JustPaste.it

আর আমি বেঁচে থাকব?

–শহীদুল ইসলাম

=================================================

 

        মসজিদে নববীতে ঝুলন্ত একখানা উন্মুক্ত তরবারী থেমে থেমে বাতাসে দুলছে। সকল সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) মসজিদে নববী চত্বরে সমবেত। সবাই একবার উন্মুক্ত ঝকঝকে তরবারী খানার দিকে আর একবার তরবারী উত্তোলনকারীর দীপ্ত চেহারার প্রতি লক্ষ করছে। সবাই নিরব-নির্বাক। কার আছে এমন দুঃসাহস যে সে মহানবী (সঃ) -এর পরম বন্ধুর কথার প্রতিবাদ করবে। বিশ্ব নবী (সঃ) এর প্রথম খলিফার কাজে ভেটো দেবে, কে আছে এমন রাহাদুর!

 

        সিংহের ন্যায় গর্জে উঠলেন, বিশ্ব নবীর (সঃ) হিজরাতের সঙ্গী সিদ্দীকে আকবার বল্লেন, মহানবী ঘোষণা করেছেন, “যতক্ষন পর্যন্ত মানুষ কালিমায়ে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুর হক -- নামায, যাকাত আদায় না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।”

 

        আমি ঘোষণা করছিঃ “যে সকল মানুষ নবী করীম (সঃ) -এর সময় একটি ছোট্ট বকরীর বাচ্চাও যাকাত হিসাবে দিত সে যদি এখন তা আদায় করা থেকে অস্বীকার করে, মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলর শপথ করে বলছি, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছি। একজন মানুষও যদি আমার অনুগামী না হয়, তবুও আমি একাই এ নাঙ্গা তরবারী নিয়ে এদের মোকাবেলায় জিহাদে ঝাপিয়ে পড়ব।”

 

        নিস্তব্ধ, নীরবতায় ছেয়ে গেল মসজিদে নববী ও তার চত্বর! সে যুগের কোন রাজা বা স্বৈরাচারী বাদশাহর মুখ থেকে এমন কথা বেরুলে কারো আশ্চর্য হওয়ার তেমন কিছু ছিলাে না। কিন্তু এ ঘোষণায় ছিলনা কোন রাজপ্রতাপ, ক্ষমতার লালসা, না ছিল দম্ভ-অহমিকার কোন গন্ধ। যার মুখ নিসৃত এ বজ্র নিনাদ, তিনি হলেন ইসলামের প্রথম খলিফা বিশ্ব নবী (সঃ) -এর গারে সাউরের মহান সাথী হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। তবুও সাহাবীগণ সিদ্ধান্তে স্থির হতে পারছিলেন না। তাঁরা খলিফার এই ঘোষণার পর গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। কেউই সরাসরি তাঁর প্রতি সমর্থন দিচ্ছে না। তবে খলিফা আবু বকর সিদ্দকী (রা) এর সাহস, বিচক্ষণতা ও সত্যশ্রয়ী চরিত্রে যে বিন্দু মাত্র কারো মনে কোন সন্দেহ বা অশ্রদ্ধা ছিল তা নয়, বরং তখনকার মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এতটা নাজুক, স্পর্শকাতর ও বিদঘুটে অবস্থার সৃষ্টি করেছিলাে, যে কারণে এ দুঃসময়ে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনায় তারা খফিার সাথে একমত হতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন।

 

        রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর কি যেন হয়ে গেল। চতুর্দিকে শুধু শোনা যায় বিদ্রোহের আওয়াজ আর মেঘাচ্ছন্ন পরিস্থিতির ঘটনা। ইয়েমেন থেকে সিরিয়া এবং আরব উপদ্বীপ থেকে বাহরাইন ও আম্মান সাগর তীর পর্যন্ত ইসলামের সোনালী মানচিত্রে দেখা দিল মহা দুর্যোগ। কোন গোত্র বিদ্রোহে কোমর বেঁধে লেগে গেল। কোনটি ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে গেল। নবুয়তের মিথ্যা দাবীদারেরা সুযোগ বুঝে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। ইয়েমেনে আসওয়াদে আনসী, ইয়ামামায় মুসাইলামায়ে কাজ্জাক, মধ্য আরবের গোত্ৰপতি তলাইহা নিজেদের নবী বলে দাবী করছে। সাজ্জাহ বিনতে হারেসা নান্মী এক

        সুন্দরী মহিলা ইরাক ও হেরাত অঞ্চলে নিজেকে মহিলা নবী হিসাবে ঘোষণা দেয়ার পর এতদঞ্চলের বিভ্রান্ত যুবকদেরকে নিয়ে সে তৈরী করল এক বিশাল বিদ্রোহী বাহিনী।

 

        এমনই এক বেসামাল মুহূর্তে ইসলামের প্রথম খলীফার মুখ থেকে বেরুচ্ছিল জিহাদের জ্বালাময়ী বক্তৃতা। সাহাবায়ে কেরাম গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। তাঁরা ভাবছেন, ইনিই কি সেই কোমল হৃদয় আবু বকর (রাঃ) নন, মক্কায় কাফেররা নবী করীম (সঃ) কে বাজারের গলিতে হাটার সময় গলায় ফাঁস নিক্ষেপ করে টানতে ছিল, আর ক্রমান্বয়ে নবীজীর গলায় ফাঁস আটকে তার প্রাণবায়ু উড়ে যাওয়ার অবস্থা। এমন সময় আবু বকর, মানুষের ভীর ঠেলে নবীজীর গলার ফাঁস খুলতে খুলতে চিৎকার দিয়ে বলছিলেন “ ওরে জালেমের দল, তোরা কি এমন এক ব্যক্তিকে মেরে ফেলবি, যিনি তাওহীদের বানী প্রচার করেন।” তখন কাফেররা সম্মিলিত ভাবে তাঁর উপর আক্রোশে ফেটে পড়ল, কাফিরদের আঘাতের পর আঘাতে তার সমস্ত শরীর রক্তাক্ত হয়। তার মাথা ফেটে দর দর করে রক্ত বেয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু আকাশসম ধৈর্য, পাহাড়সম দৃঢ়তা ও পরম সহিষ্ণুতার মূর্তপ্রতীক আবু বকর (রাঃ) এর মুখে তখনও উচ্চারিত হয়, “তাবারাক তা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম”। হে প্রভু! তুমি বড় মহান, প্রচণ্ড শক্তি শালী, বড় করুনশীল।

 

        প্রবীণ সাহাবীদের স্মৃতিপটে তখন ভেসে উঠলো দরদী আবু বকর (রাঃ) ও নির্দয় উমাইয়া বিন খালফের সেই বাক্যালাপ। উমাইয়া ইবন খালফ যখন মরুতপ্ত বালুতে হযরত বেলাল (রাঃ) -কে চিতকরে শুইয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখত, আর হযরত বিলাল (রাঃ) অসহ্য যন্ত্রণায় উহঃ আহঃ না বলে কেবল বলতেন, আহা! আহাদ! আর তখন নরপশু উমাইয়া ইবনে খালফ পৈশাচিক হাসি ফুটিয়ে উচ্চারণ করতো, “হে ধর্ম ত্যাগী, যতক্ষণ পর্যন্ত মুহাম্মদের ধর্ম ত্যাগ করে লাত মানাতের কালেমা না পড়বে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রাণ চলে গেলেও তোকে রেহাই দেবো না।”

 

        হযরত বিলালের (রাঃ) উপর অকথ্য নির্যাতনের এই সংবাদ শুনে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর দুচোঁখ অশ্রুতে ভিজে উঠে। তিনি তক্ষুনি উমাইয়ার কাছে গিয়ে বললেন, তোদের কি একটুকু দয়াও নেই? এই নিরীহ মানুষটির উপর হাত তুলতে তোদের কি আল্লাহর ভয় হয় না? উমাইয়া ক্ষোভে অগ্নি শর্ম হয়ে বললাে, তোমরাইতো একে নষ্ট করেছে!

 

        আবু বকর (রাঃ) কতক্ষণ চুপ থেকে বললেন, উমাইয়া! আমার কাছে তোমাদের ধর্মের একটা তাজা তাগড়া যুবক গোলাম আছে, তুমি সেটির পরিবর্তে এই দুর্বল, হীন, কুশ্রী গোলামটি আমাকে দিয়ে দাও। উমায়া ইবনে খালফ তাঁর এ প্রস্তাবে রাজী হলাে। আবু বকর দৌড়াতে দৌড়াতে ঘরে গিয়ে তাঁর সেই জোয়ান গোলমটিকে এনে উমাইয়ার হাতে তুলে দিয়ে তখনই বেলাল (রাঃ) কে ঘরে নিয়ে এলেন। উমাইয়ার অত্যাচার থেকে মুক্ত করে তিনি তাঁকে চিরদিনের জন্য গোলামীর জিজ্ঞির থেকে আযাদ করে দেন। যে কারণে বেলালের পক্ষে সেই মুয়াজ্জিন হওয়ার সৌভাগ্য হয়। যার আযান শুনার জন্য ফেরেশতারাও ব্যাকুল হয়ে থাকত। হযরত আবু বকর (রাঃ) আমের ইবনে ফুহাইরা (রাঃ) কেও তুফাইল ইবনে আবদুল্লাহ ইজদীর নিকট থেকে খরিদ করে আযাদ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমের ইবন ফুহাইরা মহানুভব মুক্তিদাতার সঙ্গ ত্যাগ না করে আবু বকর (রাঃ)-এর ভেড়া বকরী চড়ানোর কাজ করতেন সেই সুবাদে তিনি মহানবী (সঃ) ও আবু বকর (রাঃ) হিজরতের প্রাক্কালে যখন ‘ গারে সাউর ’-এ আত্মগোপন করেছিলেন, তখন এই আমের ইবন ফুহাইরা (রাঃ) তাঁদের খাবারের জন্য গোপনে বকরীর দুধ সরবরাহ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।

 

        হযরত আবু বকর (রাঃ) নাহদিয়া এবং উম্মে উবাইস নাম্নী দু’জন মহিলা বাঁদী মুসলমান হয়ে যাওয়ার পর নিজ পকেটের দিনার খরচ করে আযাদ করে দিয়ে ছিলেন। এইভাবে ইসলাম গ্রহণ করার পর বাঁদীগণ যখন মনিবের সীমাহীন নির্যাতন অত্যাচারের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছিল তখন সেই আরবের এই খোদাভীরু খ্যাতনামা ব্যবসায়ী নিজের অর্জিত চল্লিশ হাজার দিরহামের বিরাট পুঁজির সবটুকুই দ্বীনের পথে খরচ করে ছিলেন।

 

        উপরন্তু আবু বরক (রাঃ) এর ভাষা ও চরিত্র ছিলাে নিবয় ও মাধুর্যে পরিপূর্ণ। একমাত্র সেদিনই আবু বকর (রাঃ) এর মুখে কঠিন কথা উচ্চাতি হতে দেখেছি যেদিন তিনি বাড়ীর সামনে নির্মিত ছোট্ট মসজিদ খানায় এবাদাত করতে থাকার প্রতিবাদ করেছিলাে কাফিররা। পরিস্থিতি ছিল খুবই নাজুক। তখন ক্রমবর্ধমান অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মুসলমানগণ আবিসিনিয়া ও অন্যান্য দেশে হিজরত করতে ছিলেন। এমন কি হযরত আবু বকর নিজেও মহানবীর অনুমতি নিয়ে আবিসিনিয়ার পথে রওনা হন।

 

        ঘর থেকে আবিসিনিয়ার পথে বের হওয়ার পর আবু বকর (রাঃ) তাঁর চির পরিচিত বাড়িঘর, রাস্তা-ঘাট, বাগান, বৃক্ষের প্রতি ফিরে ফিরে বার বার তাকাচ্ছিলেন। প্রিয় রাসূল (সঃ) এর বিচ্ছেদে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল তাঁর কপোল বেয়ে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তিনি অতি পরিচিত পথও হারিয়ে ফেলেন। বরকগুমাদ নামক স্থানে পৌছালে বনীকৃারা কবিলার গোত্ৰপতি ইবনে দাগিনার সাথে তার দেখা হয়। আবু বকরের (রাঃ) সততা, বিশ্বস্ততা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সে পুরোপুরি অবহিত ছিল। আবু বকরের এহেন অবস্থা দেখে ইবনে দাগিনা অত্যন্ত মর্মাহত হয়। সে আবু বকর (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাে, হে আবু ফুহাফার বেটা আবু বকর! তোমার এমন কি হলাে যে একেবারে ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে?

 

        অতি দুঃখে আবু বকর (রাঃ)-এর মুখ থেকে অজান্তে বেরিয়ে আসে “আহ!” শব্দটি, তিনি বললেন, হে বনী কারাহ গোত্রপতি! আমি স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়িনি, বরং আমাকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। নিজ ঘরে স্বাধীন ভাবে আমাকে আমার প্রভুর ইবাদত করতে দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু আমার প্রভুর জমীন এতে সংকীর্ণ নয়। আমি এখন এমন এক স্থানে যাচ্ছি যেখানে আমাকে ইবাদত থেকে কেউ রুখতে আসবে না। স্বাধীনভাবে আমি এক আল্লাহ্ তা'আলার ইবাদত করতে পারব।

 

        আবু বকর (রাঃ) -এর কথায় ইবনে দাগিনা যার পর নেই আশ্চার্যান্বিত ও বিচলিত হয়। ইবনে দাগিনা বল্লো, আবু বকর! কুরাইশদের বুদ্ধি বিবেচনার প্রতি আমার দুঃখ হচ্ছে। তোমার মত এমন একজন গুণী ব্যক্তির মক্কায় থাকা অত্যন্ত জরুরী। তুমি মক্কায় ফিরে চল। আমি তোমার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজকাঁধে তুলে নিচ্ছি। অবশ্যই তুমি স্বাধীন ভাবে নিজ গৃহে এবাদত করতে পারবে। কেউ আর তোমাকে বাঁধা দিবে না। উপরন্তু যে তোমার প্রতি শক্রতা পোষণ করবে আমি তার শত্রুতে পরিণত হব।

 

        ইবনে দাগিনা হযরত আবু বকর (রাঃ) -এর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের কথা বলে তাঁকে মক্কায় ফিরে যাওয়ার আবেদন জানালে তিনি তার প্রস্তাবে সম্মত হন এবং স্বগৃহে ফিরে আসেন। সে সময় ইবনে দাগিনার দাপট ছিল সারা মক্কা ও আরব জুড়ে। সে আবু বকরকে (রাঃ) মক্কায় ফিরিয়ে এনে সকল কুরাইশ নেতাদের একত্রিত করে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে, “হে কুরাইশ নেতারা! আবু বকরের মত এমন মহান ব্যক্তিকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করতে তোমাদের লজ্জা হয় না? কুরাইশদের মধ্যে তার মত কৃতিত্বের দাবী করতে পার এমন আর কে আছো? আমি ইবনে দাগিনা পরিস্কার ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছি, আজ থেকে আবু বকর এর সার্বিক নিরাপত্তার আমিই জিম্মাদার। যে ব্যক্তি তার বিরুদ্ধাচরণ করবে, সে আমার ঘোর শত্রুতে পরিণত হবে।” ইবনে দাগিনার দাপটে আর কেউ আবু বকরের বিরোধীতা করতে সাহস পেল না। তারা শুধু এই শর্ত জুড়ে দিলাে যে, “সে তাঁর ঘরে বসেই ইবাদত করবে, বাইরে প্রকাশ্যে দাওয়াতের কাজ করতে পারবে না।”

 

        কিছু দিন হযরত আবু বকর (রাঃ) নিজ গৃহাভ্যন্তরেই কুরআন তিলাওয়াত ইবাদতের মধ্যে কাটিয়ে দেন। এপর তিনি তার বাড়ীর আঙ্গিনায় একটি মসজিদ তৈরী করেন। যেটি ছিল মক্কা মুয়াজ্জামায় মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত সর্ব প্রথম মসজিদ।

 

        হযরত আবু বকর (রাঃ) -এর কণ্ঠ ছিল অত্যন্ত কোমল ও শ্রুতি মধুর। তিলাওয়াত করার সময় তাঁর চোঁখ গড়িয়ে প্রবাহিত হতো অশ্রুধারা। তাঁর মিষ্টি মধুর কণ্ঠের তেলাওয়াত আশে পাশের শিশু-কিশোর, জায়া-কন্যারা ভীড় জমাতো মসজিদের পাশে মধুমাখা মিষ্টি সুরের তিলাওয়াত শুনে শিশু কিশোর ও মেয়েরা কুরআনে কারীমের যাদুস্পর্শে অভিভূত হয়ে যেত। দেখতে দেখতে এমন হলাে যে, রোজ রোজ তার কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত শুনার জন্য শ্রোতাদের ভীড় বেড়েই চল্লো। আবু বকর (রাঃ) কুরআন তিলাওয়াত শুরু করার সাথে সাথে মেয়ে-মহিলাদের খুব বেশী ভিড় জমতে থাকে। একতো ছিলাে তাঁর দরদমাখা দাউদী কণ্ঠস্বর, দ্বিতীয়তঃ আল কুরআনের ঐশী, আকর্ষণে শ্রোতারা ঘন্টার পর ঘন্টা এক স্বপ্নীল জগতে নিশ্চল নিথর দাড়িয়ে থাকতো। কোন ক্ষুধা তৃষ্ণার অনুভব যেন তাদের হত না।

 

        শিশু কিশোর ও মেয়েদের বৃত্ত পেরিয়ে একদিন এখবর পুরুষদের কানেও পৌছে যায়। খবরের সত্যতা যাচাই করার জন্য কতিপয় কুরাইশ সর্দার একদিন মসজিদের পাশে গিয়ে নিজেদের স্ত্রী-কন্যা, শিশুদের সেখানে দেখতে পেয়ে তেলে বেগুণে জ্বলতে থাকে। ধমকিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেয় মসজিদের পাশ থেকে। তারপর ওরা সোঝা উপস্থিত হয় ইবনে দাগিনার বাড়িতে। একসাথে অনেক লােক আসতে দেখে ইবনে দাগিনা মনে করলাে, হয়তো তারা যুদ্ধ করতে আসছে। তাই সেও এদের প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হয়।

 

        দূর থেকেই এক সর্দার হেঁকে উঠলাে, হে ইবনে দাগিনা! তুমি কি আবু বকরের জিম্মাদারী নিজের দায়িত্বে নাওনি? ইবনে দাগিনা বল্লো, হ্যাঁ, আমি তো তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছি! হে ইবনে দাগিনা! এতদিন তোমার কাছে আমাদের সম্পর্কে আবু বকরের পক্ষ থেকে কি কোন অভিযোেগ এসেছে? সে তৎক্ষণাত জবাব দিল, তোমাদের সম্পর্কে আবু বকরের কোন অভিযোগ থাকলে সে অবশ্যই আমার কাছে আসতো। একথা কি সিদ্ধান্ত হয়নি, আবু বকর নিজ গৃহে যেমন ইচ্ছা তেমন ভাবেই ইবাদত করতে পারবে? হ্যাঁ! তাতো ছিল- তোমার কি বলার আছে তাই বলো! ইবনে দাগিনা একটু ঝাঝালাে কণ্ঠে কথাগুলাে বল্লো।

 

        ইবনে দাগিনা! তুমি শুনে রাখ, আবু বকর তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তার বাড়ীর সামনে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে। সেখানে বসে সে কুরআন পড়ে। তবুও আমরা তোমার কাছে অভিযোগ করতাম না। কিন্তু অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, আমাদের ছেলে মেয়ে, স্ত্রী-কন্যারা তাঁর ইবাদত দর্শন ও তিলাওয়াত শোনার জন্য এতো ব্যাকুল যে, সে তেলাওয়াত শুরু করলেই সব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আমাদের ভয় হচ্ছে, না জানি এ মুসিবতে আমাদের ঘরগুলােও আক্রান্ত হয় — না জানি সবাই আবু বকরের ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে।

 

        ইবনে দাগিনা একথা শুনে বিস্মিত হয়। সে আবু বকর (রাঃ) -এর উপর প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়ে বির বির করে বলতে থাকে, সিদ্দীকে আকবরের কদম তার দেয়া বৃত্তের বাইরে চলে গেছে!

 

        ইসলামের যে অগ্নি মশাল আবু বকর (রাঃ) -এর অন্তরে প্রজ্জলিত হয়েছে তা নির্বাপিত করবে এমন শক্তি দুনিয়াতে কারও নেই। কিছুক্ষণ ভেবে ইবনে দাগিনা বললাে, হে সম্মানিত কুরাইশ গোত্রপতিগণ! তোমরা এখানে একটু বস! আমি আবু বকরের সাথে দেখা করে এক্ষুনি আসছি। যদি তোমাদের অভিযোগ সত্য হয় তাহলে আমি তাকে কঠোরভাবে নিষেধ করব। আর যদি ঘটনা সত্য হওয়ার পরও সে মানতে অস্বীকার করে তবে-তরবারী মুষ্ঠিবদ্ধ করে লম্বা লম্বা কদমে ইবনে দাগিনা সিদ্দীকে আকবরের বাড়ীর দিকে অগ্রসর হয়।

 

        সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) -এর মসজিদের বাইরে অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ইবনে দাগিনা হতভম্ব হয়ে গেল। যে স্ত্রী-কন্যা, শিশুরা অভিভাবকদের তাড়া খেয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল, অভিভাবকরা চলে যেতেই পঙ্গপালের মত আবার তারা মসজিদের পাশে এসে জড় হয়েছে। মসজিদের ভিতর থেকে আবু বকরের হৃদয় নিংড়ানো তিলাওয়াতের গুঞ্জরণ বাতাসে বাতাসে অনুরণীত হচ্ছে। বাইরে মোহাবিষ্ট হয়ে দাড়িয়ে ছিল অসংখ্য মেয়ে শিশু ও কিশোরের দল। কুরআনের ঐশী আকর্ষণে তারা মোহাবিষ্টেরমত দুলছিলাে। যেন এক মায়াময় যাদুর জিঞ্জিরে বাঁধা পড়ে গেছে সব। [অসমাপ্ত]

 

*****