JustPaste.it

তাফসীরুল কুরআন

. আল্লামা আব্দুল্লাহ আযযাম (রাহঃ)

 

সূরা তাওবাঃ আয়াত-..

برَاءَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ فَسِيحُوا فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ ۙ وَأَنَّ اللَّهَ مُخْزِي الْكَافِرِينَ وَأَذَانٌ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ أَنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِّنَ الْمُشْرِكِينَ ۙ وَرَسُولُهُ ۚ فَإِن تُبْتُمْ فَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ ۗ وَبَشِّرِ الَّذِينَ كَفَرُوا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ

            তরজমা

             আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সে সব মুশরিকদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা হল, যাদের সথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে।

             সুতরাং তোমরা চার মাস এদেশে নির্বিঘ্নে পরিভ্রমণ কর। আর জেনে রাখ, তোমরা আল্লাহ্‌কে পরাভূত করতে পারবে না, আর নিশ্চয় আল্লাহ্‌ কাফেরদের লাঞ্ছিত করে থাকেন।

            আর মহান হজ্জের দিনে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে লোকদের নিকট ঘোষণা করা হচ্ছে যে, আল্লাহ্‌ ও তার রাসূল মুশরিকদের থেকে দায়িত্বমুক্ত। অবশ্য যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর যদি বিমুখ হও, তাহলে জেনে নাও, তোমরা আল্লাহ্‌কে পরাভূত করতে পারবে না। আর আপনি কাফিরদেরকে মর্মান্তিক শাস্তির সুসংবাদ দিন।

            নাম ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা

            এটি মদীনায় অবতীর্ণ সর্বশেষ সূরা, যার আয়াত সংখ্যা ১২৯। এ সূরায় মুসলিম সমাজের সাথে অন্যান্য সমাজের সম্পর্কের চূড়ান্ত স্বরূপ নির্ধারিত করা হয়েছে। তাছাড়া মুসলমানদের সাথে কাফির ও মুনাফিকদের সম্পর্কের সীমাও নির্ধারিত করা হয়েছে।

               সূরার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ নাম তাওবা। কারণ এ সূরার ১১৭ নং আয়াতে আল্লাহপাকের ব্যাপকভাবে সকল মুসলমানের তাওবা কবুল করে তাদের উপর অনুগ্রহ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ১১৮নং আয়াতে বিশেষভাবে তিনজন সাহাবী কা’ব ইবনে মালিক, হিলাল ইবনে উমাইয়া ও মুরারা ইবনে রবী (রাঃ)-এর তাওবা কবুল করে তাদের উপর অনুগ্রহ করার ঘোষণা বিবৃত হয়েছে।

               সূরাটি সূরাতুল বারাআ নামেও প্রসিদ্ধ। বারাআ শব্দের অর্থ সম্পর্ক ছিন্ন করা। এ সূরায় মক্কার সকল গোত্রের সাথে কৃত মুসলমানদের সকল চুক্তি ছিন্ন ও বাতিল করা হয় এবং তাদের চার মাসের সময় প্রদান করা হয়। এর মধ্যে যেন তারা যেদিকে সুবিধা চলে যায় বা ইসলামের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে।

               সূরার আরেক নাম ‘আল ফাজিহা’। ফাজিহা শব্দের অর্থ অপমানকারী, লাঞ্ছনা দানকারী। কারণ এ সূরা মুনাফিকদের অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেছিল। সাঈদ ইবনে জুবাইর (রাঃ) বলেন, আমি আব্বাস (রাঃ) কে সূরা বারাআ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, এটি ফাজিহা (অপমানকারী)। কারণ, এ সূরার বিভিন্ন আয়াতে মুনাফিকদের স্বরূপ উন্মোচন করা হয়েছে। যেমনঃ বলা হয়েছে-

والذين اتخذوا مسجدا ضرارًا        ومنهم الذين يوذون النبى... ومنهم من عاهد الله ….. ومنهم من يلمزك فى الصدقات

               এভাবে মুনাফিকদের আলোচনা অবতীর্ণ হতে থাকে। শেষে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম, হয়তো কারো উল্লেখ-ই বাদ পড়বে না। এভাবে এ সূরা মুনাফিকদের সকল ভেদ ও গোপন বিষয়ের আলোচনা করে তাদের অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেছে। এ কারণে এ সূরাকে সূরাতুল বুহূস ও সূরাতুল মুবাসারাও বলা হয়। বুহূস ও মুবাসারা অর্থ আলোচনা। এ সূরায় মুনাফিকদের গোপন ও রহস্যময় বিষয়সমূহের আলোচনা করা হয়েছে।

 

 

              বিসমিল্লাহ না লিখা তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা

            সূরাটিই কুরআনের একমাত্র সূরা, যার শুরুতে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” লিখা হয়নি। কেন লিখা হয়নি, এ প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি অভিমত রয়েছে।

              . জাহিলী যুগে আরবদের নিয়ম ছিল, তারা যদি কোন চুক্তি ভঙ্গ ও ছিন্ন করার ইচ্ছা করত, তখন তারা পত্র লিখে প্রতিপক্ষকে জানিয়ে দিত। আর সে পত্রে বিসমিল্লাহ লিখত না। আল্লাহ্‌ তা’আলা এ সূরার মাধ্যমে রাসূল ও মুশরিকদের মাঝে বিদ্যমান চুক্তি ছিন্ন ও ভঙ্গের ঘোষণা দিয়েছেন এবং তাদের চারমাসের অবকাশ দিয়েছেন। তাই এ সূরাটিও বিসমিল্লাহ ছাড়া অবতীর্ণ হয়েছে।

              ২. ইমাম নাসায়ী (রহ) তাঁর সূত্র পরম্পরায় উসমান (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমাদেরকে ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমি উসমান (রাঃ)কে জিজ্ঞেস করলাম, যে নিয়মে কুরআনের সূরাগুলোর বিন্যাস করা হয়-অর্থাৎ প্রথম দিকে শতাধিক আয়াত সম্বলিত বৃহৎ সূরাগুলো রাখা হয়। পরিভাষায় এ সূরাগুলোকে মি-ঈন বলা হয়। তারপর শতের কম আয়াত সম্বলিত সূরাগুলো রাখা হয়। পরিভাষায় এ সূরাগুলোকে মাসানী বলা হয়। সুতরাং কুরআন বিন্যাসের এই নিয়ম হিসাবে আগে সূরা তাওবা তার পর সূরা আনফাল লিখার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কেন আপনি তার ব্যতিক্রম করলেন? তদুপরি এ সূরা দু’টিকে মিশিয়ে লিখেছেন- মাঝে ‘বিস্‌মিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লিখেননি। এর কারণ কি?

             জবাবে উসমান (রাঃ) বললেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট কোন আয়াত অবতীর্ণ হলে তিনি যারা অহী লিখতেন তাদের কাউকে ডাকতেন। তারপর বলতেন, এটা অমুক সূরার সাথে লিখে রাখ। আর সূরা আনফাল মদীনায় প্রথম অবতীর্ণ সূরাগুলোর একটি। আর সূরা তাওবা মদীনায় অবতীর্ণ সর্বশেষ সূরা। অথচ উভয় সূরার আলোচ্য বিষয় ও ঘটনাবলী প্রায় সাদৃশ্যপূর্ণ। ইন্তেকালের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের স্পষ্টভাবে বলে যাননি যে, সূরা তাওবা সূরা আনফালের অংশ। আমরা তখন ধরনা করলাম যে, সূরা তাওবা সূরা আনফালেরই অংশ। তাই এক সাথে মিশিয়ে লিখেছি এবং উভয় সূরার মাঝে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লিখিনি।

              . খারীজা, আবূ ইসমা প্রমুখ কুরআন বিশারদ তাবেঈ বলেছেন, হযরত উসমান (রাঃ)-এর খিলাফতকালে কুরআন সংকলন শুরু হলে রাসূলের সাহাবীদের মাঝে মতবিরোধ দেখা দিল। কতিপয় সাহাবী বললেন, তাওবা ও আনফাল একই সূরা। আর অন্যান্য সাহাবী বললেন, না, বরং দু’টি দুই সূরা। তাই যারা বলেছিলেন, দুই সূরা, তাদের মতের প্রতি লক্ষ্য রেখে দুই সূরার মাঝখানে কিছু জায়গা খালি রাখা হল। আর যারা এক সূরা বলেছিলেন তাদের প্রতি লক্ষ্য রেখে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লিখা হল না। এ কারণে উভয় মতের সাহাবীরা সন্তুষ্ট হলেন এবং উভয়ের মতামতই কুরআন সংকলনের ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হল।

              ৪. আব্দুল্লাহ ইবন্ আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমি আলী ইব্‌ন আবী তালেব (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, সূরা তাওবার শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম কেন লিখা হল না? উত্তরে তিনি বললেন, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ শান্তি ও নিরাপত্তার পয়গাম বিদ্যমান। অথচ সূরা তাওবায় শান্তি ও নিরাপত্তা চুক্তিগুলো নাকচ করে জিহাদের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তাই, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লিখা হয়নি।

     ৫. ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, সূরা তাওবার শুরুতে বিসমিল্লাহির লিখা হয়নি। তার কারণ জিবরাঈল (আঃ) তা নিয়ে অবতীর্ণ হননি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের পক্ষ থেকে তা লিখতেন না। জিবরাঈল (আঃ) নিয়ে এলে তবেই তিনি লিখতেন। এখানে জিবরাঈল (আঃ) নিয়ে আসেননি তাই তা লিখা হয়নি।

              

তাফসীর

               সূরাটি নবম হিজরীতে অবতীর্ণ হয়। এতে তাবুকের যুদ্ধ, যুদ্ধের প্রস্তুতি, যুদ্ধের পূর্বের ও পরের মদীনাবাসীদের অবস্থা সম্পর্কে অলোচনা করা হয়েছে। এ সূরার কিয়দাংশ যুদ্ধের পূর্বে এবং কিয়দাংশ যুদ্ধের পরে অবতীর্ণ হয়। নবম হিজরীর রজব মাসে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবনের এটিই শেষ যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পর রাসূল অন্য কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। 

              রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তা হলঃ

১. বদরের যুদ্ধ, দ্বিতীয় হিজরীর রমযান মাসে তা সংঘটিত হয়েছিল।

২. উহূদের যুদ্ধ, তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে তা সংঘটিত হয়েছিল।

৩. বনু নাজীরের যুদ্ধ, তৃতীয় হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল।

৪. মুরাইসী বা বনু মুস্তালিকের বুদ্ধ, এ যুদ্ধ কখন ঘটেছিল, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন তা চতুর্থ হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল আর অন্যরা বলেন তা ষষ্ঠ হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল।

৫. খন্দকের যুদ্ধ, যা পঞ্চম হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছিল।

৬. হুদায়বিয়ার যুদ্ধ, ষষ্ঠ হিজরীতে তা সংঘটিত হয়েছিল।

৭. খায়বরের যুদ্ধ, সপ্তম হিজরীতে তা সংঘটিত হয়েছিল।

৮. মূতার যুদ্ধ, অষ্টম হিজরীতে তা সংঘটিত হয়েছিল।

৯. মক্কা বিজয়, অষ্টম হিজরীর রমযান মাসে তা সংঘটিত হয়েছিল।

১০. হুনাইনের যুদ্ধ, অষ্টম হিজরীর শাওয়াল মাসে তা সংঘটিত হয়েছিল।

১১. তায়েফের যুদ্ধ, অষ্টম হিজরীর শেষ দিকে তা সংঘটিত হয়েছিল।

১২. তাবূকের যুদ্ধ, নবম হিজরীর রজব মাসে তা সংঘটিত হয়েছিল।

             রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বপ্নে দেখলেন, তিনি বাইতুল্লাহ’য় উমরা পালন করছেন, তাওয়াফ করছেন। তখন তিনি ও তার সঙ্গি চৌদ্দ শ’ বা পনের শ’ সাহাবী মক্কার পথে রওনা হলেন। ষষ্ঠ হিজরীর যীকা’দা মাসে তাঁরা যাত্রা শুরু করলেন। কুরাইশ যখন শুনল যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাওয়াফ করতে আসছেন, তাদের উপস্থিতিতেই মুসলমানরা মক্কায় প্রবেশ করবে, তখন তারা দারুণ ক্ষীপ্ত হল। বলল, আমাদের উপস্থিতিতে কিছুতেই তারা মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে না।  এ পরিস্থিতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুদায়বিয়ার যে অংশ হারামের অন্তর্ভুক্ত নয়, সেখানে অবস্থান নিলেন। নামাযের সময় হলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হারামের অংশে প্রবেশ করে নামায আদায় করতেন। তারপর পূর্বের স্থানে ফিরে আসতেন। হারামের নামায আদায়ের ফযীলত অর্জনের জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা করেছিলেন।

             রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাফিরদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার কথা শুনে বললেন, হায় কুরাইশের ধ্বংস! ‍যুদ্ধই তাদের তিলে তিলে শেষ করে দিল! তাদের ‍কি হত, যদি আরবদের জন্য আমার পথ উন্মুক্ত করে দিত?  তাদের কি ক্ষতি হত, যদি আরবদের জন্য আমাকে ছেড়ে দিত! যদি তারা আমার উপর বিজয়ী হয়, তবে তারা তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে। আর যদি আমি বিজয়ী হই, তবে তারা ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হবে। আর যদি তারা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তবে তাদের তা করার শক্তি আছে। কিন্তু কুরাইশ কি ধারণা করে? যিনি আমাকে সত্য সহ প্রেরণ করেছেন, তাঁর শপথ করে বলছি, আল্লাহ্ বিজয়ী করা পর্যন্ত আমি এই ধর্মের প্রচার করতেই থাকব অথবা এ পথেই আমি নিঃশেষ হয়ে যাব।

              হুদাইবিয়ায় পৌঁছুলে রাসূলের উট বসে পড়ল। প্রহার করার পরও তা উঠল না। সবাই বলাবলি করতে লাগল, ‘কাছওয়া (রাসূলের উষ্ট্রীর নাম) অবাধ্য হয়ে গেছে। কাছওয়া অবাধ্য হয়ে গেছে।’ রাসূল বললেন, ‘কাছয়া অবাধ্য হয়নি। এমনটি তার চরিত্রও নয়। তবে আবরাহার হাতীকে যিনি আটকিয়ে ছিলেন, তিনিই তাকে আটকিয়েছেন।’ তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘আজ কুরাইশরা যে প্রস্তাব নিয়ে আসবে, আমি তা-ই মেনে নেব। কুরাইশরা একের পর এক লোক পাঠাতে লাগল। তারা উরওয়া ইবনে মাসউদকে পাঠাল। উরওয়া ছকীফ গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তি। তায়েফের সম্পদশালী ও সরদারদের অন্যতম। ছিল অন্ধ। সে এসে বলল, মুহাম্মদ! তুমি কি আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকদের একত্রিত করে নিজের গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছ? সে হাত বাড়িয়ে রাসূলের দাড়ি মোবারক ধরতে চাচ্ছিল। সে যখনই হাত বাড়াত, তখনই মুগীরা ইবনে শো’বা (রাঃ) তরবারীর বাট দ্বারা তা প্রতিহত করতেন। মুগীরাও ছাকীফ গোত্রেরই লোক ছিলেন।

               অবশেষে তিনি বললেন, তুমি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দাড়ি স্পর্শ কর না। উরওয়া বলল, কে এই লোকটি? উপস্থিত সাহাবীরা বললেন, মুগীরা। তখন উরওয়া বলল, হে লজ্জায় কাতর ব্যক্তি! তুমি কি তোমার লজ্জার বিষয়টি ঢেকে রেখেছ? জাহেলী যুগে মুগীরা (রাঃ) লুণ্ঠনকারী ছিলেন, অত্যন্ত শক্তিধর ছিলেন। একদা তিনি কতিপয় লোককে হত্যা করে ফেললে উরওয়া ইবনে মাসউদ তাদের রক্তপণ আদায় করে দিয়েছিল এবং বিষয়টি গোপন রেখেছিল। উরওয়া সে দিকেই ইঙ্গিত করেছিল।

               মক্কার লোকেরা একের পর এক লোক পাঠাতে লাগল। অবশেষে সুহাইল ইবন আমরকে পাঠাল। তার সাথেই সন্ধিচুক্তির কথা চূড়ান্ত হয় এবং চারটি শর্তে সন্ধিচুক্তি লিপিবদ্ধ হয়।

             . মুসলমানদের কেউ ইসলাম ত্যাগ করে কুরাইশদের নিকট ফিরে এলে কুরাইশরা তাকে গ্রহণ করে নিবে। কাফিদের কেউ মুসলমান হয়ে রাসূলের নিকট এলে রাসূল তাঁকে গ্রহণ করবেন না।

                ২. এ সন্ধির চুক্তিতে যে কোন গোত্র রাসূলের সঙ্গে যোগ হতে চাইলে যোগ দিতে পারবে। আর কুরাইশদের সাথে শামিল হতে চাইলে শামিল হতে পারবে। এ ধারা মতে খুজাআ গোত্র রাসূলের সাথে শামিল হল আর বনু বকর গোত্র কুরাইশদের সাথে শামিল হল।

             ৩. দশ বৎসরের জন্য যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা হল।

            ৪. এ বৎসর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সঙ্গীরা মদীনায় ফিরে যাবেন। ওমরা আদায় করবেন না। আগামী বৎসর তরবারী কোষাবদ্ধ করে আসবেন এবং উমরা পালন করবেন।

            এ ধরনের শর্তের কথা শুনে সাহাবীরা অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। উমর (রাঃ) ধারণা করলেন যে, এতে মুসলমানদের লাঞ্ছনা ও ক্ষতি রয়েছে। তাই তিনি অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এলেন। বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা কি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নই? রাসূল বললেন, হ্যাঁ আমরা সত্যে প্রতিষ্ঠিত। উমর (রাঃ) বললেন, তারা কি মিথ্যায় প্রতিষ্ঠিত নয়? রাসূল বললেন, হ্যাঁ, তারা মিথ্যায় প্রতিষ্ঠিত। এবার উমর (রাঃ) বললেন, তাহলে আমরা কেন আমাদের ধর্মে লাঞ্ছানাকর বিষয় অনুপ্রবেশের সুযোগ দিব? রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, নিশ্চয় তিনি আমার রব। তিনি আমার ক্ষতি করবেন না। নিশ্চয় তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। আমি কিছুতেই তার নির্দেশ অমান্য করব না।

            এরপর উমর (রাঃ) আবূ বকর (রাঃ)-এর নিকট গেলেন। বললেন, আমরা কি সত্যের উপর নই? আবূ বকর (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ আমরা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। উমর (রাঃ) বললেন, তারা কি মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়? আবু বকর (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ, তারা মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। তখন উমর (রাঃ) বললেন, তাহলে কেন আমরা আমাদের ধর্মে লাঞ্ছনার বিষয় অনুপ্রবেশের সুযোগ দিব?

             আবূ বকর (রাঃ) বললেন, ‘নিশ্চয় তিনি সত্যের উপর রয়েছেন। সুতরাং তার ‍সিদ্ধান্ত মেনে নিন। নিশ্চয় তিনি সত্যের উপর রয়েছেন। সুতরাং তার সিদ্ধান্ত মেনে নিন।’

(চলবে)

 

অনুবাদঃ আরশাদ ইকবাল