JustPaste.it

আমরা যাদের উত্তরসূরী

ইমাম বুখারী রহঃ

 

          নীল আকাশের রূপালি চাঁদোয়ার নিচে  আর সবুজ গালিচার এ পৃথিবীর বুকে পবিত্র কুরআনের পর সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য  ও প্রামাণ্য গ্রন্থ হলো সহীহ আল বুখারী। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, হাদীসের ক্ষেত্রে এক জগত জোড়া নাম ইমাম মোহাম্মদ বিন ইসমাইল এর অনবদ্য অবদান এই গ্রন্থ।এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে ইমাম বুখারী সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনার প্রয়াস পাবো।

          ইমাম বুখারীর পুরো নাম আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইসমাইল ইবনে ইব্রাহিম ইবনে মুগীরা ইবনে বারদিযবা আল বুখারী। হাদীসের জগতে তিনি "আমিরুল মু'মিনীন" উপাধিতে ভূষিত। তাঁর পিতা ইসমাইল একজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস, খোদা ভীরু ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন।প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হওয়া সত্বেও তিনি ভোগ লিপ্সা ও লোভ লালসাকে ঘৃণা করতেন। সম্পদের মোহ তাকে স্পর্শ করতে পারে নি কখনো। জনৈক মুহাদ্দিস বর্ণনা করেন যে, আমি ইমাম বুখারীর পিতা ইসমাইলের অন্তিম মূহুর্তে তাঁর মুমূর্ষু কন্ঠে শুনেছি, "আমি প্রচুর সম্পদের মালিক ছিলাম, অনেক সম্পদ রেখে গেলাম।কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ তাতে বিন্দুমাত্র সন্ধিগ্ধতার অবকাশ নেই।" তার এই উক্তি থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম বুখারীর রক্ত দেহ ও মস্তিষ্ক কেমন পুত হালাল উপকরণে গঠিত হয়েছিল।

          ইমাম বুখারী ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওয়াল শুক্রবার বাদ জুমা ঐতিহাসিক বুখারা শহরে জন্ম লাভ করেন। শিশু কালেই তিনি পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হন।তাই তার মমতাময়ী মাতা লালন পালন ও প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণ করে।ইমাম বুখারীর মাতা অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ, পুণ্যবতী ও বিদুষী ছিলেন।শিশু কালে ইমাম বুখারী দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন।এ দূর্ঘটনায় তাঁর প্রতি মায়ের মমতা উথলে উঠল। তিনি শোকাহত হৃদয়ে আল্লাহর দরবারে তার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আকুল প্রার্থনা জানান।মাতৃ হৃদয়ের আবেগ কাতর প্রার্থনার ফলে আল্লাহ তাঁর দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়ে এত তীক্ষ্ণ ও প্রখর করে দেন যে, ইমাম বুখারী তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রন্থ "তারিখে কাবীর" রচনার কাজ চাঁদের আলোতেই  সমাপ্ত করেন।স্নেহময়ী মাতার তত্বাবধানে ইমাম বুখারী স্থানীয় শিক্ষাঙ্গণে অত্যন্ত  কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, বিরল প্রতিভা ও প্রত্যুৎপন্ন মতিত্বের এবং বিস্ময়কর স্মরণ শক্তির অধিকারী। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি আব্দুল্লাহ বিন মোবারকের সমস্ত কিতাব মুখস্ত করে ফেলেন। তখন থেকে তাঁর মনে হাদীস চর্চার এক অদম্য স্পৃহা জাগ্রত হয়।তিনি নিজে বর্ণনা করেন যে, "আমি মক্তবে শিক্ষাবস্থায়ই হাদীস চর্চার প্রতি অনুপ্রাণিত হই"।

          প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ইমাম বুখারী বুখারা নগরীর  স্বনামধন্য মুহাদ্দিসগণের শিষ্যত্ব  গ্রহণ করে হাদীস চর্চায় ব্রত হন।হাদীস চর্চার সূচনাতেই তিনি যে চরম  অভিজ্ঞতা ও পারদর্শিতার পারাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন নিম্নের ঘটনা থেকেই তা বুঝা যায়ঃ

          বুখারা নগরীর এক খ্যাতিমান মুহাদ্দিসের দরসে হাদীসে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন।অন্যান্য সকলেই হাদীস লিখার প্রতি চরম গুরুত্ব আরোপ করলেও ইমাম বুখারী সেদিকে মোটেই ভ্রুক্ষেপ করতেন না।তিনি হাদিস লিখতেন না।এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর কেউ কেউ তাকে তিরস্কারের সুরে বলতেন যে, তুমি যখন হাদিস লিখছ না তাহলে অনর্থক সময় নষ্ট করে লাভ কি? তদুত্তরে ইমাম বুখারী বললেন যে, আচ্ছা তাহলে তোমরা যে সমস্ত হাদীস লিখেছ প্রত্যেকেই তার এক এক কপি হাতে নাও এবং সমস্ত হাদীস আদ্যোপান্ত আমার কাছ থেকে শুনে আপন আপন কপি সংশোধন করে নাও।ঠিক তাই হলো।একই বৈঠকে ইমাম বুখারী ৭০ হাজার হাদীস আদ্যোপান্ত ধারাবাহিকভাবে শুনিয়ে দিলেন এবং উপস্থিত সকলে আপন আপন কপি সংশোধন করে নিলেন।তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬ বছর।

১৬ বছর পর্যন্ত ইমাম বুখারী জন্মভূমি বুখারার মুহাদ্দিসগণের কাছেই হাদীস শিক্ষা করেন। ২১০ হিজরীতে স্নেহময়ী মাতা ও ভাই আহমদের সাথে বিদেশ পর্যটনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন।মক্কায় হজ্জ পালনের পর মা ও ভাই দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু ইমাম বুখারী হাদীস শাস্ত্রে আরো অধিক বুৎপত্তি লাভের আকাঙ্ক্ষায় পবিত্র মক্কায় থেকে যান। মক্কার প্রতি যশা বড় বড় মুহাদ্দিসগণের কাছে দুই বছর যাবত হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে যথাক্রমে মদিনা, বসরা, কুফা ও বাগদাদে হাদীসের উচ্চ জ্ঞান লাভ করেন।

          ইমাম বুখারীর হাদীসের উস্তাদগণের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ মুসনাদী, ইবরাহীম ইবনে আশ'আছ, মোহাম্মদ ইবনে সালাম বয়কান্দী, আল্লামা হুমাইদী আবুল ওলীদ, আহমাদ ইবনে আরযাফ, আব্দুল্লাহ ইবনে যোবায়ের প্রমুখ।

          ইমাম বুখারীর বাগদাদ গমনের সাথে সাথে সমগ্র নগরীতে সাড়া পড়ে যায়।ততকালীন খেলাফতে আব্বাসিয়ার রাজধানী বাগদাদে ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বলসহ বড় বড় মুহাদ্দিসগণ একত্রিত হন এবং ইমাম বুখারীর সাথে তাঁরা পরীক্ষামূলক আলোচনার ব্যবস্থা করেন। এ পর্যায়ে বাগদাদের খ্যাতিসম্পন্ন ১০ জন মুহাদ্দিসকে নির্বাচিত করা হয়।তাঁরা প্রত্যেকে দশটি করে হাদীসের সনদ  ও মতন উলট পালট করে মোট একশত হাদীস ইমাম বুখারীর সামনে পেশ করেন।ইমাম বুখারী প্রত্যেকের প্রতিটি হাদীসের ভুল বর্ণনা ও পরে তার সঠিক সনদ ও বিশুদ্ধ মতন এক এক করে ধারাবাহিকভাবে বিস্ময়কর পারদর্শিতার সাথে পেশ করেন।উল্লেখিত ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে,খোদা প্রদত্ত স্মৃতিশক্তির অধিকারী ইমাম বুখারীকে আল্লাহ পাক ইলমে হাদীসের জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন।

হাদীস সংকলন ও ধর্মীয় অনুভূতিতে ইমাম বুখারী ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক। তাঁর আখলাক-চরিত্র ও বিশ্বস্ততার ব্যাপারে কোন রকমের সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে এমন সব আচরণ থেকে তিনি সর্বদা সতর্ক ছিলেন। প্রয়োজনে যে কোন ধরনের পার্থিব স্বার্থ ত্যাগ করতেও তিনি মোটেই কুন্ঠাবোধ করতেন না।

          ছাত্র জীবনের একটি বিস্ময়কর ঘটনা। একবার তিনি ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা সঙ্গে নিয়ে সমুদ্র পথে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে সাধুবেশী এক কপট ব্যক্তি ইমাম সাহেবের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং কথা প্রসঙ্গে ইমাম বুখারীর নিকট ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা থাকার কথা জেনে ফেলে। এক সময় সেই ধূর্ত বন্ধুটি ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ সজোরে চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে, আমার ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা  চুরি হয়ে গেছে।জাহাজে তখন এক চাঞ্চল্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। শুরু হয় ব্যাপক তল্লাশি। ইমাম বুখারীর ধূর্ত বন্ধুর দুরভিসন্ধি বুঝতে বাকি রইলো না।তিনি ভাবলেন, এই পরিস্থিতিতে তার সত্য কথায় কেউ কান দিবে না।বরং তার কাছে স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেলে তা হবে তার বিশ্বস্ততার প্রতি এক দুরপনেয় কলঙ্ক। কিংকর্তব্যবিমুঢ় ইমাম বুখারী হাদীস শাস্ত্রের ইজ্জত রক্ষার খাতিরে মুদ্রার তোড়াটি সন্তর্পণে সমুদ্র গর্ভে নিক্ষেপ করেন।এ ঘটনায় হাদীসের প্রতি তার সুগভীর প্রেম ও পার্থিব সম্পদের মোহহীনতার অত্যুজ্জ্বল প্রমাণ। তিনি সনদসহ ৬ লক্ষ হাদীস মুখস্থ জানতেন। তদূপরি, সহীহ,গাইরে সহীহ হাদীসের মধ্যে পার্থক্য বিধান ও হাদীসের দোষ-ত্রুটি যাচাইয়ের মতো সুকঠিন কার্যেও প্রবল উৎসুক্য ও পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন।হাদীস বর্ণনায় তাঁর সততা, সাধুতা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, স্মৃতি শক্তি ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর কোন তুলনা হয় না।

          ছয়খানি হাদীস ভান্ডারের শ্রেষ্ঠতম হাদীস গ্রন্থ সহীহ আল বুখারী বিশ্ববাসীর জন্য ইমাম বুখারীর অনুগ্রহ ও তুলনাবিহীন অবদান। সুদীর্ঘ ১৬ বছর অক্লান্ত সাধনা করে তিনি এ জগৎ বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থটি সংকলন করেন। ছয় লক্ষ হাদীসকে বিশুদ্ধতার কষ্টিপাথরে যাচাই করে ৯০৮২ টি হাদীস দ্বারা তিনি এ মহান গ্রন্থটি অলংকৃত করেছেন। প্রতিটি হাদীস লিখার পূর্বে গোসল করে নিতেন এবং দু'রাকাত সালাত আদায় করে হাদীসের বিশুদ্ধতার প্রতি পূর্ণ নিশ্চয়তা ও নির্মল

          মানসিক প্রশান্তির পরে এক একটি হাদীস লিখতেন।বুখারী শরীফ সংকলনের দীর্ঘ ১৬ বছর যাবত তিনি ধারাবাহিকভাবে রোজা রেখেছিলেন। অসাধারণ সাধনা ও সীমাহীন অধ্যাবসায়ের বদৌলতে ইমাম বুখারী রাসূলের প্রিয় আমানতকে বিশ্বস্ততার সাথে সংগ্রহ করে গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অভাবনীয় কল্যাণ সাধন করে গেছেন।তাই সমগ্র জগত তার এই অবদানের কথা পরম কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেছে ও করবে।

          ইসলামী জগতে এই পুণ্যশীল ইমামুল মুহাদ্দিসীন আবু আব্দুল্লাহ আল বুখারী ২৫৬ হিজরীর পহেলা শাওয়াল ঈদুল ফিতরের রাত্রিতে প্রায় ৬২ বছর বয়সে সমরখন্দ যাওয়ার পথে খরতংগ নামক স্থানে গোটা মুসলিম মিল্লাতকে শোক সাগরে ভাসিয়ে আপন প্রতিপালকের সান্নিধ্যে চলে যান।

          সূর্য যতদিন উদিত হবে এবং বিচ্ছুরিত হবে প্রভাতের আলো, শিশির রাতে নীল আকাশে ঝুলতে থাকবে সিতারার মালা ততোদিন বিশ্ব মানব তোমায় স্মরণ রাখবে।

          হে ইমাম, হে মুহাদ্দিসগণের ইমাম!তোমার ওপর বর্ষিত হোক আল্লাহর অফুরন্ত রহমতের অঝোর ধারা।