আলকাউসার জুমাদাল উলা-জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪২ || জানুয়ারি ২০২১ সংখ্যায় ‘হযরত মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী রাহ.: কিছু কথা কিছু স্মৃতি’ প্রবন্ধে মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব লিখেছেন,
“আজকাল কওমী মাদরাসায় অধ্যয়ন সম্পন্নকারী কিছু কিছু ব্যক্তির মাঝে এই রোগ দেখা দিয়েছে যে, তারা কতিপয় কট্টরপন্থী সালাফীর এবং সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনাকারী কিছু লোকের বিচ্ছিন্ন চিন্তা-ভাবনাকে এই বলে প্রচার করছে যে, এটাই কুরআন-সুন্নাহ্র দাবি এবং এটাই আসল দেওবন্দিয়াত!
অথচ তাদের ‘বিশেষ’ চিন্তা-ভাবনা উলামায়ে দেওবন্দের নীতি-আদর্শ এবং গোটা দুনিয়ার জুমহুর আকাবির উলামায়ে কেরামের নীতি-আদর্শের বিপরীত। জানা নেই, কে তাদেরকে ‘মানহাজী’ নাম দিয়েছে আর কিসের ভিত্তিতে দিয়েছে? হযরত মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী রাহ. এ ধরনের লোকদের চিন্তা-ভাবনার বিরোধী ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে সরাসরি আমাকে বলেছেন এবং আশংকা ব্যক্ত করেছেন। আর বলেছেন, এ বিষয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।”
মানহাজি বলতে কারা উদ্দেশ্য?
অবশ্যই জামাত বা আহলে হাদিস উদ্দেশ্য নয়। কারণ, তারা একেতো আজকালকার নতুন ফিতনা না, দ্বিতীয়ত তারা দেওবন্দিয়াতের দাবিদারও না। তাবলিগ বা চরমোনাইয়ও অবশ্যই উদ্দেশ্য না। বাকি রইল শুধু আলকায়েদা আইএস। আইএস যে ভ্রান্ত তা বহু আগেই পরিষ্কার এবং আলকায়েদা তাদের থেকে সম্পর্কও ছিন্ন করেছে বহু আগে। রয়ে গেল শুধু আলকায়েদা। বেশির চেয়ে বেশি এতটুকু বলা যায়, আলকায়েদা আইএসকে তারা এক পাল্লায় মাপছেন বা আইএসের মতাদর্শ দিয়ে আলকায়েদাকে বিবেচনা করছেন। এটা অবশ্যই উচিৎ না। আইএসের ব্যাপারে আলকায়েদা বহু আগেই তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। উভয়কে এক পাল্লায় বা একই মানহাজে বিবেচনা করা অবশ্যই অনুচিত।
কয়েকটি নিবেদেন
ক. মানহাজি কারা যদিও কথার ধরন থেকে পরিষ্কার, তবে স্পষ্ট করে নাম নিয়ে বলে দিলেই ভাল হতো। তা’রিজ, ইশারা ইঙ্গিত স্পষ্ট সমালোচনার চেয়ে অনেক বেশি দিলে বিঁধে।
খ. কট্টরপন্থী সালাফী এবং সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনাকারী কিছু লোক কারা এবং তাদের বিচ্ছিন্ন চিন্তা-ভাবনাগুলো কি, যেগুলো মানহাজিরা অনুসরণ করছে, কিছুই পরিষ্কার করা হয়নি। পরিষ্কার করে দিলে ভাল হতো। এতে যাদেরকে এ ফিতনা থেকে বাঁচানো উদ্দেশ্য তারা সহজে বাঁচার পথ পাবে। আর মানহাজিরাও দেখতো যে, তাদের দিকে যে চিন্তা ভাবনাগুলোর নিসবত করা হচ্ছে, আসলেই তারা সেগুলো পোষণ করে কি’না। আর করে থাকলে এবং সত্যিই ভুল হয়ে থাকলে শুধরেও নিতে পারতো।
গ. পরিষ্কার করা হয়নি যে, মানহাজিদের সেই ‘বিশেষ’ চিন্তা-ভাবনাগুলো কিভাবে কুরআন সুন্নাহ এবং জুমহুর উলামা-আকাবিরের আদর্শের খেলাফ হচ্ছে। মারকাজের মতো প্রতিষ্ঠানের অবশ্যই এভাবে দলীলবিহীন কথা বলা উচিৎ না। মারকায এর আগেও মুজাহিদিনের সমালোচনা করেছে। তবে দুঃখের ব্যাপার তাদের কথায় দলীলভিত্তিক একটা লাইনও কোনো সময় থাকে না। এভাবে দলীলবিহীন সমালোচনা অবশ্যই বড়দের থেকে কাম্য নয়। পক্ষান্তরে মানহাজিরা যা বলে সব সময়ই *কুরআন সুন্নাহর দলীল এবং মু’তামাদ আলাইহি উলামাদের হাওয়ালায় বলে। এর জবাবে মারকায শুধু সমালোচনা বা দিলে বিঁধার মতো তীর্যক কিছু কথাই বলেই ক্ষান্ত; দলীল দেয় না কখনও। জানা কথা যে, দলীলবিহীন সমালোচনা দুর্বলতার পরিচায়ক। অধিকন্তু বর্তমান দুনিয়ায় নিরেট দাবির চেয়ে দলীলের চাহিদা অনেক বেশি। এটাকে আমরা সূ’য়ে আদব নাম যদিও দিই, কিন্তু বাস্তব কথা এটাই যে, দলীল ছাড়া কথা এখন কেউ নিতে চায় না। আর যেখানে অজু গোসলের সাধারণ মাসআলাতেও আমরা সপ্তাহ দুই সপ্তাহ সময় নিই এবং দশটা-বারোটা হাওয়ালা দিয়ে বলি, সেখানে উম্মাহর এমন এমন ভয়ানক মানহাজি ফিতনার সমালোচনা শুধু মুখে *মুখে করে গেলে কে মানতে রাজি হবে?!
ঘ. মুজাহিদিন, মুসলিম-নামধারী ও অমুসলিম তাগুতগোষ্ঠীর ব্যাপারে মুজাহিদিনের অবস্থান, গ্লোবাল জিহাদ এবং শরীয়ত প্রত্যাখ্যানকারী মুসলিমনামধারী শাসকদের ব্যাপারে মারকায কখনও কোনো পরিষ্কার কথা বলে না। যতদিন অবস্থান পরিষ্কার না করা হবে, অবশ্যই অনুসারিরা সহীহ দিক নির্দেশনা পাবে না। আপনারা বর্তমান তাগুতি দুনিয়ার ব্যাপারে কি মত পোষণ করেন, মুজাহিদিনের সাথে এক্ষেত্রে আপনাদের কোন কোন বিষয়ে দ্বিমত এবং কুরআন সুন্নাহর আলোকে কোনটা সহীহ- এসব কিছু যদি পরিষ্কার না করা হয়, তাহলে যাদের এ মানহাজি ফিতনা থেকে বাঁচানো উদ্দেশ্য, তারা কখনও সহীহ রাস্তা পাবে না। আর মানহাজিদের আচরণ থেকে তো স্পষ্টই যে, তারা থেমে যাবার মতো লোক নয়। এভাবে ধোঁয়াশায় থেকে গেলে না মানহাজিরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে, আর না অনুসারিরা মানহাজি ফিতনা থেকে বাঁচতে পারবে। বরং মানহাজিদের দল দিন দিন ভারীই হচ্ছে। পাক-সাফ অবস্থান না নিলে শুধু ইজমালি কিছু সমালোচনার উপর ভরসা অনেকে করতে পারবে না আর পারছেও না। তখন শুধু আফসোসই করতে হবে যে, বিশ্বস্ত লোকগুলোও ছুটে যাচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।
ঙ. আপনাদের ভাইদের সাথে রহমের আচরণ করুন। তাগুত শাসকগোষ্ঠী আপনাদের যে পরিমাণ গালিগালাজ করছে, হুমকি ধমকি দিচ্ছে- এরপরও তাদের সাথে আপনাদের আচরণ-কথাবার্তা কেমন হচ্ছে আর মানহাজিদের সাথে কেমন হচ্ছে আপনারা নিজেরাই একটু বিবেচনা করুন। আসলেই ব্যাপকভাবে মানহাজিরা এর উপযুক্ত? না’কি আরও একটু রহম তাদের প্রাপ্য? একটু নির্জনে ফিকির করুন। সবাইকে আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হবে। আল্লাহ তাআলা সেদিন সবার থেকে সবার হক আদায় করবেন।
চ. আপনারা মানহাজিদেরকে সরাসরি ফিথনা ও ضلالة এর কাতারে ফেলে দিচ্ছেন। অথচ আপনারা নিজেরাও জানেন, মানহাজিদের পক্ষে যুগের শ্রেষ্ঠ শত হাজারো হকপন্থী আলেম উলামা ছিলেন এবং আছেন। তাদের রায় যদি আপনারা ভুলও মনে করেন, তাহলেও একে ফিতনা বা ضلالة অবশ্যই আখ্যা দিতে পারেন না। আপনারা আবারও একটু ভেবে দেখুন, মানহাজিরা সব সময় কুরআন সুন্নাহ এবং মু’তামাদ আলাইহি উলামাদের হাওয়ালায় কথা বলে। একটা কথাও তারা নিজেদের থেকে দলীলবিহীন বা হাওয়ালাবিহীন বলে না। তাদের আচরণ থেকে স্পষ্ট, তারা হকতলবি। হকের সন্ধানী। যদি ভুল হয়, ইজতিহাদি খাত্বা আখ্যা দিতে পারেন। সে রকম আচরণই তাদের সাথে করুন। এ ধরনের ইখতিলাফকে অবশ্যই বলা ضلالة যায় না। বিশেষত যখন শত হাজারো হকপন্থী এবং যুগশ্রেষ্ঠ আলেম তাদের পক্ষে আছেন এবং ফতোয়া দিয়েছেন। তখন -আপনারাই বিবেচনা করুন, কিভাবে তাদেরকে ضلالة -এর কাতারে গণ্য করছেন?! এ ধরনের ভুলের ক্ষেত্রে আপনাদের প্রথম দায়িত্ব: দলীলের আলোকে ভুল ধরিয়ে দিয়ে সহীহ রাস্তা দেখিয়ে দেয়া। এরপরও ফিরে না আসলে কথা ভিন্ন। অধিকন্তু ফিরে না আসলেও ضلالة আখ্যা দেয়া যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, শত হাজারো হকপন্থী যুগশ্রেষ্ঠ আলেম তাদের পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন। তাদের ফতোয়া এবং কিতাবাদি দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে আছে। অস্পষ্ট কিছু নয়। অল্প দু’চারজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন কোনো মতও নয় যে, ضلالة আখ্যা দিয়ে দেয়া যায়।
পরিশেষে সবার প্রতি নিবেদন থাকবে, যেমনটা শায়খ আইমান আযযাওয়াহিরি হাফিযাহুল্লাহ জানিয়েছেন,
“# আল-কায়দার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে পূর্বেও বিভিন্ন অপবাদ দেয়া হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে। ... তারা আমাদের তাকফিরি, কট্টরপন্থী, চরমপন্থী, অর্থ ও ক্ষমতা লোভী এবং অথর্ব বলে গালমন্দ করেছে। ... এসকল অপবাদের মুখে ধৈর্য ধারণের প্রতিদান আমরা আল্লাহর কাছে পাব ইনশাআল্লাহ।
তবে আমি এখানে যে বিষয়টি স্পষ্ট করতে চাই তা হল; এই বিভ্রান্তি ও প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে স্বাধীনচেতা ও উদার দর্শকদের সতর্ক করা। আপনারা কোন সংশয়ের সম্মুখীন হলে প্রথমে আল-কায়দার বার্তাগুলো দেখবেন। এই বার্তাগুলো আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এগুলো জাতির কাছে পৌঁছে দেয়ার পর, এটিকে মুসলিম উম্মাহ গ্রহণ করলে সেটাই আমাদের সত্যিকারের বিজয়। যদি কেউ এই বার্তাগুলোতে ভাল এবং সত্য বিষয় খুঁজে পান তবে তার উচিত হবে সে বিষয়গুলো মেনে নিয়ে আমল করা। আর যদি এর মধ্যে সত্য ছাড়া অন্য কিছু থাকে তবে সে যেন তা পরিত্যাগ করে এবং আমাদেরকে সে বিষয়টি সম্পর্কে উত্তম পরামর্শ দেয়।
# আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা হয়ে থাকে এবং অনেকেই দাবি করেন যে, তারা আমাদের ব্যাপারে অনেক ভাল জানেন। অথচ যা বলা হয় তার অনেক কিছুই সত্য নয়। অনেকক্ষেত্রে সেটা সত্য ও কল্পনার সংমিশ্রণ ছাড়া আর কিছু নয়। তাই আমি সম্মানিত দর্শকের (পাঠকের) কাছে - আমরা যা ঘোষণা করি সেগুলি ছাড়া ভিন্ন কিছুর সাথে আমাদের সম্পৃক্ত না করার অনুরোধ করছি। যদি কেউ এসে বলে: আমি আল-কায়দার সদস্য, বা কোন গোয়েন্দা সংস্থা যদি কোন ব্যক্তিকে আল-কায়দার সদস্য বলে দাবি করে তবে তার জন্য আমরা দায়ী নই। একইভাবে কোন ব্যক্তি যদি কোন দলের সাথে যুক্ত থাকে এবং সে দল আল-কায়দার সাথে যুক্ত থাকার দাবি করে, এবং সে ব্যক্তি দলের সাথে থাকার কারণে নিজেকে আল-কায়দার সদস্য বলে দাবি করে অথচ আমরা সে ব্যাপারে কোন ঘোষণা জানাইনি, এমন দল বা ব্যক্তিদের ব্যাপারেও আমরা দায়ী থাকব না। হে আল্লাহ্! আপনি সাক্ষী থাকুন, আমি পৌছে দিয়েছি।”