JustPaste.it

মুজাহিদের আযান

 

জিহাদের বায়'আত

মাওলানা মাসউদ আযহার

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

দূর্বলতা প্রকাশ করে জিহাদ থেকে বিরত থাকার অপচেষ্টা

অনেকের মুখে শোনা যায়, তারা বলে থাকে, দুশমনের গোলাবারুদ ও ট্যাংকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিহাদ করার মতো শক্ত ঈমান এখতো আমরা অর্জন করতে পারি নি। আমাদের সেই সামরিক শক্তি কোথায় যদ্বারা আমরা শত্রুপক্ষের যুদ্ধ বিমান ঘায়েল করে মাটিতে ফেলে দিব!তারা বলে, সামান্য শক্তি নিয়ে বিশাল শক্তিধর প্রতিপক্ষের মুকাবিলায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা তো আজকাল চিন্তাই করা যায় না। যদি যুদ্ধ করতেই হয় প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্রের।অথবা আসমানী ফেরেশতার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং প্রয়োজন আশি বছর বয়সী পাকা ঈমান।কাঁচা ঈমান নিয়ে যুদ্ধে নেমে জীবন বিসর্জন দিয়ে লাভ কি? চাই জিহাদের জন্য দীর্ঘদিনের মেহনতি মজবুত ঈমানওয়ালা লোক।

এই কথা যারা বলেন, তারা দয়া করে জানাবেন কি, কবে আপনাদের ঈমান মজবুত ও টেকসই হবে?আশি বছর বয়সে?

সুযোগ সন্ধানী ওই লোকগুলো বয়স আশি বছরে দাঁড়ালে তখন অবশ্যই এই আয়াতখানা পড়ে শুনাবে-

لَّيْسَ عَلَى الْأَعْمَىٰ حَرَجٌ وَلَا عَلَى الْأَعْرَجِ حَرَجٌ وَلَا عَلَى الْمَرِيضِ حَرَجٌ ۗ

এখনতো পায়ে বল নেই, চোখে দেখি খুবই কম, শরীর ভীষণ দুর্বল। অর্থাৎ এখন পা থাকতেও খোড়া, চোখ থাকতেও অন্ধ আর শারীরিক অসুস্থতার কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। যে যে কারণে জিহাদে যাওয়া ফরজ হয় না তা সবই এখন বর্তমান।অতএব, আমাদের উপর এখন ফরজ নয়।

হে আমার সুযোগ সন্ধানী দূর্বলমতি ভাইয়েরা! ইচ্ছামতো, এভাবে কথা বললে রেহাই পাওয়া যাবে না। যে আল্লাহ সকল মুসলিমকে ইসলাম বিরোধী শক্তির মোকাবিলায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি ঈমান মজবুত বানাতোর পদ্ধতিও শিখিয়ে দিয়েছেন। স্পষ্ট ভাষায় তিনি বলেছেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا

"হে ঈমানদারগণ! যখন কাফিরদের সাথে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হও (অবশ্যই  তোমার শত্রুপক্ষ হাতি নিয়ে যুদ্ধ করছে, তাদের ট্যাংক ও অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে, তাদের রয়েছে ধারাল বল্লম ও লক্ষ্যভেদী তীর ধনুক) তখন তুমি দৃঢ় পদ থেকে তাদের মোকাবিলায় লড়ে যাও।"

আয় আল্লাহ!চতুর্দিক থেকে গোলাবারুদ নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, সামনে থেকে দৈত্যাকারের ট্যাংক ধেয়ে আসছে, মাথার উপরে যুদ্ধ বিমান বোমা নিক্ষেপ করছে। বোমার বিস্ফোরণে পৃথিবী অন্ধকার দেখা যাচ্ছে। এমন ভয়াবহ কঠিন অবস্থায় যুদ্ধের মাঠে কীভাবে দৃঢ়পদ থাকবো?

তাই আল্লাহ বলছেন,

وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا

"তখন আমাকে বেশি পরিমাণে স্মরণ কর"।

তবেই তোমার নজরে শত্রুর সাজ সাজ রব, মারমার তৎপরতা খেলনা মনে হবে। গোলাবারুদ, তোপ, বোমা মামুলী আর কি! ওর ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারিতা তোমার দৃষ্টিতে হালকা পরিগণিত হবে। তীব্রগতির বিমানগুলো দেখতে তোমার ভালই লাগবে। বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত পোড়া যমীন তোমার কাছে সবুজ-শ্যামল মতোমুগ্ধকর শষ্যক্ষেতরূপে প্রতিভাত হবে। তুমি তখন জীবনের সার্থকতা অনুভব করতে পারবে। কেবল তখনই সে  যুদ্ধ তোমাকে দান করবে, কল্পনাতীত সুখ, অফুরন্ত শান্তি ও মৃত্যুহীন জীবন।জান্নাতে সবার উপরে থাকবে তোমার আসন।

একদিকে জীবনের সর্বাপেক্ষা সঙ্গিন মুহূর্তে হৃদয়ের গভীর আকুতির সাথে আল্লাহকে স্মরণ করা হচ্ছে। ওদিকে তোমার সাহায্যে আকাশ থেকে ফেরেশতা অবতরণ করছে। তারা তোপ অকার্যকরী করে দিবে অথবা তোপের গতি পাল্টে দিয়ে ভুল নিশানায় নিক্ষেপ করবে। তখন যদি হুর এসে উপস্থিত হয়, তবে গুলিটি তোমার বুক ভেদ করে সৌভাগ্যের রাজটিকা তোমাকেই উপহার দিবে। তুমি হয়ে গেলে জান্নাতের অনিবার্য অংশীদার।

তবে এ স্বাদ ও মধুর মৃত্যুতে তুমি সন্তুষ্ট হতে পারবে না। এই মৃত্যুর স্বাদ ও আনন্দের কথা তুমি জান্নাতে যেয়েও ভুলতে পারবে না। সেখানে যেয়ে তুমি আল্লাহকে অনুরোধ করে বলবে, ইয়া আল্লাহ! ঐ মৃত্যু তুমি আমাকে আবার দান কর।

উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তা'আলা মুমিন বান্দাদেরকে কেবল যুদ্ধ করতে বলেই ক্ষান্ত হননি বরং তিনি যুদ্ধের নিয়ম ও কলা-কৌশলও বলে দিয়েছেনঃ তোমরা যদি শক্ত পায়ে বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করতে চাও, তবে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ও বায়’আতের উপর অটল থাক এবং শত্রুর মুকাবিলায় দাঁড়িয়ে আল্লাহকে স্মরণ কর। তবেই তুমি স্বচক্ষে দেখতে পাবে কত বিপুল আয়োজনে আল্লাহর সাহায্য তোমার সাথী হচ্ছে। আল্লাহ তোমার কত নিকটে তখনই তুমি তা একান্তভাবে উপলব্ধি করতে পারবে। শত্রুর মুকাবিলায় দাঁড়িয়ে আল্লাহকে স্মরণ কর। তুমি তাকে অতি কাছেই পাবে। শত্রুর মুকাবিলায় দাঁড়িয়ে একমাত্র তিনিই অভিবাবক, সাহায্যকারী ও মদদগার।

 

আল্লাহর শক্তি স্বচক্ষে অবলোকন

এক লোক জনৈক বুযুর্গ ব্যক্তিকে ইসমে আযম' শিখিয়ে দেয়ার জন্য ভীষণ পীড়াপীড়ি করছিল। লোকটির ধারণা ছিল, “ইসমে আযম' কোন অজ্ঞাত ও আশ্চর্য বিষয় হবে। শেষে বুযুর্গ ব্যক্তি তাকে বললেন, 'আল্লাহ' হলো ইসমে আযম।

বুযুর্গ ব্যক্তির কথা লোকটির আদৌ বিশ্বাস হলো না। সে তাকে বললো, আপনি কেমন বুযুর্গ, ইসমে আযম’ জানেন না!

বুযুর্গ ব্যক্তি তাকে বললেন, আমার কথা বুঝতে হলে বাস্তব অভিজ্ঞতার দরকার আছে। বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন যেদিন হবে সেদিনই কেবল আমার কথার যথার্থ সত্যতা বুঝতে পারবে।

একদিন ঐ লোকটি নৌকায় চড়ে কোথাও যাচ্ছিল। নদীর মাঝখানে হঠাৎ ঝড় শুরু হলো। গভীর পানিতে নৌকা ডুবে গেল ।সাঁতার না জানার ফলে লোকটি ডুবে যাচ্ছিল। এ জন্যই অভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ট বিদগ্ধজন বলেছেন, পাঠশালায় ভর্তি হওয়ার আগে সাঁতার শিখে নেয়া দরকার।

হযরত ওমর (রাঃ)-এর লিখিত একখানা পত্রে আমি দেখেছি, তিনি লিখেছেনঃ

علموا أولادكم السباحة

‘নিজ সন্তানদেরকে সাঁতার শিখাও।

তিনি আরো লিখেছেন, সন্তানদেরকে প্রথমে সাঁতার শিখাও, তারপর ইলম শিখাও।

কারো কোন বিষয় অজানা থাকলে অন্যের নিকট থেকে জেনে নেয়া যায়। কিন্তু পানিতে ডুবে গেলে মাছ কাউকে বলে দিবে না, কিভাবে সাঁতার কাটতে হয়। তখন কী উপায় হয়?

ঐ লোকটি এখন নাকানি-চুবানি খেয়ে গভীর পানিতে ডুবে যেতে থাকলে তার মনে পড়ল সেই বুযুর্গের কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ’ হলো ইসমে আযম। লোকটির বিশ্বাস ছিলো, ইসমে আযমের বরকতে কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এবার সে হৃদয়ের গভীর আকুতি সহ ‘আল্লাহ’ বলে তার নিকট নিশ্চিত মৃত্যুর ভয়াভহ বিপদ থেকে উদ্ধারের অনুরোধ জানালো। পর মুহূর্ত থেকে সে সাঁতরিয়ে কূলের দিকে উঠে এলো। এবং স্বীকার করলো, বুযুর্গের কথা সত্য। আসলেই ‘আল্লাহ’ ইসমে আযম। এ কথা সম্পূর্ণরূপে তখন উপলব্ধি হবে যখন কোন মাধ্যম ও সাহায্য ছাড়া একমাত্র তাকেই ‘মালিক’ রূপে বিশ্বাস করা হবে।

মানুষ আল্লাহর উপর ভরসাও করে, আবার পকেটের দিকেও তাকিয়ে দেখে। আল্লাহর উপর ভরসা করে পথ চলা শুরু করে গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস আছে তবুও জাগতিক স্বার্থে হন্নে হয়ে ঘুরে মরে।

বিশ্বাস করি, যদি হৃদয়ে সত্যিকার অর্থে আল্লাহকে স্মরণ করার আকুতি জাগে, যদি তার সাহায্য স্বচক্ষে দেখার সাধ হয়, আল্লাহ নামের মিষ্টি স্বাদ গ্রহণের ইচ্ছা যদি জাগ্রত হয়, তবে নির্দ্বিধায় জিহাদের ময়দানে উপস্থিত হও।

দেখতে পাবে, নির্ঘাত গুলির নিশানা থেকে মুজাহিদরা কীভাবে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে।ঈমানের মজবুতি দেখতে হলে জিহাদের ময়দানে ছুটে এসো। দেখো, মুজাহিদদেরকে আল্লাহ দান করেন কত দৃঢ় ও মজবুত ঈমান।কীভাবে তাঁর কুদরতের সাহায্যে ট্যাংকের ভয়াবহ বিস্ফোরণ থেকে তারা রক্ষা পায়, যুদ্ধ বিমানের বোমার আঘাতে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে তারা কীভাবে অক্ষত বেঁচে যায়।

যদি সাহাবীওয়ালা ঈমানের এক ক্ষুদ্রাংশও অর্জন করার সাধ হয়-

যদি সাহাবা জীবনের অনুসরণ করতে ইচ্ছে হয়-

যদি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর নিঃসীম শক্তি উপলব্ধি করার আগ্রহ জাগ্রত হয়-

যদি আল্লাহর শক্তি অবলোকন করার আকাংখা হয়-

যদি চিরঞ্জীব ও সদাবর্তমান আল্লাহর চিরঞ্জীবত্ব উপলব্ধি করার আগ্রহ থাকে-

যদি আল্লাহর কাহহারিয়াত ও জাব্বারিয়াত এর ভয়াবহ চিত্র স্বচক্ষে দেখার তামান্না হয়-

তবে জিহাদের ময়দানে এগিয়ে এসো, সেখানে আল্লাহ তোমাকে বুঝিয়ে দিবেন, তিনিই পরাক্রমশালী এবং তাঁর শক্তিই সর্বক্ষেত্রে বিজয়ী।

كَم مِّن فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ ۗ

অর্থঃ ক্ষুদ্র দলই বিরাট দলের মোকাবিলায় জয়ী হয়েছে আল্লাহর হুকুমে।' (বাকারাঃ আয়াতাংশ-৪৯)

–আমিই ট্যাংকের বিশালাকার গতি ঘুরিয়ে দেই, আমিই যুদ্ধ বিমানের বোমা অকার্যকর করে থাকি, আমিই বারুদের আঘাত থেকে তোমাদের রক্ষা করি।যখন তোমরা ময়দানে উপস্থিত হবে এবং এই অভাবিতপূর্ব অত্যাশ্চর্য দৃশ্য স্বচক্ষে দেখবে, তোমার ঈমান অত্যন্ত মযবুত ও সুদৃঢ় হয়ে উঠবে।

এই হলো জিহাদের বায়আতের বিস্তারিত বিবরণ ও তার ফলাফল। এ ছাড়াও এ বিষয়ের উপর বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

আমি এ আলোচনা দ্বারা কখনো এ কথা বলতে চাচ্ছি না যে,ইসলাহী বায়আত নিষিদ্ধ বা তা করা যাবে না। আমি নিজেই একজন বুযুর্গের হাতে বায়আত করেছি। আমি আমার সাথী-বন্ধুদেরকে ইসলাহী বায়আত গ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে থাকি যে, তারা যেন বুযুর্গদের সাথে ইসলাহী কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলে। এর দ্বারা বহু আত্মিক রোগের চিকিৎসা ও নিরাময় লাভ হয়ে থাকে।ইসলাহী বায়আতের এই উপকারিতা ও বাস্তবতা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

এখন যেহেতু জিহাদের বায়আতের কথা আলোচনা হচ্ছে সেহেতু এক্ষেত্রে ইসলাহী আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না  এবং তা উচিতও হবে না। কেননা বর্তমান সময়ে এই বিষয়ের আলোচনাকে আমি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকি এবং এটাই সময়ের দাবী।

এ হলো সেই বায়আত যে বায়আত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সময়ে গ্রহণ করা হতো আর আকাশ থেকে ফেরেশতা এসে বায়আত গ্রহণকারীদের বেহেশত-এর সনদ বিতরণ করত।

সাহাবীগণ বলেছেন, প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (হুদায়বিয়ায়) বৃক্ষের নীচে বসে যখন হযরত উসমান (রাঃ) এর রক্তের বদলা নেয়ার উদ্দেশ্যে আমাদের প্রত্যেকের নিকট থেকে মৃত্যু ও জিহাদ থেকে পিঠটান দিয়ে পিছনে ফিরে না থাকার বায়আত গ্রহণ করছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন, আজ আল্লাহর যমীনে তোমাদের থেকে উত্তম কোন লোক নেই, এবং আকাশেও কেউ নেই তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উঁচু মর্যাদার দাবীদার।

 

মুজাহিদের মর্যাদা

এই মর্যাদা এ জন্য যে, তারা আপন জীবন আল্লাহর নিকট সোপর্দ করার দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছে। একেই বলে মুসলিম জীবনের মেরাজ, এটাই আল্লাহর দাসত্বের শ্রেষ্ঠ স্তর। আমার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস জীবন ও সম্পদ সাহসের সাথে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করার চেয়ে উত্তম কাজ আর কি হতে পারে? পবিত্র কুরআনের এই আয়াতে সে কথাটি বলা হয়েছেঃ

فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً ۚ

অর্থঃ আল্লাহ মুজাহিদীনকে উপবিষ্টদের উপর, মহান প্রতিদানে শ্রেষ্ঠ করেছেন।' (নিসাঃ আয়াতঃ ৯৫)

বিজ্ঞ আলিমগণ লিখেছেন, আয়াতে উল্লেখিত শব্দটি দ্বারা নির্দিষ্ট কোন শ্রেণীকে বুঝাতো হয় নি। এর দ্বারা প্রত্যেক যুগের তাদের সকলকে বলা হয়েছে, যারা জিহাদে অংশগ্রহণ না করে ঘরে বসে রয়েছে,জিহাদী জীবন অবলম্বন না করে উপেক্ষা করেছে।জিহাদ ও মুজাহিদদের সাহায্য-সহযোগিতায় অবহেলা ও উন্নাসিকতা দেখিয়েছে। এরা সকলে এই উপবিষ্টদের অন্তর্ভুক্ত।

কিছু লোক আছে, যারা রাত দিন সমানে ইবাদাত করতে থাকে,ফাযায়েল-ফযিলাত পালনে দারুণ আগ্রহ দেখায়, হাবভাবে বুযুর্গী প্রকাশ করে। এদের চেয়ে সেই ব্যক্তি বহুগুণে শ্রেষ্ঠ ও আল্লাহর প্রিয়পাত্র, যিনি ফাযায়েল ফযিলাত পালনের সময় বেশী পান না বটে,তবে তিনি জিহাদী জিন্দেগী গ্রহণ করেছেন এবং ময়দানে ইসলামের শত্রুর মোকাবিলায় বুকটান করে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। এ কথা পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। বিশ্বাস করি, এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার দুঃসাহস কেউ দেখাবেন না অবশ্যই।

এ প্রসংগে আবারো আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের কবিতার কথা মনে পড়েছে। সে সময়ে মক্কার ও পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ ফোযাইল ইবনে ইয়াযকে তিনি জিহাদের ময়দান থেকে এই পংক্তি কয়টি লিখে পাঠিয়েছিলেন। ফোযাইল ইবনে ইয়ায প্রতি রাতে অন্ততঃ সত্তর বার পবিত্র কাবা তাওয়াফ করতেন। তিনি অনন্য বুযুর্গ ও আল্লাহওয়ালা লোক ছিলেন। বাদশাহ হারুন রশীদ তাঁর সাক্ষাতে এলেও তিনি তাঁর ঘরের দরজা খুললেন না এ কারণে যে, ইবাদাতে তার একনিষ্ঠতা নষ্ট হয়ে যাবে। রণাঙ্গনে যুদ্ধকালীন সময়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের নিকট কোন এক ব্যক্তি এই বুযুর্গের কথা উল্লেখ করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারকের কথা কে না জানেন। তিনি ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ। তাঁর মত বিদগ্ধ হাদীস বিশারদ পৃথিবীতে দ্বিতীয়জন উপহার দিতে পারে নি।

তখন আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক 'তরসুস’ রণাঙ্গনে ছিলেন। প্রচন্ড শীতের মৌসুম। হাঁড় কাঁপাতো শীতের মধ্যে তিনি এক হাতে তরবারী নিয়ে তাঁবু পাহারা দিচ্ছেন।

এই সময়ে তাকে কেউ বলে আপনি উত্তম কাজ করছেন, কিন্তু মক্কার ফুযায়েলকে কি বলবো বলুন! কাবা নিয়েই সে ব্যস্ত রয়েছে, চোখ ভরে কাবা দেখে, রাত দিন তাওয়াফ করে, এবং ওখানেই থাকে। কেবল হেরেমের মাটির উপরই হাঁটে-যে মাটিতে হেঁটেছেন প্রত্যেক নবী-রাসূল।

আমার এক ওস্তাদ বলেছিলেন, মক্কার হেরেমে আর কিছু লাভ না হোক অন্তত এতটুকু সৌভাগ্য অর্জন হয় যে, নবী রাসুলগণ যেখানে পা রেখেছেন, আমার পা সেখানের ধূলা-মাটি স্পর্শ করে ধন্য হলো ।হয়তো এ কারণেও আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন।

এমন পবিত্রতম পূণ্য ভূমিতে ফোযায়েল ইবনে ইয়ায রাতদিন ইবাদাত করছেন।

যাক, ঐ লোকের কথা শুনে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক তৎক্ষণাৎ ফোযায়েল ইবনে ইয়া্যকে উদ্দেশ্য করে এই পংক্তি কয়টি লিখেনঃ

يا عابد الحرمين لو أبصر تنا

لعلمت انك بالعبادة تلعب

অর্থ-পবিত্র হেরেমে ধ্যানে মগ্ন হে সাধক! তুমি যদি এখানে এসে আমাদের ইবাদাত দেখতে, তবে আমাদের ইবাদাতের তুলনায় তোমার ইবাদাতকে তুমি খেলনা মনে করতে।

এবার শুতো, তোমার ও আমাদের ইবাদাতের মাঝে পার্থক্য কতটুকুঃ

من كان يخصب خده بدموعه

فنحورنا بدمائنا تتخصب

অর্থ-যখন তোমার ইবাদাতে জোশ ও জযবা আসে, তখন তোমার আঁখি বেয়ে অশ্রু ঝরে, কপাল সিক্ত হয়। আর আমাদের যখন জযবা আসে তখন গ্রীবার রাঙ্গা রক্তে বুক সিক্ত হয়।

তোমার আঁখিবাহিত অশ্রুও পবিত্র। তবে তার রং সাদা। আর আমরা যে প্রবাহে সিক্ত হই তার রং লাল। তোমার আঁখি-অশ্রুর ধারা ফোঁটা ফোঁটা ঝরতে থাকে এবং জীবন ভর ঝরে। কিন্তু আমাদের বাহিত রক্ত অদম্য এবং অজস্র ধারায় এক বার ঝরে। সে রক্ত সিক্ত করে প্রতিটি বনী আদমকে। ওখানেই একটি জীবনের সমাপ্তি ঘটে। মৃত্যুকে তারা আলিঙ্গন করে অকুণ্ঠচিত্তে।

ريح العبير لكم ونحن عبيرنا

رهج السنابك والغبار الاطيب

অর্থঃ তুমিও খোশবু-আঁতর ব্যবহার কর! আমরাও খোশবু-আঁতর ব্যবহার করি। তুমি মেশক আম্বরে সুরভিত হয়ে তাওয়াফ কর, আমরাও সুরভিত খোশবু ব্যবহার করি, তবে তা মেশক আম্বর নয়, তা যুদ্ধ ময়দানের ধুলোবালি, যা আমাদের অবয়ব ও পরিধেয় কাপড়ে লেপ্টে থাকে।

মনে রাখবে, তোমার খোশবুর মর্যাদা ও ফযীলাত বর্ণনায় জান্নাতের অঙ্গীকার করা হয় নি। যদিও খোশবু ভাল জিনিস। কিন্তু আমাদের এই অবয়ব ও কাপড় মলিন করা ধুলো-বালু সম্পর্কে প্রিয় নবী স্পষ্ট করে বলেছেনঃ

‌‌«‌لَا ‌يَجْتَمِعُ ‌غُبَارٌ ‌فِي ‌سَبِيلِ ‌اللَّهِ ‌وَدُخَانُ ‌جَهَنَّمَ

অর্থ- জিহাদের ময়দানে ধুলো মলিন অবয়ব আর জাহান্নাম কখনো একত্রিত হবে না। জাহান্নামের ধোঁয়াও এ মুখো হবে না।' (তিরমিযী পৃঃ ২৯২ খঃ ১)

প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেনঃ

مااغبرت قدما عبد في سبيل الله فتمسه النار

অর্থ-যে ব্যক্তির দু'পা খোদার রাহে ধূলিতে আচ্ছন্ন হয়েছে, তাকে দোযখের আগুন স্পর্শ করতে পারে না।' (বুখারীঃ পৃঃ ৩৯৫ খঃ ১)

জিহাদের ময়দান থেকে যে নাকে ধূলো যাবে, ধুলোমলিন যে পায়ে দাঁড়িয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে,সে পা ও নাক এবং জাহান্নাম একাকার হবে না এক মুহূর্তের জন্যও, কল্পনায়ও নয়। এর দ্বারা বুঝে নাও, তোমার খোশবু ও আমার খোশবুর মধ্যে ব্যবধান কতটুকু।

او كان يتعب خيله في باطل

فخيولنا يوم اللكر يهة تتعب

অর্থঃ তোমার ঘোড়া দিনমান অনর্থক কাজে ক্লান্ত হয়,

আমাদের ঘোড়া ভয়াবহ যুদ্ধে লড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

তুমি সকালে ঘর থেকে বের হও এ আশা নিয়ে যে, বিকেলে ফিরে আসবে।

আর প্রতি কদমে আমাদের দুরন্ত আকাঙ্খা থাকে,

এখনই বুঝি শাহাদাতের মধু পেয়ালা নসীব হবে।

আমরা প্রতিক্ষণ প্রভূর দিদারের আশায় উন্মুখ থাকি, আর তোমরা বিচ্ছেদের আশা পোষণ করে দিন যাপন কর। মিলন ও বিচ্ছেদের অর্থ কি কখনো এক হতে পারে? কখনোই নয়।

একদিন দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে তোমাকে এবং আমাকেও। পুরস্কৃত হওয়ার কি নিশ্চয়তা নিয়ে যাচ্ছো তুমি, একবার ভেবে দেখবে।

মৃত্যুর পর তোমাকে গোসল দেয়া হবে, তোমার বিদায়ে কত লোক শোকাবিভুত হবে, জানাযা হবে, কবরে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। হয়ত তোমার জন্য তা কোন জটিল বিষয় না-ও হতে পারে।

পক্ষান্তরে আমাদের ব্যাপার তোমার থেকে ভিন্নতর। মুজাহিদদের শাহাদাত লাভে কেউ কাঁদে না, শোকাভিভূত হয় না, বরং সকলে আনন্দ প্রকাশ করে, ফুল দিয়ে তাকে মুবারকবাদ জানায়।গোসলের দরকার হয় না। শহীদদের পবিত্র খুন কেন ধুয়ে ফেলবে!

তোমাদের পরনের কাপড় খুলে ফেলা হয়। আর শহীদের কাপড় শরীরেই থাকে। কবরে তাঁকে ফেরেশতা প্রশ্ন করতে উদ্যোগী হলে তাকে বলা হবে, কি প্রশ্ন করছো একে, এর রক্তাক্ত শরীরই তো তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে।

তোমাদের জানাযায় হয়ত অসংখ্য লোক হবে, সকলে তোমার মাগফিরাত প্রার্থনা করবে।

আমাদের জানাযা তো বহু লোক এ ভয়ে পড়বে না যে, কিভাবে জীবন্ত লোকের জানাযা পড়বো! আল্লাহ তা'আলা তো এদেরকে জীবিত বলে ঘোষণা দিয়েছেন, জীবিত মানুষের আবার জানাযা কিসের?

সাহসী কিছু লোক জানাযা পড়বে বটে। তবে আমাদের মাগফিরাতের জন্য নয়। বরং আমাদের মাগফিরাত প্রার্থনার উসীলা ধরে নিজের পাপ মাফ করিয়ে নেয় উদ্দেশ্যে। তোমার ও আমার জীবন-মৃত্যুর এই হলো ব্যাবধান।

ولقد آتانا من مقال نبينا قول صادق لا يكذب

অর্থঃ প্রিয় নবীর অমর বাণী বেজেছে মোদের কানে,

সত্য যাহা সঠিক যাহা কে আছে মিথ্যা বলে?

هذا كتاب الله ينطق بيننا

ليس الشهيد بميت لا يكذب

অর্থঃ আল্লাহর এই কিতাব তোমার আমার মাঝে সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে বলছে, শহীদ কখনো মৃত্যুবরণ করে না। সে চির জীবন্ত।

তবে মৃত্যুর পরে তোমাকে লাশ ও মৃত বলা হবে। পক্ষান্তরে শহীদকে মৃত বলতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। সে চিরজীবন্ত, অমর। কত প্রসন্ন শহীদের ভাগ্য। বিষয়টা একবার ভেবে দেখবেন! (চলবে)

অনুবাদঃ মনযুর আহমাদ