JustPaste.it

 ফিলিস্তিনে হামাসের উথানঃ ইসরাইল থরথর কাঁপছে

মুহাম্মাদ শেখ ফরিদ

======================================================

 

        মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের ইহুদীদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ওরা এখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। রাতের বেলা জেগে জেগে দুঃশ্চিন্তায় কাটাচ্ছে প্রতিটি অভিশপ্ত ইহুদী। ঘুমের ঘোরে দেখতে পাচ্ছে খেজুর তলার মরুচারী সেই দুর্ধর্ষ মরুশার্দুলরা আবার জেগে উঠেছে। ফিরে পেয়েছে তাদের হারানো সৌর্য-বীর্য। হাতে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে বিশ্বখ্যাত আরবী ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আবার ছুটে আসছে জেরুজালেম উদ্ধার করতে। আর এই দুরন্ত বাহিনীর পুরোভাগে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এককালের পাশ্চাত্যের মহা আতংক সালাউদ্দিন আইউবী।

 

        হ্যা, ১১৮৭ খৃষ্টাব্দে গাজী সালাউদ্দিন জিহাদ ঘোষণা করে জেরুজালেম অভিমুখে যাত্রা করলে পাশ্চাত্যের ক্রুসেডারদের ঘরে ঘরে যে কান্নার রোল উঠেছিল, মুসলমানদের হাতে জেরুজালেমের পতন এবং পাশ্চাত্যের কাছে যেমন এ দুঃসংবাদ বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত করেছিল, মধ্যপ্রাচ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসা ইহুদীদের মনে এখন সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সাদ্দাম হোসাইনের স্কাড মিসাইলের ভয়ে ওরা একবার ইদুরের মতো মাটির তলায় গর্ত খুড়েছিল, কিন্তু এবার আতঙ্কে কারবালার মাতম করতে শুরু করেছে। আর এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে ধুমকেতুর ন্যায় আবির্ভূত ইসলামী জিহাদ ভিত্তিক ফিলিস্তিনী এক সংগঠন। যার নাম হামাস। হামাসের উথানকে গাজী সালাউদ্দিনের উত্থানের সাথে মূল্যায়ন করতে ইহুদী পত্রিকাগুলোও আজ সরব।

 

        ১৯৮৭ সালে হামাস সাংগঠনিক রূপ ধারণ করে এবং ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। ইন্তিফাদা আন্দোলনের সময় হামাসের কার্যক্রম ব্যাপক সমর্থন লাভ করে, এ সময় হামাসের কর্মীরা আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ইসরাইল অধকৃত গাজা ভূখণ্ডের গজওয়া পট্টিতে এক উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে হামাসের অভ্যুদয়। গত ১৪ মাস ধরে। হামাসের তৎপরতা বেগবান হয়ে গাজা ভূখণ্ডে ছাড়িয়ে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। হামাসের প্রতিটি কর্মী জিহাদী চেতনায় উজ্জীবিত। তারা ইসরাইল রাষ্ট্রটির সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হওয়ার পক্ষপাতি। ইসরাইলের ধ্বংসস্তুপের ওপর একটি স্বাধীন ইসলামী ফিলিস্তিন কায়েমই তাদের প্রধান লক্ষ্য। তারা তাদের মাতৃভূমিকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন দেখতে চায়। এ ব্যাপারে কোন কাটছাট বা ইহুদীদের সাথে নিছক বাগাড়ম্বর কোনটাই তারা মানতে রাজি নয়। হামাসের একজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা বলেন, আমরা দীর্ঘ ৪৬ বসর যাবত বিভিন্ন আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছি। ইহুদীবাদ, খৃস্টান আরব জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, সেকুলারিজম দেখেছি। জাতিসংঘ নামক আমেরিকান গৃহপালিত প্রতিষ্ঠানটির কীর্তিকলাপেরও আমরা কম ভূক্তভোগী নই। সব আন্দোলনের মাধ্যমেই আমরা ভাগ্য পরীক্ষা করেছি। কিন্তু আমাদের আসল সমস্যার কোন সমাধান পাইনি। এখন আমরা একটা সর্বশেষ সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে, শুধু ইসলামই আমাদের ইজ্জতকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আলোচনার মাধ্যমেও যে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হবে না তা গত ১৪ মাসে প্রমাণিত হয়ে গেছে। সুতরাং একমাত্র জিহাদের মাধ্যমেই ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান সম্ভব। জিহাদই মুসলিম জাতির গৌরব ও আত্মমর্যদার চাবিকাঠি। দুনিয়ার সমস্ত দাম্ভিক শক্তির সাথে পাঞ্জা লড়ার সাহস নিয়ে হাতিয়ার তুলে নেয়ার আগ পর্যন্ত ঈমানদারের সম্মান প্রতিষ্ঠিত হবে না।

 

        মূলত হামাসের এই আপোসহীন ভূমিকা ভাগ্যহারা ফিলিস্তিনীদের বুকে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ধুধু বালুকাময় অনুর্বর ভূমি, কর্মসংস্থান এবং জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণের তীব্র অভাবের কষাঘাতে জর্জরিত। ইসরাইলী সৈন্যদের হাতে অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডের ১৮ লাখ ফিলিস্তিনী নতুন করে সাহস পাচ্ছে। তারা এখন হামাসের সংস্পর্শে এসে ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী জীবনযাপন করছেন। অধিকাংশ মহিলা পর্দাকে মেনে চলছেন। পতিতাবৃত্তি ও মাদক সেবন নিষিদ্ধ। করা হয়েছে। শরিয়ত বিরোধীদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিষেধ অমান্যকারীদের হত্যা করে তাদের লাশ জনগণের শিক্ষার জন্য খোলাস্থানে ঝুলিয়ে রাখা হয়। অধিকৃত ভূখণ্ডের ৪০% লোকই হামাসের সদস্য। হামাসের এই হঠাৎ উদয় এবং ক্রমশক্তি বৃদ্ধিতে পিএলও’র সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গি প্রচণ্ড চাপের মুখে। তাদের জনপ্রিয়তা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রধান প্রফেসর ইলা বেকহেস বলেন যে, “হামাস পিএলওর প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হচ্ছে এবং ইসরাইলের জন্য ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। হামাসের শক্তি বৃদ্ধির জন্য পিএলও ইসরাইল আলোচনা ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অথচ ইসরাইলেল জন্য আলোচনা চালিয়ে যাওয়াই ছিল ভাল। কেননা, পিএলও ভাগভাটোয়ারায় প্রস্তুত ছিল।”

 

        নাজহা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রফেসর আবদুস সাত্তার কাসেমী বলেন, “পিএলওর দীর্ঘদিনের একঘেয়ে আন্দোলন। ও ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণেই ফিলিস্তিনীরা পিএলও থেকে হামাসের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এই অবস্তায় হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে জীবন-মরণ দীর্ঘ রক্তক্ষীয় সংগ্রামের পটভূমি সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ এবং ইসরাইল এটা দেখতে রাজি নয়।”

 

        গত বছর হামাসের পুরো দুনিয়ার জিহাদী আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে আফগান মুজাহিদদের সাথে রয়েছে এঁদের গভীর সম্পর্ক। আফগান জিহাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ আফগান ফেরত ফিলিস্তিনী মুজাহিদরাই এ সংগঠনের চালিকা শক্তি। দলের মুখপাত্র ডঃ মোহাম্মদ জাহের বলেন, “আফগান জিহাদ আমাদের দৃষ্টি খুলে দিয়েছে। সশস্ত্র জিহাদের খুন রাঙা পথে এখন আর আমরা ভীত নই।”

 

        পৃথিবীর কোন বৃহৎ শক্তির আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। পাশ্চাত্যের জড়বাদী সমাজ আমাদের সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেয়া ছাড়া কোন সহযোগিতাও করবে না। আমরা ইসরাইলের সমর শক্তি নিয়েও চিন্তিত নই। বিশ্বের দুর্ভেদ্য ম্যাজিনো লাইন ও শ্রেষ্ঠ কমাণ্ডা বাহিনী গড়ে ইসরাইলের আত্মপ্রসাদ লাভ করার কিছু নেই। কেননা, মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য লড়াই করে বলে আল্লাহই তাদের বড় সাহায্যকারী হয়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পরাশক্তি রাশিয়াও একদা শত্রু বেশে শ্রেষ্ঠ কমাণ্ডো ও মরণাস্ত্র নিয়ে আফগানিস্তানের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু তারাই আফগানীদের বিজয় লাভে বেশী, সাহায্য করেছে। তারা আফগানিস্তানে যে বিপুল সমরাস্ত্র রেখে গেছে তা দিয়ে আমেরিকার ন্যায় পরাশক্তির সঙ্গে ১০ বছর যুদ্ধ করা যাবে। সুতরাং আমাদেরও আল্লাহর ওপর আস্থা থাকলে ইসরাইলের বিপুল সমরাস্ত্রের গুদাম পাশ্চাত্যের ক্রুসেডের মোকাবিলায় কাজে লাগতে পারে। দুর্ভেদ্য ম্যাজিনো লাইন হতে পারে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা লাইন। হামাসের এই দৃঢ় প্রত্যয় ইসরা ইলীদের মনে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করেছে। উপরন্তু গত ডিসেম্বর মাসে হামাসের এক সামরিক অভিযানে ৫ জন সৈন্য নিহত এবং একটি ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়। অন্য এক ঘটনায় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের একজন সেনা নিহত হলে সমগ্র ইসরাইলে ব্যাপকভাবে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালের পর ইসরাইলের ভেতরে এতবড় ঘটনা এই প্রথম।

 

        ইসরাইল, এ ঘটনার প্রতিশোধ স্বরূপ ৪১৮ জন ফিলিস্তিনী বুদ্ধিজীবীকে ‘নোম্যান্স লাণ্ডে’ বহিস্কার করে। বহিস্কৃত ৪১৮ জনের মধ্যে ২৫০ জনই উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রীধারী, ১৮ জন পিএইচডি, ২৫ জন প্রফেসর, ১৮ জন ইঞ্জিনিয়ার, ১০৮ জন মসজিদের বিশিষ্ট ইমাম। এরা সবাই হামাসের সদস্য না হলেও ইসলামী জিহাদের প্রতি ঝুঁকে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। ইসরাইলী প্রধান মন্ত্রী আইজাক রবিন তার মুখপাত্রের পত্রিকা, আদিদ বিন আমির সাথে এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন যে, “হামাসের তৎপরতায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, “হামাস এবং অধিকৃত এলাকায় জিহাদী আন্দোলনকে ধ্বংস করা ছাড়া আমাদের কোন গত্যন্তর নেই। এই উদ্দেশ্যেই ফিলিস্তিনীদের বহিষ্কার করা হয়েছিল। বাস্তবে এর উল্টোটা ঘটেছে। হামাস এই বহিস্কার ঘটনায় বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।”

 

        বরজিয়াত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর আবু আমেরও রবীনের সুরে সুর মিলিয়ে বলেছেন, ফিলিস্তিনীদের বহিষ্কার ঘটনায় হামাসের সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের মনোবল বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের সদস্যদের মধ্যে আগ্রহ দৈনন্দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নোম্যান্সল্যাণ্ডে আটকে পড়া ফিলিস্তিনী বুদ্ধিজীবীরাও হামাসকে তাদের ভবিষ্যৎ মুক্তির পথ বলে ভাবতে শুরু করেছে। তারা তুষার ও বরফের মধ্যে জনমানবহীন পার্বত্য ভূমিতে আটকে পড়েও এই অঙ্গীকার করেছে যে, আমাদের মায়ের কসম আমরা আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাবই এবং ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রকে আমাদের শরীরের তাজারক্ত দ্বারা শীতল করবই, ইসরাইলের হিংস্রতার বদল নেবই। বহিস্কৃত ফিলিস্তিনীদের এ অনমনীয় ভূমিকার কারণে ইসরাইল তাদের ফিরিয়ে নিতেই এত ছল চাতুরী করছে।”

 

        হামাসের এই ভাবমূর্তির কারণে প্রতিটি ইসরাইলী মনে করে, হামাস ইসরাইলের জন্য মরণফাঁদ। এর সম্পূর্ণ ধ্বংস ছাড়া ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও ফিলিস্তিনের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ইসরাইলের উচিত হামাসের শক্ত ঘাঁটি গজওয়া পট্টি ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেয়া। কেননা এই গজওয়া পট্টি থেকেই পুরো গাজা এরাকায় হামাসের তৎপরতা নিয়ন্ত্রিত হয়।

 

        গাজা এলাকার সৈন্যরা এখন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। প্রথম প্রথম হামাসের কর্মীরা তাদের ওপর বোতল, দেশীয় তৈরী গ্রেনেড, হাত বোমা ও পাথর ছুড়ে মারত। বর্তমানে তারা মিশর ও ইসরাঈলী চোরাচালানীদের নিকট থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সংগ্রহ করে তাদেরকে নিশানা বানাচ্ছে। গাজা এলাকায় গুলী বিনিময়, চোরাগুপ্তা হামলা ও ইসরাঈলী সৈন্যদের অস্ত্র কেড়ে নেয়া হামাসের কীদের রুটিন কাজে পরিণত হয়েছে। তাই রবীনর লেবার পার্টির দুই তৃতীয়াংশের বেশী সদস্য ও ৪ জন কেবিনেট মন্ত্রী সম্প্রতি রবিনকে পরামর্শ দিয়েছে যে, অবিলম্বে পিএলওর প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করা হোক এবং তাদের সাথে শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হোক। এর মাধ্যমে হামাসের উথান ঠেকানো যেতে পারে। কিন্তু রবিন এ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন, আরব অধিকৃত এলাকাকে আরও উত্তপ্ত করা এবং ফিলিস্তিনের ভাগ্যকে পিএলওর ওপর ছেড়ে দিতে সম্মত নয়। তবে হামাসের শক্তি বৃদ্ধি পাক তাও চান না। অবস্থা পরিবর্তিত হতে থাকলে তাদের এ পরামর্শ যে কোন সময় মেনে নেয়াও অসম্ভব নয়। ইতোমধ্যে পিএলও'র সাথে যোগাযোগ করার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে সে পথে এক কদম এগিয়েও গেছে।