মরনজয়ী মুজাহিদ
মল্লিক আহমদ সারওয়ার
========================================================================
আলী তার সাথী মুজাহিদদেরকে তিনটি দলে ভাগ করে দিলেন। পাঁচ জনের একটি গ্রুপকে শত্রু বাহিনীর লটবহর কব্জা করে দ্রুত গিরি পথে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। তাদের বলে দিলেন, প্রয়ােজনীয় অস্ত্র গাড়ীতে নিয়ে আসতে যেন তারা ভুল না করে। দশজন মুজাহিদের অন্য একটি দলকে বললেন, তােমরা শত্রুদের সবগুলাে তাঁবু ও গােলাবারুদে আগুন ধরিয়ে দিবে। তবে নিজেদের নিরাপত্তার প্রতি খেয়াল রেখাে। আগুন লাগানাের পর পূর্বদিক থেকে আগমনকারী সম্ভাব্য শত্রুদের তােমরা গতি রােধ করবে। যেন আমরা শত্রু বেষ্টিত হয়ে না পড়ি। এ দুই দল নিজেদের কর্তব্য পালনে চলে গেল।
এর পর আলী শত্রু বেষ্টিত মুজাহিদ কমান্ডারের সাথে ওয়ারলেসের মাধ্যমে বললেন, আপনারা উত্তর দিক দিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন। শত্রু বেষ্টিত কমান্ডার বললেন, উত্তর দিকে শত্রু বাহিনী আমাদের জীবিত আটক করার জন্য ওঁৎ পেতে রয়েছে। আলী তাকে বললেন, আপনারা দ্রুত রেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন। দশ মিনিটের মধ্যে সামনের পথ পরিস্কার হয়ে যাবে। শত্রুদেরকে আপনারা পূর্ব দিকে পালায়নপর দেখতে পাবেন। এ মুহুর্তে শত্রুরা আমাদের বেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে। এর চেয়ে বেশী আর কিছু আমি এখন বলতে পারছি না। তাড়াতাড়ি করুন। সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না।
শত্রু বেষ্টিত কমান্ডারের সাথে কথা শেষ করে আলী তার পনেরজন মুজাহিদ সাথী সহ শত্রু ক্যাম্পের দিকে এগুতে লাগলেন। তারা দুশমমনের দৃষ্টি এড়ানাের জন্য হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হন।
রাত ভাের হয়ে আসছিল। দ্রুত তাদের অপারেশন ফলপ্রসু না হলে, না মুক্তি পেতাে শত্রু বেষ্টিত মুজাহিদরা না জীবন বাঁচাতে পারতাে আলী ও তার সাথীরা। এজন্য অতি দ্রুত ও নির্ভুল এ্যাকশনমূলক সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হয়েছে। আলীর দলের হাতে বন্দি রুশ সেনাদেরকেও তাবু ভষ্মকারী দশ মুজাহিদের সহযােগিতার জন্যে পাঠিয়ে দেয়া হল । এ দশজনকে বলে দেয়া হলাে, তাবুর ভিতরে কোন শত্রুসেনা পেলে এদের খতম করে ফেলবে। কারণ অধিক বন্দীদের পাহারা দেয়ার মতাে পর্যাপ্ত জনবল আমাদের নেই।
আলী ও তাঁর সাথীরা পাহাড়ের মাঝামাঝি উঠেই শত্রু সেনাদের ছাউনী স্পষ্ট দেখতে পেল। শত্রুদের দৃষ্টি এড়ানাের জন্যে ঝােপ ও বড় বড় পাথরের আড়ালে সবাই লুকিয়ে পড়ল। শত্রুতাবু জ্বলে উঠলেই সেনা ছাউনি গুলাের দিকে রকেট হামলা করার সিদ্ধান্ত ছিল। আলী এজন্য শত্রু তাবুর দিকে গভীর দৃষ্টি রাখল। কিছুক্ষণ পরেই আলী দেখলেন শত্রু বাহিনীর তাঁবু দাউ দাউ করে জ্বলছে এবং লাট বহর নালার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দেখতে দেখতেই শত্রু বাহিনীর অস্ত্রভান্ডারে বিস্ফোরণের ঘটায় আকাশময় ধুয়ায় ছেয়ে গেল ।
এই সুযােগের অপেক্ষায়ই ছিল আলী। সংকেত দিতেই সকল সাথীরা পাহাড়ের উপর শত্রু ছাউনী গুলােয় একসাথে রকেট হামলা চালাল। এই হামলা ছিল শত্রুদের সম্পূর্ণ ধারণাতীত। দুশমনরা হঠাৎ হামলার শিকার হয়ে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে প্রাণ ভয়ে পালাতে শুরু করল। আলীর ধারণানুযায়ী ওরা পূর্ব দিকেই পালাচ্ছিল। ওয়ারলেসের মাধ্যমে আলী শত্রু বেষ্টিত মুজাহিদদের পথ শত্রুমুক্ত হওয়ার শংকেত দিয়ে দুশমনদের ছাউনী দখল করে নিল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই শত্রু বেষ্টিত মুজাহিদরা আহত ও শহীদ মুজাহিদদের নিয়ে দখলকৃত ছাউনীতে এসে পৌছাল। আলী তাদেরকে বলল, আপনারা দ্রুত গিরি পথে চলে যান। সেখানে আমাদের পাঁচ জন মুজাহিদ পাহারারত রয়েছে। আমরা বড়জোর দশ মিনিট এখানে শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখব। ওরা যদি বুঝতে পারে আমরা হটে যাচ্ছি তাহলে পিছন থেকে হামলা করতে পারে।
রকেট হামলায় পলায়নপর রুশ ও নজীব বাহিনীর মৃত লাশ বিক্ষিপ্ত ভাবে ফেলে রেখে বাকীরা পালিয়ে গেল। আলী যখন নিশ্চিত হলাে যে, শত্রু বেষ্টিত মুজাহিদরা গিরিপথে পৌছে গেছে, তখন বিশেষ সাংকেতিক কোরে দশজনের গ্রুপটিকেও গিরিপথে চলে যাওয়ার নিৰ্দিশ দিয়ে নিজে সেনা চৌকির গােলা বারুদ নিষ্ক্রিয় করার কাজে লেগে গেলাে।
আলী আগেই কয়েকটি প্রেশার বােমা সাথে নিয়ে এসে ছিলাে। সে তড়িৎ মৃত পাঁচ শত্রু সেনার পেটে প্রেশার বােমা রেখে দিলাে। মুজাহিদ পাঁচ জনকে তাঁর সাথে থাকার কথা বলে অন্যদের গিরি পথে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলাে। এ পাঁচজন সাথীকে দুশমনদের প্রতি প্রচন্ড ফায়ারিং অব্যহত রাখার জন্য বললাে। মজার ব্যাপার হলাে, তখন শত্রুদের অস্ত্র দিয়েই তাদের প্রতি আঘাত জোরদার করা হয়েছিল।
কিছুক্ষণ পর সাথী পাঁচ জনকে নিয়ে আলী। গিরিপথে সবার সাথে মিলিত হয়ে বললােঃ ছােট ছােট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আমাদের এখান থেকে যেতে হবে ।
গিরি পথে যাওয়া নিরাপদ নয়। শত্রুদের পােতা মাইন থাকতে পারে। আসার পথেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। গাড়ী থেকে নেমে আলী ও অন্যান্য মুজাহিদরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে মাত্র পাহাড়ের মাঝামাঝি পৌছে ছিল, এসময়ই শত্রুবাহিনী বােমারু বিমান থেকে প্রচন্ড বােমা হামলা চালাল। দ্রুত মুজাহিদরা ঝােপ ঝাড় ও পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল! শত্রুরা মুজাহিদদের অবস্থান পুরােপুরী সনাক্ত করতে না পেরে জনশুন্য গাড়ী গুলাের উপর বােমা নিক্ষেপ করল। কিন্তু দুটি বােমা এদিকে নিক্ষিপ্ত হওয়ায় দু’জন মুজাহিদ শহীদ হলেন। বােমা হামলা ক্ষান্ত হলে আলী সাথীদের বললাে, তাড়াতাড়ি পাহাড়ের শেষ মাথায় পৌছানাের চেষ্টা করুন। এদিকে লুকানাের মতাে ঘন ঝােপ ঝাড় নেই। শত্রুদের হেলিকপ্টার এসে গেলে আমাদের কারাে জীবন বাচাঁনাে সম্ভব হবেনা।
আলী ও সাথীরা নিহত ও আহত মুজাহিদদের তখনও অপারেশন থেকে ফিরেননি। শত্রু বেষ্টনিতে আটকে পড়া মুজাহিদ কমান্ডার আলীর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, এই বেষ্টনী থেকে জীবিত বেরিয়ে আসার কোন আশা আমাদের ছিল না। আমি এখনাে বিশ্বাস করতে পারছি না, এ কোন বাস্তব ঘটনা না স্বপ্ন ! আমি পাহাড়ের চূড়ায় লােক দেখে মনে করে ছিলাম, এ অপারেশনের কমান্ডার তুমি ছাড়া অন্যকেউ হবে। কারণ তােমাকে আমি খুবই নবীন অপরিপক্ক ভেবেছিলাম । আমি অত্যন্ত গর্বিত ও প্রীত যে, তােমাদের মতাে সাহসী ও মেধাবী তরুণ আমার দেশে এখনও আছে। তােমার মতাে যুবক আমার এক ছেলে গত বছর রণাঙ্গানে শহীদ হয়েছে।
রাতের এই অভিযানের অবর্ণনীয় পরিশ্রমে মুজাহিদরা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ক্লান্ত মুজাহিদরা ক্যাম্পে পৌছাল। সকলের চোখেই ঘুম। শহীদদের দাফন এবং আহতদের চিকিৎসা করে সবাই নাশতা সেরে ঘুমিয়ে গেল।
মুজাহিদরা যখন ঘুম থেকে উঠল ,তখন জোহরের সময় হয়ে গেছে। কিন্তু কমান্ডার ওমর তখনও ক্যাম্পে ফিরেননি। আলী ভাবতেছিলেন, কয়েকজন মুজাহিদকে তার খোঁজে পাঠাবেন। এসময়ই পাহারারত মুজাহিদরা হাঁক দিলাে, কমান্ডার ওমর আসছেন। কমান্ডার ওমরকে স্বাগত অভিবাদন জানানাের জন্যে সব মুজাহিদ ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে এলাে। পুরাে ক্যাম্প উচ্চকিত হলাে তকরিব ধ্বনীতে। কয়েকজন মুজাহিদ ক্লাশিনকভের ফাঁকা গুলি ছুড়ে উল্লাস প্রকাশ করলেন।
কমান্ডার ওমর আলীকে বুকে জড়িয়ে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর শত্রু বেষ্টনি থেকে বেরিয়ে আসা ওই কমান্ডারের সাথে কোলাকুলি করলেন।
কমান্ডার উমর আলীর কাছে অভিযানের বিস্তারিত কাহিনী শুনে বলেন, তােমাদের পাঠিয়ে দিয়ে আমি ভীষণ চিন্তায় ছিলাম। বার বার আল্লাহর কাছে সফল ভাবে তােমাদের ফিরে আসার দু'আ করেছি। আর জানাে, আমরা আকুস্থলে পৌছা মাত্রই দুশমনদের উপর ফায়ার শুরু করে দেই। ওরা হয়তাে ভেবেই ছিল, এদিক থেকে আমাদের আক্রমণ হতে পারে। শত্রুবাহিনীর জবাবী হামলায় অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের পাঁচজন শহীদ হল। এর পর আমরা অবস্থান বদলে নিয়ে আত্মরক্ষা করলাম। বেলা উঠার পর আমি এক সাথীকে পাহাড়ের চূড়ায় আরােহন করে দুশমনদের অবস্থান নির্ণয় করতে বললাম। সে এসে জানাল, ওরা ট্যাংক ও সাজোয়াযান সহ পিছু হঠছে। আমি তার কথায় দ্বিধামুক্ত হতে পারলাম না। আমাদের ফায়ার ওদেরকে আঘাত করছে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি নিজেই পাহাড়ে চড়লাম। দূরবীনে দেখতে পেলাম, সে ঠিকই বলেছে। আমি এদের তাড়া করার ইচ্ছা করলাম। কিন্তু ইত্যবসরে শত্রু বাহিনীর বােমারু বিমান আমাদের মাথার উপরে এসে গেছে। অগত্যা আমরা পিছুটান দিতে বাধ্য হলাম। কারণ বিমান বিধ্বংসী রকেট আমাদের হাতে ছিল না। অবশ্য থাকলেও বিমান সনাক্ত করার উপায় ছিল না। বহু উপর থেকে ওরা বােমা নিক্ষেপ করছিল। এজন্য আমাদের ফিরতে বিলম্ব হয়েগে। কিন্তু তুমি যে অস্বাভাবিক, সফল, অপারেশন করেছে, তা চির দিন অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে।
আলী হায়দার-মারকাজে পৌছার জন্য তৈরী হচ্ছিলেন। এ মুহুর্তে নজীব পক্ষত্যাগী দু'জন সিপাহী এসে হাজির। এরা বলল, গত ভােরে আপনারা যখন আমাদের চৌকিতে হামলা করেছিলেন, তখন আমাদের অফিসাররা ধারণা করেছিল, বহু সংখ্যক মুজাহিদ চতুর্দিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। তাবু গুলাে যখন জ্বলে উঠলাে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলাে গােলা বারুদ, আর আচমকা সেনা ছাইনিতে রকেট বর্ষণ হতে লাগল, তখন মুকাবেলার কথা ভাববে তাে দূরের কথা নিজ জীবন নিয়ে পালানাের চেষ্টাতেই সবাই ছিল ব্যাস্ত। ক্যাম্পের দক্ষিণ দিকে যেসব সেনা ছাউনী ছিল এদেরও পলায়নের নির্দেশ ছিল। দ্বিপ্রহরের পর যখন আবার অফিসাররা সব একত্রিত হলাে, তখন অনেকেই বলল, যদি মুজাহিদ সংখ্যা অধিক হতাে তাহলে এরা যে ভাবে আমাদের ঘিরে ফেলেছিল, অবশ্যই আমাদের পশ্চাদাবন করতাে, আর এ অবস্থা হলে আমরা একটি ছাউনীও রক্ষা করতে পারতাম না।
আসরের দিকে যখন আপনারা চলে এলেন, তখন ওরা খবর পেল যে, উত্তর দিক থেকেও আপনারা হামলা করে ছিলেন। ওদের ধারনায় আপনাদের সংখ্যা এক হাজারের চেয়ে কম ছিল। সন্ধ্যায় সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক সহ বিশাল কনভয় মৃত লাশ উঠিয়ে নেয়ার জন্য ক্যাম্পে এলাে। তখন গােলাবারুদ অটুট ও অক্ষত দেখতে পেয়ে ওরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল। পশ্চিমের পাহাড় থেকে মৃত লাশ উঠানাের সময় বিস্ফোরণে কয়েকজন রুশ ও সরকারী সেনা নিহত হল । যারফলে কয়েকটি লাশ ফেলেই ওরা চলে গিয়েছে। আর আমরা আগেই সরকার পক্ষ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম। এই সুযােগে আমরা দু’জন পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। অন্ধকার নেমে এলে বেরিয়ে আপনার ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ভাবতেছিলাম, পথে কোন মুজাহিদ পেলে আপনাদের ঠিকানা জেনে নিব। এর পর পথিমধ্যে আমাদেরকে দু' মুজাহিদ গ্রেফতার করে আপনার এখানে নিয়ে এলাে। নজীব পক্ষত্যাগী সৈনিকদ্বয়ের কথা শুনে আলী অনুতপ্ত ও আনন্দিত হলেন। বললেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা দ্বারা আমাদের মদদ করেছেন। না হয় ত্রিশজন মুজাহিদকে এক হাজার মুজাহিদের মতাে শক্তিশালী মনে করার কথা নয়। কিন্তু তিনি আফসােস করলেন এই বলে যে, আমরা কাপুরুষের মতাে পিছিয়ে এসেছি। দুশমনদের গােলাবারুদ আমাদের নিয়ে আসা উচিৎ ছিল । কমান্ডার ওমর আলীর একথা শুনে বললেন, যে বিরাট বিজয় তােমরা অর্জন করেছাে এটা কোন ভীতু কাপরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ নিশ্চয়ই এতে মদদ করেছেন। কাপরুষদের কখনও আল্লাহ সাহায্য করেন না। ওমর বললেন, কিন্তু লাশগুলাে বিস্ফোরিত হওয়ার বিষয়টি আমি বুঝে উঠতে পারছিনা, তার রহস্য কি?
আলী, কমান্ডার ওমরকে বললেন, আমি সাথে করে প্রেশার বােমা নিয়ে গিয়েছিলাম। কয়েকটা লাশে সে কয়টা পুশকরে দিয়ে ছিলাম । (চলবে)
অনুবাদঃ শহীদ আহম্মদ
═──────────────═