JustPaste.it

ভূ-গোলময় পৃথিবী

দ্বন্দ্বমুখর আফগানে প্রচন্ড শক্তিসহ রহস্যময় আবির্ভাবঃ “ মুভমেন্ট অফ তালেবান ”

আব্দুল্লাহ আল ফারুক


যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তান বিভীষিকাময় গৃহযুদ্ধে এখন আহত, নিহত আর পঙ্গু মানুষে পরিপূর্ণ এদেশ। রক্ত দেয়া-নেয়ার হিসাব- কিতাবকে কেন্দ্র করেই এখন এদেশের জনজীবন আবর্তিত হচ্ছে। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, যুদ্ধ যানের সাথে পাল্লা দিয়ে যেন গৃহযুদ্ধ এ দেশের জনজীবন বিধ্বস্ত করে চলছে প্রতিনিয়ত। যুদ্ধবাজ গড়া নয়, ভাঙ্গায়ই যেন বেশ সুখ পাচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে আগ্রাসী রুশ সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর আফগানীদের ন্যায় বিশ্ববাসীও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল এই ভেবে যে, এবার বুঝি ধ্বংস যজ্ঞের দানব শৃঙ্খলিত হবে, রক্ত ঝরা দিনগুলির অবসান ঘটবে, দেশে শান্তি ফিরে আসার সাথে সাথে একটি নতুন সুখী সমাজ গড়ে তোলার কাজ শুরু হবে। কিন্তু রুশদের পর তাদের বংশধরদের পতন হল কিন্তু যুদ্ধ থামল না। মারণাস্ত্রের নয়া টার্গেট নির্ধারিত হল। শত্রু সৈন্য দেখল যে হাত ‘ট্রিগার’ টিপতে নিশপিস করত সে হাত আপন ভাইয়ের বুক লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপতে শুরু করল। ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ শুরু হল। ইসলামের আদর্শের চেতনা ও দেশপ্রেম ক্ষমতা, গোত্রগত দ্বন্দ্ব ও ঈর্ষার অনলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কমু্যনিস্ট দুঃশাসনের পর এই ভ্রাতৃঘাতি লড়াই আফগান জনগণের জীবনযাত্রাকে আরও বিপর্যস্ত করে তুলে। সকল দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রধানতম শিকার হতে থাকে তারা। আফগানিস্তানের জনগণ যখন এই বিপর্যয়ের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলো না ঠিক তখনই ধুমকেতুর ন্যায় আবির্ভাব ঘটে একটি নতুন বাহিনীর, নতুন শক্তির। তাদের বিশ্বয়কর অগ্রাভিযানে আফগানের ক্ষমতার মানচিত্রে ব্যাপক ওলট-পালট ঘটে যায়। যুদ্ধবাজ বাহিনী ও আঞ্চলিক শক্তিসমূহের ক্ষমতার দাবার ছকে নতুন হিসাব কষা শুরু হয়ে যায় এই নতুন বাহিনীর নাম 'তালেবান'। আফগান রাজনীতির ভবিষ্যত নির্ধারণে এ দল এখন চালকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এ দলকে কেন্দ্র করেই এখন আফগানের সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহল ও এখন আফগান গৃহযুদ্ধের পরিণতির হিসাব করছেন তালেবানের ভবিষ্যত সাফল্য বা ব্যর্থতার যোগ-বিয়োগের আলোকে।

কারা এই তালেবান?
তালেবানকে বলা হয় রহস্যময় বাহিনী। অনেকটা এমন-বলা নেই, কওয়া নেই, নাম নেই, পূর্বাভাস নেই হঠাৎ এসে ঘাড়ের উপর সওয়ার হওয়ার মত অবস্থা। পাঁচ মাস আগেও এই তালেবানের কোন অস্তিত্ব ছিল না। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত আফগানবাসী হঠাৎ একদিন শুনল যে, দক্ষিণ আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশের ক্ষমতাসীন বাহিনীকে নতুন একটি বাহিনী চরম মার দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে ঐ বাহিনীর নিজস্ব শাসন ব্যবস্থাও কায়েম করা হয়েছে। উৎসুক আফগানীদের সবারই একটা প্রশ্ন, কারা এরা? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই তারা নিত্য নতুন খবর শুনতে লাগল, এই নতুন বাহিনীর অপ্রতিহত অগ্রাভিযানের মুখে একের পর এক শহরের পতন ঘটছে। এলাকার নিয়ন্ত্রণকারী আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাদের কাছে চরম মার খেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে দক্ষিণ আফগানিস্তানের ৯টি প্রদেশ এ নতুন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেল। মরু ঝড়ের ন্যায় সম্মুখের সকল বাধা, প্রতিবন্ধকতা ধ্বংস করে ফেব্রুয়ারীর শেষভাগে যখন এ বাহিনী কাবুলের দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হয় তখন আফগানবাসীরা সকল জল্পনা-কল্পনা আর হাজারো গুজব-বিভ্রান্তির বেড়াজাল ছিন্ন করে শুনতে পায়, নতুন এ বাহিনীর নাম 'তালেবান'। আফগানের স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে এ বাহিনী গঠিত হয়েছে। এদের অনেকেই কম্যুনিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদের পোড় খাওয়া সৈনিক। আর এ বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে কান্দাহার প্রদেশের অধ্যাত এক মাদ্রাসার ততোধিক অখ্যাত একজন ওস্তাদ মোল্লা মোহাম্মদ ওমর। তিনি রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ নেন এবং একটা চোখ হারান। ওস্তাদ মোহাম্মদ ওমরের এই বাহিনী গঠন এবং মাদ্রাসা-স্কুলের ছাত্রদের নিজ নিজ গণ্ডি থেকে বেড় করে একটি অপ্রতিহত বাহিনীতে পরিণত করার পটভূমির কথা শুনে আফগানরা আরও হতভম্ব এবং বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যায়। হেকমতিয়ারের হেজবে ইসলামী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কান্দাহার শহরে গত জুলাই মাসে একজন কমাণ্ডার ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা তিনজন মহিলা নির্যাতিত ও নিহত হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় লোকজনের মনে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। মুহাম্মাদ ওমর মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে জনগণের প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেন এবং অপরাধী কমাণ্ডারকে হত্যা করেন। তার সহযোগীরা কোনক্রমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর পরবর্তী প্রতিশোধ আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ওস্তাদ ওমর অনুগতদের নিয়ে একটি সশস্ত্র দল গঠন করেন এবং কান্দাহার নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনীর অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। এ হামলায় হিজবে ইসলামী বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করে দেশের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। কান্দাহার সেনা ঘাটি ও স্পিন বোলডাক ঘাটি থেকে প্রচুর পরিমাণ সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ তারা করায়ত্ত করে। কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে তালেবান নেতা প্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা কঠোরভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। দস্যুতা, খুন, নারী ধর্ষণের জন্য অপরাধীদের প্রকাশ্যে শাস্তি দিয়ে অপরাধের স্বর্গ কান্দাহারের অপরাধী চক্রের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। সকল সশস্ত্র ব্যক্তিদের নিরস্ত্র করা হয়। জন-জীবন অতিষ্ঠ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে যাত্রীদের হয়রানী, ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে চাঁদা আদায় ও তাদের মাল-পত্র লুটপাট করে নেয়া, খাদ্য সামগ্রীবাহী যানবাহন আটকে রাখা ও খাদ্যদ্রব্য কেড়ে নেয়া, ভ্রমণকারী মহিলাদের ওপর নির্যাতন করা প্রভৃতি অপরাধের উৎস নির্মূল করা হয়। মহিলাদের পর্দা বাধ্যতামূলক সহ সকল শরিয়াত আইন কঠোরভাবে কার্যকর করা হয়। ফলে জনজীবনে অপ্রত্যাশিত স্বস্তি ফিরে আসে। ক্রমান্বয়ে তালেবানের সমর্থন দাবানলের মত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর তালেবানের নেতৃত্ব ৩০ সদস্যের একটি শুরা বা কেন্দ্রীয় কমাণ্ডের হাতে ন্যস্ত হয়। কান্দাহারের পার্শ্ববর্তী প্রদেশগুলিতে তখনও হেজবে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল। তাই তালেবান বাহিনীর ওপর কোন প্রতিশোধ আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়ার পূর্বেই তালেবানরা ঝড়ের গতিতে হেজাবে ইসলামী বাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের এই অগ্রাভিযানের মুখে দ্রুত গতিতে কান্দাহার, ওরুজান, হেলমান্দ, জাবোল, নিমরোক্ত, ফারাহ, গজনী, ওয়ারদাক, লোগার, থাকতাপুল প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশের পতন ঘটতে থাকে। এসব প্রদেশ ও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখল করতে কোথাও আদৌই কোন লড়াই হয়নি আবার কোথাও প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী লড়াই করতে হয়েছে। তবে গজনী দখল করতে গিয়ে তালেবানদের হেকমতিয়ার বাহিনীর সাথে ভয়ঙ্কর লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। এ লড়াইয়ে হেকমতিয়ারের বাহিনী পিছু হটলে তাদের অব্যাহত বিজয়ের ষোল কলা পূর্ণ হয়। গজনী দখলের ফলে রাজধানী কাবুলের প্রবেশের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। ১০ই ফেব্রুয়ারী কাবুলের ২৫ কিঃমিঃ দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত ময়দান শহরের পতন হলে কাবুল তালেবানদের কামানের পাল্লায় এসে যায়। ওদিকে মায়দান শহর পতনের ফলে কাবুলের দক্ষিণে হেকমতিয়ারের শক্তিশালী ঘাটি চর সাহেবের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। চারদিন পর তালেবানরা এই ঘাটি অবরোধ করে হেকমতিয়ারের বাহিনীকে অস্ত্র সমর্পণ করার আহ্বান জানায়। হেকমতিয়ার যুদ্ধের পথ বেছে নিলেও অতীত পরাজয়ের অভিজ্ঞতার আলোকে তার বেশ কিছু কমাণ্ডার তালেবানদের ওপর গুলী ছুড়তে অস্বীকার করে। তারা দলত্যাগ করে তালেবানের পক্ষ নেয়। অবশেষে হেকমতিয়ার বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের ভাণ্ডার তালেবানদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ঘাঁটি থেকে সরে যান। এসব অস্ত্রের মধ্যে ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টারও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর পূর্বে বিভিন্ন যুদ্ধে তালেবানরা যুদ্ধ বিমান ও হস্তগত করেছিল। ফলে দুর্দান্ত মানসিক শক্তির সাথে এসব আক্রমণাত্মক ভারী অস্ত্র যোগ হওয়ায় তালেবানরা আরও দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে। অবশেষে তারা কাবুল নিয়ন্ত্রণকারী সরকারী বাহিনীকেও অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানায়। এর পূর্বে তারা শিয়া মিলিশিয়াদের এক প্রকার হুমকি দিয়েই কাবুলের ঘাটি ত্যাগ করতে বাধ্য করে। কিন্তু সরকারী বাহিনী তালেবানদের এ দাবী প্রত্যাখ্যান করে এবং অস্ত্রের ভাষায় এর জবাব দেয়। সরকারী বাহিনী যুগপত স্থল ও বিমান হামলা চালিয়ে তালেবানদের ও শিয়াদের চরসাহেবের দখলকৃত ঘাটি থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। উত্থানের পর এই প্রথম তালেবানরা অগ্রাভিযানে বাধাগ্রস্থ হয়।

তালেবানের ভবিষ্যত লক্ষ্য কি?
তালেবানের এই উথানের পেছনে দু'টি উদ্দেশ্য কাজ করছে। এক আফগানিস্তানকে হত্যা, ধ্বংস ও রক্তপাতের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা, দুই দেশে ইসলামী আইন বলবৎ করা। এই উভয় উদ্দেশ্য পূরণের একটাই পথ—সর্বপ্রথম দেশে শান্তি ও স্থিতি ফিরিয়ে আনা। এ জন্য তারা প্রত্যেক সশস্ত্র গ্রুপকে নিরস্ত্র করে একটি নিরপেক্ষ বাহিনী গঠন করতে চায়। এই নিরপেক্ষ বাহিনী ইসলামী সরকারের অধীনে কাজ করবে। 

তালেবানদের উত্থানের প্রতিক্রিয়াঃ 
তালেবানের উত্থান আফগান জনগণকে একদিকে যেমন বিষয় বিমূঢ় করেছে অন্যদিকে তাদের কার্যকলাপ জনগণের ব্যাপক সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক এখন তালেবান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শরীয়াহ আইন কঠোরভাবে বলবৎ করা হয়েছে। লুণ্ঠন, চাঁদা আদায়, খাদ্য সরবরাহে ভাগ বসানো সহ সকল অপরাধের উচ্ছেদ করা হয়েছে। তারা ইসলামের নামে যারা খুনী বনে গেছে এবং মাদকদ্রব্যের চোরাকারবারে লিপ্ত হয়েছে তাদের উৎখাত করছে। প্রতিটি বিজিত এলাকায় আইন- শৃঙ্খলা পুণঃ প্রতিষ্ঠার জন্য শূরা বা প্রশাসনিক কাউন্সিলের অধীনে প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে। কান্দাহারে গত ১০ বছর যাবৎ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা অচল ছিল। তালেবানরা এই পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পুণঃ চালু করেছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত দালান কোঠা নির্মাণে হাত দিয়েছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। পপি উৎপাদন এলাকা থেকে মাদক দ্রব্যের চালান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চুরি ও দস্যুবৃত্তির মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দেয়া হয়েছে। এ অপরাধে জড়িত দু'ব্যক্তির লাশ ট্যাঙ্কের ব্যারেলে ঝুলিয়ে কান্দাহার শহর প্রদক্ষিণ করা হয়। এটা অপরাধীদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। অথচ এসব অঞ্চলের মানুষ গত চার বৎসরে হত্যা আর লুণ্ঠন ছাড়া কিছুই দেখেনি। রুশরা বিদায় নেয়ার পর আফগানীরা একটি শান্তিময় স্বদেশের আকাক্ষা করেছিল, কিন্তু বিভিন্ন দলের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তাদের সকল স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। কিন্তু জাতির এই ক্রান্তি লগ্নে মাদ্রাসার তরুণ ছাত্রদের একত্রিত করে তালেবান নেতারা যে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে তাতে স্রোতের ন্যায় জমসমর্থন তালেবানের দিকে ঝুঁকে পড়াই স্বাভাবিক। আফগানের ইতিহাসে কোন শক্তি আজ পর্যন্ত এরূপ দুরুহ কাজটি সম্পাদন করতে পারেনি। তালেবানের অপ্রতিহত অগ্রাভিযানের কারণে বিভিন্ন সশস্ত্র দলের ফিল্ড-কমাণ্ডাররাও দলত্যাগ করে তালেবানের সাথে মিলিত হয়েছে। আফগানিস্তানে যুদ্ধরত বাহিনীর সবগুলিই মুসলমান। তাই এদেরকে সহজে পথে আনার জন্য তালেবান আর একটি কৌশল অবলম্বন করে থাকে। যুদ্ধের ফিল্ডে প্রত্যেক সৈন্যের গলায় আল-কুরআন ও হাতে ক্লাসিনকোভ থাকে। এ ছাড়া কোন এলাকায় হামলা চালাবার পূর্বে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ তালেবান বাহিনী প্রতিপক্ষের অবস্থানের খুব কাছে গিয়ে হাজির হয়। এরপর বিজ্ঞ আলিম ও বয়স্ক লোকদের পবিত্র কুরআন শরীফসহ মুজাহিদ কমাণ্ডারদের কাছে পাঠায় এই ফরমান নিয়ে, “তোমরা গৃহযুদ্ধ পরিত্যাগ করে ইসলামী আফগানিস্তান কায়েম করতে আমাদের সহযোগিতা কর। আমাদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ কর।” আলোচনা ব্যর্থ হলে তারা অস্ত্রের ভাষায় তা সমাধানে প্রবৃত্ত হয়। 

তালেবানের শক্তি কি পরিমান?
শুরুতে তালেবান অল্প সংখ্যক মাদ্রাসার ছাত্র নিয়ে গঠিত হলেও তালেবানের কর্মসূচীতে আস্থাভাজন হয়ে সারা দেশের বিভিন্ন ক্যাডেট মাদ্রাসা ও স্কুল কলেজের ছাত্ররা এতে অংশগ্রহণ করতে থাকে। বর্তমানে এ বাহিনীর যোদ্ধার সংখ্যা ২৫ হাজার। আফগানের মুজাহিদ নেতাদের পরস্পর হানাহানি ও কর্মকাণ্ডে বিতশ্রদ্ধ হয়েই এসব ছাত্ররা বিদ্যালয়ের গণ্ডি ছেড়ে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে ময়দানে নেমেছে। তবে রুশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এমন অসংখ্য মুজাহিদ এবং দলত্যাগী কমাণ্ডার এখন তালেবান বাহিনীর নিয়মিত সদস্য।

তালেবানের জন্ম রহস্য নিয়ে বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনাঃ
তালেবানের হঠাৎ এই উত্থান এবং আফগান রাজনীতিতে নয়া মেরু করণে এর ভূমিকার কারণে এর জন্ম রহস্য নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা ধরণের প্রশ্ন। বিভিন্নজনের বিভিন্ন মত। কেউ বলেন, এর পেছনে রয়েছে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা আই, এস, আই। কেউ বলেন সি, আই, এর হাত রয়েছে। অনেকে আবার এর সাথে সৌদি আরবকেও টেনে আনছেন। পাকিস্তানের স্বার্থ হল, আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে চমন-কান্দাহার-হিরাট তুঘুন্দি রুটে মধ্য এশিয়ার সাথে একটি বাণিজ্য রুট খেলা। আর এ মহাসড়কে হেকমতিয়ারের নিয়ন্ত্রণ দূর করতে এই তালেবানদের ব্যবহার করা হচ্ছে। পাকিস্তানের সংশ্রব অনুসন্ধানকারীদের যুক্তি হল, একবার পাকিস্তানের একটি বাণিজ্য কনভয় এই রুটে মধ্য এশিয়া যাওয়ার সময় হেকমতিয়ারের লোকজন তা' আটক করে। পড়ে তালেবান এসে যুদ্ধ করে তা উদ্ধার করে। কেন তালেবান এটা করল? এই ঘটনার মাধ্যমে তালেবান প্রথম বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়া তালেবানের উত্থান যে কান্দাহার প্রদেশে তা পাকিস্তান সীমান্তের খুব নিকট। এছাড়া তালেবানের কর্মীরা শুরুতে নাকি পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও উত্তর প্রদেশ সীমান্তের পশতু এলাকায় ট্রেনিং নেয়। তারা দাবী করেন, তালেবানে যোগ দেয়া মাদ্রাসার অধিকাংশ ছাত্র বেলুচিস্তানের সুন্নী সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পরিচালিত মাদ্রাসা সমূহের ছাত্র। এই সংগঠনটির প্রধান হলেন মাওঃ ফজলুর রহমান। যিনি প্রধান মন্ত্রী বেনজীর ভূট্টোর একজন ঘনিষ্ঠ মিত্র। অতএব, তালেবানের সাথে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সম্পর্ক না থেকে পারে না। 
এছাড়া তালেবানের অভিযানের শুরুতে পাকিস্তানের আই,এস, আই'র সাবেক প্রধান জেনাৱেল হামিদ গুল আফগানিস্তানে দীর্ঘ দিন সফর করেন। তিনি আফগান যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জেনারেল (অবঃ) নাসরুল্লাহ বাবরও নাকি তালেবানদের সাহায্য সহযোগিতা করছেন বলে শোনা যায়। এছাড়া যারা সি,আই,এ বা সৌদি আরবকে তালেবানের উৎস বলে দাবী করেন তাদের যুক্তি হল, আফগান জিহাদের চেতনা যাতে বহিঃর্বিশ্বে ছড়াতে না পারে তা কার্যকরভাবে প্রতিহত করা।
অবশেষে বলতে হয়, তালেবানের জন্ম রহস্য নিয়ে যে যাই বলুক এর জন্মরহস্য হাজারো বিভ্রান্তি, অপপ্রচার বা কল্পনার গোলক ধাধায় মহা-রহস্যই থেকে গেছে। হরেক রকমের বিশেষজ্ঞের মন্তব্যের কারণে এ রহস্য আরও জটিল হয়ে গেছে। তাই এখন এর ভবিষ্যত কার্যক্রম ও সাফল্যের ওপর নির্ভর করা ছাড়া তাদের সঠিক উদ্দেশ্য ও আন্তরিকতা সম্পর্কে মন্তব্য করা অসম্ভব। তবে এটা ঠিক, তালেবানের উদ্দেশ্য নিয়ে যত প্রশ্নই থাক না কেন, আফগান জনগণ কিন্তু ক্রমশই তালেবানকে নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছে। তারা এখন দুনীর্তিবাজ, নিষ্ঠুর ও যুদ্ধবাজ কমাণ্ডারদের দুঃশাসনের পরিবর্তে তালেবান শাসন ব্যবস্থায় দেখতে চায়। যুদ্ধে বিক্ষত জনগণের এতখানি আস্থা অর্জন করা কি সহজ ব্যাপার?