ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্বের যৌক্তিকতা
মাওলানা হিফজুর রহমান
অনুবাদকঃ মাওলানা আব্দুল আউয়াল
পৃথিবীতে একটি কল্যাণধর্মী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এজন্য প্রয়োজন যে, আল্লাহ প্রদত্ত জীবনোপকরণ থেকে উপকৃত হতে হবে যা প্রতিটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ।কিন্তু জীবন ও জীবনোপকরণের সাথে যখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রবৃত্তি বা অনুভূতির সংঘাত বাঁধে তখন প্রকৃতির বিধান যা আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে সমগ্র বিশ্বকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে তা প্রতিটি মানুষকে সমাজ বদ্ধ জীবন যাপনে বাধ্য করে।কিন্তু ন্যায়নীতি ও সাম্যের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগীতা ও সহমর্মিতা না থাকলে উক্ত সমাজ বদ্ধ জীবন ব্যবস্থার কথা কল্পনাই করা যায় না। বস্তুত ন্যায়নীতি ও জীবনধারার ক্ষেত্রে সাম্যই হবে উক্ত ব্যবস্থার চাবিকাঠি। আর মানব জাতির জীবন ব্যবস্থায় নিম্নের নীতিগুলো কার্যকর থাকলেই সমাজদেহে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব।
১। উক্ত ব্যবস্থাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তির জীবনোপায়ের জিম্মাদার হতে হবে।তার কর্মক্ষেত্রে কেউ যাতে জীবনোপায় থেকে বঞ্চিত না হয়, এই নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
২। যেসব উপকরণ অর্থনৈতিক প্রাধান্যের সুযোগ সৃষ্টি করে, মানব সমাজে শোষণ-নির্যাতনের পথ উন্মুক্ত করে এবং অর্থ ব্যবস্থার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেগুলো নির্মূল করতে হবে।
৩। সম্পদ ও সম্পদ-উপকরণ কোন বিশেষ ব্যক্তি বা শ্রেণীর কুক্ষিগত হওয়া থেকে মুক্ত রাখতে হবে এবং উক্ত ব্যক্তি বা দলকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গোটা মানুব সমাজের কল্যাণ সাধনের পরিবর্তে উক্ত বিশেষ শ্রেণীর উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার হাতিয়ারে পরিণত হবে না।
৪। শ্রম ও পুঁজির মধ্যে সুষ্ঠু ভারসাম্য কায়েম করতে হবে এবং এককে অপরের সীমানায় অন্যায় হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে হবে।
-অর্থনীতির আধুনিক চিন্তাধারা
উপরোক্ত নীতিমালা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে লক্ষণীয় বিষয় হলো, বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে অর্থনীতি বিদ্যা সম্পর্কে যেসব খুঁটিনাটি তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তার সারাংশ। অর্থনীতি সম্পর্কে যেসব দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা যায়,তা হলো তিন প্রকার।অতি প্রাকৃতিক জ্ঞানগত দৃষ্টিকোণ, প্রাকৃতিক জ্ঞানগত দৃষ্টিকোণ এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ। অর্থনীতিবিদরা এগুলোকে যথাক্রমে মানদন্ডিক বা আদর্শিক দৃষ্টিকোণ, বিন্যাসিক দৃষ্টিকোণ ও বস্তুগত দৃষ্টিকোণ বলে অভিহিত করেছেন।মানদন্ডিক বা আদর্শিক অর্থনীতি কাকে বলা হয়, একজন অর্থনীতিবিদের ভাষায় দেখুন। তিনি বলেছেনঃ
" মানদন্ডিক অর্থনীতির উদ্দেশ্য বর্তমান জীবনোপায়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করা নয়।সুষ্ঠু জীবনোপায় অন্বেষণই এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। অর্থনীতি নামীয় যন্ত্রটির বিভিন্ন অংশ কীভাবে কাজ করছে, শুধু এইটুকু জানিয়েই সে সন্তুষ্ট নয়।সে জানতে চায়, অর্থনীতি যন্ত্রটি কীরূপ হতে হবে।
মানদন্ডিক অর্থনীতির দৃষ্টি অনেক উঁচু। সে অর্থনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণের প্রত্যাশী।আর এ উদ্দেশ্য নির্ধারণকে সে ইলম বা জ্ঞানচর্চা বলে অভিহিত করে। যেসব চিরন্তন আইন-কানুন নৈতিক জগতে প্রচলিত ও মানব জাতির জীবনোপায়ের পরিমন্ডল এবং যেসব আইন-কানুন তদ্বারা পরিচালিত সেগুলো অনুসন্ধান করা পরিমাপগত অর্থনীতি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করে।আর এই অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে সুষ্ঠু জীবনোপায় খুঁজে বের করা। অর্থাৎ সে জীবনোপায় মানুষের জীবন ও জগতের লক্ষ্যানুগ হবে এবং তার সাথে সম্পৃক্ত হবে।বস্তুত এই সুষ্ঠু ও কল্যাণকর জীবনোপায়ই সেসব পরিমাপের কল্পনার কেন্দ্রবিন্দু। এটা পরিমাপ বা নির্ণয় করার পর অন্যান্য সকল সমস্যা যেমন সংগত ও সঠিক পারিশ্রমিক, সম্পদের সংগত ও সঠিক বন্টন, সুদের বৈধতা-অবৈধতা সব কিছু এমনি মীমাংসা বা সমাধান হয়ে যাবে।
মানদন্ডিক অর্থনীতির দৃষ্টিতে তাদের ব্যবস্থায়ই সুষ্ঠু ও উন্নতমানের জীবনোপায় রয়েছে।বাকিসব এর চাইতে নিম্নমানের এবং এর অধঃস্তন অর্থনীতির কাজ হলো এর চেয়ে আরো উন্নতমানের অনুসন্ধান করা।উন্নতমানের সাথে নিম্নমানগুলোর সংগত ও সমন্বিত রূপ সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া। আর যেসব অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারা সেগুলোকে উন্নতমানের কষ্টিপাথরে পরখ করে তার মধ্যে ভাল-মন্দ ও শুদ্ধাশুদ্ধির ফায়সালা করবে। [১]
বিন্যাসিক অর্থনীতি প্রকৃতি বিজ্ঞানেরই একটি শাখা। প্রকৃতি বিজ্ঞানের ভিত্তির উপর বিন্যাসিক অর্থনীতির ইমারাত গড়ে তুলো। কিন্তু কর্মজীবনে তার মর্যাদা ও গুরুত্ব স্বীকার করে নেয়া সত্ত্বেও এর ভিত্তিটা যে কি, উক্ত লেখকের ভাষায় তা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ
উপরোক্ত তিনটি গ্রুপের (কল্পিত, স্থাপিত ও গাণিতিক) মধ্যে সাযুজ্যতা হলো এই যে, এগুলো দর্শনের চাইতে ইলম বা জ্ঞানের অধিক সমর্থক। অর্থাৎ "আছে" বস্তু নিয়ে আলোচনা করতে চায়। যা হওয়া উচিত তার সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক রাখে না। সকল প্রকার অভিজ্ঞতা বহির্ভূত ও অতি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে নিজের জ্ঞানকে পূতপবিত্র রাখতে চায়।এসব গ্রুপ অর্থনীতির ক্ষেত্রে নৈতিক বিধি-বিধানের চরম বিরোধী।তাদের নিকট প্রকৃতি বিজ্ঞানই হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান।এই জ্ঞানক্ব সকল জ্ঞান বিশেষ করে অর্থনীতির ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এজন্যই বিন্যাসিক অর্থনীতির উদ্দেশ্য হলো, 'আইন-কানুন প্রণয়ন করা'। যাতে প্রতিটি অর্থনৈতিক বিষয়কে কোন আইনের অধীনে বিশেষ একটি অংশ হিসেবে আনা যায়।এটাই তাদের নিকট তাত্ত্বিক জ্ঞানের পুঁজি। [২]
ইউরোপের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরা উপরোক্ত মতবাদ সমর্থন করেন।তাদের মধ্যে রয়েছে, জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart mill), কার্ল মিংগার(Carl minger), কার্ল মার্কস(Carl Marx), প্যারিটো (Parito) প্রমুখ।
বস্তুগত অর্থনীতিকে 'ইলমে তামাদ্দুনের' একটা অংশ মনে করতে হবে।আর মানুষের হাতে সৃষ্ট ও লালিত পালিত সব কিছুকেই এখানে তামাদ্দুন বলে বোঝানো হয়েছে। কেননা, বস্তুগত বিদ্যার বুনিয়াদ এই নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত যে, সমশ্রেণীকে বুঝা সমশ্রেণীর পক্ষেই সম্ভব।নিম্নলিখিতভাবে এ কথার ব্যাখ্যা করা হয় এভাবেঃ
বস্তুগত বিদ্যার এই দার্শনিক মতবাদ দাঁড় করানো হয়েছে কতগুলো মৌলিক চিন্তা-ভাবনার ওপর।আর তা হলো সমশ্রেণী সম্পর্কে জ্ঞান অর্থাৎ সমশ্রেণীকে বুঝা সমশ্রেণীর জন্যই সম্ভব।আর যে বস্তুটি আমরা তৈরি করতে পারি তা আমরা সবদিক থেকে পুরোপুরি জানতে ও বুঝতে পারি।আর তামাদ্দুনিক বা সামাজিক অবস্থা অনুধাবন প্রচেষ্টায় যেহেতু বোধশক্তি অন্তরের এবং অনুধাবিত বস্তুটিও অন্তরেই রূপ লাভ করে সেদিক থেকে উভয়টিই সমশ্রেণীর।এজন্যই তা পুরোপুরি বুঝা বা অনুধাবন করা সম্ভব। আর পুরো তমদ্দুন বা সমাজই মানুষের হাতে তৈরি ও লালিত পালিত। সে-ই এটাকেগড়ে তুলেছে।এ জন্য সে এটাকে অনুধাবন করতে সক্ষম। অপরদিকে, 'প্রকৃতি' মানুষের অনুভূতির বাহ্যিক রূপ নয়,এ হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশের বাহ্যিক বা বাস্তব রূপ।প্রকৃতি' মানুষের তৈরি ও লালিত পালিত নয়। সে জন্য প্রকৃতিকে বুঝা বা অনুধাবন করা, তার সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান লাভ করা মানুষের অনুভূতি শক্তির পক্ষে সম্ভব নয়।
কিন্তু বস্তুগত অর্থনীতি জীবন ব্যবস্থার শুধু একটি অংশ বুঝতে চায়, অনুধাবন করতে চায়। নাগরিক জীবন কিংবা মানব জীবনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সে অনুসন্ধান চালাতে চায় না।
এজন্যই বস্তুগত অর্থনীতি দর্শন, অতিপ্রাকৃতিক কিংবা ধর্ম নয়। সোজা কথায়, এ হচ্ছে অভিজ্ঞতা প্রসূত, শ্রেণীগত ও সামাজিক জ্ঞান। [৩]
এই হলো অর্থনৈতিক বিদ্যার আধুনিক চিন্তাধারা বা মতবাদ যা নিয়ে আজ গর্ব করা হচ্ছে এবং এটাকে জ্ঞান-বিজ্ঞান হিসেবে মর্যাদা দেয়া হচ্ছে।
-ইসলামী ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ
কিন্তু ইসলামী 'জীবনোপায় ব্যবস্থার' সীমারেখা উল্লেখিত মতবাদ ও চিন্তাধারার চাইতে অনেক প্রসারিত এবং এর চিন্তার ব্যাপ্তি তা থেকে অনেক উঁচু। ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানদণ্ডিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উল্লেখিত বিষয়গুলো ছাড়াও আরো অনেক কিছু রয়েছে। অনুরূপভাবে, বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকেও সে অনেক ব্যাপক এবং অনেক কল্যাণকর কর্মপদ্ধতির প্রতিষ্ঠাতা।
দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মানদণ্ডিক অর্থনীতির মৌলিক ধারণা হচ্ছে কল্যাণকর জীবনোপায়ের পরিকল্পনা। কিন্তু পিছনে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কল্যাণকর জীবনোপায়ের যে বিশ্লেষণ দেয়া হয়েছে তার চাইতে বেশি কল্যাণকর জীবনোপায়ের ধারণা কি কেউ কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দেখাতে পারবে? কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চিন্তাধারা কি এতো উঁচুতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে?ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শুধু প্রয়োজনীয় উপকরণ ও প্রয়োজন মেটানোর মধ্যকার ব্যবধান দূর করাই নয় বরং এটা বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, মৈত্রী,সমবেদনা, নৈতিক উন্নতি ও চিরন্তন সুখ লাভের মাধ্যমও বটে।
বস্তুগত অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা ও গবেষণার ক্ষেত্র হচ্ছে বর্তমান কার্যকর অর্থনীতি। এটাই তার মেরুদণ্ড ও কেন্দ্রবিন্দু। এজন্যই সমাজের এই অধ্যায়টিতে সে শ্রেণীগত, নাগরিক ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত -এই তিন প্রকারে কার্যকরী করে।কিন্তু আমাদের সামনের আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত হবে যে, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ই সমাজের এই অধ্যায়টির সুন্দর ও অনুপম সমাধান দিয়েছে। শ্রেণী সংগ্রাম ও পুঁজিবাদের প্রভাববলয় থেকে দূরে রেখে অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার কষ্টিপাথরে যাচাই বা পরীক্ষা করে সে যেরূপ সমাধান দিয়েছে পৃথিবীর অন্য কোন কর্ম ব্যবস্থায়ই তা দৃষ্টিগোচর হয় না।
অবশিষ্ট রইলো বিন্যাসিক অর্থনৈতিক চিন্তাধারা। এই চিন্তাধারা তার দার্শনিক ও প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তাধারা হতে স্বতন্ত্র। বলা চলে সম্পূর্ণ বিপরীত। অবশ্য এর কিছু কিছু খুঁটিনাটি ভালো দিকও রয়েছে।এগুলো উক্ত চিন্তাধারা থেকে পৃথকভাবেও স্বতন্ত্র মর্যাদা রাখে।তবে এগুলো ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও রয়েছে।
দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, অর্থনীতির দৃষ্টিতে সবার আগে প্রয়োজন মেটানোর উপকরণগুলোর মধ্যকার ব্যবধান দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আর যে কোন রূপেই হোক, এই সব কাজে অসম্পূর্ণতা-সম্পূর্ণতা এবং উন্নতি-অবনতি হওয়া অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার। এজন্যই এমন একটি দর্শনের প্রয়োজন যা বিন্যাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করবে এবং সে সবের অসম্পূর্ণতা ও সম্পূর্ণতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করবে।আর এটা ইসলামী অর্থনীতিতে যদিও কোন বিশেষ বিদ্যা বা বিষয়ের মর্যাদা রাখে না তবুও হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহঃ এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন।তিনি এটাকে 'ইরতেফাকাত'[৪] বলে অভিহিত করেছেন।তিনি এর বিভিন্ন স্তরও নির্ধারণ করেছেন।এগুলোকে বাস্তব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা প্রভৃতির জন্য উপায় বা মাধ্যম হিসেবে মর্যাদা প্রদান করেছেন।অবশ্য বর্তমান অর্থনীতি বিদ্যার এই চিন্তাধারা জ্ঞানের একটি বিষয় হিসেবে ইসলামী অর্থনীতিতে কোন গুরুত্ব বহন করে না।সে এসবের পরিবর্তে এমন সব নীতি ও সেসবের অধীন এরূপ কার্যকর ব্যবস্থার পক্ষপাতি যা মানব জাতির ব্যাপক কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও শান্তির জন্য উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।অর্থনীতির যাত্রাপথে মানব জাতি যাতে সবল ও দুর্বল, অত্যাচার ও অত্যাচারিত ইত্যাদি শ্রেণীতে বিভক্ত না হয় সে ব্যবস্থা এ-র নিশ্চয়তা বিধান করবে।
অভিজ্ঞতা স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে, আধুনিক যুগে অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের তুলনায় অর্থনীতি বিদ্যা একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে।এশিয়া ও ইউরোপের পন্ডিতেরা এ বিষয়ে বিরাট বিরাট গ্রন্থ লিখেছেন। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও অর্থনীতি শাস্ত্রের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি সাধন আজ পর্যন্ত রূপকথার শুকপাখি হয়ে আছে।ধন-সম্পদ ও তার উপকরণ একটা বিশেষ শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে।সাধারণ মানুষের জীবন মৃত্যুর চাইতেও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।অপরদিকে, মহানবী সাঃ ও খুলাফায়ে রাশেদার আমলে অর্থনীতির এত সব তত্ত্ব কথা ছিল সম্পূর্ণ কল্পনাতীত ব্যাপার। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমগ্র ইসলামী রাষ্ট্রে একটা অনাবিল স্বচ্ছল অবস্থা বিরাজমান ছিল।মুসলিম, কাফির, মুমিন, মুশরিক, নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো, মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষে সবাই সুখ শান্তি ও স্বচ্ছলতার জীবন যাপন করছিল। ইতিহাসে দেখা যায়, এক পর্যায়ে ইসলামী রাষ্ট্রে মানুষ তার দানের সম্পদ নিয়ে ঘুরে বেড়াত।কিন্তু তা গ্রহণ করার কোনো লোক পাওয়া যেত না। [৫]
-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য
এছাড়া এ বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য যে, পৃথিবীতে কোন কাজই উদ্যোগ ও উদ্দেশ্য ছাড়া অস্তিত্ব লাভ করে না। প্রতিটি কাজের পেছনে একটা বিশেষ মানসিকতা কাজ করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কল্যাণকর-অকল্যাণকর হওয়ার পরিমাণও তার উদ্যোগ ও উদ্দেশ্যের ভাল-মন্দ হওয়ার উপর নির্ভর করে।যদি তার পিছনে খারাপ মানসিকতা কার্যকর থাকে, তাহলে পুরো উদ্যোগটাই খারাপ বলতে হবে।আর এরূপ অবস্থায় নিঃসন্দেহে উক্ত ব্যবস্থা মন্দ ব্যবস্থা। যদি কোন ব্যবস্থার পিছনে ভাল মানসিকতা কাজ করে এবং তার উদ্যোগ ও উদ্দেশ্য সবই ভালো হয় তাহলে উক্ত ব্যবস্থা বা পদ্ধতি কল্যাণকর হওয়া সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করারও অবকাশ নেই।
এই নীতির প্রেক্ষিতে আমরা যখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত করি এবং সুক্ষ্ম দৃষ্টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাই তখন তার উদ্যোগ, উদ্দেশ্য ও পিছনে কর্মরত মানসিকতাকে দুটি অবস্থায় সীমিত দেখতে পাই।তার মধ্যে একটি হলো, অধিক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং তার মধ্যে বিনিময় ও দর কষাকষির চেতনা জাগিয়ে রাখতে হবে। এরূপ ক্ষেত্রে মুনাফাবাজির 'আরো চাই' আরো চাই শ্লোগানকে কোন পর্যায়েই কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।এই চিন্তাধারাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে এবং এর ছত্রছায়ায় উক্ত ব্যবস্থা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
আমেরিকার ফোর্ড কোম্পানি কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া সত্ত্বেও বাজারে আরও অগ্রগতি চাচ্ছে।তার আরো অর্থ চাই।কারণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যে পরিবেশে সে ব্যবসা করছে তার বুনিয়াদ হচ্ছে অধিক মুনাফা ও দরকষাকষি। এই ব্যবস্থা ধনীকে আরো ধনী করে।অন্যদের নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর করে তোলে।এখানে প্রয়োজন মেটানোর চেতনা কাজ করে না যা সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বার্তা বয়ে আনবে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পিছনে কার্যকর অপর দিকটি হলো, এই ব্যবস্থার চেতনা ও উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন নয় বরং মানব জীবনের প্রয়োজন মেটানোর ও অভাব দূর করাই এর লক্ষ্য। আর এজন্য শুধু ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজন মেটানোর মানসিকতাই এর পিছনে কাজ করে।তাতে অধিক মুনাফা অর্জনের কোন অবকাশ নেই।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরোক্ত দুটি মানসিকতা কিংবা চেতনার মধ্যে ইসলামী অর্থনীতি শুধু একটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে।ইসলামের এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বুনিয়াদ হলো, মানব জাতির ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজন মেটানো এবং অভাব-অনটন দূর করা। ইসলাম অর্থনীতিকে বিত্তবানদের মধ্যে মুনাফা লুটার প্রতিযোগিতার মাঠে পরিণত করতে চায় না।সে এটাকে অভাব মোচন ও প্রয়োজন মেটানোর একটা কল্যাণকর মাধ্যমে রূপান্তরিত করে সবার জন্য অবারিত করার পক্ষপাতি। এ সম্পর্কে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছেনঃ
(ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়) অবশ্যই অধিক উপার্জনকারী সদস্য থাকবে।কারণ রুযী রোজগার ব্যতীত কোনো মানুষই জীবিত থাকতে পারে না। কিন্তু যে ব্যক্তি যত উপার্জন করবে সে পরিমাণ ব্যয় করতেও সে বাধ্য থাকবে।তাতে করে ব্যক্তির রোজগার যে পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে ব্যষ্টি হিসেবে ব্যষ্টির স্বাচ্ছন্দ্যও সে পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকবে।যোগ্য ব্যক্তিরা অধিক পরিমাণে উপার্জন করবে। কিন্তু তারা শুধু নিজের জন্য উপার্জন করবে না, সে উপার্জন হবে জাতির প্রতিটি লোকের জন্য।এক শ্রেণীর উপার্জন অন্য সবার জন্য দারিদ্র্যের সংবাদ বয়ে আনবে যা বর্তমানে সাধারণত হচ্ছে (ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায়) কখনো এরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। [৬]
উল্লেখিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরিষ্কার প্রতিভাত হয়েছে যে, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কল-কব্জাগুলো কিরূপ অনুপমভাবে সাজানো হয়েছে। এর ক্রমবিকাশ ও অগ্রগতি এমন সব সুশৃঙ্খল আইন-কানুন ভিত্তিক যা শুধু প্রকৃতি বিজ্ঞান পর্যন্ত এসে থেমে৷ যায় নি বরং নৈতিক ও ধর্মীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ হয়ে ধর্ম তথা আল্লাহর বিধানের অধীনে অস্তিত্ব লাভ করেছে। ইহকাল ও পরকালের জন্য কল্যাণকর কতগুলো নীতি হচ্ছে এই ব্যবস্থার প্রেরণা শক্তি।এসব নীতির দৃষ্টিতে অর্থ ব্যবস্থা হলো অভাব-অনটন দূর করা ও প্রয়োজন মেটানোর জন্য।অধিক মুনাফা ও লাভ অনুসন্ধানের জন্য নয়।বলা বাহুল্য, এ ধরনের সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব পৃথিবীর জন্য নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ ও কল্যাণকর বার্তাবহ।
সারকথা, ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি কল্যাণকর ব্যবস্থা। তাতে অর্থনীতি বিদ্যার প্রাচীন ও আধুনিক,ধর্মীয় ও যৌক্তিক সকল কল্যাণ নিহিত রয়েছে।এমনকি এই ব্যবস্থা তার চাইতেও অনেক বেশি সৌন্দর্যের অধিকারী এবং অপরাপর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দোষ-ত্রুটি থেকে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ মুক্ত।বলা চলে, এটা সেসব ব্যবস্থার বিষাক্ত প্রভাবের নজিরবিহীন প্রতিষেধক। সকল সৌন্দর্য ও গুণাবলি ছাড়াও এই ব্যবস্থার আর একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, এটা মানুষের মস্তিষ্কের গড়া নয়।আর মানুষের গড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে প্রতিশোধ কিংবা শ্রেণীগত বিদ্বেষের মতো অপরিপক্ক বিষয়। বস্তুত ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হলো বিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার গড়া ব্যবস্থা।
১। অর্থনীতির উদ্দেশ্য ও স্তর, ডঃ জাকির হোসেন, পৃঃ ১১-১২
২। পূর্বোক্ত, পৃঃ ৫৭
৩। পূর্বোক্ত, পৃঃ ৭৯-৮০
৪। আরবী 'ইরতেফাক' শব্দের বহুবচন 'ইরতেফাকাত' এর অর্থ উপকৃত হওয়া
৫। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫ম খন্ড, পৃঃ৬৪
৬। তরজুমানুল কুরআন, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৩২