জীবন পাথেয়
দয়াময়ের শ্রেষ্ঠ নিয়ামত আল-কুরআন
কামরুজ্জামান লস্কর
অনেকদিন আগের কথা। আমার এক জেষ্ঠ্য সহকর্মী বাংলাদেশ থেকে বদলী হয়ে বিদেশে গেছেন। দেশে তার অসুস্থ বৃদ্ধ শ্বশুরকে রেখে গেছেন, যিনি সম্পর্কে তার আপন মামা। ছোটকালে পিতৃহারা হলে এই মামাই তার লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। অতএব এই বৃদ্ধ একাধারে তার শ্বশুর, মাতুল ও পিতা। পরম ভক্তি ডাকেন বাপজান।
বাপজানের অসুখ প্রায়ই কঠিন আকার ধারণ করে। খবর পেয়ে আমার সহকর্মী দেশে ছুটে আসেন। কিছুদিন সেবা শুশ্রুষার পর বাপজান কিছুটা সুস্থ হলে আবার কর্মস্থলে ফিরে যান। কখনো একেবারে যাই যাই অবস্থা হয়ে উঠে। তড়িঘড়ি খবর পাঠাই। সহকর্মী হাতের কাছে যে ফ্লাইট পান, তাতে চেপে ছুটে আসেন। বিদেশে তখন তিনি বিমানের একজন ষ্টেশন ব্যবস্থাপক।
বাপজানের জন্য তাঁর দুশ্চিন্তার অন্ত ছিলো না। বিদেশের মাটিতে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতেন আর মনের শান্তি ও বাপজানের রোগমুক্তির জন্য এখানে ওখানে ছুটে বেড়াতেন। এইভাবে একদিন এক দ্বীনদার পীরের দরদারে হাজির হলেন। ভক্তরা পরিচয় করিয়ে দিলো, দরবেশ স্নেহভরে কাছে ডেকে এনে বসালেন। ম্যানেজার সাহেব তাঁর অন্তরের দুঃখ-বেদনার কথা খুলে বললেন ও দোয়া চাইলেন। পীর সাহেব আস্তে করে জিজ্ঞাস করলেনঃ বাবাজী, নামাজ পড়েন? আল্লাহর অলীর সামনাসামনি বসে মিথ্যা কথা বলতে মন সায় দিলো না। বললেনঃ 'মাঝে মাঝে পড়ি'। দরবেশ স্মিতহাস্যে বললেনঃ হ্যাঁ, বাবাজী, নামাজ তো মাঝে মাঝে পড়ারই জিনিস। সেই সুবহে সাদেকের সময় ফজরের ওয়াক্তে, এইভাবে বহু সময় পরে আসর আর একেবারে দিনের শেষে মাগরিব। এশা তো সেই রাতের বেলা। ম্যানেজার সাহেবের দু'চোখে অশ্রু নেমে এলো। দরবেশ তাকে লজ্জা দিলেন না, কিন্তু নসিহত করলেন যথার্থভাবে।
এভাবেই দিন কাটছিলো। একদিন হঠাৎ করে আমার অফিসে সংবাদ এলো,বাপজানের অবস্থা আশংকাজনক। সংবাদদাতা জানালেন সময় সম্ভবতঃ শেষ; শেষ দেখা বুঝি আর হলো না। আল্লাহর কি ইচ্ছা জানি না, হঠাৎ আমার খেয়াল হলো, এখুনি যে বিমানটি ঢাকা ছাড়ছে, সেটি তো ওখানেই যাচ্ছে। আমি দিগ্বিদিক জ্ঞান শ্যূন্যের মতো দৌঁড় দিলাম বিমানের দিকে। বিমান ছাড়ার শেষ মুহূর্তটি বাকি ছিলো। সিড়ি সড়ানোর বাকি। ইঞ্জিন ষ্টার্ট দিয়েছে। শুধু ইংগিতে বুঝালাম, অতি জরুরী ব্যাপার। দ্রুত সিড়ি বেয়ে উপড়ে উঠলাম এবং সরাসরি ককপিটে ঢুকে পড়লাম। ক্যাপ্টেন পুরাতন বন্ধু; অতি সংক্ষেপে বুঝালাম, একটু খানি সময় দাও, এক টুকরা কাগজ ও কলম দাও, একটি চিঠি দেব, ব্যাস। কাগজ-কলম নিয়ে তীর বেগে সহকর্মীকে লিখলামঃ এই বিমানে যদি চলে আসতে পারেন তাহলে বাপজানের সাথে দেখা হতে পারে।' কাগজটি ভাজ করে পাইলটকে বললামঃ বন্ধু, বিমান অবতরণের সাথে সাথে চিঠিটি ম্যানেজার সাহেবকে দেবে, অতি জরুরী। এই বলে দ্রুত নেমে এলাম। বিমান চলে গেলো।
বিমান যথারীতি তাঁর গন্তব্য পৌছালো। যাত্রীর আগমন-নির্গমন নিয়ে ম্যানেজার সাহেব ছিলেন দারুন ব্যস্ত। ক্যাপ্টেন বিমান থেকে নেমেই চিঠিটি পৌছে দিলেন। ম্যানেজার সাহেব চিঠিটি নিয়েই আবার ছুটলেন আবার যাত্রীদের দিকে। ছুটাছুটি আর পেরেশানীর মধ্যে চিঠি পড়ার অবসর মিললো না কিছুতেই এবং এক সময় সবযাত্রী বিমানে আরহন করলে বিমান ধীরগতিতে বিদায় নিলো আপন গন্তব্যে প্রত্যাবর্তনের জন্য।
ম্যানেজার সাহেব টারমাক থেকে ছুটে গেলেন লাইটপোস্টের দিকে এবং পকেট থেকে চিঠি নিয়ে যা পড়লেন, তা শুধু তাঁর অন্তর বিদীর্ণ করে একটি চিৎকার হয়ে বেরিয়ে এলো। কিন্তু বিমানের তিন ইঞ্জিনের প্রচন্ড গর্জনে তা তৎক্ষণাৎ হারিয়ে গেলো। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে দেখলেন, বিমান ঢাকার যাত্রী নিয়ে আকাশে উড়ছে।
কোনো রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে অন্য এয়ারলাইন্সের টিকেট সংগ্রহ করে একাধিকবার যাত্রাবিরতি ও উড়োজাহাজ পরিবর্তন করে যখন ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন, তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হলো সরাসরি কবরস্থানে তাঁর বাপজানের কবর জিয়ারতের জন্য।
এইভাবে জীবনের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে আবার যথারীতি বিদেশে কর্মস্থলে ফিরে গেলেন। কাজ-কর্মে মন বসছে না। তাই একদিন হাজির হলেন পীর সাহেবের দরবারে। সব শুনে পীর সাহেব গভীর স্নেহে বললেনঃ 'বেটা, ঠিক এভাবে আপনার পরওয়ারদিগার আপনার কাছে একটি মেসেজ অর্থ্যাৎ এক অতি জরুরী বার্তা পাঠিয়েছেন তাঁর বন্ধু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে। আপনি কি সেই মেসেজ- যার নাম কুরআনুল করীম -পড়েছেন? যদি না পড়ে থাকেন, তাহলীর চেয়ে বহুগুণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে আপনার। দেখুন বেটা, একখানি জরুরী চিঠি সময় মতো না পড়ার কারণে মৃত্যুর সময় বাপজানের কাছে যেতে পারলেন না। অথচ কত সহজে কাজের মাঝে একবার চিঠিখানি পড়ে নিতে পারতেন। ঠিক এমনিভাবে দুনিয়ার হাজার ঝুট-ঝামেলার মাঝখানে সময় করে আল্লাহর কালাম পড়ে নিতে হবে। এবং যতদিন হায়াত মিলবে, ততদিন এই কালাম পড়তে হবে ও সেই মতো চলতে হবে। দয়াময় আল্লাহ্ অত্যন্ত জরুরী সব কথা বলে পাঠিয়েছেন আপনাকে আল-কুরআনের মাধ্যমে। আপনার আমার সামনে এক মুসিবতের সময় আসছে। মৃত্যুর মুসিবত, কবরের মুসিবত, কিয়ামতের মুসিবত, হিসাবের মুসিবত, দোজখের মুসিবত। এই সব মুসিবতের সময় কেমন করে নাজাত পেতে হবে সেই সব কথা তিনি দয়া করে তাঁর বান্দাদের জানিয়েছেন। পরকালের পথে তো পাড়ি দিতে হবে, কী নিয়ে পাড়ি দেবেন, কেমন করে পাড়ি দেবেন এই সব সংবাদ যথাসময় আপনার কাছে পৌছে গেছে; মৃত্যুদূত আসার আগেই তা পাঠ করবেন কি করবেন না, সেই মতো প্রস্তুতি নেবেন কি নেবেন না, সেই কথা একবার ভেবে দেখুন।
আশেপাশেই কোথাও কবরের জায়গা নির্দিষ্ট করে রাখা আছে। আপনি বেখবর থাকলেও আপনার আপনজন যথারীতি সেই ঠিকানায় আপনাকে পৌছে দেবে। মুনকার-নকীবের সেই ঠিকানা জানা আছে। কবরে-হাশরে-মীজানে সর্বত্র এই কুরআনুল করীমের কথামতো আপনার সাথে ব্যবহার করা হবে। কুরআনের বাণীর কোনো পরিবর্তন হবে না। অনাদি অনন্তকাল পর্যন্ত এই পাক-কালামের আগাম সংবাদ অনুযায়ী ঘটনা প্রবাহ ঘটতে থাকবে। দয়াময় আমাদের সকলকে কুরআন পাক পড়ার ও বুঝার তওফীক ও নসীব এনায়েত করুন।