রমযান,ইতেকাফ ও লাইলাতুল কদরের তাৎপর্য ও আবেদন
মুহাম্মাদ মহিউদ্দীন
==============================================================
হযরত সালমান ফারসী (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) এক শাবানের শেষ দিবসে জনতার উদ্দেশ্যে তাঁর খুতবায় বলেনঃ “হে লোক সকল! তোমাদের সম্মুখে এমন একটি মর্যাদা সম্পন্ন পবিত্র ও বরকতময় মাস সমাগত যার একটি রজনী (শবে কদর) হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। সেই মাসে আল্লাহ তাআলা রোযা ফরজ করেছেন এবং রাত্রিকালে মহান আল্লাহর দরবারে দণ্ডায়মান হয়ে নফল ইবাদতের বিধান দিয়েছেন। যে ব্যক্তি সেই মাসে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য সুন্নত বা নফল ইবাদত পালন করে, বিনিময়ে তাকে অন্য সময়ের ফরজের সমান সওয়াব দেয়া হবে। আর যে একটি ফরজ আদায় করবে তাকে দেয়া হবে সত্তরটি ফরজের সমান সাওয়াব।
রমযান ধৈৰ্য্য, সহনশীলতা, সমবেদনা ও সহমর্মীতার মাস। ধৈৰ্য্য বা সবরের বিনিময় হলো জান্নাত। এই মাসে ঈমানদারের জীবিকা বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। যে কোন ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাওয়াব লাভের আশায় কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে, তাঁর (সগীরা) গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে এবং দোজখের আযাব থেকে মুক্তি দেয়া হবে। উপরন্তু তাকে রোযাদার ব্যক্তির পূর্ণ সাওয়াব দেয়া হবে কিন্তু রোযাদারের সাওয়াবে কোন ঘাটতি হবে না। জিজ্ঞাসা করা হলো যে, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের প্রত্যেকের তো অন্যকে ইফতার করাবার সামর্থ্য নেই। তাহলে কি গরীব যারা তারা এমন সাওয়াব থেকে মাহরূম থাকবে? উত্তরে রসূলে করীম (স) বললেনঃ
“এই সাওয়াব আল্লাহ্ তায়ালা তাকেও দিবেন যে কিঞ্চিত দুধ কিংবা সামান্য পানি দ্বারা কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে। (এতটুকু সামর্থ্যও কি কারো নেই?)”
অতঃপর তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে তৃপ্তির সাথে খানা খাওয়াবে, আল্লাহ্ তাকে আমার কাওসার দ্বারা এমন ভাবে তৃপ্ত করাবেন যে, বেহেশতে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত তার আর পিপাসা অনুভূত হবে না।এই পবিত্র মাসের প্রথমাংশ রহমত, মধ্যমাংশ মাগফেরাত ও শেষাংশ হলো জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ। যে ব্যক্তি এই মাসে ক্রীতদাস ও শ্রমিক-মজুরদের শ্রম লাঘব করে দিবে; আল্লাহ্ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং তাকে দোজখ থেকে মুক্তি দিবেন।” (বায়হাকী)
উল্লেখ্য যে, রমযান মাসকে মহানবী (স) ধৈৰ্য্য, সহনশীলতা, সমবেদনা ও সহমর্মিতার মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইসলামের পরিভাষায় "সবর" বা ধৈৰ্য্য বলা হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রবৃত্তি দমন করে অন্যায় ও অপকর্ম থেকে বিরত থাকা এবং কষ্ট হলেও আল্লাহর নির্দেশাবলীকে যথাযথভাবে পালন করা। রমযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি রোযায় সবর বা ধৈর্যের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে। রোযা রেখে রোযাদার হাড়ে হাড়ে টের পায় যে, দারিদ্র আর ক্ষুধার জ্বালা কাকে বলে। এতে গরীব মিসকিনদের প্রতি খাঁটি রোযাদারদের সমবেদনা ও সহানুভূতি জাগ্রত হয়। রমযান মাসে ঈমানদারদের রুজি বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। তাই দেখা যায় যে, রমযান মাসে রেমাযাদারগণ অন্য মাসের তুলনায় স্বচ্ছলতার সাথে উত্তমভাবে পানাহার করে থাকে। বস্তুতঃ এই বস্তু জগতে মানুষ যে ভাবেই যা লাভ করুক তা আল্লাহর ফয়সালায়-ই হয়ে থাকে। তিন শ্রেণীর লোক রমযানের ফজীলত ও বরকত লাভ করে উপকৃত হবেন।
প্রথমতঃ যারা নেক ও সৎকর্মশীল এবং সর্বদা তাকওয়া ভিত্তিক জীবন-যাপনে অত্যন্ত। রমযানের প্রথমাংশ এদের জন্য রমহত। প্রথম দিন থেকেই এদের উপর আল্লাহর রহমতের বারিধারা বর্ষিত হতে শুরু হয়।
দ্বিতীয়তঃ যারা এই পর্যায়ের পরহেযগার বা মুত্তাকী নন বটে কিন্তু প্রথম শ্রেণীর তুলনায় খুব মন্দও নন। এ ধরণের লোকদের জন্য রমযানের মধ্যমাংশ হলো মাগফেরাত। প্রথম দশদিন এরা বিভিন্ন আমল ও তাওবা এস্তেগফার দ্বারা নিজেদের অবস্তার উন্নতি সাধন করে এবং নিজেদেরকে মাগফিরাতের বা ক্ষমার উপযুক্ত করে তুলেন। অতঃপর রমযানের মধ্যমাংশে আল্লাহ্ তায়ালা তাদের জন্য ক্ষমার ফয়সালা করে দেন।
তৃতীয়তঃ যারা নিজেদের উপর সীমাহীন জুলুম করেছেন এবং বদ আমলের কারণে জাহান্নামের উপযুক্ত হয়ে গেছেন। রমযানের শেষাংশ তাদের জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তির বার্তা বয়ে আনে। প্রথম ও মধ্যমাংশে তাঁরা অন্যান্য মুসলমানদের সাথে রোযা পালন করে তাওবা এস্তেগফারের মাধ্যমে নিজেদের পাপের বোঝা লাঘব করে নিতে পারলে শেষ দশদিন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দোজখ থেকে মুক্তি দান করেন। এভাবে আল্লাহ তায়ালা সমগ্র মুসলিম মিল্লাতকে স্বীয় রহমতের কোলে তুলে নেন।
রোজার মূল্য ও প্রতিদান
------------------------------------------------------------------
হযরত সাহল ইবনে সাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সঃ) বলেন,“জান্নাতে বাবুর রাইয়্যান (তৃপ্তদের দ্বার) নামক একটি দরজা আছে। কিয়ামতের দিন সেই দরজা দিয়ে শুধু রোযাদারগণই বেহেশতে প্রবেশ করবেন অন্য কেউ সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন না। সেদিন উচ্চ স্বরে ঘোষণা করা হবে যে, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রমযান মাসে রোযা রেখে ক্ষুধা পিপাসার কষ্ট সহ্য করেছে তারা আজ কোথায়? তখন রোজাদারগণ উঠে দাঁড়িয়ে উল্লেখিত দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অতঃপর দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।” (বুখারী, মুসলিম)
উল্লেখ্য যে, রমযান মাসে রোযার ব্যাপারে যে বস্তুটি সবচেয়ে বেশী অনুভূত হয় এবং সর্বাধিক ত্যাগ বলে বিবেচিত, তা হলো পিপাসা। তাই এর বিনিময়ে যে প্রতিদান ও পুরস্কার দেয়া হবে তন্মধ্যে পিপাসা নিবারণই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে ইংগিত করেই রোযাদারদের। বেহেশতে প্রবেশের দরজাকে “বাবুর রাইয়ান” (তৃপ্তদের দ্বার) নাম করণ করা হযেছে। জান্নাতের প্রবেশের পর রোযাদারকে কি পুরস্কার দেয়া হবে তা আল্লাহই ভাল জানেন। তিনি নিজেই বলেছেনঃ “রোযা কেবল আমার জন্য আর আমিই দেব এর পুরস্কার।”
রোযা এবং কুরআনের সুপারিশ
------------------------------------------------------------------
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত যে, রাসূলে করীম (সঃ) বলেনঃ “রোযা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে,হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে পানাহার এবং যাবতীয় মানবিক চাহিদা থেকে বিরত রেখেছি। অতঃপর আপনি আজ তাঁর জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তার রাতের আরামের নিদ্রাকে হারাম করেছিলাম। অতঃপর আজ তার জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। আল্লাহ তায়ালা বান্দার জন্য রোযা ও কুরআন উভয়ের সুপারিশই কবুল করে নিবেন এবং জান্নাত ও মাগফেরাতের ফয়সালা করে দিবেন।”
রোযার দাবী
------------------------------------------------------------------
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “যে ব্যক্তি রোযা রেখে মিথ্যা কথা ও অনর্থক কাজ ত্যাগ করবে না, তার পানাহার ত্যাগ করায় আমার কোন প্রযোজন নেই।” অর্থাৎ রোযা রেখে মিথ্যা ধোকাবাজী কুসংস্কার, শিরক, বেদআত ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত না হলে এমন, রোযা কোন কাজে আসে না।
এতেকাফ
------------------------------------------------------------------
ইবাদতের উদ্দেশ্যে সাংসারিক কাজকর্ম হতে অবসর গ্রহন করে মসজিদে অবস্থান করাকে এ'তেকাফ বলা হয়। হানাফী মতে এ'তেকাফ তিন প্রকার।
(১) ওয়াজিব এ'তেকাফ-নযর ও মান্নতের এতেকাফ এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। কোনো ব্যক্তি যদি মনস্থ করে যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে বা অমুক আশা পূর্ণ হলে আমি এতেকাফ করবো অথবা এমনিতেই যদি কেউ নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত এ'তেকাফ করার নিয়ত করে, তবে তার উপর এ এতেকাফ ওয়াজিব হয়ে যায় এবং নিয়তকৃত মেয়াদ পূর্ণ করা তার জন্য কর্তব্য হয়।
(২) সুন্নত এ'তেকাফঃ রম্যান শরীফের শেষ দশ দিনের এতেকাফ এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। রসূলুল্লাহ (সাঃ) এ দিনসমূহে এতেকাফ করেছেন। রমযানের বিশ তারিখ সন্ধ্যা অর্থাৎ সূর্যাস্তের সময় থেকে তা শুরু করতে হয় এবং ঈদের দিনের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এর মেয়াদ! এই এ'তেকাফ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা- এ কেফায়া।
(৩) মোস্তাহাব বা নফল এতেকাফঃ ওয়াজিব এবং সুন্নত এতেকাফ ছাড়া সব এতেকাফই মোস্তাহাব। বছরের সকল দিনেই এ এ'তেকাফ পালন করা যায়। ফযীলতের কারণে স্বল্প মেয়াদের জন্যে হলেও সকলের এতেকাফে যাবার চেষ্টা করা উচিত। রমযানের বিশ তারিখ বহু রোযাদার মসজিদে এতেকাফে বসেন। দুনিয়াবী সকল চিন্তাভাবনা ও কায়কারবার থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে রমযানের শেষদশ দিন কোনো মসজিদের এক কোণে অবস্থান নেন। এতেকাফের অনেক সওয়াব রয়েছে। খোদ আল্লাহর রসুল এ'তেকাফের ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন। এ'তেকাফের দ্বারা নির্ঝঞ্জাটের মধ্য থেকে একনিবিষ্ট চিত্তে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা যায়। এ সময়টির মধ্যে কায়মনোবাক্যে কুরআন তেলাওয়াত, নফল নামায, যিকির-ফিকির, তসবীহ-মুনাজাত ইত্যাদির মধ্য দিয়ে একজন লোক আত্মশুদ্ধির এক মহত্তর স্তরে নিজেকে পৌছাতে পারে। মহাপ্রভু আল্লাহ তাআলার নিকট তার কোন ভক্তের সম্পূর্ণ একাকিত্বে অখণ্ড মনে দোয়া মোনাজাত করা এবং তাঁর স্মরণে নিযোজিত থাকা এমনিতেও অতি প্রিয় কাজ। উপরন্তু এতেকাফে মাহে রমযানের পুণ্যময়:দিবসরজনী একই অবস্থায় থাকাটা যে আত্মশুদ্ধির জন্যে কত বেশী সহায়ক তা সহজেই অনুমেয়। রমযানে তারাবীহ, নফল নামায, কুরআন অধ্যয়ন, যিকির-ফিকির তাসবীহখানী ইত্যাদি কাজগুলো হুকুমের দিক থেকে অপরিহার্যতার পর্যায়ভুক্ত না হলেও আরও নানান দিকের বিচারে এগুলোর সওয়াবের পরিমাণ রমযান মাসে অধিক হয়ে থাকে। যেমন পবিত্র কুরআন মজীদে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,
“তারা আপন প্রভুর উদ্দেশ্যে নামাযে দণ্ডায়মান এবং সিজদার মধ্য দিয়ে রাত্রি যাপন করে। আর (এ বলে আমার নিকট প্রার্থনা জানায় যে,)-হে প্রভু! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তিকে দূর করে সরিয়ে রাখো।”
কুরআন মজীদের অন্যত্র মহানবীর প্রতি ইরশাদ হয়েছে, "আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাতে ঘুম থেকে জাগা কু-প্রবৃত্তির দমনের একটি কঠোর পন্থা এবং বক্তব্য হিসেবে সুদৃঢ়। দিনের বেলা তোমার অনেক ব্যস্ততা থাকে। সুতরাং রাতের বেলা তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করো এবং সকল কিছুর সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র তাঁর দিকেই রুজু হয়ে যাও।”
উল্লেখ্য যে, মহানবীর দিনের বেলায় কর্মতৎপরতা নবুয়তী কাজের বাইরে ছিলো না, তার পরও রাতের গভীরে আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ রুজু হবার নির্দেশ থেকে একান্ত আল্লাহর ধ্যানের গুরুত্বই স্পষ্ট হয়ে ওঠে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের এ মহৎ কাজগুলো মাহে রমযানের মধ্যে বিশেষ করে রাতের অংশে এবং এতেকাফের ও মহিমান্বিত শবে কদরে অধিক কল্যাণবাহী হয়ে থাকে। আর এমনি করে এগুলো রোযার অপরিসীম সওয়াব প্রাপ্তিতে ও রোযার মূল লক্ষ্য অর্জনে সোনায় সোহাগার কাজ করে। এভাবে ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নত-নফল ইত্যাদি আমলের সওয়াবের অধিকারী ব্যক্তি সম্পকেই হাদীসে সে শুভ সংবাদ প্রযোজ্য হয়, যেখানে বলা হয়েছে, "যে ব্যক্তি যথারীতি রমযানের রোযা পালন করে সে যেন সদ্য জন্ম-নিষ্পাপ শিশুর ন্যায় মাসুম বেগুনাহ বান্দায় পরিণত হয়।"
আল্লামা ইবনে কাইয়ুম বলেন, ‘এতেকাফের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য হলো আল্লাহর ইচ্ছার সাথে নিজেকে একাকার করে নেয়া।’ এ'তেকাফকারী দুনিয়ার সব ভুলে গিয়ে প্রভুপ্রেমে এতই বিভোর হয়ে পড়ে যে, তার সকল ধ্যানধারণা, চিন্তা-ভাবনা একমাত্র তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়, সংসারের সকল সম্পর্ক ছিন্ন একমাত্র আল্লাহর সাথেই সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ সম্পর্ক ও ভালোবাসা তার করবের সঙ্গী-সাথীহীন অবস্থায় সহায়ক হবে। মারাকিউল ফালাহ কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে, এ'তেকাফ আন্তরিক নিষ্ঠা সহকারে পালিত হলে তা বান্দার আমলসমূহকে উত্তমতার চূড়ান্ত মনযিলে পৌঁছায়। কারণ, এতে বান্দা দুনিয়ার সকল কিছুর মায়া ভুলে একমাত্র আল্লাহরই পানে মুখ ফিরায়। সর্বতোভাবে প্রভুর সমীপে আত্মনিবেদন করে এবং তাঁরই করুণার দুয়ারে মাতা ঠোকে। তদুপরি এতেকাফের প্রতিটি মুহূর্ত এবাদাতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়, কেননা এতেকাফকারীর শয়ন-স্বপন সব কিছুই ইবাদতের মধ্যে গণ্য! তিনি সর্বক্ষণ আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হন।
হাদীস শরীফে আছে, "যে ব্যক্তি আমার প্রতি এক বিঘত অগ্রসর হয় আমি তার পানে এক হাত অগ্রসর হই। যে আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।”
মাসআলা
------------------------------------------------------------------
পুরুষের জন্যে এ'তেকাফের সর্বোত্তম স্থান হলো মসজিদুল হারাম, অতঃপর বায়তুল মোকাদ্দাসের মসজিদ, তারপর ঐ মসজিদ যেখানে জুমার জামায়াত অনুষ্ঠিত ইমাম আযম আবু হানিফা (র)-এর মতে, যে মসজিদে পাঞ্জেগানা নামায জামায়াতে আদায় করা হয় , সে মসজিদে এতেকাফ করা চলে। ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদের মতে শরীয়তের দৃষ্টিতে যে ‘মসজিদ’ বলে স্বীকৃত, তাতে পাঞ্জেগানা জামাত রীতিমতো না হলেও এতেকাফ করা দুরস্ত আছে।
মহিলাদের এতেকাফ
------------------------------------------------------------------
মহিলারা পারিবারিক পরিমণ্ডলে নির্দিষ্ট মসজিদে বা নামাজের কামরায় এতেকাফ করবেন। কোনো নির্দিষ্ট স্থান না থাকলে ঘরের কোনো একটি নির্জন কোণ এতেকাফের জন্য বেছে নেয়া উচিত। পুরুষের তুলনায় স্ত্রীলোকের এ'তেকাফ সহজসাধ্য। তারা ঘরের অন্যের দ্বারা গৃহকর্ম করিয়ে সাংসারিক কাজ চালিয়ে যেতে পারেন অথচ এতেকাফের সওয়াবেরও অধিকারী হতে পারেন। আমাদের মহিলা সমাজের জন্যে পারিবারিক পরিমণ্ডলে শিশুদের হৈচৈ কিংবা অন্যান্যদের কথা বার্তার আওয়াজ থেকে দূরে থেকে একনিবিষ্ট চিত্তে আল্লাহর ইবাদতের সুযোগ পালন খুব কমই হয়ে থাকে। এ ব্যাপারটির প্রতি যাদের সামর্থ্য আছে তারাও গুরু দেন না। অথচ নির্জন পরিবেশ ছাড়া ঘরের লোকদের কথাবার্তা ও ছেলেমেয়েদের আনাগোনার মধ্যে নামায, ইবাদত কিছুই ঠিকমত মন দিয়ে করা যায় না।
এতেকাফে যেসব কাজ জায়েয
------------------------------------------------------------------
(১) পেশাব পায়খানার প্রযোজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া,
(২) গোসল। ফরয হলে গোসলের জন্যে বের হওয়া,
(৩) জুমার নামাযের জন্য বেলা ঢলে যাবার পর কিংবা এতটুকু আগে বের হওয়া যে জামে মসজিদে গিয়ে খুৎবার আগে চার রাকাত সুন্নত পড়া যায়),
(৪) পেশাব-পায়খানার জন্যে জায়গা যতদূরেই হোক যেতে পারবে,
(৫) মসজিদে খানা-পিনা, শোয়া, দরকারী কিছু কিনে নেয়া যা মসজিদে নেই, জায়েজ রয়েছে।
যেসব কারণে এ'তেকাফ নষ্ট হয়
------------------------------------------------------------------
(১) এ'তেকাফ অবস্থায় স্ত্রীর শয্যাসঙ্গী হওয়া, যদিও সেটা ভুলেই হয়ে যাক না
(২) বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃতভাবে বাইরে যাওয়া।
(৩) কোন ওজরে মসজিদ থেকে বাইরে যাবার পর প্রযোজনাতিরিক্ত সময় সেখানে অবস্থান করা।
(৪) রোগ কিংবা ভয়জনিত কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া। এ সকল অবস্থায় এতেকাফ বিনষ্ট হয়।
যে সকল কারণে এ'তেকাফ মাকরূহ হয়
------------------------------------------------------------------
(১) সম্পূর্ণ নীরব থাকা এবং কারুর সাথে আদৌ কথা না বলা। (২) মসজিদে পণ্য সামগ্রীর ক্রয়-বিক্রয়।
(৩) কলহদ্বন্দ্ব ও বাজে কথা চর্চা করা।
এতেকাফে মোস্তাহাব কাজ
------------------------------------------------------------------
(১) কথা বলার সময় নেকীর কথা বলা।
(২) কুরআন মজীদ তেলাওয়াত করা।
(৩) দরুদ শরীফ পড়া।
(৪) নফল নামায পড়া।
(৫) দ্বীনী ইলম হাসিল করা কিংবা অপরকে শিক্ষাদান করা।
(৬) ওয়াজ-নসীহত করা
(৭) মসজিদে এতেকাফ করা।
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন, একদা রমযান মাসে রসূলুল্লাহ প্রথম দশক এ'তেকাফ করলেন। তারপর মধ্যবর্তী দশকেও। অতঃপর তিনি যে তাঁবু খাটিয়ে এতেকাফ করছিলেন, সেই তুর্কী তাঁবুর মধ্য হতে মাথা বের করে আমাদের সম্বোধন করে বললেন, “আমি শবে কদরের প্রথম দশকে এতেকাফে কাটালাম। অতঃপর মধ্যবর্তী দশকও কাটালাম। তারপর এক আগন্তুক (ফিরিশতা) এর মাধ্যমে আমাকে জানানো হলো যে, এটা শবে কদর মাসের শেষ দশক। সুতরাং যারা আমার সাথে এতেকাফে আছে, তাদের শেষ দশকও এতেকাফে কাটানো উচিত। আমাকে এ রাতটি দেখানো হয়েছিল। কিন্তু পরে তা আমাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি সে রাতের প্রত্যুষে কাঁদা মাটিতে সেজদা করেছি। সুতরাং তোমরা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতসমূহে শবেকদরের অনুসন্ধান করো।”
বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন, সে রাতটিতে বৃষ্টি হয়েছিল। মসজিদ ছিল ছাপড়ার বৃষ্টির ফলে ছাদ দিয়ে পনি ঝরছিল। আমি স্বচক্ষে সেই ভোরে রসূল করীম (সাঃ)- এর ললাটে কাদা মাটির চিহ্ন দেখেছি, এটা ছিল ২১ রমযানের ভোর বেলা।
শবেকদর-মহিমান্বিত রাত
------------------------------------------------------------------
আল্লাহ তায়ালা গোটা বছরের সকল রাতের মধ্যে যে একটি রাতের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, সেটি হলো 'লাইলাতুল কদর’ -মর্যাদার রাত। তাঁর ভাষায়ঃ “আমি এক মর্যাদার রাত লাইলাতুল কদরে (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি। কদর রজনীর গুরুত্ব ও মাহাত্ম সম্পর্কে আপনি অবগত আছেন কি?-কদর রজনী হচ্ছে হাজার মাসের চাইতে শ্রেয়। অসংখ্য ফিরিশতা ও জিবরাঈল ঐ রাতে তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে প্রতিটি কল্যাণের বস্তু নিয়ে যমীনে অবতীর্ণ হন। এ রাতটি আগাগোড়াই শান্তিময়-সালাম। এমন কি ফজর তথা সোবহে সাদেক প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকে।” এ রাতের মর্যাদা সম্পর্কে দু' একটি হাদীস এখানে উদ্ধৃত করছিঃ
(১) হযরত আবু হুরাইরারা রাঃ এর বর্ননা মতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কদরের রাতে সওয়াব হাসিলের আশায় (ইবাদতের জন্যে) দাঁড়ায়, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। - (তারগীর বঃ মঃ উদ্ধতিসহ)।
হযরত ওমর (রাঃ) এশার নামায পড়ে ঘরে তশরীফ নিয়ে যেতেন এবং ফজর পর্যন্ত নফল নামায পড়ে রাত কাটিয়ে দিতেন। শবেকদর রহস্যাবৃত থাকা সম্পর্কে ওলামা- এ-মুহাদ্দেসীনের মত হলো এই যে,
(১) নির্দিষ্ট করা হলে অনেক গাফেল লোক অন্যান্য রাতে ইবাদত করাই ছেড়ে দেবে।
(২) অনেক লোক রয়েছে যারা পাপকর্মে লিপ্ত হত, তবে তা তার জন্যে অধিক বিপজ্জনক হতো। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা প্রণিধানযোগ্য। একবার নবী করীম (সাঃ) দেখলেন, এক সাহাবী মসজিদে ঘুমাচ্ছেন। তিনি হযরত আলীকে বললেন, আলী যেন ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগিয়ে ওযু করতে বলেন। হযরত আলী এ নির্দেশ পালন করার পর হুজুরকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি তো সকল পুণ্যকাজেই অগ্রগামী, এ ব্যাপারে আপনি নিজে তাকে না বলে আমাকে দিয়ে জাগানোর ও বলানোর তাৎপর্য আছে কি? হুযুর (সাঃ) বললেন, আমার ভয় হয়, ঘুমের ঘোরে পাছে সে ব্যক্তি গাত্রোত্থান করতে অসম্মত হয় আর নবীর কথা অমান্য করায় কুফরীতে নিপতিত হয়ে পড়ে। তোমার কথায় অস্বীকৃতি জানালে কুফরী হতো না।
(৩) শবেকদর নির্দিষ্ট থাকলে এবং ঘটনা চক্রে কোনো ব্যক্তি উক্ত রাতে এবাদত হতে বঞ্চিত হলে, এ শোকে সে পরবর্তী রাতগুলোতে আর ইবাদতের জন্যে জাগতে পারতো না।
(৪) শবেকদরের ইবাদত করার উদ্দেশ্যে যে সব রাতে জাগরণ করা হয়, সে সব রাতের স্বতন্ত্র নেকী পাওয়া যায়। সাহাবা-ই-কেরাম (রাঃ) রাতের নফল নামাযে এক এক রাকাতে পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করে দিতেন।
(২) হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন শবে কদর উপস্থিত হয়, তখন জিব্রাঈল (আঃ) একদল ফিরিশতা সহ পৃথিবীতে অতবরণ করেন এবং দাঁড়ানো বা বসা অবস্থায় আল্লাহর স্মরণে রত বান্দাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, তারপর ঈদের দিন যখন রোযা ভাঙ্গার সময় আসে, তখন আল্লাহ তাআলা ফিরিশতাদের কাছে তাঁর বান্দাদের নিয়ে গর্ব করে বলেন,
“ফিরিশতাগণ! মজুর তার কার্য সম্পাদন করলে তার প্রতিদান কি?” জবাবে ফিরিশতাগণ আরয করলেন, প্রভু! পূর্ণ পারিশ্রমিক দান করাই তার প্রতিদান। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে আমার। বান্দারা! যাও, আমি তোমাদের মাফ করে দিলাম এবং তোমাদের পাপরাশিকে নেকীতে পরিবর্তিত করে দিলাম।”
শবেকদর রহস্যাবৃত থাকার তাৎপর্য
------------------------------------------------------------------
রমযানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোর কোনো একটিতে শবেকদর হয়ে থাকে। এর প্রত্যেকটিতে এ মহিমান্বিত রজনীটি অনুসন্ধান করার জন্য রসুল (সাঃ) হুকুম করেছেন। বলা বাহুল্য, এদিক থেকে এতেকাফে উপবিষ্ট ব্যক্তিরাই অতি ভাগ্যবান। কেননা তারা রমযানের। দশদিনের প্রত্যেকটি দিনেই সওয়াব লাভের সে সুযোগ নিতে পারেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে সিয়াম, ইতেকাফ ও শবেকদরের নেকী লাভের পূর্ণ তওফীক দান করুন।