সত্যের সন্ধ্যানে
ঈসাবেলা
মাওলানা আব্দুল হালিম শরর লখনবী
অনুবাদঃ মাওলানা আব্দুর রাযযাক
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পরদিন প্রত্যুষে মীখাইলের একজন সেবিকা ঈসাবেলার নিকট এসে তাকে একখানা চিঠি প্রদান করল। তাতে লেখা ছিলঃ- “বেটী ঈসাবেলা! তোমার সাথে আমার কিছু কথা বলবার আছে। তুমি এখনই তোমার সব কাজ ছেড়ে দিয়ে আমার গৃহে চলে এসো। আমি অপেক্ষায় রইলাম।” তোমার ওস্তাদ, মীখাইল।
ঈসাবেলা বুঝতে পারল এটা গতদিনের পরিকল্পনার ক্রিয়া। সে তার মাম্মীকে জানিয়ে তখনই মীখাইলের গৃহের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ল। মীখাইলের গৃহে পিটার্স এবং জনৈক বিখ্যাত সংসার বিরাগী রাহেবও ঈসাবেলার জন্য অপেক্ষমান ছিলেন, যিনি আপন বৈরাগ্যবাদী সাধনার বদৌলতে সমগ্র স্পেনের খৃষ্টীয়গণের আন্তরিক ভক্তি ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মীরানো তার অন্যান্য সহচরীদের তাদের গৃহে দ্রুত আগমনের জন্য সংবাদ পাঠিয়েছিল, সংবাদ পেয়ে তারা তৎক্ষণাৎ এসে পৌঁছল। মীখাইল ঈসাবেলাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ
গতকাল তুমি আমার প্রশ্নের গোলমেলে উত্তর দিয়ে আসল ব্যাপার হতে পাশ কেটে যাওয়ার চেষ্টা করেছ। অদ্য আমি তোমার নিকট হতে পরিস্কার জবাব পেতে চাই। বল, তুমি ঠিক ঠিক উত্তর দেবে কিনা?
ঈসাবেলাঃ প্রথমত, আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত যোগ্যতা আমার নেই। তারপর এমন ব্যাপারও আমি দেখছি না, যার জন্য এত প্রশ্নোত্তরের প্রয়োজন হতে পারে। সে যাই হোক আপনি প্রশ্ন করতে চান তো করুন, আমি আমার জ্ঞানানুপাতে তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
মীখাইলঃ তুমি মুসলমান হয়ে গিয়েছ?
ঈসাবেলাঃ আমি এর উত্তর গতকালই দিয়েছি। তা হতে বেশী কিছু আমার বলবার নেই।
মীখাইলঃ বেশ, তবে বল, পবিত্র ত্রিতত্ববাদে তোমার ঈমান আছে কি না? আর খোদাওন্দ যীশুকে তুমি অনাদি অনন্ত খোদা বলে বিশ্বাস কর কিনা?
ইসাবেলাঃ আমি খোদাকেই খোদা বলে বিশ্বাস করি, কোন মানুষকে খোদা মানি না।
মীখাইলঃ বুঝলাম, তুমি খোদাওন্দ যীশুর খোদায়িত্বকে অবিশ্বাস কর। তা হলে তোমার মুসলমান হওয়ার আর কি বাকী রয়েছে?
ঈসাবেলাঃ আমার উদ্দেশ্য এই যে, পবিত্র বাইবেলের কোথাও যীশুর খোদায়িত্বের প্রমাণ নেই।
মীখাইলঃ খোদার শপথ! তুমি পবিত্র বাইবেলের দুর্নাম করো না। তুমি কি বাইবেলে এ কথা পাঠ করনি যে, তিনি খোদার পুত্র?
ঈসাবেলাঃ খোদার পুত্র তো অনেকেই ছিল, তাদেরও কি খোদা মানতে হবে?
মীখাইলঃ কখনই নয়। একমাত্র খোদাওন্দ যীশু ব্যতীত অপর কোন মানুষই প্রকৃত অর্থে খোদার পুত্র বলে কথিত হয়নি।
ঈসাবেলাঃ (বাইবেল হাতে) বেশ, আপনি আমাকে বাইবেলের এই বাক্যটির মর্ম বুঝিয়ে দিন। বাক্যটি এই, “ইহুদিগণ যীশুর মস্তক বিচুর্ণ করবার উদ্দেশ্যে পুনরায় প্রস্তর উত্তোলন করল । যীশু তাদেরকে বললেন, আমি তোমাদের পিতার পক্ষ হতে অনেক সৎকর্ম প্রদর্শন করেছি। তন্মধ্য হতে কোন কাজটির দরুণ তোমরা আমার মস্তক বিচূর্ণ করছ? ইহুদীগণ তাকে উত্তর দিল, সৎকার্যের জন্য নয় বরং কুফরী কার্য করার দরুণ তোমাকে হত্যা করছি। আর এই জন্য যে, তুমি মানুষ হয়ে নিজেকে খোদা বানাচ্ছ। যীশু তাদের বললেন, তোমাদের ব্যবস্থা পুস্তকে কি এটা লেখেনি যে, আমি বললাম, তুমি খোদা; যখন তিনি তাদেরকে খোদা বানিয়েছেন, যাদের নিকট খোদার বাণী এসেছে, তখন তোমরা পিতা যাকে পবিত্র করে পাঠিয়েছেন সেই ব্যক্তিকে বল যে, তুমি কুফরী করছ, এই জন্য যে, আমি বলেছি, আমি খোদার পুত্র?” যোহন ১০৪ ৩১-৩৬ পদ দ্রষ্টব্য।
অর্থাৎ প্রাচীন নবীগণকে ওল্ড টেষ্টামেন্টে যেমন খোদা বলা হয়েছে, তদ্রুপ যীশুকেও খোদার পুত্র বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন এই যে, প্রাচীন নবীগণকে কোন অর্থে খোদা বলা হয়েছে? খৃষ্টানগণও স্বীকার করে থাকেন যে, প্রাচীন নবীগণকে রূপক ভাবে এবং মহব্বতের প্রেরণায় খোদা বলা হয়েছে। আমি বলতে চাই যে, এই প্রকার ভাবার্থেই মহব্বত স্বরূপ যীশুকেও খোদার পুত্র বলা হয়েছে। এই অর্থে নয় যে, বাস্তবেই যীশু প্রকৃত খোদা ছিলেন, যেমন খৃষ্টানগণ দাবী করে থাকে।
মীখাইলঃ অভাগিনী বালিকা! বড় বক্তৃতা শিখেছ, আমার নিকট বাইবেল শিক্ষা করে আমার উপরই ওস্তাদি জাহির করছ? যেন আমি একজন মূর্খ আর তুই-ই পন্ডিত। কিন্তু জেনে রাখিস, প্রাচীন নবীগণের প্রকৃত খোদা এই কারণে হওয়া সম্ভব হয়নি যে, তারা নিস্পাপ ছিলেন না। আর খোদাওন্দ যীশু কস্মিনকালেও কোন প্রকার পাপ বা অপরাধ করেননি, কারণ তিনি প্রকৃতই খোদা ছিলেন।
ঈসাবেলাঃ পাপী বা নিস্পাপ হওয়া সম্বন্ধে কোন কথা হয়নি। কথা ত এই যে, যীশু নিজেকে নিজে খোদার পুত্র ঐ অর্থে বলেছেন, যে অর্থে অন্যান্য নবীকেও খোদা বলা হয়েছে। যদি বলা হয় যে, যীশু প্রকৃত অর্থেই খোদা ছিলেন, তবে অন্যান্য নবীকেও খোদা স্বীকার করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ বাইবেলের উক্ত বাক্যগুলির মধ্যে যীশু ইহুদীদের অভিযোগের জবাব প্রদান করছেন। যদি বাস্তবেই তিনি খোদার পুত্র হতেন, তবে ইহুদীদের অভিযোগ খন্ডনের জন্য যুক্তি প্রদর্শন না করে বরং বলতেন যে, আমি নিজেকে নিজে খোদা বলে প্রচার করছি,একে তোমরা আমার অপরাধ বলে ধারণা করছ? অথচ এটা আমার অপরাধ নয়। বরং বাস্তবেই আমি খোদার পুত্র।
মীখাইলঃ ওহ বলিহারী! বড় বিদ্যাবতী হয়ে পড়েছ আর গুরুজনদের কর্ণ কর্তন করা শুরু করেছ। বুঝা গেছে তুমি বড় ইঁচড়ে পাকা হয়ে পড়েছ। খোদাওন্দ যীশু যদি খোদা না হতেন বরং শুধু মানুষ হতেন, তবে তিনি আমাদের প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে করলেন? মানুষ কখনও মানুষের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারে কি? আর মানুষ কখনও নিস্পাপ হতে পারে কি?
ঈসাবেলাঃ “কোনো মানুষ নিস্পাপ হতে পারবে না” এই আইনটি আপনারা কোথা হতে গড়ে আনলেন, আমি বুঝতে অক্ষম! অথচ স্বয়ং বাইবেলে শালেম রাজ মল্কীষেদক সম্বন্ধে লিখিত হয়েছেঃ
“এ একজন অপিতৃক, অমাতৃক অজ্ঞাত বংশ ব্যক্তি। নেই এর জীবনের আদিঅন্ত; বরং এ হয়েছে খোদার পুত্র সদৃশ। ইব্রানিয় ৭ : ৩ পদ দ্রষ্টব্য।
হযরত যাকারিয়া ও তাহার স্ত্রী সম্পর্কে বাইবেলে লিখিত আছে, তারা উভয়ে খোদার সমীপে সত্যপন্থী এবং খোদার সম্পূর্ণ নির্দেশ ও কানুনের নিখুত পথিক ছিলেন। লুক ১ঃ ৬ পদ।
এ দ্বারা জানা গেল যে, শালেমরাজ মল্কীষেদক, যাকারিয়া ও তার স্ত্রী অবশ্যই নিস্পাপ ছিলেন। নতুবা খোদার পুত্র সদৃশ এবং নিখুঁত ইত্যাদি শব্দগুলি অর্থহীন হয়ে পড়বে। অতএব নিস্পাপ হওয়ার মধ্যে যীশুর কোন বৈশিষ্ট্য নেই বরং অপর নিষ্পাপদের মত তিনিও একজন নিস্পাপ ছিলেন। এখন থাকলো প্রায়শ্চিত্তের ব্যাপার। কিন্তু বাইবেলে প্রায়শ্চিত্তের কোনো প্রমাণ নেই। একজনের অপরাধ অন্যের উপর আরোপিত হোক, এটা কেউই বরদাশত করতে রাযী নয়। অধিকন্তু স্বয়ং যীশু বলেছেন যে, মুক্তি কর্মের দ্বারা হবে-প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা নয়। যেমন মথি ১৬৪২৭ পদে আছে, “আদম পুত্র আপন পিতার প্রতাপ সহকারে তদীয় ফেরেশতার সাথে আগমন করবেন। ঐ সময় প্রত্যেককে তার কর্ম অনুযায়ী বিনিময় প্রদান করবেন।”
আরও দেখুন মথি ১৯ অধ্যায় ১৬-২০, মাকাস ১০ঃ ১৭-১৮ লুক ১৮১৮ পদে লিখিত আছে, এক ব্যক্তি এসে বলল, হে সদগুরু, আমি কোন সৎকর্ম করব, যাতে চিরস্থায়ী জিন্দেগী পেতে পারি? যীশু বললেন, যদি তুমি জিন্দেগীর ভিতর প্রবেশ করতে চাও, তবে আদেশ অনুসারে কাজ কর। সে বলল, কোন আদেশ অনুসারে? যীশু বললেন, এই যে, খুন করো না, চুরি করো না, শরাব পান করো না ইত্যাদি।
বাইবেলের এই বাক্যসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, মুক্তি শুধু সৎকর্মের উপরই নির্ভরশীল। যীশু প্রশ্নকারীর উত্তরে এটা বলেননি যে, তোমার সৎকর্মের কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা, তোমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমিই করব।
মীখাইলঃ ঈসাবেলা! তুই কি আমাকে বাইবেল শিক্ষা দিতে এসেছিস? আমার উপর তোর বিশ্বাস নেই? দেখ, আমি তোর ওস্তাদ, আমি যা কিছু বর্ণনা করি, তুই তা-ই মেনে নে। আপন জ্ঞানে পবিত্র বাইবেলের সূক্ষ্ম বিষয় বুঝবার ক্ষমতা তোর নেই। প্রায়শ্চিত্তের প্রশ্ন ত পিছনের জিনিস, খোদাওন্দ যীশুর খোদায়িত্বের প্রশ্নের মীমাংসা প্রথমে হওয়া উচিৎ। দেখ, যীশুকে জীবিতাবস্থায় আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, যা মুসলমানগণও স্বীকার করে, এটা কি তার খোদায়িত্বের প্রমাণ নয়? খোদাওন্দ যীশু বিরাট বিরাট অলৌকিক কর্ম দেখিয়েছেন। মৃতকে জীবিত করেছেন, অন্ধকে দর্শন শক্তি দান করেছেন। এ সকল ব্যাপার দ্বারা খোদাওন্দের খোদায়িত্বের উপর বিশ্বাস স্থাপন কর, অথবা তাকে অস্বীকার কর। অতঃপর অন্য বিষয়ের আলোচনা কর।
ঈসাবেলাঃ প্রায়শ্চিত্তের প্রশ্ন আপনিই উত্থাপন করেছিলেন, তজ্জন্য আমিও তার সম্বন্ধে বলছিলাম। যদি যীশু জীবিতাবস্থায় আকাশে উত্থিত হওয়ার দরুন খোদা হতে পারেন, তবে ইলিয়াকেও (ইদ্রিস আঃ) খোদা স্বীকার করতে হবে। কেননা, বাইবেলের বর্ণনানুযায়ী তিনিও আকাশের উপর জীবিতাবস্থায় উত্থিত হয়েছিলেন। রাজাবলি ২ঃ ১১ পদ খুলে দেখলেই স্পষ্ট প্রমাণ পাবেন। এখন রইল যীশুর মৃতকে জীবিত করা এবং অন্ধকে দর্শন শক্তি দানের কথা; কিন্তু তার দ্বারাও তার খোদা হওয়ার প্রমাণ হয় না। কেননা অন্যান্য নবীগণও এইরূপ অলৌকিক কর্ম প্রদর্শন করেছেন, যার বর্ণনা বাইবেলে সবিস্তারে বিদ্যমান রয়েছে। এসব অলৌকিক ব্যাপার দ্বারা যদি কেউ খোদা হতে পারে, তবে অন্যান্য নবীগণও খোদা সাব্যস্ত হন!
পিটার্সঃ দেখ, বালিকাটি কিরূপ প্রতারণা করে চলেছে। আরে নির্বোধ বালিকা! অন্যান্য আম্বিয়া যেসব অলৌকিক কর্ম দেখিয়েছেন, তা আপন ক্ষমতায় নয় বরং খোদার ক্ষমতায় এবং হুকুমে। কিন্তু খোদাওন্দ যীশু আপন ক্ষমতায় অলৌকিক কর্ম প্রদর্শন করেছেন, এ দ্বারা প্রমাণিত হল যে, তিনি খোদা ছিলেন।
ঈসাবেলাঃ অলৌকিক কর্মের দ্বারা খোদায়িত্বের প্রমাণ হওয়া ত দূরের কথা এর দ্বারা নবুওয়াতেরই প্রমাণ হয় না। অর্থাৎ খৃষ্ট ধর্মের দৃষ্টিতে কেউ অলৌকিক কর্ম দেখাতে পারলেই সে ব্যক্তি নবী বলে সাব্যস্ত হওয়া আবশ্যকীয় নয়। কাজেই এ দ্বারা যখন নবী হওয়াই প্রমাণিত হয় না, তখন খোদা হওয়া কিভাবে প্রমাণিত হতে পারে? দেখুন বাইবেল যোহন ১৪ অধ্যায় ১২ পদে যীশু কি শিক্ষা দিচ্ছেন, “আমি তোমাদেরকে সত্য সত্য বলছি যে, যে ব্যক্তি আমার উপর ঈমান রাখে, এসব কাজ আমি যা করি সে ব্যক্তিও করবে এবং এর চাইতেও বড় কাজ করবে।”
অতঃপর আপনি বলেছেন, যীশুর মোজেযা বা অলৌকিক কাজ তার আপন ইচ্ছা ও ক্ষমতার অধীন ছিল, কিন্তু অপর নবীগণের তদ্রপ ছিল না। অর্থাৎ অপর নবীগণ খোদার আদেশ ও ইচ্ছায় মোজেযা প্রদর্শন করেছেন, কিন্তু যীশু আপন স্বাধীন ক্ষমতা ও ইচ্ছায় বিরাট বিরাট অলৌকিক কাজ করে দেখিয়েছেন। আপনার এ দাবীও ভুল, কেননা বাইবেলের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় যে, শুধু মোজেযা প্রদর্শনের ব্যাপারেই নয়, বরং যাবতীয় কাজ কর্মেই অন্য নবীগণ যেরূপ খোদার ইচ্ছা, আদেশ ও ক্ষমতার মুখাপেক্ষী ছিলেন, যীশুও ঠিক তদ্রুপ মুখাপেক্ষী ছিলেন। যীশু যখন কোনো মোজেযা দেখাতে ইচ্ছা করতেন, তখন প্রথমে খোদার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতেন। যেমন লিখিত আছে যে, তিনি রুটি এবং মৎসের মোজেযা দেখাবার সময় খোদার সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। অপর এক স্থানে লিখিত আছে, তিনি তার শিষ্য হাওয়ারিগণকে বলেছেন, “বদরূহ সমূহকে বের করা দোয়ার উপর নির্ভরশীল।” যীশু একজন মৃতকে দোয়ার সাহায্যে জীবিত করেছিলন! বাইবেল মথি ১৪ অধ্যায় ১৮ পদ, মাকাস ৯ঃ২৯ এবং যোহর ১১ঃ৪১-৪৭ পদ পাঠ করে দেখলেই আমার কথা প্রমাণিত হবে।
ঈমানের পরশ
ঈসাবেলা তার বক্তৃতায় বলে চললঃ
মোজেযা প্রদর্শনের ব্যাপারে যীশুর কোনো স্বাধীন ক্ষমতা ছিলনা। যার প্রমাণ বাইবেল দ্বারা দেওয়া হল। এখন আমার বক্তব্য এই যে, যীশু প্রত্যেক কাজে এবং প্রত্যেক ব্যাপারে অন্যান্য মানুষের ন্যায়ই অক্ষম ছিলেন। যদি তিনি খোদা হতেন, তবে এই অক্ষমতা তাকে স্পর্শ করতে পারত না এবং স্বাধীন ইচ্ছার মালিক সর্বশক্তিমান খোদার ন্যায় তিনিও সকল কাজে সর্বক্ষেত্রে স্বাধীন হতেন। অপরের নিকট সাহায্য প্রার্থনার কোনো প্রয়োজন তার হত না। (বাইবেল খুলে) এই দেখুন, যোহন কেতাব ৫ অধ্যায় ২৬-২৭ পদে যীশু বলছেন, “যে ভাবে পিতার নিজের মধ্যে নিজে জিন্দেগী রাখেন, ঐভাবে তিনি পুত্রের মধ্যেও এটা দান করেছেন যে, নিজে নিজের মধ্যে জিন্দেগী রাখে। আর তিনি (পুত্রকে) বিচার করবারও অধিকার প্রদান করেছেন এই জন্য যে, তিনি আদম সন্তান।”
অর্থাৎ যীশুর জিন্দেগীও তার নিজস্ব ছিল না। বরং খোদা কর্তৃক প্রদত্ত ছিল এবং তাকে খোদা-ই বিচার করবার অধিকার দিয়েছিলেন। খোদাপ্রদত্ত অধিকার ব্যতীত তিনি বিচার করতে পারতেন না। আর এ কথার কারণ এই বর্ণনা করেছেন যে, যীশু আদম সন্তান ছিলেন। আর ইহা প্রকাশ্য কথা যে, খোদার সাহায্য ব্যতীত আদম সন্তান কিছুই করতে পারে না।
যোহন ৫ অধ্যায় ৩০ পদে যীশু বলেন, “আমি আপনা হতে কিছুই করতে পারি না। যেরূপ শ্রবন করি তদ্রুপই বিচার করি। আর আমার বিচার ন্যায্য।” উক্ত পুস্তকের ৬ অধ্যায় ৩৮ পদে তিনি আরও বলেছেন “আমি আকাশ হতে অবতরণ করেছি, এজন্য নয় যে আপন খুশী মত কর্ম করব, বরং এই জন্য যে, আপন প্রেরকের খুশীমত কর্ম করব।”
অতএব প্রমাণিত হল যে, যীশু অন্যান্য মানুষের মতই অক্ষম এবং পরমুখাপেক্ষী ছিলেন। আর অক্ষম ও পরমুখাপেক্ষী ব্যক্তি কখনও খোদা হতে পারে না। সুতরাং যীশুও খোদা নন।
পিটার্সঃ (মীখাইলের উদ্দেশ্যে) দেখছেন তো মেয়েটি কিরূপ পাকা হয়ে গিয়েছে, আর মুসলমানদের হাতে ট্রেনিং পেয়ে কেমন মুখড়া হয়ে উঠেছে? এখনও কি আপনার বিশ্বাস হয় যে, সত্যপথে আসতে পারবে? আমার ধারণা এর সাথে আলাপ-আলোচনা অনর্থক। কেননা এখন গুরুভক্তি উধাও হয়ে গিয়েছে এবং এ শক্ত বে-আদব হয়ে পড়েছে।
মীখাইলঃ এখন আমারও দৃঢ় বিশ্বাস হল যে, এ মেয়েটির উপর শয়তান পরিপূর্ণরূপে অধিকার স্থাপন করেছে। (ঈসাবেলার প্রতি) যত প্রমাণ তুমি খাড়া করেছ, তার জবাব ত অতি পরিস্কার। আর খোদায়িত্বের দর্শনে তুমিও তা পাঠ করেছ। এছাড়া আরও জবাব আছে, যা তুমি বুঝতে সম্পূর্ণ অক্ষম। কিন্তু এখন উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে আমরা তোমার পূর্ণ মনোভাব শ্রবণ করব, যেন তোমার সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহৰ্ণ করা আমাদের জন্য সহজ হয়। তুমি অত্যন্ত স্পষ্টরূপে যীশুর খোদায়িত্ব এবং প্রায়শ্চিত্ত সম্বন্ধে আপন মনোভাব ব্যক্ত করেছ। এখন যা বাকী রয়েছে বলে ফেল।
ঈসাবেলাঃ আমি পবিত্র বাইবেলকে অস্বীকার করিনি এবং যীশুকেও নয়। বরং আমি বলতে চাই যে, প্রকৃত বাইবেলের শিক্ষায় যীশুর খোদা হওয়ার প্রমাণ নেই এবং তার প্রায়শ্চিত্তের নয়। এটা সম্পূর্ণই খৃষ্টীয়গণের আবিস্কার।
মীখাইলঃ অর্থাৎ তুমি বলতে চাও, দুনিয়ার খৃষ্টীয়গণ সকলেই মিথ্যা বলছে এবং তারা সকলেই পবিত্র বাইবেলের বিরুদ্ধে ঐক্যমত গঠন করে নিয়েছে। হতভাগিনী জাহান্নামী বালিকা! যদি কোনো কথা বুঝতে তোর মস্তিষ্কের ক্ষমতায় না কুলোয়, তবে বড়দের সিদ্ধান্তকেই শিরোধার্য করে নে। তোর পিতা—যিনি প্রধান পাদ্রী এবং পাপ মার্জনা করবার পূর্ণ অধিকার যিনি প্রাপ্ত হয়েছেন তিনিও কি এ সব ব্যাপারে ভুলে পড়ে আছেন? সংসার বিরাগী খৃষ্টীয় রাহেবগণ ধর্মতত্ত্ববিদ ও খৃষ্ট ধর্মের সেবকবৃন্দ সকলেই কি পথভ্রষ্ট?
ঈসাবেলাঃ যেরূপ পবিত্র বাইবেল দ্বারা যীশুর খোদায়িত্ব এবং প্রায়শ্চিত্ত প্রমাণিত হয়, তদ্রুপ বর্তমান কালের তথাকথিত খৃষ্টীয়গণের খৃষ্টীয় হওয়াও বাইবেল দ্বারা প্রমাণিত হয় না
অতএব, তাদের ধ্যান-ধারণাও আমার জন্য প্রামাণ্য হতে পারে না।
মীখাইলঃ বাঃ বাঃ। আমরা সকলেই যেন মিথ্যা এবং মেকী খৃষ্টান আর তুই কেবল খাঁটি এবং সত্য খৃষ্টান। অভাগিনী, বলি তোর কান্ডজ্ঞানের মাথা খেয়েছিস কি? তুই যে মহাজ্ঞানী মহাজনদের আশ্রয় হতেও সরে পড়েছিস। বলি তোর নিকট কি প্রমাণ আছে যে, বর্তমান খৃষ্টীয়গণ প্রকৃত খৃষ্টীয় নন?
ঈসাবেলাঃ ক্রুদ্ধ হওয়ার কোনোই কারণ নেই। ব্যাপার অত্যন্ত পরিস্কার। যদি আপনি বর্তমান খৃষ্টীয়গণকে পবিত্র বাইবেলের দৃষ্টিতে খৃষ্টীয় বলে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। তবে আমি তাদের সিদ্ধান্তকেই সর্বান্তঃকরণে শিরোধার্য করে নেব এবং তাদের বাণীর সম্মুখে বাইবেলের কোন বাক্যকেই প্রমাণ স্বরূপ পেশ করবনা। আপনি বর্তমান খৃষ্টীয়গণের খৃষ্টীয় হওয়া বাইবেল দ্বারা প্রমাণিত করুন।
মীখাইলঃ যদি কেউ সূর্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তবে তাকে বুঝানো কিভাবে সম্ভব? সারা বিশ্বে অগণিত খৃষ্টীয় বিদ্যমান রয়েছে, আর তুই বলছিস বাইবেলের দৃষ্টিতে তারা খৃষ্টীয় নয়। আমাদের সকলের খৃষ্টীয় হওয়ার জন্য এ প্রমাণটি কি ক্ষুদ্র যে, আমরা পবিত্র বাইবেল মেনে থাকি, খোদা ও যীশুর খোদায়িত্বে বিশ্বাস করি, যীশুর খোদায়িত্বে বিশ্বাস করি, যীশুর নিহত হওয়া ও প্রায়শ্চিত্তের উপর আমরা ঈমান রাখি।
ঈসাবেলাঃ বাইবেল তো (ইঞ্জিল) মুসলমানগণও মেনে থাকে। এতে আপনি তাদেরকে খৃষ্টীয় বলতে পারেন কি? অতপর যীশুর খোদায়িত্ব ও প্রায়শ্চিত্তের উপর ঈমান রাখা খৃষ্টীয় হওয়ার জন্য প্রামাণ্য নয়, বরং এ কথায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, এই প্রকার মানুষ কখনই খৃষ্টীয় নয়। কেননা এরূপ কথা বিশ্বাসের কোনো সন্ধ্যান বাইবেলে পাওয়া যায় না।
পিটার্সঃ অভাগিনী! কি হয়েছে তোর, আর কেন তুই আমাদের খৃষ্টীয় হওয়া সম্বন্ধে সন্দেহ করেছিস? যদি আমরা খৃষ্টীয় না হয়ে থাকি, তবে প্রকৃত খৃষ্টানগণ দুনিয়ার কোথায় বাস করে?
ঈসাবেলাঃ আপনারা যত ইচ্ছা ক্রোধ প্রকাশ করুন, কিন্তু সত্যকে ঢেকে রাখা যেতে পারে না। যদি আপনারা আমার নিকট প্রমাণ চান, তবে পরিস্কার জেনে রাখুন বর্তমান খৃষ্টীয়গণ কখনই খৃষ্টীয় নয়। আর প্রকৃত খৃষ্টীয় কে হতে পারে, পবিত্র বাইবেল দ্বারাই আমি তার প্রমাণ দিতে প্রস্তুত।
মীখাইলঃ আরে অভাগিনী, এত বক্তৃতা কেন দিচ্ছিস? প্রমাণ পেশ কর।
ঈসাবেলাঃ উত্তম, জেনে রাখুন প্রকৃত খৃষ্টীয়গণের পরিচয় বাইবেলে এরূপ এসেছেঃ “আর ঈমান আনয়নকারীগণের মধ্যে এ সব মোজেযা হবে, তারা আমার নামের সহায়তায় বদরুহ সমূহকে বের করবে, নতুন নতুন ভাষায় কথা বলবে, সর্পদলকে ধরে হটাবে, আর যদি কোন প্রাণ বিনাশক জিনিস পান করে, তবে তাদের কোনই ক্ষতি হবে না, তারা পীড়িত ব্যক্তির উপর হাত রাখলে পীড়া নিরাময় হয়ে যাবে।” বাইবেল মাকাস, ১৬ অধ্যায় ১৭-১৮ পদ খুলে দেখুন।
অন্যত্র ঈমানদার খৃষ্টীয়গণের পরিচয় এ রূপ বলা হয়েছেঃ- “শিষ্যগণ যীশুর নিকট নিরবে এসে বলল যে, আমরা এই বদরূহকে কেন বের করতে পারি না? তিনি তাদেরকে বললেন, আপন ঈমানের স্বল্পতার দরুন। কেননা, আমি তোমাদেরকে সত্য বলছি যে, যদি তোমাদের মধ্যে সরিষার বীজ পরিমাণ ঈমান থাকবে, তবে তোমরা পাহাড়কে বলবে যে, এস্থান হতে ঐ স্থানে চলে যা। তখনই তা চলে যাবে। কোন কিছুই তোমাদের জন্য অসম্ভব হবে না। বাইবেল মথি, ১৭ অধ্যায় ১৯-২০ পদ দেখুন।
অর্থাৎ যদি কোন খৃষ্টীয়ের মধ্যে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও থাকে, তবে তার আদেশে পাহাড়ও আপন স্থান হতে সরে অন্যত্র যাবে। পবিত্র বাইবেলে এই স্থান দুটি হতে প্রকৃত খৃষ্টানদের যে ছয়টি পরিচয় পাওয়া গেল, তা এইঃ (১) বদরুহ সমূহকে বের করা, (২) শিক্ষাকরণ ব্যতিরেকে নতুন নতুন ভাষায় কথা বলা, (৩) বিষধর সর্প সমূহকে অনায়াসে ধরে উঠানো, (৪) বিষ পান করে ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া, (৫) পীড়িত ব্যক্তিগণের উপর হস্ত স্থাপন দ্বারা তাদেরকে পীড়া মুক্ত করা এবং (৬) পাহাড় সমূহকে তার স্থান হতে সরিয়ে দেওয়া।
অতএব যে ব্যক্তি নিজেকে খৃষ্টীয় বলে দাবী করে, তার কর্তব্য সর্বপ্রথম উক্ত ছয়টি গুণ তার নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা তা যাচাই করে দেখা। বেশ, আপনিও তো খৃষ্টীয়, এই ছয়টি গুণের মধ্যে মাত্র দুই একটি করে দেখান তো দেখি। একজন পীড়িত ব্যক্তির উপর হাত রেখে তাকে সুস্থ করে দিন। আর আপনি পাহাড় স্থানান্তরিত করার স্থলে অন্ততঃ আপনার সম্মুখস্থ ঐ ক্ষুদ্র প্রস্তর খন্ডটিকে স্থানান্তরিত হওয়ার আদেশ করুন এবং বেশী না হয় দু' চার হাত সরিয়ে দিন, যেন বাইবেলের দৃষ্টিতে আপনার প্রকৃত খৃষ্টান হওয়া প্রমাণিত হয়ে যায়।
মীখাইলঃ বে-শক, বাইবেলে এ সব কথা বিদ্যামান আছে। কিন্তু এ কথা কোথায় লিখিত আছে, যে ব্যক্তি এই সকল মোজেযা দেখাতে অক্ষম সে খৃষ্টীয় নয়? দ্বিতীয়তঃ এই সব পরিচয় কেবল হাওয়ারিগণের বৈশিষ্ট্য, সাধারণ খৃষ্টীয়গণের নয়।
ঈসাবেলাঃ আপনার উভয় কথাই ভুল। বাইবেলে তো পরিস্কার লেখা আছে যে, যে খৃষ্টীয়ের অন্তরে সরিয়া বীজের পরিমাণও ঈমান হবে, তার আদেশে পাহাড় আপন স্থান হতে সরে যাবে। এ কথার অর্থ এটাই দাড়ায় যে, যে খৃষ্টীয়ের আদেশে পাহাড় স্থানান্তরিত হবে না, তার অন্তরে সরিষা বীজ পরিমাণও ঈমান নেই।
দ্বিতীয়তঃ উল্লেখিত ছয়টি গুণ শুধু হাওয়ারিগণের বৈশিষ্ট্য আপনার একথাও ভুল, কেননা বাইবেলে পরিস্কার লিখিত আছে যে, “এবং ঈমানদারগণের মধ্যে এই সব মোজেযা হবে।” অতএব যদি এইসব গুণ শুধু হাওয়ারিগণের বৈশিষ্ট্য হয়, তবে ঈমানদারীও কেবল হাওয়ারীগণের বৈশিষ্ট্য। এ দ্বারা ও
প্রমাণিত হল যে, হাওয়ারিগণের পরে প্রকৃত খৃষ্টীয় কেউ সৃস্ট হয়নি।
পিটার্সঃ অভাগিনী! এ জন্যই ত আমি বলি যে, বাইবেলের গুপ্ত ভেদসমূহ বুঝবার ক্ষমতা তার নেই। আরে নিবোর্ধ! এই সব মোজেযা দ্বারা আধ্যাত্মিক বিষয় উদ্দেশ্য করা হয়েছে। পীড়া অর্থ আধ্যাত্মিক পীড়া, বিষের অর্থ কুফরী। অর্থাৎ খৃষ্টীয়গণের উপর যদি কাফেরগণেরও আক্রমণ হয়, তথাপি তারা ঈমান হতে বিচ্ছিন্ন হবে না ইত্যাদি।
ঈসাবেলাঃ একটু চিন্তা করে উত্তর দিন। আপনি ত আমাকে নির্বোধ সাব্যস্ত করছেন, কিন্তু দেখুন, এই বিশ্লেষণটি আপনার উপর গিয়ে পতিত হয় কিনা। বাইবেল যোহন ১৪ অধ্যায় ১২ পদে লিখিত যীশুর বাক্যটি পাঠ করুনঃ
“যে ব্যক্তি আমার উপর ঈমান রাখে, এ কাজ যা আমি করছি, তা সে ব্যক্তিও করবে; এর চাইতেও বড় কাজ করবে।”
যদি মোজেযা দ্বারা আধ্যাত্মিক বিষয় উদ্দেশ্য হয়, তবে স্বীকার করতে হবে যে, যীশু কোন মৃতকে জীবিত করেননি, কোন অন্ধকে দর্শনশক্তি দান করেননি, কোন পীড়িত ব্যক্তির পীড়াও নিরাময় করেননি। বরং তিনি মনের মৃত্যু, অন্তরের অন্ধত্ব এবং রূহের অপবিত্রতা বিদূরণ করেছেন। অর্থাৎ তাদের মধ্যে ঈমানের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোন ব্যক্তি যীশুর অলৌকিক কর্মের এইরূপ অর্থ করলে আপনারা তা বরদাশত করতে প্রস্তত নন। অথচ অপরের বেলায় উল্টা নিয়ম খাড়া করতে তৎপর হয়ে উঠেন। যীশু ত বলেছেন যে, যা আমি করছি সেই কার্য সেই ধরনেই করা ঈমানদারদের কর্তব্য। নতুবা সে ঈমানদারই নয়।
পিটার্সঃ এই কাফের মেয়েটিকে বুঝানো খুবই কঠিন কাজ। এর চিকিৎসা বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করা নয়, বরং ইনকুইজিশন ডিপার্টমেন্টের হাওয়ালা করাই এর একমাত্র চিকিৎসা, যেখানে অপরাধীকে শেকে প্রায় (এক প্রকার সংকীর্ণ যাতাকল বিশেষ, যদ্বারা অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার হয়) আবদ্ধ করে রাখা। মিষ্টার মীখাইল! আপনি একে ঘর হতে বের করে দিন এবং পবিত্র প্রধান পাদ্রীকে জানিয়ে দিন যে, এখন এর রোগ অনারোগ্য হয়ে পড়েছে। অতএব, এর জন্য এখন অন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করা কর্তব্য।
অতঃপর মীখাইল এবং পিটার্স উঠে অন্য কামরায় চলে গেলেন এবং কিছু পরামর্শ করতে লাগলেন। মীখাইলের কন্যা মীরানো ঈসাবেলাকে বলল, অবিলম্বে তুমি সরে পড়, নতুবা কোন বিপদ এসে পড়ে তা জানা নেই। কিন্তু সাব্যস্ত হয়ে গেল যে, ঈসাবেলা এবং সকল সহচরী কর্ডোভার বিখ্যাত উদ্যানে সন্ধ্যায় অবশ্যই মিলিত হবে এবং ভবিষ্যত সম্বন্ধে বিশেষ চিন্তা ও জরুরী পরামর্শ করবে। ঈসাবেলা এ ব্যাপারে সহচরীদের সাথে ওয়াদা করে মীখাইলের গৃহ হতে বের হয়ে আসল এবং নিজ গৃহপানে যাত্রা করল। সে তো অগ্রসর হচ্ছিল সম্মুখে, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তাকে পশ্চাৎদিকে আকর্ষণ করছিল। সে চিন্তা করছিল, দেখি গৃহে আবার আমার জন্য কোন আপদ অপেক্ষমান। সে বহু দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে গৃহে পৌঁছল এবং মায়ের অনুরোধে আহারও সমাধা করল। কিন্তু বিভিন্ন চিন্তার দরুন সে আপন ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারল না। কাজেই সন্ধ্যার অপেক্ষায় আপন প্রকোষ্ঠে অবস্থান করতে লাগল। সে বসে বসে কখনও নিজ লাইব্রেরীর পুস্তকাদির প্রতি, কখনও আপন ব্যবহারের দ্রব্যাদির প্রতি এবং গৃহের বিভিন্ন জিনিসের প্রতি করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগল। আর পুনঃ পুনঃ দীর্ঘ নিশ্বাসের সাথে চিন্তা করতে লাগল যে, এ গৃহে আমার অবস্থান আর সম্ভব হবে কি? আমার অবর্তমানে আমার এ সকল প্রিয় জিনিসপত্র কার ব্যবহারে আসবে? আমার পুস্তকাদি কে অধ্যয়ন করবে? এ সব চিন্তা করতে করতে এক সময় হঠাৎ তার মুখ হতে অলক্ষ্যে এ কথাটি বের হয় পড়ল যে, যাক যার ইচ্ছা এ গৃহে বাস করুক, যার খুশী এ জিনিসপত্র ব্যবহার করুক, তাতে আমার কি, আমি সত্যের সন্ধ্যানে ছিলাম, খোদার শুকরিয়া যে, আমি উহার সন্ধ্যান পেয়ে গেছি। আমার খোদা আমার পথ প্রদর্শন করেছেন। তার লাখ শুকরিয়া তিনি আমাকে সত্যের মহাসম্পদ দান করেছেন। আমি সত্য প্রাপ্ত হয়েছি; এটাকি কম সম্পদ? এ গৃহের ন্যায় হাজার গৃহও ইসলামরূপ দৌলতের জন্য বিসর্জনীয়; ঈসাবেলা সেজদায় পতিত হয়ে খোদার শুকরিয়া আদায়ে মশগুল হল।
(চলবে)