JustPaste.it

ইনসাফের আদালতে

 

ধর্মীয় রাজনীতি নয় ধর্ম বিদ্বেষী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক

– কাজী হাসান

=================================================

        নমরুদ, ফেরাউন, সাদ্দাত, আবু জাহেল, আবু লাহাব, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই, আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা প্রভৃতি কতগুলি ইতিহাস কুখ্যাত চরিত্র। এসব মানুষের নাম উচ্চারিত হলেই ধার্মিক মুসলমান সর্বান্তকরণে ঘৃণা প্রকাশ করেন, পক্ষান্তরে শয়তানের। দোসর ও চেলা-চামুন্ডারা তাদেরকে নিজেদের এককালের সেরা দোসর মনে করে পুলক বোধ করেন।

 

        এসব জালিম ও খোদাদ্রোহীরা সত্য ধর্মকে প্রত্যাখ্যান, হক ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পথে বাধাদানের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ, আল্লার দেয়া আইন ও বিধানের বিরুদ্ধাচারণ করার জন্যই ইতিহাসে এত নিন্দিত ও কুখ্যাত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। নিজেদের কুকীর্তির জন্য এরা ইতিহাসের আস্তকুড়ে নিক্ষিপ্ত হলেও এরা কখোনো নির্বংশ হয়ে যায়নি। তাই দেখা যায় যুগে যুগে দেশে দেশে মুসলিম সমাজে ঐসব জালিম ও খোদাদ্রোহীদের স্বার্থক উত্তর পুরুষদের ভয়ঙ্কর উৎপাত। মুসলমানদের বিভ্রান্ত করা ও মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড। কুফরী ও বাতিলের ক্রোড়ে সপে দেয়া মানুষ কখনও সত্যকে সাদরে গ্রহণ করেনি, তারা সর্বদা সত্যকে, ইনসাফকে প্রধান শত্র মনে করেছে এবং সমস্ত বিবেক, বুদ্ধি, কৌশল ও শক্তিকে প্রয়োগ করে সত্যকে, সত্যের বার্তাবাহকদের ধ্বংস অথবা ক্ষতি করতে নিজেকে নিয়োজিত রেথে পৃথিবীর মানুষদের এরা সর্বদা নিজেদের শয়তানী ও জাহিলী ধ্যান-ধারণায় বশীভূত করে নিজেদের পৃথিবীর একচ্ছত্র মালিকে পরিণত করতে চেয়েছে, মানুষকে নিজেদের আইন কানুন দ্বারা শোষণ করতে সচেষ্ট হয়েছে। এজন্য সত্যের অনুসারীদের সাথে তাদের বার বার টক্কর লেগেছে। কিন্তু সত্যের সাথে, টক্করে সকল যুগের সকল বাতিল পরাজিত হয়েছে। জাহিলিয়াত ও বাতিলের ধারক সেসব দাম্ভিক জালিমেরা পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের ঘৃণিত ও কলঙ্কিত চরিত্রে। কিন্তু তবুও যুগে যুগে বাতিল মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তাদের জাহিলিয়াতের গাল-গল্পের টোপ ফেলে। সত্য পথের অনুসারী মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

 

       এদেশে নব্য আবু জাহেলদের ধর্ম বিরোধী তৎপরতাঃ আমাদের দেশও এসব নষ্ট ও বিভ্রান্ত মানুষদের কবল থেকে মুক্ত নয়। এদেশেও নব্য আবু জাহেলরা তাদের হিংস্র থাবা বিস্তার করে চলছে। চৌদ্দশ বছর আগে ইতিহাস কুখ্যাত আবু জাহেল সত্যের নবী রাসূল ﷺ -কে ইসলাম প্রচারে বাধা দেয়ার জন্য এমন কোন অত্যাচার নেই যা করেনি, পরিশেষে তাঁকে জন্মভূমি ত্যাগ করে মদীনায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল। রাসূল ﷺ মানুষকে ইসলামের পথে আহবান জানিয়েছিলেন বলেই তাঁর সাথে আবু জাহেল চাচা হয়েও চরম শত্রুতায় লিপ্ত হয়। আবু জাহেল ছিল তখনকার যুগের জাহেলিয়াতের অন্যতম ধারক বাহক। বাতিল ও কুফরের প্রতিনিধি আবু জাহেল তাই সত্য ধর্ম ইসলামকে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ না করে তার বিরুদ্ধে আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছে। সেই আবু জাহেলের এদেশীয় উত্তরসূরীরাও আজ এদেশের ১০ কোটি মানুষের প্রাণের ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে শক্রতায় লিপ্ত হয়েছে।

 

        রাসূল ﷺ ইসলাম প্রচার করার সুযোগ পেলে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে এবং একসময় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তা প্রতিষ্ঠিত হলে তার সকল অনাচার অপকর্মের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। এ আশঙ্কায় আবু জাহেল ইসলামের বিকাশকে রুদ্ধ করার জন্য শক্তি প্রয়োগ, প্রভাব বিস্তার, অপপ্রচার, প্রোপাগাণ্ডাসহ সম্ভাব্য সকল উপায় অবলম্বন করেছিলাে। এদেশের নব্য জাহেলরাও সমাজ ও রাষ্ট্রে যাতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাদের অনাচার, অপকর্মের পথ রুদ্ধ না হয় সে জন্য ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এত দিন এদেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক লাইনে আঘাত হানা হচ্ছিল, বর্তমানে তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের নিজ দেশে অধিকারচ্যুত করার পায়তারা চলছে। ১৯৭২ সাল হতে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এদেশে সেকুলার সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, অর্থনীতি, প্রশাসন, প্রচার মাধ্যম, সংবাদপত্রসহ সকল সেক্টরে সেকুলার চেতনা সম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল।

 

        পরবর্তিতে বহুবার সরকার। প্রধান, মন্ত্রী পরিবর্তন ঘটলেও সরকারী চাকুরীর সুবাদে এসব আমলার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বরং এসব আমলা ধীরে ধীরে নিজ নিজ সেক্টরে সেকুলার ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, মুসলিম চেতনা সম্পন্ন সংখ্যালঘু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রুপিংয়ের হাতিয়ার প্রয়োগ করে হয় কোনঠাসা করে ফেলেছে অথবা চাকুরীচ্যুত হতে বা চাকুরী ছাড়তে বাধ্য করেছে। ষড়যন্ত্রের এই পথ ধরে আজ সরকারের প্রতিটি সেক্টরে সেকুলার চক্র নিজেদের প্রভাব পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই দেখা যায় প্রচার মাধ্যমে সেকুলার ভাবধারার প্রচার প্রোপাগাণ্ডার ছড়াছড়ি, সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেকুলার ও নাস্তিক শিক্ষকদের সীমাহীন দাপট, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ইসলাম বিরোধী বিজাতীয় সংস্কৃতি চর্চার হুলস্থূল, শিক্ষা পদ্ধতি থেকে। ইসলাম সম্পর্কিত পাঠ সযত্নে পরিহার করার ভয়ঙ্কর স্পর্ধা, প্রশাসন থেকে ইসলামের শত্রুদের প্রকাশ্যে আঙ্কারা দেবার উলঙ্গ প্রবণতা। এভাবে প্রশাসন, সংস্কৃতি, শিল্প, শিক্ষা ব্যবস্থাকে পূর্ণ সেকুলারীকরণ করার পর সেকুলার ও কমুনিস্ট মতলবাজ রাজনীতিকরা ইসলামের বিকাশের সর্বশেষ সম্ভাবনাময় পথটিকে রুদ্ধ করার জন্য। আওয়াজ তুলেছেঃ “ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ কর”।

 

       ইসলামে রাজনীতির গুরুত্বঃ ইসলাম একটি জীবন বিধান। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান কেবল ইসলামেই সম্ভব। রাজনীতি যেমন মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রার বহির্ভূত নয় তেমনি রাজনীতি তথা প্রশাসন প্রতিষ্ঠা, পরিচালনার ব্যাপারেও ইসলাম নীরব নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে ইসলামেরই কেবল বলিষ্ঠ বিধান রয়েছে, যার একাংশও পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম উপহার দিতে সক্ষম নয়। ইসলামী সমাজে অর্থনীতির সুসম বন্টন নিশ্চিত করণ, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা, অপরাধের মূলােচ্ছেদের জন্য ইসলামী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যতীত সুষ্ঠুভাবে যাকাত আদায় ও বন্টন, মজলুমের পক্ষে সকল জালিমের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা, অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা, নাগরিকদের অর্থনৈতিক সমস্যার সুষ্ঠ সমাধান করা সম্ভব নয়। অথচ এগুলি ইসলামের অন্যতম ভিত্তি বলে ঘোষিত হয়েছে। রাসূল ﷺ তাঁর জীবনে একই সাথে সমাজ সংগঠন, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা, যাকাত আদায়, জিহাদ পরিচালনা, মানুষকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ, অমুসলমানদের মধ্যে ইসলাম প্রচার, অপরাধীর বিচার কার্য সম্পাদন করে সমাজে পূর্ণাঙ্গরূপে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন।

 

        তিনি তাঁর তৎপরতাকে আমাদের জন্য মডেল হিসেবে উপস্থাপন করে আমাদের একথাই বুঝাতে চেয়েছেন যে, ইসলাম প্রচার, জিহাদ পরিচালনা, মসজিদে নামাজ পড়া, রোজা রাখা, জাকাত আদায়, হজ্জ পালন, তাওহীদে বিশ্বাস স্থাপন, মানুষকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ, অপরাধকে ঘৃণা করা ও অপরাধের মূলােচ্ছেদ করা, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য খোদাভীরু লােকের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, জুলুমের প্রতিরোধ করা প্রভৃতি তৎপরতা নিয়েই ইসলাম। এর প্রতিটি তৎপরতা ইসলাম নামক যন্ত্রের এক একটা পার্টস বা অংশ। এর প্রতিটি অংশ একটির ওপর অন্যটি নির্ভরশীল। এর যে কোন অংশের অভাবে ইসলামী সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। যে অংশের গুরুত্ব যত বেশী সে অংশের অভাবে সমাজে তত বেশী ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। যাকাত আদায়, জুলুমের বিরুদ্ধে জিহাদ, অপরাধের মূলােচ্ছেদের জন্য ন্যায় বিচারক নিয়োগ, ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য সৎ ও পরহেজগার নেতৃত্ব ও প্রশাসন প্রভৃতি ইসলামের মৌলিক ভিত্তির অভাবে সমাজে আরও ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা ঘটতে বাধ্য।

 

        ইসলামের প্রতি শত্রুতা পোষণকারী এদেশের আবুজাহেল ও আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের উত্তরসূরীরা সে সুযোগটিই কাজে লাগাতে চাইছে। এদেশের মুসলমানরা ইসলামী রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে ইসলামী সরকার গঠন করে দেশে পূর্ণাঙ্গ রূপে ইসলামকে প্রতষ্ঠিত করুক এটা ওদের কাম্য নয় বলেই আজ সংসদ, রাজপথে ইসলামী রাজনীতি চর্চা নিষিদ্ধ করার দাবীতে গলাবাজী চলছে। ওরা চায় ইসলামের উক্ত মৌলিক দাবীসমূহ অপূর্ণ রেখে সমাজকে চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার মধ্যে নিমজ্জিত করে মানুষের মন থেকে ইসলামী চেতনাকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে দেয়া।

 

       এহেন ইসলাম বিরোধীতার হেতু কি? নাস্তিক চক্র আব্দার জানাচ্ছে, এদেশে ইসলামী রাজনীতি চলবে না, চলবে সেকুলারিজম, তথাকথিত পাশ্চাত্য গণতন্ত্র অথবা ইসলাম বিরোধী কমুনিজম। একথার মাধ্যমে ওরা এটাই প্রমাণিত করতে চায় যে, ইসলাম একটি নিকৃষ্ট (?) জীবন ব্যবস্থা অথবা ইসলামী রাজনীতি আধুনিক যুগে অচল। আমরা জানি, ইসলাম সম্পর্কে এই অযুক্তিক মূল্যায়ন পাশ্চাত্যের সেকুলার গণতন্ত্রপন্থী ও মার্ক্সবাদী পণ্ডিতদের থেকে এদেশের নষ্ট বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা চেতনায় পাচার হয়ে এসেছে অথবা মগজ ধোলাই করে তাদের মস্তিষ্কে ফিট করে দেয়া হয়েছে। মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই ইউরোপ জাহেলিয়াতের অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। যদিও বর্তমানে তারা বৈষয়িক ও কারিগরি বিদ্যায় সাফল্য লাভ করেছে, কিন্তু মানবতার ছিটে ফোটাও তারা লাভ করতে পারেনি। মানবতার সঠিক সংজ্ঞা সম্পর্কেই তারা অজ্ঞ। প্রাথমিক যুগে মানবতার পথ প্রদর্শক সকল নবী রাসূল (আঃ) -গণ পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে (মধ্য প্রাচ্যে আগমন করেন, যা ছিল ইউরোপ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। এসব স্থান থেকে মানবতার বাণী পাহাড় পর্বত ও সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌছার পূর্বেই বিকৃত হয়ে যেত। যারা এ বাণীর ধারক বাহক হয়ে ইউরোপে পৌছাত তাদের অধিকাংশই নবী (আঃ) গণের বাণীকে অতিরঞ্জিত ও বিকৃত করে ফেলে নিজেদের কৃতিত্ব লাভের চেষ্টা করতো। ফলে ইউরোপের মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ভ্রান্তির মধ্যেই দিন কাটায়। সপ্তম শতাব্দীতে মুসলমানগণ ইউরোপে ইসলামের আলাে পৌঁছালেও তাদের আজন্ম গোড়ামীর কারণে তা গ্রহণ করেনি।

 

        বিকৃত ইহুদী ও খৃস্টান ধর্মগুরুরা নিজস্ব আইন রচনা করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে যেভাবে ইচ্ছে পরিচালনা করত। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা শাসনের নামে শোষণ, অত্যাচার চালাত। মূলত এসব ধর্মে রাষ্ট্র পরিচালনার কোন সুস্থ বিধি-বিধানের অস্তিত্ব ছিল না। তাই প্রয়োজন মাফিক যে কোন শাসক, পাদ্রী বা পোপ তাদের স্বার্থের অনুকুলে ধর্মের নামে আইন রচনা করে নিত। ধর্মগুরুদের এই স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সাধারণ জনগণ সর্বদাই মজলুম হত, ধর্মকে তারা দানব হিসেবে গণ্য করত। কালক্রমে তাদের মন থেকে ধর্মের প্রভাব মুছে যেতে থাকে এবং এ দানবের কবল থেকে সমাজকে মুক্ত করার পথ খুঁজতে থাকে। বিপ্লব, প্রতিবিল্পব, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলার পথ ধরে ইউরোপের রাজনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। রাজ, সামন্ততন্ত্র, চার্চতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, গণতন্ত্র, সমাজ ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি বহু, ইজমের উদ্ভব হয়। রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করা হয় শুধুমাত্র স্বেচ্ছাচারী ও স্বার্থলােলুপ ধর্মগুরুদের ধর্মের নামে অত্যাচার নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য। যদি বিকৃত খৃষ্টবাদে সুষ্ঠু রাষ্ট্র পরিচালনার কোন বিধান থাকত তবে ইউরোপের রাজনৈতিক অঙ্গণে এত পরিবর্তন ঘটত না। স্বভাবতই মানুষ ভাল কিছুর পরিবর্তন চায় না। মধ্য যুগে ইউরোপে ধর্মের নামে বর্বরতা এত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল যে, আজও যদি কোন ইউরোপিয়ান ধর্মীয় রাজনীতির কথা বলে তবে অন্যান্যরা প্রশ্ন করে, “তুমি কি সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ফিরে যাওয়ার কথা বলছ?” ইউরোপের খৃষ্টবাদের সাথে ইসলামের ক্রুসেডকালীন শত্রুতা ও ধর্মীয় বৈরিতা এবং ইউরোপীয়ানরা নিজেদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাতা রূপে কল্পনা করার কারণে এসব খৃষ্টান পণ্ডিত ইসলামকেও খৃষ্টবাদের ছাচে ফেলে মূল্যায়ন করছে।

 

        তারা না জেনে শুনে ধরে নিয়েছে যে, মধ্য যুগে ইসলামও খৃষ্টবাদের ন্যায় বর্বর আচরণ করেছে, মানবতাকে নির্মম ভাবে মথিত করেছে। ইসলাম বিদ্বেষী পোপ পুরোহিতদের বধৌলতে তারা ইসলাম সম্পর্কে এতটুকুই জানতে পেরেছে, “ইসলাম মানুষের সৃষ্ট ধর্ম, এর সকল বিধি বিধান জাহেলিয়াতের চেয়েও নিকৃষ্ট!” সুতরাং তারা এক বাক্যে আওয়াজ তুলেছে, “হোক মুসলিম, হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদী দেশ, সর্বত্রই রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদ করতে হবে, ধর্ম বর্বরতার প্রতীক, মানবতার শত্রু।” ইসলাম সম্পর্কে বিকৃত মানসিকতার ধারক এসব পণ্ডিতদের সুরে সুর মিলিয়ে এদশীয় সেকুলার ও নষ্টা বুদ্ধিবাজ.ও বখাটে রাজনীতিকরা হরদম আব্দার জানাচ্ছিল, “ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ কর, রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করে ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা কর, মসজিদে রাজনীতি বন্ধ কর” ইত্যাদি। বর্তমানে তারা আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে দাবী জানাচ্ছে ইসলামের রাজনীতি নিষিদ্ধ কর। ইসলামী রাজনীতি পঁচে গন্ধে পরিবেশ নষ্ট করছে, তাই তার ঘাটাঘাটি বন্ধ করতে হয়, নষ্ট রাজনীতিকরা তেমন একটা ভাব দেখাচ্ছেন যেন এসব পণ্ডিতরা তাদের কৃতি মুরুব্বীদের ন্যায় ইসলামী রাজনীতি সম্পর্কে একেবারেই ব-কলম। মুসলিম ঘরের সন্তান হলেও এরা পাশ্চাত্যের চাকচিক্যময় জীবন ধারায় আকৃষ্ট হয়ে ভ্রষ্ট হওয়ার দরুন ইসলামের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি সম্পর্কে কোন জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ বা প্রয়োজন মনে করেনি। শুধুমাত্র প্রভুদের মুখে যতটুকু ইসলাম সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ, সমালােচনা শুনেছে ততটুকুই গ্রহণ করেছে ও রাজনীতির ময়দানে তাই নিয়ে লম্ফ ঝম্ফ দিচ্ছে। এজন্যই ওরা কাদিয়ানীদের ভ্রান্ত মদবাদ ও বিকৃত ব্যাখ্যা সম্বলিত কিতাবকে ইসলাম ও কুরআন শরীফ বলে ফতোয়া দেয়।

 

        মসজিদ নির্মাণ করে অপকর্মের সয়লাব বইয়ে দেয়ার দরুন মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ হয়ে কাদিয়ানীদের তথাকথিত মসজিদ ভেঙ্গে দিলে ওদের কলিজায়ও চোট লাগে। এই মহল থেকে মুগ্ধের মত ধর্ম নিরপেক্ষতার পক্ষে মোক্ষম ফতোয়া জারী করা হয় এই বলে “তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে।” অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম নিরপেক্ষ যুক্তিই বটে একখানা! ইসলামের সাথে ওদের এত শক্রতার কারণ হল, ইউরোপীয় স্টাইলে ক্ষমতায় আসীন হয়ে এদেশে পাপাচারের সয়লাব বইয়ে দেয়ার পথে ইসলামই একমাত্র বাধা। ওরা পার্লামেন্টে আইন পাশ করে শাসন করবে, কিন্তু ইসলাম ঘোষণা করছে আইন রচনা করে মানুষকে শাসন করার কোন মানুষের অধিকার নেই। আইন করার, বিচার করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর, মানুষ তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করবে মাত্র। ওরা বলছে, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, পক্ষান্তরে ইসলাম তার চ্যালেঞ্জ করে ঘোষণা করেছে, সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর। ইসলাম ধনীদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করে গরীবের অর্থনৈতিক অভাব দূর করে সমাজে স্থিতিশীলতা স্থাপন করতে চাইবে, পক্ষান্তরে ওরা পুঁজিবাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থ হাসিল করবে, যাকাতকে অর্থদণ্ড মনে করে গরীবের হক মেরে দেবে, তাদের শোষন করে নিজেরা অর্থের পাহাড় গড়বে। ইসলাম সমাজে স্থিতিশীলতা, শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সকল প্রকার, অশ্লিলতা, পর্ণোগ্রাফী, মাদকাশক্তি, যৌতুক প্রথা, পতিতাবৃত্তি, পর্দাহীনতা, দুনীতি, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি সকল সামাজিক অপরাধ দূর করবে কিন্তু সেকুলারপন্থীরা প্রগতি, নারী স্বাধীনতা ও মানবতার দোহাই দিয়ে এগুলিকে উঙ্কে দেবে।

 

        ইসলাম সমাজে ইনসাফ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে, কৃষক, মহাজন, শ্রমিক, মালিক, প্রজার মধ্যে সকল পার্থক্য মুছে দিয়ে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে, পক্ষান্তরে ওরা সমাজ ও রাষ্ট্র প্রভু সেজে মানুষের মাঝে আভিজাত্যের দেয়াল তুলে দেবে, মানুষের মাঝে ভেদাভেদ সৃষ্টি করবে। ইসলামী রাজনীতি ওদের আমদানী করা রাজনীতির পুরো বিপরীত হওয়ায় এবং ওদের স্বার্থের পথে প্রতিবন্ধক প্রতিপন্ন হওয়ায় ইসলামী রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার জন্যই ওদের এত মাথা ব্যাথা। কুরআনের আলােকে ইসলামী রাজনীতিঃ আল্লাহ পাক আল কুরআনে ঘোষণা করেছেন, “ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত জীবন বিধান।” (আলে ইমরান -১৯) যেহেতু রাজনীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রার সাথে সম্পর্কিত। তাই আল্লাহর এ ঘোষণার মাধ্যমে প্রমানিত হয় যে, ইসলামে মানুষের দৈনন্দিন সার্বিক সমস্যার সমাধানের সাথে সাথে রাজনীতি তথা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিও ইসলামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাছাড়া মদীনা রাষ্ট্রের প্রধান রাসূল ﷺ -কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ্ অন্যত্র ঘোষণা করেছেন, “লােকদের মধ্যে শাসনকার্য পরিচালনা কর আল্লাহর নাজিল করা বিধান অনুযায়ী এবং লােকদের কামনা। বাসনাকে অনুসরণ করো না।” [আয়াতাংশ- ৪৯, মায়িদা]

 

        এখানে রাসূল ﷺ -কে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন পরিচালনা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এবং মানুষের ইচ্ছানুযায়ী তথা কামনা-বাসনাকে পরিত্যাগ করে শাসন করার স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যত্র মানুষকে উদ্দেশ্যে করে ঘোষিত হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর আনুগত্য কর রাসূলের।” (আয়াতাংশ -৫৯, সূরা নিসা)

 

        আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করার নির্দেশের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী এবং রাসূল ﷺ -এর অনুসৃত পথ অনুযায়ী জীবন যাপন করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ রাসূল ﷺ যে পন্থায় ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন ঈমানদারদের হুবুহু সেই পন্থাই অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। এজন্যই ঘোষিত হয়েছে, “যে লােক রাসূলের আনুগত্য করল। সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।” [আয়াতাংশ -৮০, সূরা নিসা]

 

        ইসলামে রাজনীতি তথা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ আরও স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছেন, “তোমাদের মধ্য থেকে কেবল তারাই হুকুম চালাবে, যারা সুবিচার নীতির অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের ধারক বাহক।” [সূরা মায়িদা]

 

        কিন্তু আমাদের দেশের সেকুলার মহল আল্লাহুর এই শাশ্বত ঘোষণার বিরুদ্ধাচারণ করেই কেবল ক্ষান্ত হয়নি, ভবিষ্যতে যাতে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে সে জন্য ইসলামী রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করার পায়তারা চালাচ্ছে। রাসুল ﷺ -কে আল্লাহর বিধানে অটল থেকে এবং মানুষের কামনা-বাসনাকে উপেক্ষা করে শাসন চালানোর আদেশ করা হয়েছে। অথচ ওরা আল্লাহর বিধানকে উপেক্ষা করে এদের কামনা-বাসনা অনুযায়ী শাসন চালানোর স্পর্ধা দেখাচ্ছে। এদের উদ্দেশ্য করেই আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, “আল্লাহর নাযিল করা যাবতীয় বিধান অনুযায়ী যারা বিচার ফয়সালা করে না তারা কাফের, যালেম, তারা ফাসেক।” [মায়েদা- ৪৪-৪৭]

 

        “আল্লাহ্ এবং তার রাসুল যখন কোন বিষয়ে আদেশ করেন, চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেন, তখন কোন মুমিন পুরুষ-স্ত্রীর জন্য তাদের ব্যাপার সংক্রান্ত এই হুকুম বা ফয়সালা মেনে নেয়া বা না নেয়ার কোন ইখতিয়ারই থাকে না। যদি কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম অমান্য করে, তাহলে সে স্পষ্ট গুমরাহীর মধ্যে পড়ে গেল।” [আহযাব -৩৬]

 

        সর্বশেষ কথাঃ ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি ঘটিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তানকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্দেশ্যে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও ইসলামী আদর্শ থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাইনি অর্থাৎ পাকিস্তানের কর্তৃত্ব থেকে গরিষ্ঠ বেড়িয়ে আসার উদ্দেশ্য এটা ছিল না যে, আমরা ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্য থেকেও দূরে সরে যাচ্ছি। সেকুলারিজম ও নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশের মানুষ সংগ্রাম করেনি। ইসলাম মানেই পাকিস্তান নয় যে পাকিস্তানের সাথে বিচ্ছিন্নতা মানে আমাদের সাথে ইসলামেরও বিচ্ছিন্নতা ঘটবে। বরং মুসলমান যে পরিবেশে, যে সমাজে বা যে ভূখণ্ডেই অবস্থান করুক না কেন আল্লার দ্বীন ইসলামকে সে ভূ-খণ্ডে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা তার অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার দেয়া হয়েছে। তাই সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্ম পালনের অংশ হিসেবে ইসলামী রাজনীতি চর্চা করা সাংবিধানিক অধিকারও বটে। আর এতে বাধা প্রদান করা এ অধিকারে তথা মৌলিক নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করারই নামান্তর। গুটিকতেক নাস্তিক ও সেকুলার রাজনীতিককে কে অধিকার দিয়েছে যে, তারা মুসলমানদের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করার দুঃসাহস দেখায়? আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী জালিম, ইসলামদ্রোহী বলে বিবেচিত হয়েও তারা এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী বাতিল মতবাদ নিয়ে হৈ চৈ করার অধিকার কোথায় পেল? এদেশে ইসলামী রাজনীতি চলবে কি চলবে না তা ইসলামে বিশ্বাসী জনগণ ও তাদের বিবেক আলিমগণই নির্ণয় করবেন, মানবতা ও ইনসাফের মুষ্টিমেয় শত্রুরা নয়। ইসলাম এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম। সুতরাং এদেশে একমাত্র ইসলামী রাজনীতি চলবে এটাই বাস্তবতা। যারা ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ইসলামের। ওপর আঘাত হানতে চায় এবং ইসলাম বিরোধী মতবাদ কায়েম করতে চায়, এদেশে তাদের বাতিল মতবাদ আমদানী ও তার সম্প্রচার নিষিদ্ধ করাই ইনসাফ।

 

*****