দেশে দেশে ইসলাম
চীনা মুসলমানদের অতীত ও বর্তমান
নাসিম আরাফাত
=================================================================
প্রায় সাইত্রিশ লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে পূর্ব এশিয়ার এক বিশাল ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশ 'গণপ্রজাতন্ত্রী চীন'। ১৯৭০ সালের গণনা অনুযায়ী জনসংখ্যা প্রায় ৭৩,১৬,০০,০০০। বর্তমানে এ সংখ্যা একশত কোটি ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। যার ৩% হইতে ৫% জন মুসলমান। কারো মতে ১১% মুসলমান। সুউচ্চ পর্বতমালা বুকে নিয়ে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদে সমৃদ্ধ এই "চীন গণ প্রজাতন্ত্র"। উত্তর চীনের সমভূমিতে প্রবাহিত হোয়াংহো নদী যদিও অত্যাধিক বন্যার কারণে চীনের দুঃখ নামে খ্যাত; তবে দক্ষিণ চীনে প্রবাহিত ইয়াংসী ও সী-কারাং নদীদ্বয়ের অববাহিকা অত্যন্ত উর্বর ও বসবাসের উপযুক্ত স্থান। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে চীন সরকার দেশের প্রতিটি ইঞ্চিকে কৃষি উপযোগী করছে। এমন কি নিচু নিচু পাহাড় কেটে তা কৃষি কাজের উপযুক্ত করে তুলছে।
খনিজ সম্পদে চীন অত্যন্ত সমৃদ্ধ। কয়লা, ফসফেট, ম্যাঙ্গানিজ, এলমুনিয়াম, সীসা, দস্তা, তামা, সোহাগা ছাড়াও স্বর্ণ-রৌপ্য, বিসমাথ, পারদ, ইত্যাদি খনিজদ্রব্য চীনের ভূতল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। প্রাচীন চীনারা শিল্পজাত পণ্যাদির মাঝে মৃৎশিল্পে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল। নকশাঙ্গন ও চিত্রাঙ্কনেও তাদের প্রসিদ্ধ কম ছিল না। বর্তমানে চীনে বিশাল বিশাল কারখানা কারিগরি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হচ্ছে। ভারী শিল্প স্থাপনও ক্রমে ব্যাপকতা লাভ করেছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের বর্তমান ২১ টি প্রদেশে পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ও ৩টি পৌর এলাকা রয়েছে। স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল গুলো হল।
(১) মধ্য মঙ্গোলিয়া (INNER MONGOLIN)
(২) কোয়াং সি চয়াং (KWANGSI CHANG)
(৩) নিং সিয়াহুই (NING SIA HUI
(৪) সিংকিয়াং উইগুর (SINKIANG UIGHUR)
(৫) তিব্বত (TIBET)
আর পৌর এলাকা গুলো হলঃ
(১) রাজধানী পিকিং (PEKING)
(২) শাংহাই (SHAWAHUI)
(৩) তিয়েপিসিন (TIENPINSI)
চীনে মুসলমানদের আগমন:
চৈনিক সভ্যতার ইতিহাস অতি প্রাচীন। তাদের প্রায় চার হাজার বছর পূর্ব পর্যন্ত সময় কালের ইতিহাস পাওয়া যায়। আবহমান কাল থেকেই পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার সাথে আরব ব্যবসায়ীদের ছিল সুগভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক। আরবদের বাণিজ্য জাহাজের বহর ভারতবর্ষ ও চীনের পণ্য সামগ্রী নিয়ে লোহিত সাগর, আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের বুকে দূর্দম গতিতে চলাফেরা করত।
দাইরাতুল মা'আরিফে (উর্দু ইসলামী বিশ্বকোষ) উল্যেখিত হয়েছে, রাসূল (সাঃ) এর জীবদ্দশায় ও ওয়াহব ইবনে বা'ছা (রাদিঃ) নামক এক সাহাবী চীনে এসে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন এবং তিনি চীনেই ইহধাম ত্যাগ করেন। প্রসিদ্ধ চিনা ঐতিহাসিক চিন য়ুওয়ান বর্ণনা করেন, ২৯ হিজরী ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে হযরত উসমান (রাদিঃ) এর শাসনামলে হযরত সা'দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রাদিঃ) এর নেতৃত্বে একটি মুসলিম প্রতিনিধি দল চীনের চিং আন শহরের সম্রাটের নিকট আগমন করেন এবং তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানান এবং সাআদ (রাদিঃ) বন্দর নগরী ক্যান্টনে একটি মসজিদও নির্মাণ করেন। যা আজও চীনা মুসলমানদের ইতিহাস, ঐতিহ্য বুকে নিয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। পরবর্তীকালে বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি কুতাইবা ইবনে মুসলিম (রাদিঃ) বোখারা, তুর্কিস্তান বিজয়ের পর চীন আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে তৎকালীন চীন সম্রাট য়ূনচুং (শাসনকাল ৭১৩-৭৫৫) এর নিকট একটি প্রতিনিধিদল করে তাকে ইসলাম গ্রহণের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। উমাইয়াদের শাসনামলে প্রায় ১৭ টি মুসলিম প্রতিনিধি দল চীনে আগমন করে এবং ৭৫০ সালে আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর থেকে এদের তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পায়। কারো মতে ৭৫০-৮০০ হিজরী সাল পর্যন্ত সময়ে চীনে 15 টি মুসলিম প্রতিনিধি দলের আগমন ঘটে। চীনা ইতিহাস গ্রন্থ সমূহে খলিফা মনসুর ও হারুন রশিদের প্রেরত প্রতিনিধিকে "খাগ্রবীতাশী" নামে অতিবাহিত করা হয়েছে।
সুং বংশের (৯৬০ ১২৭৭ খৃঃ) শাসনামলে চীনের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হয় এবং বাণিজ্য ও ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে দলে দলে মুসলমানরা চিনি গমন করে। বন্দরনগরী ক্যান্টেন তখন মুসলিম জাহাজের গমনাগমনে আমোদিত হয়ে ওঠে। মুসলিম ব্যবসায়ীরা চীন সম্রাট কে বহু মূল্যবান সামগ্রী উপহার দান করে। কথিত আছে নূহ্ ইবনে নাসর নামক এক মুসলমান চীন সম্রাট মাচীনের কন্যাকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে চিনি থেকে যান।
সুং বংশের পর মোঙ্গলদের উত্থান হয় ১২৭৭ সাল থেকেই ১৩৬৮ সাল পর্যন্ত সূর্য পূজক মোঙ্গলীয়রা মুসলমানদের উপর নানা অত্যাচার চালায়। মোঙ্গলদের পর মিন বংশ (১৩৬৮-১৬৪৪ সাল পর্যন্ত) রাজ সিংহাসনে আরোহন করে। এ সময়ে মুসলমানরা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, চিকিৎসা, মহাকাশ বিজ্ঞান প্রভৃতিতে প্রভুত উৎকর্ষ লাভ করে।
মাঞ্চু বংশের উত্থান ও মুসলিম নির্যাতনের ঘনঘটা:
সুং বংশের পর রাজ ক্ষমতায় মাঞ্চু বংশের (১৬৪৪-১৯১১) আগমন ঘটে। এরা ছিল মুসলমানদের ঘোর শত্রু। পিশাচের দোসর। তাদের শাসনামলে নিষ্পাপ মুসলমানদের জনপদ রক্তের বন্যায় ভেসে যায়। কারণে-অকারণে নানা অজুহাতে তারা মুসলমানদের উপর অমানুষিক নির্মম অত্যাচার ও নিপীড়ন চালায়। ১৭৮৩ সালের সম্রাট চিন লুং (১৭৩৬-১৭৯৫ খৃঃ) এর শাসনামলে হাইফুন, সূন নামক জৈনাক মুসলমানকে শুধুমাত্র একুশটি আরবি কিতাব রাখার তথাকথিত অপরাধে নির্মম শাস্তি দেওয়া হয়। ১৭৩১ সালে সম্রাট য়াংচুং (১৭২৩-১৭৩৫) গরু জবেহ করা নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৭৮৫ সালে কানসূ অঞ্চলের মুসলমানরা এক অভ্যুত্থান ঘটালে সম্রাট চিনলুং মুসলমানদের হজ পালন, আলেমদের চিনে প্রবেশ ও মসজিদ নির্মাণ ইত্যাদি বন্ধ করে দেয়। ১৮৬২ সালে কানসূ অঞ্চলে মিনকিয়া গ্রামের মুসলমানদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। মুসলমানরা এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হলে শানসী প্রদেশের সকল মুসলমানদের পশুর ন্যায় হত্যা করা হয়। তারপর রাশিয়ার জারের গোপন সহায়তায় চীন সরকার মুসলমানদের গুপ্তহত্যা ও নানা নির্যাতন চালাতে থাকলে ১৮৯৫ সালের মুসলমানরা এর প্রতিবাদ করে। এ কারণে কানসু প্রদেশের মুসলিম অধ্যুষিত কেটাং কাং শহরকে সম্পন্ন বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়। রাস্তার পার্শ্ববর্তী প্রতিটি বৃক্ষে মুসলমানদের ছিন্নমস্তক ঝুলিয়ে রাখা হয়। এর মাত্র এক মাস পর সিনিনক শহরের এক প্রশাসকের আদালতে ৮০০ মুসলমানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ভ্রমহলের মতে হাজার ১৮৬২ হতে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত সময়ে উত্তর-পশ্চিম চীনে প্রায় এক কোটি মুসলমানকে অন্যায় ভাবে শহীদ করা হয়। ১৯২৮ সালে কানসু প্রদেশের হুচার শহরের মুসলমানদের সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। ইউনান প্রদেশের অবস্থাও একই হয়। ১৮৩৪ সালে মান মাইন তাং শহরের ১৬শ মুসলিম নারী পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৮৫৫ সালে এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। চীনারা শীহাচাং প্রদেশে মুসলিম খনি শ্রমিকদের উপর আক্রমণ চালালে মুসলমানরা তার পাল্টা জবাব দেয়। এতে প্রাদেশিক কর্তা রুষ্ট হয়ে ১৮৫৬ সালের ১৯মে দিবসকে মুসলিম গণহত্যা দিবস রুপে নির্বাচিত করে। এ গোপন পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে মুসলমানদের মাঝে ধারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ সময় চীনের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মুসলমানদের হত্যা করা হয়। শত শত মসজিদ ধ্বংস করা হয়। মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের আকার ধারণ করে এবং হিংস্র হায়েনার মতো নিরীহ মুসলমানদের তারা জঘন্য ভাবে হত্যা করে।
মাঞ্চু রাজ বংশের পতন ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা:
১৯১১ সালে ডক্টর সানয়াত সেনের নেতৃত্বে মাঞ্চু বংশের বিরুদ্ধে এক শসস্ত্র সফল বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিদ্রোহের সময় ডাক্তার সান দেশের বাহিরে থাকার কারণে চীন এক অবিসংবাদিত নেতার নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় এবং সেনাপতি দেশের বিভিন্ন অংশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে চীনে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চিনা যুবসমাজ রুশদের সংস্পর্শে সমাজতন্ত্রের দীক্ষা গ্রহণ করে এবং কিছু রুশ উপদেষ্টার সহায়তায় মাওসেতুং চৌ এনলাই, চৌতা, লিন পিয়াও এবং চিয়াং কাইশেককে নিয়ে একটি জাতীয়তাবাদী দল গঠনের পরিকল্পনা করা হয় এবং ১৯২১ সালে তা এক শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রবক্তা জেনারেল চিয়াং কাইশেক সমাজতন্ত্রী বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সেনাবাহিনীর উপর আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং সাংহাই ও ক্যান্টন শহরে হাজার হাজার সমাজবাদী বিপ্লবীদের হত্যা করে এবং সমাজবাদীদের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
মাওসেতুং এর নেতৃত্বে বিপ্লবী বাহিনী ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং কাইশেক বাহিনীর পরাজয় বরণ করতে থাকে। অবশেষে চিয়াং কাইশেক অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী নিয়ে সমাজবাদীদের নিস্তব্ধ করে দেয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। কিন্তু তার আগেই মাওসেতুং তার গণবাহিনী নিয়ে সকল বাধা অতিক্রম করে। চীন প্রাচীরের নিকট পৌঁছে যায়। অপরদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চীন-জাপান যুদ্ধ শুরু হয় তখন বাধ্য হয়ে কাইসেক বিপ্লবীদের সাথে আপোষ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান চীনের অনেক অঞ্চল দখল করে নেয়। অরাজকতার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে দেশ ছেয়ে যায় এবং সমাজবাদীরা ক্ষমতা গ্রহণ করলে কাইশেক পরাজিত হয়ে ফরফে আশ্রয় নেয়। অতঃপর সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি মাওসেতুং এর নেতৃত্বে চীনের সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়িম হয়।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবোত্তর চীনা মুসলমানদের অবস্থা:
বিপ্লবোত্তর চীনা মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। তবে এ ব্যাপারটি সুস্পষ্ট ও সহজেই অনুমেয় যে, সমাজতন্ত্রের মূলমন্ত্র হলো নাস্তিক্যবাদ। তাদের মতে ধর্ম মানে আত্মিক দুর্বলতা গত কিছু মনগড়া মত ছাড়া আর কিছুই নয়। চীনের ন্যায় অবিমিশ্রিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন রূপে পালন করা অসম্ভব। তাই নাগরিক অধিকার অক্ষুন্ন থাকলেও ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব হওয়াই স্বাভাবিক।
(ক) প্রশাসনিক কাজে চীনা মুসলমানদের দক্ষতা:
পরিসংখ্যান মতে চীনে মুসলমানদের হার শতকরা ১.৬৬ হলেও জাতীয় কংগ্রেস তাদের হার শতকরা ৩.৩৪ জন।৯ তাছাড়া সরকারি বহু উচ্চপদে মুসলমানরা অধিষ্ঠিত রয়েছে। স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যের শাসনকর্তা উপ শাসনকর্তা এবং বিভিন্ন পৌরসভা ও ব্যবস্থাপনা পরিষদের প্রশাসক এর গুরুত্বপূর্ণ পদে মুসলমানরা দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করছে। পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের কারণে তাদের মাঝে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি হয়েছে। অন্যান্য সংখ্যাগুরু জাতির মাঝে তারা প্রধান্য বিস্তার করে আছে। অন্যদের মতো মুসলমানরাও পূর্ণ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার অর্জন করেছে। সকল ক্ষেত্রেই আজ মুসলমানদের চাকরির দরজা উন্মুক্ত।
(খ) শিক্ষা দীক্ষা ও জীবন ধারা:
চীনা মুসলমানরা ধর্মীয় ও বৈষয়িক উভয় ক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতি গ্রহণ করছে প্রাচীন ও আধুনিক। চীনে ৪০ হাজারেরও বেশি মসজিদ রয়েছে। সাধারণত ধর্মীয় শিক্ষা মসজিদ ও মসজিদ সংলগ্ন মক্তব্যগুলোতে হয়ে থাকে। ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে কানুস ও ইউনান প্রদেশ দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কানুস প্রদেশের রাজধানী হুচাও মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা এসে মাদ্রাসা, মক্তব ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় লেখাপড়া করে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে দারিদ্র পরিবারের সন্তানরাই বেশি। বিত্তবান মুসলমান ও সেবামূলক সংস্থাসমূহের আর্থিক সহায়তায় এসব প্রতিষ্ঠানগুলো চলে।
বিত্তবান ও সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা সাধারণত বৈষয়িক শিক্ষা গ্রহণ করে। তবে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল গুলোতে পাঠ্যপুস্তকসমূহ ইসলামী ভাবধারা ও আকিদা-বিশ্বাসের আলোকে রচনা করা হয়েছে। কারিগরি ও প্রযুক্তিগত বিদ্যালয়েও মুসলমানরা বিপুলভাবে অংশগ্রহণ করছে। উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয় এবং স্বীয় রুচি অনুযায়ী যে কোন বিভাগ ও অনুষদে লেখাপড়া করতে পারে। সমগ্র চিনে অসংখ্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক মাদ্রাসার ছাড়াও পিকিং, নিচাও, য়ান চাওয়ান, সাংহাই এবং চিংচাউ প্রভৃতি শহরে বহু মুসলমান বসবাসের কারণে তাদের জন্য আলাদা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মহাবিদ্যালয় রয়েছে। ইসলামী সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার কল্পে চীন সরকারের সহায়তায় ১৯৫৩ সালে চীনা মুসলমানরা "আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়্যাতুস চীনিয়্যাহ্" নামক একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। এর ১৯৫৫ সালে "আল মাহাদুল ইসলামিস-সীনিয়্যা নামে একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণিতশাস্ত্র জ্যোতিবিদ্যা ছাড়াও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি শাখায় মুসলমানরা বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে।
চীনা মুসলমানরা চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ী, কৃষক ও মজুর ইত্যাদি পেশায় কাজ করে। কৃষকরা মনে করে জীবন মানেই পরিশ্রম। বনজঙ্গল তাদের চিত্তবিনোদন ক্ষেত্র। আর কৃষি ক্ষেত্র তাদের শিক্ষায়তন। অধুনা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে বড় বড় উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। সিংকিয়া প্রদেশ ও অন্যান্য অঞ্চলে বড় বড় কারখানা স্থাপিত হয়েছে। ইতিমধ্যে যিংগীরিয়া মরুভূমি পেট্রোলিয়ামের বৃহত্তর কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মুসলমান শ্রমিকরা এসব প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে।
(গ) চীনা মুসলমানদের ফেরকাবন্দী:
চীনাদের মাঝে ইসলাম ধর্ম দুটি নামে পরিচিতঃ (১) তিসিং চিং চিআও (পবিত্র ও বিশুদ্ধ ধর্ম)। (২) হূই হূই চিয়াও (দৈহিক ও আধ্যাত্বিক জীবনকে পরিবেষ্টনকারী ধর্ম)। সংক্ষেপে এদের চিয়াও মিন ও হূই হূই বলা হয়। ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত চীনা মুসলমানরা ছিলো এক ও ঐক্যবদ্ধ। তারা ছিল হানাফী মাযহাবের অনুসারী। শীয়া সুন্নী ইত্যাদী দল ও উপদল সম্পর্কে তারা অবহিত ছিলনা।
কানসা জেলা চীনা মুসলমানদের এই ফেরকাবন্দীর সূতিকাগার। ১৭৩৬ সালে এ জেলার মানযী নামক মুসলমান বোখারা থেকে শিক্ষা লাভ করে দেশে এসে প্রচলিত কু-প্রথা ও বিদআতের সংস্কার সাধনের ও চীনা মুসলমানদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নব উদ্যমে প্রচার কার্য শুরু করেন। ইউনান ও সাতাং প্রদেশের মুসলমানরা তার আদর্শে দীক্ষিত হয়। পরবর্তীতে তারা কিছু নতুন আকীদা-বিশ্বাসকে বাড়িয়ে চি আও মিন নামক এক নতুন ফেরকার সূচনা করে।
দ্বিতীয় ফেরকাটির প্রতিষ্ঠাতা মানযীরের সহপাঠী মানিন সীন। লেখাপড়া শেষ করে দেশে এসে কানসূ প্রদেশে কুওয়ান চওয়ান গ্রামে একটি আলাদা প্রচার কেন্দ্র স্থাপন করে কার্যধারা শুরু করে। অত্যন্ত হাস্যকর বিষয় হলো এদের মতপার্থক্য কোন মৌলিক বিষয় নিয়ে নয় বরং চীনে প্রচলিত কিছু প্রথা-প্রদ্ধতি নিয়ে। যেমন একজন মনে করে, কোন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কোরআন খানির পর মৌলবি সাহেবকে হাদিয়া দিতে হবে। অপরপক্ষ তার বিরোধিতা করে। একজন সালাতের তাশাহুদে তর্জনী উত্তোলন করে, অপর পক্ষ তার বিরোধিতা করে। একদল মাইয়াতকে গোসল করানোর সময় সূরা তোহা পাঠ করাকে প্রয়োজন মনে করে, অপরপক্ষ তার বিরোধিতা করে ইত্যাদি।
শান্তির ফুরফুরে বায়ু প্রবাহ্:
চিনা মুসলমানরা অত্যন্ত কর্মঠ ও আদর্শবান। তারা একাধারে শান্তি প্রিয়, পরহেজগার ও মুত্তাকী। সীয়াম সালাতে তারা কঠোর পাবন্দ। সার্বিকভাবে তারা খুব ধর্মানুরাগী। তাদের উদার মনমানসিকতা ও সুমধুর আচার-ব্যবহারের কারণে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে তাদের ধর্মীয় সম্প্রীতি ভাবে গড়ে উঠেছে। ১৯৫৩ সাল থেকে সরকারি সহযোগিতায় ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রত্যেক বছর হাজীদের একটি মিশন প্রেরণ করে থাকেন। ১৯৮২ সালে চীনের সর্বোচ্চ কংগ্রেসে এ আইন প্রণীত হয় যে, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার প্রতিটি অঞ্চলের আঞ্চলিক ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে। কারো ধর্মীয় নুভূতিতে কখনো আঘাত করা যাবে না।
কিন্তু ১৯৯১ সালের ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী ব্যর্থ বিপ্লবের পর সমাজতন্ত্রী চীন সরকার মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অনেক বিধি নিষেধ আরোপ করেছে এবং ধর্মীয় সমাবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৯২ সালে মক্কা থেকে প্রকাশিত "আল-আলামুল ইসলামীতে" এক হৃদয়বিদারক পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশিত হয়। ইউহাম নামক গ্রামে মসজিদুন নূরে এক ধর্মীয় সমাবেশে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তোলে পুলিশরা গুলি চালায়। তিনজন শহীদ হয় এবং ত্রিশের অধিক আহত হয়। সম্প্রতি অর্থনৈতিক সংস্কারের সাথে সাথে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ফুরফুরে শীতল বায়ু প্রবাহ পিকিং থেকে সারা চীনে ছড়িয়ে পড়ছে। গোটা চীনে আবার শান্তি ও স্বস্থির শ্বেত কপোত-কপোতী জানা ঝাপটাচ্ছে-উড়ছে।
*****