JustPaste.it

সাহাবীদের অপূর্ব আত্মদান

নাসীম আরাফাত

==================================================

 

সফলতার সন্ধানে

        দিগন্ত বিস্তৃত বালু সাগরের মাঝে যেন বসন্তের শ্যামলিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মক্কানগরী। ছােট নগরী। ছােট ঘােট খর্জুর কুঞ্জের মাঝে মানুষের আবাস। কাবাগৃহকে ঘিরে মূর্তি পুজার তিনটি পার্বন আর শীত-গ্রীষ্মের দুই দুইটি বাণিজ্য ভ্রমণে মক্কাবাসীদের জীবন যাত্রা কেটে যাচ্ছিলাে মােটামুটি ছন্দবদ্ধভাবে। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ কোন সে স্বস্তি নেই কানাঘুষা চলছে এখানে সেখানে। এ ওকে টেনে নিয়ে ফিসফিসিয়ে কি যেন বলছে, অজানিত আশংকায় যেন আতংকিত সবাই। ঐতাে একটা জটলা! উত্তেজনায় টগবগ করছে সবাই। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে সর্দার গােছের লােকটা কি যেন বলছে, চলাে ওখানে যাই। ও শুনেছ মুহাম্মদের কাণ্ড! ছা’আদকে ভুলিয়ে ভালিয়ে দলে ভেড়ালাে। এখন তার শােকে তার মা মরণাপন্ন। ক্ষুধা-পিপাসায় হাড় জির জিরে হয়ে গেছে বেচারী।

 

        - আহ কতাে কঠিন শপথ করলাে বেচারী লা উজ্জার নামে, ছা'আদ ফিরে না এলে আর খাবার দাবার ছুঁবে না।

 

        -আবু তালেবের ভাতিজা এ শুরু করলাে কী ? মা, বাবা, ভাই, বােন, আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে একী অনাসৃষ্টি বাঁধিয়েদিলাে।

 

        - ওকে রুখতে হবে নইলে বিপদ আরাে ঘণীভূত হবে।

 

        - এই চল আমরা ছা’আদকে নিয়ে তার মায়ের মৃত্যুশয্যায় দাঁড় করাই। দেখবি ছা’আদ মায়ের মৃত্যু যাতনা দেখে স্থির থাকতে পারবে না। মাতৃভক্তিতে আপুত হৃদয় সে ধরে রাখতে পারবে না। লুটিয়ে পড়বে। মায়ের পদতলে, মায়ের শয্যাপাশে  ছা’আদ কবুল ইবনে আবি ওয়াক্কাহ (রাঃ) একপাশে, আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধবেরা সকলে আছে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের মুখপানে, দুধে ধােওয়া বিমল মুখে ইতিমধ্যে কালি পড়েছে। বিমর্ষ মলিন হাড় জিরজিরে বিধ্বস্ত চেহারা। কোঠরাগত চোখ। প্রাণের স্পন্দনে থেকে থেকে উঠানামা করছে। কিন্তু ছা'আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাছ নির্বিকার। ভাবাবেগের কোন উদ্রেক হলাে না তার মাঝে। দীর্ঘক্ষণ পলকহীন চোঁখে তাকিয়ে রইলেন মায়ের স্নেহমাখা মুখপানে। ঈমানের কোমল স্নিগ্ধ আলাের পরশে যে। হৃদয় একবার আলােকিত হয়েছে তা আর কখনাে আঁধারে নিমজ্জিত হতে পারে না।

 

        উজ্জ্বল ঈমানী জিন্দেগী ছেড়ে নিকষ- অপরাধী কুফরী জিন্দেগী করতে পারে না। তাই ছা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাছ (রাঃ) অবিচল দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর আরাে এগিয়ে গেলেন মায়ের শয্যাপাশে। ঝুকে পড়ে মায়ের কানে নিম্নস্বরে বললেন, 'মা একী করছেন, একশত প্রাণ যদি আপনার হতাে আর একটির পর একটি করে সবগুলাে প্রাণ বের হয়ে যেতাে তবুও আমি এ কারণে কিছুতেই আমার ধর্ম ত্যাগ করতাম না। এখন ইচ্ছে হলে পানাহার করুন কিংবা বিরত থাকুন।' ঈমানের প্রতি ছা’আদের দৃঢ়তা ও অবিচলতায় আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেন এবং সাথে সাথে অহী পাঠালেন “আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করে। তবে তারা যদি তােমার ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমার সঙ্গে এমন কিছু শরীক করতে যার জ্ঞান তােমাদের নেই তবে তুমি তাদের কথা মেনাে না। (সূরা আনকাবুত)

 

        ছা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাহ (রাঃ) ছিলেন রাসূলের মাতুল ও প্রিয় সাবের। তার বীরত্ব, সাহসিকতা, ঐকান্তিকতা পরহেজগারীতে মুগ্ধ হয়ে রাসূল (সঃ) সাহাবাদের লক্ষ্য করে বলতেন, "ইনি হলেন আমার মামা, দেখাওতাে দেখি তােমাদের কারাে এমন মামা থাকলে?” সত্যানুসন্ধিৎসু সাহাবীরা (রাঃ) এমনিভাবে সকল মায়া, মমতা, ধন-সম্পদ, বিত্ত-বৈভব ত্যাগ করে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। আমরণ জপলেও যে মায়ের মাধুর্য শেষ হবে না। যে মায়ের স্মরণে হৃদয় হু হু করে কেঁদে উঠে, উতলা হয়ে উঠে মন, একমাত্র দ্বীনের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা সে মাকেও এবং দুনিয়ার সবকিছুই ত্যাগ করেছিলেন। তাই আল্লাহ ইহলােক ও পরলােকে তাদের সফলতা ও কামিয়াবী দান করেছিলেন। বর্তমান অশান্ত পৃথিবীর এই অস্থির মুহূর্তে আমাদেরও অনুসরণ করতে হবে সেই একই পথ ও পন্থা। তবেই আসবে শান্তি, নিরাপত্তা, সফলতা।

 

অপূর্ব আত্মদান 

        বদর যুদ্ধের চরম পরাজয়ের পর মক্কা নগরীতে সেই যে শােকের ছায়া নেমেছে আজো তা মুছেনি। কাফির মুশরিকরা আজও ভুলতে পারেনি তাদের সেই ব্যথা। মনে হয় যেন এ পরাজয় তাদের জীবন থেকে চিরতরে কেড়ে নিয়েছে সব হাসি, আনন্দ। বিষাদময় মক্কার আকাশ বাতাসে এখন আর আগের চঞ্চলতা নেই। নেই মরুচারী যাযাবরদের দুরন্তপনা। সর্বত্রই বিরাজ করছে পরাজয়ের গ্লানি আর শোকের কালাে হাতছানি। কিন্তু হঠাৎকরেই আজ আবার মক্কার সর্বত্রই নতুন চাঞ্চল্য ও উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এইতাে কিছুক্ষণ পূর্বে দফ বাজিয়ে বাজিয়ে আবু সুফিয়ানের কাফ্রী গােলাম সবাইকে তান’ঈনে সমবেত হওয়ার ঘােষণা শুনিয়ে গেল। বলে গেল, মুহাম্মাদের ঐ চরটিকে আজ শুলে বিদ্ধ করা হবে, বদর যুদ্ধে যে হারিছ ইবনে আমেরকে হত্যা করেছিলাে। ঘােষণা শুনে সবাই দৃশ্যটি উপভােগ করার জন্য ছুটে চলল। তাবঈনের মুক্তপ্রান্তর।

 

        এখানে ভিড় করেছে শিশু-কিশাের থেকে শুরু করে মক্কার আবাল বৃদ্ধ বণিতা করতালি আর ‘হােবল’-এর জন্য ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে আজ এ শান্ত ময়দান থেকে গুম গুম করে উঠছে। কাফির মুশরিকদের চোখেমুখে প্রতিহিংসার পাশবিক আনন্দ সুষ্পষ্ট হয়ে উঠছে। জনতার ভিড়ের মাঝে বন্দী খুবাইব বিন আদী রাদিয়াল্লাহু আনহু কাফিরদের কটাক্ষ ও হৈ হুল্লোর উপেক্ষা করে নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছেন। যেন তিনি অন্য কোন ফিকিরে বিভাের। তার সামনেই স্থাপিত শুল-কাষ্ঠ। কিছুক্ষণের মধ্যে অবসান ঘটবে তাঁর জীবনের। অথচ কী আশ্চর্য! এমন নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও খুবাইরেব মাঝে কোন অস্বাভাবিক ব্যাকুলতা নেই, নেই হিম শীতল মৃত্যুর ভয়াল বিভীষিকার আতঙ্কে কোন বিষণ্ণতা কিংবা বিচলিত হবার লক্ষণ। এক মুশরিক পায়ে পায়ে সম্মুখে এগিয়ে এসে বললাে, এই সাবী! (পিতৃ পুরুষের ধর্মত্যাগী!) তাের জীবন লীলা এখনই সাঙ্গ হবে। চিরতরে জন্ধ হয়ে যাবে তাের হৃদয়স্পন্দন, বল এই অন্তিম মুহূর্তে তাের কি কোন বাসনা আছে? খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকালেন মুখ তুলে। চারদিক থেকে ঘুরে ফিরে তাঁর দৃষ্টি এসে থামলাে প্রশ্নকারীর মুখের ওপর।

 

        বললেন- “হ্যা, দু'রাকাত নামাজ পড়তে চাই! নশ্বর এই পৃথিবী ত্যাগের পূর্বে যেন তিনি তার প্রিয়তমের সান্নিধ্যে কয়েক মুহূর্ত অবস্থানের বাসনা প্রকাশ করলেন। চারিদিকে কাফির মুশরিককদের নিচ্ছিদ্র বেষ্টনীর মাঝে অন্তিম ইচ্ছা পূরণের জন্য খুবাইব (রাঃ) নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। আল্লাহ ভীতি ও আল্লাহ-প্রীতির কী অনুপম দৃশ্য। যেন স্বীয় স্বত্ত্বা হারিয়ে কোথায় কোন সুদূরে চলে গেছেন। যেন গোপন অভিসারে প্রেমাস্পদের কানে কানে প্রেম কথা বলছেন। জীবনের সঞ্চিত সব, প্রেম-ভালােবাসা, ভক্তি পরওয়ারদেগারের সমীপে উজার করে দিচ্ছেন সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। নিরাকার রবের ইবাদতে যে এমনভাবে আপনহারা হওয়া যায়, অন্তিম মুহূর্তে জীবনের শেষ আকাঙ্ক্ষা হিসেবে যে ইবাদতকেও গ্রহণ করা যায়, হাতে গড়া নিষ্প্রাণ মূর্তির পূজারী মােটাবুদ্ধির কাফিরদের কেউ তা ভাবতেও পারেনি। তাই তাদের বিস্ময় বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে মুহূর্তের জন্য পলক পড়ছিল না। এই পরিস্থিতিতে তাদের অনেকের হৃদয়ে গুমড়ে মরছিলাে কিছু প্রশ্ন।

 

        তারা কি এমন ইবাদত করতে পেরেছে? পেরেছে কি তাদের প্রতিমার সামনে এমন কায়মনােবাক্যে দাঁড়াতে? অন্তিম আকাঙ্খা পুরণের সুযােগ পেলে তারা কি প্রতিমার পূজাকে পছন্দ করবে? বিবেকের এই প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিলাে তারা অনেকে। নামাজ শেষে তাকে শুলিতে চড়ানাে হলো। সারিবদ্ধ তীরন্দাজ দলের এক একটি তীর গিয়ে বিদ্ধ হতে লাগলাে তার দেহে। কিন্তু আল্লাহর প্রেমে নিবেদিত প্রাণ খুবাইব (রাঃ) অবিশ্বাস্য রকমের শান্ত। রূপকথার মতাে শােনালেও বাস্তব সত্য যে, উহ শব্দটি পর্যন্ত বের হলাে না তার মুখ থেকে। নশ্বর দেহের সাথে কি আচরণ চলছে সেদিকে নয় বরং আরাে উর্ধ্বে কোন অদৃশ্যলােকে তার দৃষ্টি। তার দৃষ্টি তখন সুদূর নীল আকাশের নীলিমায় নিবদ্ধ। দৃঢ় প্রশান্তিতে তার মুখমণ্ডল দিপ্তীমান। হয়তাে সেখান থেকে বেহেশতের হুরের দল তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। না হয় শ্যামলিমাময় জান্নাতের অবিনশ্বর নয়নাভিরাম সবুজ বাগ-বাগিচার দৃশ্য সমাবেশে তার দৃষ্টি আটকে গেছে। ইতিমধ্যে এক কাফিরের ডাকে খুবাইর (রাঃ) যেন বিরক্ত হয়ে তার দিকে দৃষ্টি ফিরালেন। কাফির লােকটি বললাে, খুবাইব তুমি চাইলে এখনও পরিবার পরিজনের নিকট ফিরে যেতে পারাে। তবে তােমার স্থানে শুলীবিদ্ধ হবে তােমাদের নবী মুহাম্মদ।

 

        হঠাৎ করেই জ্বলে ওঠলাে শুলীবিদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী খুবাইবের চোখের তারা। ঘৃণা আর ক্রোধের আগুন তার চোখ হতে ঠিকরে বেরুতে লাগলাে। নেতিয়ে পড়া শির আঘাত খাওয়া ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের ন্যায় ফুসে উঠল মৃত্যুপ্রয় খুবাইব (রাঃ)। অগ্নিঝড়া কণ্ঠে তিনি বললেন, “আমার মুক্তি রাসূলের পায়ের সামান্য কাঁটা ফোটার বিনিময়ে হলেও আমি রাজি নই। আমার শুলেবিদ্ধ মৃত্যুও রাসূলের সামান্য কষ্টের চেয়ে শতগুণে শ্রেষ্ঠ।” এই জবাবে কারও মুখে বাকরণ নেই। অবাক বিস্ময়ে বিহবলের মত তারা ভাবে, কঠিন মৃত্যু যাতনা ভুলেও কি কেউ প্রেমাস্পদের বিপদসংকায় শিউরে ওঠতে পারে? পারে নিজের মৃত্যু যাতনাকে এত সহজে ভুলে যেতে? তবে কি সত্যিই তারা রাসূলের পদতলে আপন জীবন লুটিয়ে দিতে পারে? কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের ওষ্ঠাধর এবার কেপে উঠলাে। সে বিস্ময় বিমােহীত কণ্ঠে বললাে- আশ্চর্য! মুহাম্মদকে তার সাথীরা যেমন ভালবাসে আর কেউই পারবে এমন করে অন্যকে ভালবাসতে। শেষে তীরটি গিয়ে মুমূর্ষ খুবাইবের শরীরে বিদ্ধ হলাে। পুনঃরায় নেতিয়ে পড়লাে তার উন্নত শির। নশ্বর দেহের পিঞ্জর ছেড়ে উঠে গেলাে তার অবিনশ্বর আত্মা। আর তার প্রশান্ত মুখের সেই অনাবিল হাসি ফুটে আছে অনন্তকালের দৃশ্যহীন অবয়বে। এ হাসি মুখ মলীন হবে না কোন দিন।

 

দেবতার দশা 

        জীবনের বেলাভূমিতে এসে পৌছেছে, নিঃশেষ হয়ে আসছে প্রাণ প্রাচুর্য। স্তিমিত হয়ে আসছে জীবন প্রদীপের সলিতা। তবুও পূজা প্রীতিতে একটুও ভাটা পড়েনি। সেই কাক ডাকা প্রত্যুষে বিছানা ছেড়ে দেব মন্দিরে প্রবেশ করে কখন ফিরে তার কোন ইয়াত্তা নেই। রাতের গভীর অন্ধকারে নিঝুম নিরালায় একাকী এ অভিসার প্রেমিক প্রেমিকার অভিসারের চেয়ে বহু বেশী মােহনীয়। সারা দিন তার একই চিন্তা, একই কল্পনা কখন নিশাগমন করবে, কখন ত্রি-সংসারের মায়া ছেড়ে দেবতার পদপ্রান্তে লুটিয়ে পড়ে নিজের সকল অস্তিত্ব, সকল আমিত্ব বিলিন করে অপূর্ণ এক তৃষ্ণায় পরিতৃপ্ত হবে। যেন গ্রীষ্মের কাঠ ফাঁটা রােদে তৃষ্ণার্ত মৃত্তিকা খন্ড এক পসলা বৃষ্টির অপেক্ষায় অধীর। দেবতা পাগল এই লােকটি ছিলাে বনু সালেমা গােত্রের এক জন বিশিষ্ট নেতা। নাম আমের।মদীনার ঘরে ঘরে মূর্তিপূজায় তার খুবই সুনাম। কিন্তু তার ছেলে মুয়ায ইসলামের মােহনীয় হাত ছানিতে বিমুগ্ধ হয়ে ইতিমধ্যে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। এর পর থেকে শুরু হলাে আলাে-আধারের, সত্য-মিথ্যার চির দ্বন্দ্ব। আলােচনা, পর্যালােচনা, বাক বিতন্ডা অবশেষে বচসা পর্যন্ত হলাে।

 

        কিন্তু আমর স্বীয় মতে অবিচল। একটুও নড়লাে না স্বীয় ধর্ম পথ থেকে। এদিকে ইসলামের আলাে মদীনার ঘরে ঘরে দ্রুত দুর্বার গতিতে ছড়িয়ে পড়লাে। জমাট বাঁধা কৃষ্ণ অন্ধকার দূরীভূত হয়ে খিল খিল করে হেসে উঠলাে মানুষের হৃদয়াকাশ। সত্যের শিখা-পরশে চারদিক আলােকিত, উদ্ভাসিত। ঘন ক্লেদ আর আবিলতার স্থানে মধুর স্নিগ্ধ—মায়াময়-দীপ্তির ছড়াছড়ি। ইতিমধ্যে আমেরের বাল্যবন্ধু অনেকেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। তারাও আমেরকে কত করে মূর্তির অসারতা, অক্ষমতা, আর জড়তার কথা বুঝালাে। কিন্তু আমের নাছােড় বান্দা, কিছুতেই সে পিতৃপুরুষের ধর্ম ছাড়লাে না। পিতার এই অনমনীয়তায় মুয়ায খুব ব্যাকুল হয়ে পড়লাে এবং সর্বাত্মক চেষ্টা চালালাে, কিভাবে তাকে সত্যের দিশা দেয়া যায়, কিভাবে তার হৃদয় সত্যের আলােতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠবে। দিন রাত এই একই চিন্তা তাকে অস্থির করে তুললো। কিন্তু প্রত্যাশার প্রস্ফুটিত কলির পাপড়িগুলাে একে একে ঝরে পড়ছে। অবশেষে বন্ধু মুয়ায ইবনে জাবালের কথা মনে হলাে। বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলে সে সমবয়সীদের মাঝে শীর্ষে। তারই সাথে পরামর্শ করা দরকার। দুজনে পরামর্শ করে এক চমৎকার ফন্দি আটলেন। নিত্যদিনের মত পরদিন প্রত্যুষে আমের ছুটলাে দেবমন্দিরে। কিন্তু প্রবেশ করেই তার আক্কেল গুড়ুম। একী ? দেবতা কোথায়? শিউরে উঠলাে সারা শরীর। তন্ন তন্ন করে খুঁজলাে মন্দিরের চারদিকে, কিন্তু নাই, তবে গােলাে কোথায়? ভয় ভীতি আর উত্তেজনা তার চোখে মুখে। ভয়ার্ত ডাকাডাকিতে হুলস্থুল পড়ে গেল। সকলে এসে জড়াে হলাে।

 

        তারপর দিগ্বিদিক ছুটলাে সকলে দেবতার সন্ধানে। কিছুক্ষণ পর সংবাদ এলাে, অদূরেই এক পুতিগন্ধময় স্থানে উপুড় হয়ে পড়ে আছে দেবতাজী। আমের হন্যে হয়ে ছুটে গেল। দেবতার এই করুণ দশা দেখে সে ভড়কে গেল। এবার বুঝি আর রক্ষে নেই। দেবতার অপছায়া বুঝি পড়েছে তার ওপর। তাই উলু ধ্বনিতে মুখরিত করে তুলে আনলাে দেবতাকে এবং ক্রোধে গর্জন করে অশ্রাব্য গাল মন্দও করলাে এই কাণ্ড যে ঘটিয়েছে তাকে। বাড়ীতে এনে আতর গােলাপ আর সুগন্ধিতে সুবাসিত করে আবার দেবতাকে স্বীয় আসনে অধিষ্ঠিত করলাে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। পর পর কয়েকদিন ঘটলো একই ঘটনা। এবার তিক্ত বিরক্ত হয়ে ক্ষেপে ওঠলাে আমের দেবতারই ওপর। তরবারী উচিয়ে খানিকটা শাসিয়ে দিলাে দেবতাকে। বললাে, আবার যদি নিজেকে নিজে রক্ষা করতে না পারিস তবে কিন্তু তাের কল্যাণ নেই। পরদিন প্রত্যুষে আবার সেই একই ঘটনা। সকল শাসন উপেক্ষা করে দেবতা উধাও হয়েছে। এবার দারুণ বিরক্ত হলাে আমের। অবাধ্য পা দুটোকে টেনে অগ্রসর হলাে পুতিগন্ধময় স্থানের দিকে। আজ দেবতার দশা আরাে গুরুতর। মৃত গলিত এক কুকুরের সাথে শক্তরশি দিয়ে চির বন্ধুত্বের বন্ধন রচনা করে পাশাপাশি শুয়ে আছে। থমকে দাঁড়ালাে আমের। নিরুপায় এক আস্ফালন যেন মাথা তার বুকে মাথা কুটছে। অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইলাে কতক্ষণ। তার পর দূর দিগন্তের নীলিমায় তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেলাে। আলাে আধারের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চিন্তায় তিনি মুষড়ে পড়লেন।

 

        তবে পাথুরে দেবতা সত্যই কি নির্জীব-নিষ্প্রাণ, বিপদে নিজেকেও রক্ষা করতে পারে না, পূতিগন্ধময় স্থান থেকে উঠে আসার শক্তিটুকুও কি তার নেই? মুয়ায যা বলেছে, বাল্য বন্ধুরা যা বলেছে তবে কি তাই সত্য? পিতৃ পুরুষদের ধর্মাচারে কি তবে কোনই বাস্তবতা নেই? হৃদয়ের সঞ্চিত সকল মাধুরী দিয়ে তিলে তিলে যে দেবতাকে পুষেছি তা কি মিথ্যা? নিশি নির্জনে গভীর নিস্তব্ধতায় একটু সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায় কত তপস্যা কত কাতর আবেদন নিবেদন করেছে সে এই দেবতার পদতলে। আজ যেন সেই দেবতাই তাকে তিরস্কার করছে। নিজ অসহায়তা, অক্ষমতার কথা ব্যক্ত করছে। তবে কি এসব কিছু মিথ্যা, ধুম্রজাল, সবকিছু ধাঁ ধাঁ? এতদিন কি সে মরিচিকার পিছনে ছুটছিলাে? অসহায়তার চাপা বেদনা তাকে ক্রমশই। অস্থির করে তুলছে। তখন কয়েকজন বাল্যবন্ধু এগিয়ে এলাে, কাঁধে হাত রেখে বললাে, বন্ধু! আর কতদিন এ মিথ্যার পিছনে, এ মরিচিকার পিছন ছুটবে এসাে আমাদের সাথে। এসাে সত্যের পথে। চলাে। যাই মুহাম্মদ (সঃ)-এর নিকট। তিনি আল্লাহর রাসূল-প্রেরিত পুরুষ। সেখাইে শান্তি পাবে। সত্য পাবে। ইতিমধ্যে সকল অন্ধকার সকল মিথ্যা তিরােহিত হয়েছে তার অন্তর থেকে। ইসলামের কমনীয়তা, সত্যতা বিকশিত হয়েছে তার হৃদয় পটে। এবার সে ছুটলাে রাসূলের দরবারে সত্যের সন্ধানে।

 

 আলাের পরশে

         মরুর রাগী সূর্যটি আজ আরাে বেপরােয়া হয়ে উঠেছে, আদিগন্ত বিছিয়ে থাকা বালুতে যেন মুঠি মুঠি আগুন ছড়াচ্ছে। চারদিকে গনগনে উত্তাপ। এরই মাঝে স্বর্গীয় স্নিগ্ধ শীতল পরশে বাইতুল্লাহর এক চিলতে ছায়ায় বসে বদরের নির্মম পরাজয়ের স্মৃতিচারণ করছিলাে ছুফিয়ান ইবনে উমাইয়া আর উমাইর ইবনে ওহাব। ছুফিয়ানঃ অশান্তি আর বিষাদ অস্থির করে তুলছে এজীবন। আবুল হাকাম, উৎবা, শায়বার পর জীবন স্পন্দন যে স্তব্ধ হয়ে গেছে। উমাইরঃ সত্যিই বলছাে বন্ধু! বদরের রাক্ষুসী বিপর্যয় লীলা যেন দুমড়ে মুচড়ে সব লণ্ডভন্ড করে দিয়ে গেলাে। হাওয়ারা যেন বুক ভরা ব্যাথ্যা নিয়ে মাতম তুলে তুলে মক্কার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেদুইনবালাদের মধুর হাসি, রাখাল বালকের ব্যাকুল বাঁশি এখন আর মরুর বুকে স্বগীয় সুধার মুছনা তুলে না।

 

        ছুফিয়ানঃ প্রতিশােধ এর নিতেই হবে, এ নির্মম বিপর্যয় কিছুতেই সহ্য করা যায় না। আবুল হাকামের খুনের বদলা খুন দিয়েই নিবাে। জিঘাংসার একরাশ লকলকে শিখা যেন উথলে উঠলাে তার কোটর থেকে।

 

        উমাইরঃ ঋণের বােঝা যদি আমাকে স্তব্ধ করে না দিতাে, কচি সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা যদি আমাকে ব্যতিব্যস্ত না করতাে, তবে শপথ করে বলছি, আবু তালিবের ভাতিজার যুদ্ধের সাধ আমি চিরতরে মিটিয়ে দিতাম।

 

ছুফিয়ানঃ সত্য-বলছিস?

        উমাইরঃ লাতের কসম। মানাতের কসম। খুনের বদলা খুন নিয়ে তবে মক্কায় ফিরতাম। জানিস আমার নাম উমাইর। তপ্ত একরাশ উত্তেজনা আর গর্জন উথলে পড়লাে তার কণ্ঠ দিয়ে। ছুফিয়ানঃ বেশ, তবে আমিই পরিশােধ করবাে তাের ঋণের বােঝা। মানুষ করব তাের সন্তানদের। রাজী আছিস? এই বাইতুল্লাহকে, এই হােবলকে সামনে রেখে বললাম, একটুও নড়চড় হবে না আমার কথার। এক অসম্ভব হিংস্রতা ও বর্বর উত্তেজনা। সারা দেহের রক্ত থেকে লাফ দিয়ে উঠে এলাে উমাইরের গলায় বললাে, “অবশ্যই রাজী, তবে আমার এ প্রতিশ্রুতি অবশ্যই গােপন রাখবে, আজই তলােয়ার শান দিয়ে বিষ মেখে নিবাে। দরজার সম্মুখে রীতিমত জটলা, উত্তেজনা, উত্তপ্ততা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। উমর (রাঃ) এলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! দুরাচার ইবনে ওহাব এসেছে, খাপে তার শানিত তরবারি! মতিগতি সন্দেহজনক! ভােরের হাস্নাহেনার মত সুবাসের মিষ্টি ও অমলীন এক হাসির রেখা রসূলুল্লাহর মুখে ছড়িয়ে পড়লো। বললেন, ওকে আসতে দাও! তলােয়ারের বাট শক্ত করে ধরে উমর (রাঃ) বললেন, এসাে, রাসূল (সাঃ) তােমায় ডাকছেন। আশে পাশে উপস্থিত সাহাবীদের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি ফেললেন। চোখের ইশারায় বললেন, তােমরা দাঁড়িয়ে কেন? সাথে সাথে এসাে। লােকটা বড়ই দুর্বৃত্ত দুরাচার, কখন কী করে বসে বলা মুশকিল।

 

        সতর্ক থেকো। একটু অগ্রসর হতেই রসূলুল্লাহ (সঃ)-কে দেখতে পেলেন। স্নিগ্ধ মমতাভরা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। বললেন, উমর, সেতো মেহমান। তাকে নির্বিঘ্নে আসতে দাও। এক আকাশ মমতা আর ভালবাসা তার কণ্ঠে বিস্ময়কর কোমলতা আর হৃদ্যতার বাচনভঙ্গীতে অকস্মাৎ যেন উমাইরের উত্তপ্ত দেহটি খরার দাবদাহ থেকে হীম শীতল ছায়ায় এসে পড়লাে। এতটুকু ভালবাসা আর মমতার স্পর্শেই তার দেহ মনে কী ভীষণ ভাঙ্গন শুরু হয়ে গেছে! রাসূল (সঃ) আবার বললেন, উমাইর, কেন এসেছাে? অঙ্গলি সঞ্চালন স্তব্ধ হওয়ার পরও বীণায় ছড়িয়ে থাকা গুঞ্জনের মতাে উমাইরের কানে রাসূলের গভীর মমতা ও মায়াময় কথাগুলাে দুলতে থাকে। কতাে, মধুর-মিষ্টি সে মায়াময় অকৃত্রিম কথামালা। বিনীত কণ্ঠে উমাইর বললাে, যুদ্ধে বন্দী ছেলেটিকে নিতে এসেছি। চোখ তুলে তাকালেন রসূলুল্লাহর পবিত্র মুখ পানে। ভােরের ফোটা শিউলির মত একটা নিরব হাসি ছড়িয়ে আছে সারা অবয়ব জুড়ে। মিটি মিটি হাসছেন রসূলুল্লাহ (সাঃ)!

 

        : তবে তরবারী সাথে এনেছো কেন?

 

        : একাকী মরু ভ্রমণে আত্মরক্ষার প্রয়ােজনে।

 

        : সত্যি বলাে, কেন এসেছাে?

 

        এবার অস্থির ভাবনার ডানা ঝাপটান শুরু হলাে উমাইরের হৃদয়ে। কপালের কুঞ্চনে তাদের শােরগােল দেখা দিলাে। ভেড়ার জিভের ন্যায় কয়েকবার শুকনাে জিভটা নড়লাে। কিন্তু একটি কথাও ফুটলাে না তার মুখ দিয়ে। দূর পাল্লার চাহনী মেলে তাকালেন রসূলুল্লাহ (সঃ) দৃষ্টি প্রসারিত করলেন দূরে, বহুদূরে—দিগন্তের নিলীমায়, যেখানে প্রকৃতি আলিঙ্গন করছে একে অপরকে। বলতে লাগলেন, যেন সব দেখে দেখে বলছেন। শুন উমাইর, কাবাগৃহের চত্বরে বসে ছুফিয়ানের সাথে প্রতিজ্ঞা করলে, যে করেই হােক তুমি বদরের প্রতিশােধ নিবে। তাই বিষমাখা তলােয়ার নিয়ে এসেছে। হতবুদ্ধির পাতায় তির তির করে কাঁপতে লাগলাে উমাইর। বিস্ময়ে চোঁখটা বড় হতে হতে এক আকাশ শ্রদ্ধায় আপূত হয়ে উঠে। কই কেউ তাে ছিলাে না আমাদের সাথে। কোন কান তাে শােনেনি আমাদের এ প্রতিশ্রুতি। তবে কি তিনি সত্যিই আল্লাহর রাসুল? চিন্তার ভাঁজে ভাঁজে হিংস্রতা, শত্রুতার বাঁধনগুলো কেটে সারা শরীর শিথিল হয়ে গেল। অন্তরের সব গলিপথগুলাে আলাের বিচ্ছুরণে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। বসন্তের শান্ত স্নিগ্ধ হাওয়ায় কুসুমকলির ন্যায় কেঁপে উঠলাে আপাদমস্তক। নিজেকে সঁপে দিলেন রাসূলুল্লাহর পদ প্রান্তে। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে সত্যের দিশা দিন। আমি আলাের পিয়াসী। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, "আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল।”

 

        রঙিন ডানায় ঝিলমিলিয়ে সে যেন উড়ে গেল একটুকরাে আলাের দিকে। এক ঝলক জ্যোতির দিকে। পিছনে পড়ে রইল নিকষ অন্ধকার আর গুমরাহী।

 

*****