেই ঐক্যমত্য বিষয়গুলো থেকে গুরুত্বে ও প্রভাবে কম নয়।

আমরা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোকে পাঁচটি পয়েন্টে উল্লেখ করব:

প্রথমত, মনস্তাত্ত্বিক জিহাদ থেকে নৈতিক জিহাদ: শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ মুজাহিদদের জন্য অস্ত্র বহনের পূর্বে কিছুটা নৈতিক প্রশিক্ষণ গ্রহণেরও আবশ্যকীয়তা অনুভব করতেন। যেন কখনো বন্দুকের নল মুমিনদের মাথার দিকে ঘুরে না যায়…।

লেখকের উল্লেখিত বক্তব্যের ব্যাপারে আপত্তি ও পর্যালোচনা রয়েছে। তার এই সংক্ষিপ্তকরণের মাঝে এমন অনেকগুলো ভুল রয়েছে, যা সত্যের ধারেকাছেও নেই। কারণ শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ যদিও হুবহু শায়খ উসামার মত মুজাহিদদের জন্য অস্ত্রবহনের পূর্বে কিছুটা নৈতিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের আবশ্যকীয়তা অনুভব করতেন, যেন বন্দুকের নল মুমিনদের দিকে ফিরে না যায়, কিন্তু তিনি মনস্তাত্ত্বিক ও সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুরুত্ব দিতেন। যেটা প্রকৃতপক্ষে সেই প্রকৃতিগত প্রশিক্ষণই, যার উপর আল্লাহ মানুষ ছাড়াও সমস্ত প্রাণীদেরকে সৃষ্টি করেছেন।তা হল- নিজের সম্মান, জীবন ও সন্তান-সন্ততির প্রতিরক্ষা করা। শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ ফিলিস্তিনে জিহাদের যুগ থেকেই এই মানসিকতা লালন করতেন। তিনি দেখলেন, আফগানরা মানবিক, প্রকৃতিগত সম্মান ও মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই মানসিকতা গ্রহণ করেছে, তথা জুলুমকে প্রত্যাখ্যান করা এবং নিজের থেকে লাঞ্ছনা ও হীনতা প্রতিহত করার মানসিকতা।তারপর তিনি তাঁর অনুসারীদের ক্ষেত্রেও এটার অনুমোদন করেন। অতঃপর, তাঁর মৃত্যুর পরে আল-কায়েদাও এই প্রকৃতিগত দৃষ্টিভঙ্গিগুলো গ্রহণ করে নিয়েছে।

এগুলো মূলত মানুষের সম্মানজনক জীবনের অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয় এবং জালিম ও মাজলুমের মধ্যকার সংঘাতের দাবি। এছাড়া, কুরআন তো তার অনুসারীদেরকে এই সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক নীতিগুলো পালন ও অনুসরণ করার আহ্বান করেছে।

শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহর যুগ যারা পেয়েছেন এবং যারা তাঁর কিতাবাদি পড়েছেন, তারা জেনে থাকবেন যে, যখন সোভিয়েত শক্তিগুলো আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হল, তখন তিনি মুসলিমদেরকে ‘ঈমানী ও আখলাকী তারবিয়া” তথা নৈতিক শিক্ষা গ্রহণের আদেশ করেননি, যেটা তার নিকট সেই শক্ত ভিত্তির ন্যায় ছিল, যার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া ব্যতীত একটি আদর্শ জিহাদ দাঁড়াতেই পারে না। যেমনটা লেখক বলেছেন।

বরং তিনি আফগানবাসীর জন্য প্রত্যেক সক্ষম মুসলিমের উপর নগদ বের হওয়া ফরজ সাব্যস্ত করতেন, চাই সে সামান্যও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ না করুক না কেন। এমনিভাবে যারা পেশোয়ারে পৌঁছত, তাঁরা সংক্ষিপ্ত একটি শরয়ী কোর্স করতেন। আর আফগানদের সাথে কীভাবে আচার-আচরণ করতে হবে সে ব্যাপারে কিছু উপদেশ শুনতেন। তারপরই তাঁদেরকে জাজির পর্বত-উপত্যকায় ও হিন্দুকুশ পর্বতচূড়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হত নিজেদের সম্মান রক্ষার যুদ্ধ করার জন্য।

বাস্তবতা জানতে আগ্রহী পাঠকগণ শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহর সেই প্রশ্নোত্তরটি পড়তে পারেন, যা জনৈক মুজাহিদের পক্ষ থেকে তাঁকে করা হয়েছিল। প্রশ্নটি হল, ‘আমরা কি ওই সকল লোকদের সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করব, যারা এখনো ইসলামী নৈতিকতার গ্রহণযোগ্য মাপকাঠিতেই উঠতে পারেনি’ (মাউসুআতুয যাখায়ির ১/১৩৫) তাহলে পাঠক এই লেখকের বক্তব্যের অসাড়তা ও বাস্তব-বিরোধিতা জানতে পারবেন।

এতকিছু সত্ত্বেও কিন্তু শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহর জীবনের শেষ সময়ে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ান লাল ভাল্লুকগুলো চলে যাওয়ার পর বন্দুকের নল আফগান মুসলিমদের দিকে ঘুরে গিয়েছিল। তখন সর্বপ্রথম যিনি এখান থেকে সরে গিয়ে সুদানে সফর করে মুসলিম হত্যার ফিতনা থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি হলেন সেই ব্যক্তি, যার ব্যাপারে এই লেখক বলেছেন।

পক্ষান্তরে, উসামা বিন লাদেনের ভাষণে ও কার্যক্ষেত্রে আল-কায়েদার মনস্তাত্ত্বিক ও সামরিক প্রশিক্ষণগুলো গ্রহণের দাওয়াতটাই বড় আকারে প্রাধান্য পায়। সাধারণ নৈতিক প্রশিক্ষণগুলো থেকে এটাকেই খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

লেখকের এটা বড়ই বেইনসাফি হয়েছে যে, তিনি শায়খ উসামার তারবিয়াতি প্রচেষ্টাগুলোকে হজম করে ফেলেছেন, একটি মুজাহিদ প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ যেগুলোর প্রতি খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। এ ব্যাপারে শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহর যত্নশীলতার একটি প্রমাণ হল- তিনি নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা সম্পন্ন আলেমদেরকে যারপরনাই গুরুত্ব দিতেন। একারণেই তিনি শায়খ আবু হাফস, আবু মুহাম্মদ আল-মিসরী, আবুল গাইস, হুসাইনান, নায্যারী, বালিদী, আবু ইয়াহইয়া ও অন্যান্য আলেমগণকে মুজাহিদদের চরিত্রগঠন, আত্মশুদ্ধি করা ও নৈতিকতা শিক্ষাদানের দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। এমনকি চরিত্র ও নৈতিকতা গঠনের অনেকগুলো প্রোগ্রাম শায়খ নিজেও তত্ত্বাবধান করতেন।

আর যে বাস্তবতাটি এই প্রাবন্ধিকের নিকট অস্পষ্ট হওয়ার কথা নয়, তা হল; যারাই শায়খ উসামা ও তাঁর সাথীদের সঙ্গে চলা ফেরা করেছেন, তারা ,তাঁদেরকে মানুষের মধ্যে সর্বাধিক চরিত্রবান হিসাবেই পেয়েছেন। শায়খ আতিয়্যাতুল্লাহর মত ব্যক্তিগণ তো শায়খ উসামার প্রশিক্ষণেরই ফল। শায়খ আতিয়্যা নিজে আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, এটা তাঁর উপর আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত যে, তিনি শায়খ উসামার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। অতঃপর, শায়খ উসামাই তাকে দিকনির্দেশনা দিয়ে ইলম অন্বেষণের জন্য পাঠিয়েছেন।

আর এই লেখক শায়খ আযযামের ব্যাপারে যা বলেছেন, সেটাকেও বাস্তবতার কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখা দরকার। কারণ লেখক, শায়খ আযযামের সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভাষণগুলোর এক বিরাট অংশ সম্পর্কে উদাসীনতা প্রদর্শন করেছেন। বিশেষ করে তাঁর সে সকল কিতাবগুলোর ব্যাপারে, যেগুলোতে তিনি শত্রুকে ভীত-সন্ত্রস্ত করা এবং ঈমানী আখলাকী তারবিয়ার অংশ হিসাবেই কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রশংসিত, সন্ত্রাসের দ্বারা গর্বিত হওয়ার প্রতি আহ্বান করেছেন।

যেমন তার কিতাব “কাফেলায় যুক্ত হও”, “মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষা ফরজে আইনসমূহের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফরজ”, “জিহাদের ঘোষণা”, “আধুনিক জিহাদের শিক্ষা ও উপদেশমালা”।

শায়খ আযযামের চিন্তা-চেতনাপ্রসূত আল-কায়েদার মনস্তাত্ত্বিক ও সামরিক নীতিগুলোই সর্বাধিক স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর আকর্ষণীয় কিতাব “মুসলিম উম্মাহর জিহাদ” এর মাঝে। কারণ এর মধ্যেই তিনি আফগান জনগণ ও তাদের উলামা কর্তৃক তাদের শাসকদেরকে তাকফীর করা এবং তাদের উপর ধর্মত্যাগ ও ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার হুকুম আরোপ করার প্রশংসা করেছেন।

এমনকি তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, যুদ্ধ করা ও তাদের পতন ঘটানোরও প্রশংসা করেছেন, যেমনটা আল-কায়েদাও কারযাই, গাদ্দাফী, আলী সালেহ ও অন্যান্য তাগুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে করেছে।

এমনিভাবে তিনি তাঁর “কাওয়াইমু মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা” নামক প্রবন্ধে (আয-যাখায়ির ২/১২০) কুফ্ফার নেতাদেরকে গুপ্তহত্যা করার নীতিমালা প্রণয়নের ভূমিকা প্রস্তুত করেন।গুপ্তহত্যার তালিকা তৈরি করতে ও তাগুতদের মস্তকগুলো বিচ্ছিন্ন করতে আদেশ করেন এবং উল্লেখ করেন যে, এটি একটি অবহেলিত ও পরিত্যক্ত সু্ন্নাহ।এটি আমাদের যুগে নতুন করে জীবিত করার চেষ্টা করা উচিত। তবে, তিনি এটাকে ঐ সমস্ত উলামাদের অনুমতির শর্তের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত করে দেন, যারা মানুষকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করেন।

শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ আফগানিস্তানে ঘটিত সমসাময়িক কয়েকটি গুপ্তহত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে মাওলবী জুল আহমাদ বাশতুনের ঘটনা বর্ণনা করেন, যে ফারিয়াব প্রদেশের অধিবাসী, নজীবুল্লাহ সরকারের সাথে বন্ধুত্বকারী একজন অসৎ আলেম ছিল। কীভাবে তাকে রাতের বেলা ঘুমের বিছানায় নিজ পরিবার, স্ত্রী ও সন্তানদের সামনেই হত্যা করা হল, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে শায়খ রহিমাহুল্লাহ এই অপারেশনের প্রশংসা করেন। এর জন্য এবং এর মত আরো অনেকগুলো ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট ভাইদেরকে মোবারকবাদ জানান।

উপরোক্ত আলোচনার উপর আরো গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বলব, শায়খ উসামা রহিমাহুল্লাহ কিছু সংমিশ্রণকারী ফিকহ পরিত্যাগ করতেন এবং ইসলামের মৌলিক বর্ণনাগুলোকে আঁকড়ে ধরতেন।যেগুলোকে“আল-কায়েদার সন্ত্রাসী ফিকহ” নামেও অভিহিত করে থাকে অনেকে। যেগুলো এই লেখক ও এরমতো লোকদের নিকট আল-কায়েদার মনস্তাত্ত্বিক ও সামরিক নীতিমালার বৈশিষ্ট্যাবলী হিসাবে গণ্য।এগুলো যে শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহও বলতেন, তার কয়েকটি উদাহরণ এই:

. তিনি সোভিয়েত শক্তিগুলোর সাথে সহযোগিতাকারী মুসলিমগণকে মুরতাদ বলতেন। (১/৩০১-২/৩৪৭-৩৫৭)

. নজীব সরকারের কর্মী আফগান বন্দীরা তওবা করলেও তাদের হত্যা করা বৈধ বলতেন, তাদের উপর মুরতাদ ও যিন্দিক হওয়ার হুকুম আরোপ করতেন। (১/৩০১-২/৩৪৭-৩৫৭)

. নজীব সরকারের সাথে বন্ধুত্বকারী আফগান মহিলাদেরকেও হত্যা বৈধ বলতেন। কেননা তারা মুরতাদ। (১/৩০৩)

. যুদ্ধের স্বার্থে আফগান সরকারের মুসলিম গোয়েন্দারা তওবা করলেও তাদের হত্যা করা বৈধ বলতেন। (২/৩৪৭)

. মুসলিম দেশগুলোর একদল শাসককে তাকফীর করতেন। যেমন: জামাল আব্দুন নাসের, গাদ্দাফী, সাদ্দাম, হাফিজ আসাদ, আফগানিস্তানের বাদশাহ জহির শাহ, বাবরাক কার্মাল প্রমুখ। (আয-যাখায়ির: ৩/১০০)

. সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও জানের মাধ্যমে জিহাদ পরিত্যাগকারী ও সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও নামায পরিত্যাগকারীর মাঝে কোনো পার্থক্য করতেন না।

. কারাগারে কোনো নারী ইজ্জত হারানোর আশঙ্কা করলে তার জন্য আত্মহত্যা করা জায়েয, এমনকি ওয়াজিব বলতেন।

. শত্রুর ঘাঁটিতে আক্রমণের সময় কাউকে কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করতে শোনা গেলেও যদিও তার থেকে বিপদের আশঙ্কা করা হয়, তাহলে তাকে হত্যা করা জায়েয বলতেন।

. তিনি বলতেন, আফগান জিহাদে অর্থের প্রয়োজনের চেয়ে লোকের প্রয়োজন বেশি ।

মোটকথা, শায়খ আযযাম রহিমাহুল্লাহ সে সকল সমসাময়িক দুর্লভ আলেমদের মধ্যে একজন ছিলেন, যারা বিরাট সংখ্যক মুসলিম দেশের শাসকদেরকে প্রকাশ্যে তাকফীর করতেন। তাদের মুরতাদ হওয়া ও দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অকাট্য কথা বলতেন। এমনকি, শায়খ রহিমাহুল্লাহ তাঁর কিতাবের কয়েক স্থানে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে ও তাদের সহযোগিতা করে, যেমন সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীগুলো, তাদেরকেও কাফের ও মুরতাদ ফাতওয়া দিতেন।

আল্লাহ চাইলে এ বিষয়টি দ্বিতীয় আসরে আমরা উত্থাপন করব ইনশাআল্লাহ। দ্বিতীয় আসরে আমরা এমন কিছু বাস্তবতা পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করব, যেগুলোকে মানুষের চোখ থেকে আড়াল করে ফেলা হয়েছে।

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।

শায়খ উসামারউক্তি

বড়দের মধ্যে একমাত্র শায়খ আযযাম ব্যতীত কেউ জেগে উঠলেন না। (আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন!)

তাই বর্তমান আফগান জিহাদের ক্ষেত্রে সমস্ত মুসলিমগণ শায়খ আযযামের পরিবারভুক্ত। সমসাময়িক জিহাদের ক্ষেত্রে সমগ্র আরবগণ শায়খ আযযামের পরিবারভুক্ত। আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন এবং তাঁকে সেই প্রতিদান দান করুন, যা তিনি একজন আলেমকে তার জাতির পক্ষ থেকে দেন। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার নিকট কামনা করি, তিনি তাঁকে ও তাঁর উভয় সন্তানকে শহীদ হিসাবে কবুল করবেন।

শায়খ আযযামের উক্তি

যে ব্যক্তি তার মালের মাধ্যমে এই সেবা সংস্থার দেখাশোনা করেছেন, তিনি হলেন ভাই আবু আব্দুল্লাহ উসামা ইবনে মুহাম্মদ ইবনে লাদেন। আমি তাঁর জন্য অনেক দু’আ করি। আল্লাহর নিকট দু’আ করি আল্লাহ তাঁর পরিবার ও সম্পদে বারাকাহ দান করুন! আল্লাহর নিকট আশা রাখি, তিনি তাঁর মতো আরো অনেক লোক সৃষ্টি করবেন। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি সমগ্র ইসলামী বিশ্বে তার উপমা খুঁজে পাইনি। তাই আল্লাহর নিকট কামনা করি,ইয়া আল্লাহ,আপনি তাঁর দ্বীন ও সম্পদের হেফাজত করুন।তাঁর জীবনকে বরকতময় করুন।

 

**************