JustPaste.it

আমার দেশের চালচিত্রঃ

 

আমাদের চরিত্র দেখে জাহিলিয়াতও লজ্জা পায়

মুহাম্মাদ ফারূক হুসাইন খান

================================================================

 

        এদেশে দাস ব্যবসা চলছে এ কথাটা বললে অনেকেই নিশ্চয় আঁতকে উঠবেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন আর না করুন এদেশে দাস  ব্যবসা চলছে এটা একটা ধ্রুত সত্য কথা। তবে তা আধুনিকতার মোড়কে অতীতের সকল ধরণ-ধারণ পাল্টে চলছে বলেই আমাদের চোখে তা ধরা পড়ে না। কিন্তু মানবীয় মনা আর সুক্ষ অনুভুতি নিয়ে একটু পর্যবেক্ষণ করুন দেখবেন, আপনারা আমার সাথে একমত হবেন। তবে কিভাবে আধুনিক এ সভ্য যুগে, উন্নয়নশীল এ দেশটিতে দাস ব্যবসার মতো ঘৃণা মধ্যযুগের ব্যবসাটা চলছে সেই রহস্যের রাজ্যে প্রবেশ করার আগে সেই মধ্যযুগীয় ব্যবসার ধরণা-ধারণা সম্পর্কে আবার একটু পরিচিত হওয়া যাক।

 

        সে যুগে শক্তিশালী লোক দুর্বলকে সুযোগ পেলেই ধরে নিয়ে দাস কেনা-বেচার বাজারে বিক্রি করে দিত। সে সমাজে যেমন বিভিন্ন স্থানে ছেলে ধরা চক্র গড়ে উঠেছিল তেমনি নিরহ লোকদের ধরে নিয়ে বিক্রি করার জন্য বিভিন্ন দল বা চক্রও ছিল। কোন দেশের রাজা যদি দুর্বল প্রতিপক্ষ রাজাকে পরাজিত করত তবে পরাজিত বাহিনীর বন্দীদের দাস রূপে বাজারে বিক্রি করতো অথবা আমির, উমারা ও জমিদারের চাহিদা অনুযায়ী দাসী হিসেবে ব্যবহার করার জন্য রেখে দিত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর ইউরোপ ও আফ্রিকার এই ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠে। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের উপনিবেশ সমূহ থেকে সম্পদ লুট করার কাজে দাসদের ব্যাপকহারে ব্যবহার শুরু করে। তারা বিজিত এলাকা বিশেষ করে আফ্রিকান হাবশি ও নিগ্রোদের জাহাজ বোঝাই করে বিভিন্ন এলাকায় দাস হিসেবে বিক্রি করার এক জমজমাট ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল। ইউরোপ যতই কৃষি যুগ ছেড়ে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে ঝুকে পড়েছিল ততই দাসদেরর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

 

        সে যুগে কোন মানবিক অধিকার ছিল না। মনিব চাবুক দিয়ে যতক্ষণ পারত শ্রম আদায় করে নিত। শিল্প-কারখানা, জাহাজের দাড় টানা, খনিজ সম্পদ উত্তোলন, মালগাড়ী টানা, কূপ থেকে পানি উঠিয়ে সেচকার্য সম্পাদন প্রভৃতি কার্যের দাসদের পেছনের মনিবের নিযুক্ত লোক চাবুক নিয়ে সদা তৎপর থাকতো। অনাহারে শীতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দাসরা নিস্তেজ হয়ে গেলও তাদের রেহাই হতোনা। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত মনিবেরা চাবুকের জোরে ও অন্যান্য শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের নিকট থেকে শ্রম আদায় করে নিত। এদের শিক্ষা চিকিৎসা তো দূরের কথা নিয়মিত খাবার পর্যন্ত দেয়া হতো না। শীতের বস্ত্র পেত না। মোটকথা এদের কোন মানবিক আচরণের যোগ্য মনে করা হতো না। মনিবেরা মনে করত শুধুমাত্র তাদের ফরমায়েশ অনুযায়ী রাত দিন পরিশ্রম করার জন্যই এদের জন্ম। বিধাতা এদের যে কোন পাপের কারণেই এদের এমন অভিশপ্ত করে সৃষ্টি করেছেন। একমাত্র মৃত্যুই এদের এ অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারবে এবং এভাবে তাদের শ্রম দান করাটাই এদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত।

 

        এই অভিশপ্ত দাস জীবনের সাথে যদি আধুনিক শহরের 'আয়া' , 'ঝি' , 'বুয়া' , 'দারওয়ান' , 'কাজের বেটি' বা 'বেটা' এবং গ্রামীণ কামলাদের জীবনের একটা সাদৃশ্য খোঁজা হয় তবে কি তা অযুক্তিক হবে? শহরের সাহেব-বিবি এবং গ্রামীণ জোরদার মাতাব্বর (সকলে নয়) এসকল উপাধিধারী কাজের লোকের সাথে যে অমানবিক আচরণ করে থাকে তাতে তাদের যদি মধ্যযুগের চাবুক হাতে সেইসব দাস প্রভু বা মনিবদের পশু চরিত্রের সাথে তুলনা করা হয় তবে তা কি ভুল হবে?

 

        সমাজ বদলে গেছে যুগের পরিবর্তন ঘটেছে মানুষ নিজেকে সভ্য বলে ভাবতে শিখেছে। কিন্তু মুছে যায়নি হিংস্র পশু স্বভাব মানবতাবোধ বিকশিত হয়নি, মানুষ মানুষকে গোলাম বানিয়ে রাখার প্রবৃত্তিকে ত্যাগ করতে পারেনি এখনও। সে যুগের উচু তলার মানুষ তাদের অভিজাত্য জাহির করার জন্য কে কত বেশি দাস-দাসী রাখতে পারে তার প্রতিযোগিতায় মেতে থাকত। এ সমাজেও উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সে জাহেলিয়াত যুগের বর্বর আচরণ ত্যাগ করতে পারেনি। তাদের অর্থ উপার্জনের পরিমাণ যতই বাড়ছে নিজেরা ততই বিলাসী হয়ে পড়ছে। দাস-দাসীর সংখ্যাও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গৃহের মহিলা সদস্যরা নিজ হাতের গৃহস্থালি কাজ করাকে কবীরা গুনাহের শামিল মনে করে। এ সমস্ত কাজের জন্য ঝি চাকর না থাকলে তাদের অভিজাত্যে নাকি আঘাত লাগে।

 

        অর্থ উপার্জনের মাপকাঠিকে এরা মনে করে অভিজাত্ত ও মান সম্মানের মাপকাঠি। যার যত বেশি অর্থ উপার্জিত হবে সে ততো বেশি সাংসারিক কাজ কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। গৃহবধূ গৃহকন্যারা মূল্যবান প্রসাধনী চর্চিত হয়ে দামি পোষাক, দামী অলংকারে সারাক্ষণ শরীর আবৃত করে রাখবে। আর বাইরে চলাফেরা, ঘরের খাবার তৈরি, বাজার করার জন্য খুঁটির ব্যবহৃত হবে ড্রাইবার, বুয়া, আয়া, ঝি উপাধিধারি মানুষগুলো পরনির্ভরশীল এবং মানবতা বর্জিত সমাজের এই আগাছা গুলো সমাজের কোন উপকার তো করছেই না বরং বিলাসিতা, অপব্যয় ও সম্পদের অপচয় ঘটাচ্ছে। বৈধ-অবৈধ সকল উপায়ে ব্যবহার করে সম্পদ জমা করে রেখে দরিদ্রদের আরো দারিদ্রের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য একটা মস্ত বড় দেয়াল তুলে দিয়েছে। ওরা প্রতিটি ঘরকে পরিণত করেছে এক একটা জালিমের আড্ডাখানা। কতগুলি নিরীহ, ভুখা-নাঙ্গা মানুষের মানবিক অধিকার দলিত মথিত করে শুরু হয় ওদের প্রতিটি সকাল। মাজলুমের চোখের পানিতে আত্মতুষ্টি নিয়ে রাতে শান্তির নীড়ে শরীর এলিয়ে দেয় এই নব্য জাহেলরা।

 

        সে যুগের দাস প্রভুরা দাস-দাসীদের যেমন মানুষ ভাবত না, এযুগের ভদ্র সাহেব-বিবিরাও তেমনি ঝি-চাকরদের মানুষ বলে তাদের প্রাপ্য মানবিক অধিকারটুকু প্রদানের প্রয়োজনবোধ করেনা। কাক ডাকা ভোর হতেই ঝি-চাকরদের দেহ নামক যন্ত্র খানাকে সাহেব-বিবিদের সেবায় সচল করতে হয়। আর মধ্যরাতে পৃথিবীর সবকিছু যখন নিঝুম হয়ে যায় হয়তো তখনো কোনদিন তাদের থালাবাসন ধোয়া বাকি থাকে হয়তো সাহেবদের সিগারেট বোতল আনতে গিয়ে জাগাতে হয় কোন ঘুমক্লান্ত দোকানি কে। সে যুগের দাসদেরও যেমন শ্রমের কোন ঘন্টা নির্দিষ্ট ছিলনা ছিলনা, ছিলনা কোন কাজের সময় সূচি, তেমনি এই যুগের আয়, ঝি-দের কাজের বেলায়ও এর কোন ব্যতিক্রম রাখেনি সমাজের প্রতাপশালী বিত্তবানরা। শ্রমের সময়সূচির দাবিতে শ্রমিকরা বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করে ১লা মে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখলেও সে আত্মত্যাগে দেশের হতভাগা ঝি-চাকরদের এতটুকু উপকারও করতে পারেনি। মানবাধিকার রক্ষার জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অধিকার নিয়ে হরেক প্রকারের সনদ রচনা করছে সভ্য মানুষ।

 

        কিন্তু সে সনদ এসব নির্যাতিত হতভাগ্য মানুষকে বাঁচাতে পারেনি জালেমদের জুলুম থেকে। ওরা মনে করে ঝি-চাকর, আয়া, দারোয়ান, ড্রাইভাররা মানুষ নয়। তাই ওদের রাত্রি যাপন করতে হয় রান্নাঘরের একপাশে অথবা বসতবাড়ি থেকে আলাদা ঝুপড়ি ঘরে, যা এসব চাকর-বাকরদের থাকার জন্যই বানানো হয়েছে অথচ বাড়ির পোষা কুকুর বিড়ালটাও দিব্বি আরামে গৃহে থাকার সুযোগ পায়। উপরন্ত চাকর-বাকর মধ্যযুগের ন্যায় অর্থ খরচ করে বাজার থেকে কিনে আনতে হয় না, একেবারে বিনামূল্যে সংগ্রহ করা যায়, ওদের বেতন দিতে হয়না, ডাক্তার দেখানোর ঝুট ঝামেলা নেই, বহু ব্যবহারের জীর্ণ কাপড় গুলো ওদের দিয়ে দিলেই হয়, নতুন কাপড় কেনার প্রয়োজন হয়না। উচ্ছিষ্ট খাবার টুকু ওদের জন্য রেখে দিলেই ওদের পেট ভরে যায়। কিন্তু পোষা বিড়াল কুকুর গুলো যে বিদেশি জাতের বহুমূল্য দিয়ে কিনতে হয়েছে। সুতরাং ওগুলোর মূল্য নিশ্চয় চাকর-বাকরদের চেয়ে বেশি! ঝি শীতে মশারি বিহীন উদোম শরীরে শুয়ে মশার কামড় খেয়ে ম্যালেরিয়ায় মরে গেলেও বা কি আসে যায়! নতুন ঝি সংগ্রহ করা তো কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু পোষা বিড়াল কুকুর কিনতে যে অনেক টাকা ব্যয় করতে হবে।

 

        ঝি চাকর পোশা জানোয়ারের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে ওরা মনিবের সাথে একত্রে বসে খাবার সুযোগ পায়না। রাতদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও এক বেলা বা দুবেলা ভাত ছাড়া কোনো শ্রমের মজুরি ওরা পায় না! এর পরেও একটু এদিক ওদিক হলে তো রক্ষে নেই। সে যুগের মনিবরা ব্যবহার করত চামড়ার চাবুক। দাস গোস্তাখি করলেই চাবুক তার পিঠের চামড়া তুলে নিত। কিন্তু এই যুগের মনিবরা একটু সভ্য কিনা-তারা সেকেলে বলে চাবুক চালাতে লজ্জা পায়, তারা বজ্রমুষ্টিতে ব্যবহার করে নির্যাতনের আধুনিক উপকরণ গরম খুন্তি, গরম ইস্ত্রি, গরম পানি, লোহার রড, সেকালে দাসদের পিঠের উপর থেকেই শাস্তি শেষ হয়ে যেত কিন্তু ঝি চাকরদের গরম খুন্তি, স্ত্রীর ছ্যাকা, গুপ্তস্থানে লোহার রড ঢুকিয়ে নির্যাতন, হাত পায়ের নখ তুলে ফেলা, শরীরে, নাকের মধ্যে গরম পানি ঢেলে দেয়া পর্যন্ত শাস্তির মাত্রা পৌঁছে যায়। মনিব এ নির্যাতনের সন্তুষ্ট হতে না পারলে ঝি চাকরদের লাশ বানিয়ে বস্তা ভরে নদীতে ফেলে দিতেও কসুর করেনা।

 

        জাহেলিয়াত যুগে মনিবেরা দাসীদের উপর যৌন নির্যাতন চালাত, তাদের রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহার করত, সেসব মনিবদের বর্তমান উত্তরসূরি সাহেবরাও কিন্তু কম যান না। ভয় ভীতি প্রদর্শন করে ঝি-চাকরাণীদের উপর যৌন নির্যাতন চালানোর ঘটনা খুব একটা কম ঘটছেনা সভ্য সমাজেও। এর কোনো প্রতিক্রিয়া হলে ঝি চাকরাণীরা স্রেফ খুন হয়ে যায় অথবা সাহেব টি প্রেজটিজ বাঁচাতে ঝি-কে নষ্ট মেয়ের মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দেয় যেন নিজে কিচ্ছুটি জানেনা।

 

        এদেশ দরিদ্র। এদেশের অধিকাংশ মানুষ গরীব তাই গুটিকতক রক্তচোষা জালিম ওদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে ওদের গোলাম বানিয়ে নিয়েছে, বঞ্চিত করেছে ওদের সকল মানবিক অধিকার থেকে। তথাকথিত সভ্য হওয়ার দাবীদার সভ্য সমাজেই সকলের গোচরে এ জাহেলী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জনকল্যাণের দাবিদার সরকার রয়েছে, প্রশাসন রয়েছে, রয়েছে মানবতা, ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে রায় দেয়ার বিচার ব্যবস্থা, বিচারালয় ও বিচারক। এরপরেও চলছে এই মধ্যযুগীয় বর্বরতা।

 

        কে ঠেকাবে বর্বরতা? জমিনে কেউ কি নেই যে বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করবে, ইসলাম দাসব্যবসা দাসী-বাঁদি রাখাকে চরম ঘৃণা করে, ইসলামের ছোট-বড় আমির-ফকির, রাজা-প্রজার, কোন পার্থক্য নেই, ইসলামের অভিধানে মনিব-ভৃত্য সাহেব-গোলাম বলে কোন শব্দ নেই? কোথায় লুকিয়ে আছে সেই কাফেলা যে জমিনের সকল আশরাফ-আতরাফ এর প্রবেশ মিটিয়ে দিয়ে আবার কায়েম করবে ইনসাফের শাসন, সাম্যের সমাজ আদর্শ ও ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা।

 

*****