JustPaste.it

ইসলাম ঐতিহ্য

দারুল উলুম হাটহাজারীর একশত বছর

আব্দুর রহিম ইসলামাবাদী

 

উপমহাদেশের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ও বৃহৎ নিখাদ ইসলামী শিক্ষা প্রশিক্ষন কেন্দ্র চট্টগ্রাম হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম এর একশত বছর পূর্তি ও দস্তারবন্দী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো ১০ ও ১১ই এপ্রিল '৯৫ইং। এই প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলনের অসাধারণ খেদমত হয়েছে। এই খেদমত গুজারীর ইতিহাস অতিদীর্ঘ। শত বছর ব্যাপী এই দ্বীনি আন্দোলনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হওয়া সময়ের এক অপরিহার্য দাবী। 
হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলামকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশের হাজার হাজার দ্বীনি মাদ্রাসা, মক্তব, খানকাহ, মসজিদ, এবাদত খানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লাহর কালাম এবং আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) হাদীস ও সুন্নাহর অসাধারণ প্রচার-প্রসার হয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে কম-বেশী সব মিলিয়ে এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৫০ হাজার ছাত্র শিক্ষালাভ করেছে। আর পরোক্ষভাবে এই প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন মধ্যস্থতায় দ্বীনি শিক্ষালাভ করেছেন প্রায় ১০ লাখ লোক।
মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খতীব, মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, মুহতামিম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আলিয়া ও কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতা, ইসলামী রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় সংসদ সদস্য, গ্রন্থকার, সাংবাদিক, সম্পাদক, পীরে কামেল এই প্রতিষ্ঠানের কৃতি ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন এবং এখনও আছেন। দেশ, জাতি ও ইসলামের খেদমতের জন্য যত ময়দান রয়েছে সব ময়দানেই এ প্রতিষ্ঠানের কৃতি ছাত্রগণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বিকার্য।
এই প্রতিষ্ঠানের বড় সৌভাগ্য হলো, দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা মোঃ কাসেম নানুতবী (রাহঃ) ও প্রথম সদর মুদাররেস শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা মুহাঃ ইয়াকুব নানুতবী (রাহঃ)-এর অন্যতম ছাত্র এবং আরেফে রাব্বানী হযরত হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (রাহঃ) ও অলিয়ে কালেম হযরত মাওলানা ফজলে রহমান গঞ্জ মুরাদাবাদী (রাহঃ)-এর প্রিয় খলিফা হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহেদ বাংগালী (রাহঃ)-এর মত বিশাল ব্যক্তিত্ব এই দারুল উলুম মঈনুল ইসলামের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানুবী (রাহঃ) এর প্রিয় ছাত্র আধ্যাত্মিক শাগরিদ শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হাবিবুল্লাহ (রাহঃ) ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম। মুজাহেদে ইসলাম হযরত মাওলানা আবদুল হামীদ সাহেবের (রাহঃ) ও সুফীকুল শিরোমণী হযরত মাওলানা সুফী আজিজুর রহমান সাহেবও ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। উল্লেখিত চার বুযুর্গের কলিজার খুন দিয়ে দারুল উলুম মঈনুল ইসলামের শুভযাত্রা ও প্রতিষ্ঠা।
বাংলা, আসাম ও বার্মায় দেওবন্দ পদ্ধতির শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় ১৮৮০ সালের পরের দিকে। হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহেদ (রাহঃ) ছিলেন এই আন্দোলনের প্রথম আহবায়ক। তিনি যে পথ দিয়ে হেটেছেন, যে এলাকায় গিয়েছেন সে সব এলাকায় আজ বড় বড় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটা আল্লাহর এই অলীর এক জিন্দা কারামত। মাওলানা আবদুল ওয়াহেদ (রাহঃ)-র দেওবন্দ থেকে বাংলায় এসে চট্টগ্রাম শহরকে কেন্দ্র করে প্রথমে কাজ শুরু করেন। তিনি মাওলানা মোঃ হাসান রায়পুরি (রাহঃ) সহযোগীতায় চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদে হাদীসের দরস শুরু করেন। অতঃপর চট্টগ্রাম শহরে, বোয়ালখালী থানার হাওলা খরন্দ্বীপে, হাটহাজারীর খন্দকিয়ায় এবং মাদার্শাতে দ্বীনি মাদ্রাসা কায়েম করেন।এটা অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকের ঘটনা। হযরত মাওলানা আবদুল হামিদ (রাহঃ) ও হযরত মাওলানা সূফী আজিজুর রহমান (রাহঃ) ছিলেন তার দু'বাজু। দ্বীনি আন্দোলনে তার দুই খলিফাই মূলতঃ এসব সংগঠিত করেন। 
শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হাবিবুল্লাহ (রাহঃ) ১৩১৩ হিঃ (১৮৯৬ইং) সনে ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুর জামেউল উলুম মাদ্রাসার হযরত হাকীমুল উম্মাত মাওলনা আশরাফ আলী থানবী (রাহঃ) ও অন্যান্যদের কাছে হাদীস, তাফসীর প্রভৃতি যাহেরী বাতেনী শিক্ষা লাভ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। মাওলানা হাবিবুল্লাহ সাহেবের সাথে দুই বুজুর্গ সর্বজনাব মাওলানা আবদুল ওয়াহেদ (রাহঃ), মাওলানা সুফী আজিজুর রহমান (রাহঃ) সাক্ষাৎ করেন। দ্বীনি শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলনকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য তারা তাকে একখানা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে অনুরোধ জানান। তাদের পরামর্শমতে ১৩১৫ হিঃ মোতাবেক ১৮৯৮ইং সনে তিনি হাটহাজারী থানার চারিয়া জোরপুলের কাছে একখানা মাদ্রাসা কায়েম করেন এবং কিছু ছাত্রকে পড়াতে শুরু করেন। ছয় মাস পর উল্লেখিত দুই বুজুর্গ মাদ্রাসা পরিদর্শন করে মতামত ব্যক্ত করেন যে, এটা বড় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মত উপযুক্ত জায়গা নয়। হাটহাজারী বাজারের পাকা মসজিদের কাছে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ সময় মাওলানা আবদুল হামিদ সাহেব হাটহাজারী থানার মাদার্শা এলাকায় একখানা মাদ্রাসা চালাতেন। তাকেও সংবাদ জানানো হলো। অতঃপর চার বুজুর্গ একত্রিত হলেন, আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠা করলেন। বারবার বৈঠকে বসলেন। অতঃপর ১৮৯৯ সালে হাটহাজারী পাকা মসজিদের কাছে (ফকির মসজিদ) মাদ্রাসা কায়েম করা হলো। ২ বছর মাদ্রাসা চলল। বড় মাদ্রাসা করার জন্য আরও বড় জায়গার প্রয়োজন হলো। এভাবে চার বুজুর্গ সর্বজনাব মাওলানা হাবিবুল্লাহ, মাওলানা আবদুল ওয়াহেদ, মাওলানা আবদুল হামিদ ও মাওলানা সুফী আজিজুর রহমান সাহেবের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বর্তমান স্থানে যেখানে এখন হাটহাজারী মাদ্রাসা কায়েম আছে আল্লাহর উপর ভরসা করে ১৯০১ সালে (১৩১৮হিঃ) দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা কায়েম করা হলো। হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানুবী ( রহঃ) এর পৃষ্ঠপোষক মুরুব্বী হিসেবে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে থাকলেন। মাওলানা হাবিবুল্লাহ সাহেবকে (রাহঃ) এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম বা মুদাররিলে আউয়াল রূপে মনোনীত করা হলো। মাওলানা আবদুল হামিদ ও মাওলানা আবুল হাসান খন্দকিয়ায় শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে থাকলেন। মাওলানা আবদুল ওয়াহেদ মুরুব্বী হিসাবে থাকলেন। কিছুকাল পর সুফী আজিজুর রহমান ও মাওলানা আবদুল ওয়াহেদ সাহেবও শিক্ষক হিসাবে যোগদিলেন। এর পর হযরত থানবীর (রাহঃ) পরামর্শে হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ গংগুহীর বুজুর্গ খলিফা হযরত মাওলানা জমির উদ্দিন সাহেব (রাহঃ)-কে পৃষ্ঠপোষক ও মুরুব্বী হিসাবে মাদ্রাসায় আনা হলো। অতঃপর মুহাদ্দিস হিসেবে আনা হলো শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দীর (রাহঃ) প্রিয় ছাত্র ও খলিফা হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ সন্দিপী (রাহঃ)-কে। ১৯০৮ সালে দাওরায়ে হাদীস খোলা হলো। ইত্যবসরে ইনতেকাল করলেন হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহেদ (রাহঃ)। হযরত মাওলানা হাবিবুল্লাহ (রাহঃ) নিজেদের এই মুরুব্বীর জানাযা নিজে পড়ালেন এবং হাওলা খরন্দীপ এর কবরস্তানে তাকে দাফন করলেন। এই কবরস্থানের পার্শ্বে আজ গড়ে উঠেছে ওয়াহেদিয়া মাদ্রাসা। ধীর ধীরে হাটহাজারী মাদ্রাসার শাখা হিসাবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী কুমিল্লা প্রভৃতি এলাকায় অনেক গুলো মাদ্রাসা গড়ে উঠল। নাজিরহাটে জামেয়া আরাবিয়া নাছিরুল ইসলাম মাদ্রাসা ও ফতেপুর-এ নাদেরুল ইসলাম মাদ্রাসা নামে দু'টি মাদ্রাসা কায়েম করা হলো। নাজিরহাট বড় মাদ্রাসায় মাওলানা সূফী আজিজুর রহমান সাহেব ও ফতেপুর মাদ্রাসায় মাওলানা আবদুল হামিদ সাহেব যোগদান করলেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামে কায়েম করা হলো কৈয়াম মাদ্রাসা। এর পর কায়েম হলো জিরি মাদ্রাসা।
রাজধানী ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহ বাহাদুরের আমন্ত্রণে হযরত থানুবীর (রাহঃ) আগমন হয় ১৯০৫/৬ সালের দিকে। এতে হযরত মাওলানা হাবিবুল্লাহ সাহেব ও অন্যান্য আলিম যোগদান করলেন। হযরত থানুবী (রাহঃ) ও হাবিবুল্লাহ (রাহঃ) এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলোচনা হলো। অতঃপর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা ইসলামিয়া মাদ্রাসা। ধীরে ধীরে অখণ্ড বাংলা, আসাম, বার্মায় হাজার হাজার দ্বীনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকলো। 
বরিশালে মাহমুদিয়া মাদ্রাসা, রাজশাহীতে পোরশা মাদ্রাসা, সিলেট বিশ্বনাথ মাদ্রাসা সহ সকল জেলা ও থানা শহরে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে উত্তীর্ণ আলেমগণ দ্বারা দ্বীনী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, ওয়াজ-নসিহত, দাওয়াত ও তাবলীগ এবং বায়আত-তালকীনের ফলে দেশব্যাপী আজ ব্যাপক হারে ইসলামের প্রচার-প্রসারের কাজ চলছে। এর ফয়েজ ও বরকত আজ উপমহাদেশ ছড়িয়ে ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকা পর্যন্ত গিয়ে পৌছিয়েছে।
১৯৪৩ সালে হযরত মাওলানা হাবিবুল্লাহ (রাহঃ)-এর ইন্তেকাল হয়। তার আমলে মাদ্রাসা যৌবনে পদার্পন করে। তার ইন্তেকালের পর তার আমলের নায়েবে মুহতামিম এবং হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানুবী (রাহঃ) এর বিশিষ্ট খলিফা হযরত মাওলানা আবদুল ওহাব সাহেবকে মুহতামিম নিযুক্ত করা হয়। তাঁর আমলে দারুল উলুম হাটহাজারী কেন্দ্রিক ইসলামী শিক্ষা আন্দোলন বলতে গেলে পূর্ণতায় পৌঁছে। তার পরবর্তী মুহতামিম হযরত মাওলানা মোঃ হামেদ সাহেব (রাহঃ) এর আমলে এটি আরো ব্যাপকতা লাভ করে। বর্তমান মুহতামিম হযরত মাওলানা আহমদ শফী সাহেবের আমলে দারুল উলুম হাটহাজারীর একশত বছর পূর্ণ হয় এবং অনুষ্ঠিত হলো শত বার্ষিকী সম্মেলন। সম্মেলনে দারুল উলুমের ফারিগ প্রায় ১২ হাজার আলিমকে দস্তার প্রদান করা হয়েছে। এটা এক ঐতিহাসিক ঘটনা বটে।
দারুল উলুম হাটহাজারী ২য় শায়খুল হাদীস ছিলেন আল্লামা ইব্রাহিম বালিয়াবী (রাহঃ)। তিনি হযরত শায়খুল হিন্দের খলীফা ও ছাত্র ছিলেন। তৃতীয় শায়খুল হাদীস ছিলেন আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (রাহঃ)-এর প্রিয় শাগরিদ হযরত আল্লামা ইয়াকুব (রাহঃ)। চতুর্থ শায়খুল হাদীস ও সদর মোদাররেস ছিলেন হযরত মাওলানা জমির উদ্দিন (রাহঃ) ও মুফতীয়ে আজম ফয়জুল্লাহ সাহেবের খলিফা আল্লামা আবদুল কায়উম (রাহঃ)। বর্তমান শায়খুল হাদীস ও সদর মোদাররেস হচ্ছেন হযরত আল্লামা আবদুল আজিজ সাহেব। তিনি হযরত মাওলানা শাহ আবদুল ওহাব (রাহঃ)-এর খলিফা।
হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রথম মুফতী ছিলেন মুফতীয়ে আযম মাওলানা ফয়জুল্লাহ (রাহঃ) এবং দ্বিতীয় প্রধান মুফতী ছিলেন হযরত মাওলানা আহমাদুল হক সাহেব-তিনি এখনও বেঁচে আছেন। বর্তমানে মুরুব্বী হিসাবে আছেন হযরত মাওলানা হাফেজুর রহমান সাহেব। তিনি কুতুবে আলম হযরত মাওলানা শাহ জমিরউদ্দীন (রাহঃ)-এর বুজুর্গ খলীফা।
দেশের অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা কেন্দ্র জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মুরুব্বীদের অনেকেই দারুল উলুম হাটহাজারীর কৃতি ছাত্রদের অন্যতম। হযরত মাওলানা এসকান্দর সাহেব, হযরত মাওলানা আলহাজ্ব মোঃ ইউনুছ সাহেব (রাহঃ), হযরত মাওলানা হাফেজুর রহমান সাহেব (রাহঃ)। এরা সকলেই দারুল উলুম হাটহাজারীর কৃতি ছাত্র এবং হযরত মাওলানা শাহ জমিরুদ্দিন সাহেবের (রাহঃ) খলিফা ছিলেন। তাছাড়া শায়খুল হাদীস ও খতিবে আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (রাহঃ) ছিলেন এ মাদ্রাসারই কৃতি ছাত্র। মুহাদ্দেস মাওলানা মোঃ ইসহাক কানাইমাদারী, মাওলানা মুফতি আবদুর রহমান, হযরত মাওলানা হাফেজ রহমত উল্লাহ সাহেব প্রমুখ এ মাদ্রাসার অন্যতম বিখ্যাত ছাত্র। 
জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মুফতী আজিজুল হক সাহেব হযরত মাওলানা শাহ জমিরুদ্দিন (রাহঃ)-এর বিশিষ্ট খলিফা এবং দারুল উলুম হাটহাজারীর প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা হাবিবুল্লাহ সাহেব (রাহঃ)-এর প্রিয় পাত্র ছিলেন। 
হযরত মাওলানা হাবিবুল্লাহ (রাহঃ), হযরত মাওলানা শাহ জমিরুদ্দিন (রাহঃ) ও হযরত মাওলানা ইবরাহিম বালিয়াবী ও হযরত মাওলানা আবদুল ওহাব (রাহঃ) প্রমুখ জামেয়া পটিয়ার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
পটিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সময় হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহাদ্দেস হযরত মাওলানা মোঃ ইয়াকুব (রাহঃ) সবক উদ্বোধন করেন। দাওরায়ে হাদীসের প্রথম সবক শুরু করিয়েছিলেন হাটহাজারীর অপর শায়খুল হাদীস আল্লামা মোঃ ইবরাহিম বালিয়াবী (রাহঃ)। হাটহাজারী, জিরী ও পটিয়া মাদ্রাসা মূলতঃ একই প্রতিষ্ঠানের শাখা-প্রশাখা স্বরূপ। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক আলেম বের হচ্ছেন এবং তারা ইসলামের ব্যাপক খেদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। এর ছাত্ররা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাজার হাজার মক্তব, মাদ্রাসা, মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
দারুল উলুম হাটহাজারী বিগত এক শতকে দেশ, জাতি ও দ্বীন-ইসলামের বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিয়েছে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন এবং বিভিন্ন ইসলামী আন্দোলনে দারুল উলুম হাটহাজারীর অবদান উল্লেখযোগ্য। হযরত মাওলানা জমির উদ্দিন (রাহঃ) এদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী আন্দোলনে সকলকে উৎসাহিত করেন। দারুল উলুমের শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা মোঃ ইয়াকুব (রাহঃ) বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার হন এবং কারাগারে বন্দী ছিলেন। দারুল উলুমের কৃতি ছাত্র জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মাওলানা ব্যারিস্টার সানাউল্লাহ (রাহঃ), মাওলানা মুফতী মোঃ ইউসুফ ইসলামাবাদী (রাহঃ) প্রমুখ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রাখেন।
পাকিস্তান আন্দোলনেও দারুল উলুম হাটহাজারীর বিরাট অবদান রয়েছে। দারুল উলুম হাটহাজারীর সাবেক মুহতামিম এবং হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রাহঃ)-এর অন্যতম খলীফা হযরত মাওলানা শাহ আবদুল ওহাব সাহেব (রাহঃ) জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। দারুল উলুম হাটহাজারী থেকে উত্তীর্ণ বহু আলিম তদানীন্তন পাকিস্তান আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে অসাধারন ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করেন। পাকিস্তানকে সত্যিকারের ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে দারুল উলুম হাটহাজারীর মুরুব্বী ও আলিমগণের ত্যাগ ও কুরবানী ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুতে পাকিস্তানকে সত্যিকারের ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত নেজামে ইসলাম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী জেনারেল খতীবে আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (রাহঃ) ছিলেন দারুল উলুম হাটহাজারীর কৃতিছাত্রগণের অন্যতম। তদানীন্তন আমলে হাফেজে হাদীস আল্লামা আবদুল্লাহ দরখাস্তী, মাওলানা গোলাম গাউস হাজারভী, মাওলানা মুফতী মাহমুদ প্রমুখের নেতৃত্বে শোষণহীন ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংগঠিত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথীও হলেন দারুল উলুম হাটহাজারীর কৃতিছাত্রদের অন্যতম।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে সকল ইসলামী দলকে ঐক্যবদ্ধ করে একক ইসলামী দল ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল)। প্রতিষ্ঠা করে এদেশে ইসলামী রাজনীতির সূত্রপাত করেন দারুল উলুম হাটহাজারীর কৃতিছাত্র খতীবে আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ সাহেব (রাহঃ)। স্বাধীনতার পর নেজামে ইসলাম পাটিকে পুনরায় সংঘঠিত করেন হাটহাজারীর অপর ছাত্র হযরত মাওলানা খাজা সাঈদ শাহ। বাংলাদেশে ইসলামী জীবন বিধানকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত ইসলামী রাজনৈতিক দলের অধিকাংশ নেতা অত্র দারুল উলুমেরই শিক্ষাপ্রাপ্ত আলিম।
আকিদায়ে খতমে নবুওয়াত হেফাজতের সংগ্রামে নিয়োজিত নিবেদিত প্রাণ সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা হাফেজ নুরুল ইসলামও অত্র প্রতিষ্ঠানেরই অন্যতম ফাযিল।
বিভিন্ন ভাষায় দ্বীনি কিতাব ও ইসলামী সাহিত্য রচনা ও সাংবাদিকতার ময়দানেও এই দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের ফাযিলগণের বিরাট অবদান রয়েছে। বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআনের তাফসীর, হাদীস এবং ব্যাপক ইসলামী সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আলীয়া মাদ্রাসা সমূহের পাঠ্যগ্রন্থাবলী, নোট ও ব্যাখ্যা গ্রন্থ প্রণয়নকারী আলেমদের অনেকেই অত্র প্রতিষ্ঠানের কৃতি ছাত্র। বহু দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকার লেখক ও সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত আছেন এই প্রতিষ্ঠানের কৃতি ছাত্রগণ। যেমন, মাওলানা আবুল ফরাহ-সম্পাদক “মাসিক ইসলাম প্রচার, মাওলানা জুলফিকার আহমাদ কিসমতী সিনিয়র সহকারী সম্পাদক দৈনিক সংগ্রাম, মাওলানা শরীফ মোহাম্মদ ইউসুফসহ-সম্পাদ দৈনিক আল-মুজাদ্দিদ, মাওলানা আবুল হাসান শামসাবাদী–সম্পাদক মাসিক রহমানী পয়গাম ও মাসিক আদর্শ নারী, মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাপ্তাহিক জমিয়ত ও নির্বাহী সম্পাদক-মাসিক পয়গামে হক, মাওলানা মনযুর আহমাদ—নির্বাহী সম্পাদক মাসিক জাগো মুজাহিদ, মুফতী ছাইদ আহমদ-সম্পাদক আর-রশীদ, হযরত মাওলানা আহমদ শফী সম্পাদক মাসিক মঈনুল ইসলাম ও মাওলানা আবু যুবাইর মোঃ নুরুল্লাহ নির্বাহী সম্পাদক মাসিক মঈনুল ইসলাম, মাওলানা মুফতী হাবিবুর রহমান কাসেমী -সম্পাদক মাসিক দাওয়াতুল হক ও মাওলানা হাফেজ আবু জাফর সাদেক নির্বাহী সম্পাদক দাওয়াতুল হক, মাওলানা ইয়াকুব শরাফতী-সম্পাদক মাসিক আল-ফালাহ, মাওলানা জাফরুল্লাহ খান-সম্পাদক মাসিক রহমত ও সাপ্তাহিক জাগো প্রহরী, মাওলানা সাইফুদ্দীন মোঃ ইয়াহিয়া–সম্পাদক মাসিক কাবার পথে প্রমুখ লেখক সাংবাদিক ও সম্পাদকগণের অবদান ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।