মুজাহিদের আযান
জিহাদের বায়’আত
মওলানা মাসউদ আযহার
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মুনাফিকের অপপ্রচার
জনৈক সাহাবী খায়বরের যুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শক্রর মুকাবিলা করে যাচ্ছিলেন। তাঁর তরবারীখানা ছিলো একটু খাট। তিনি দুশমনের শরীর তাক করে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে তরবারীখানা উঁচিয়ে পিছন থেকে নিয়ে সামনের দিকে সজোরে কশে মেরে দেন, কিন্তু তার এক পা ছিলো সামনে অপর পা ছিলো পিছনে। যে কারণে তরবারী দুশমনের পায়ে না লেগে প্রচন্ডভাবে তাঁর পায়ে এসে আঘাত করে। তিনি নিজের তরবারী সামলাতে পারলেন না। মারাত্মক আহত হলেন। অত:পর শাহাদাত বরণ করলেন।
তাঁর এক ভ্রাত্যুষ্পুত্র ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী। তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। কারণ, মুনাফিকরা বলাবলি করছিল, লোকটি তো নিজের আঘাতেই নিহত হলো; শাহাদাত বরণ করার সৌভাগ্য তাঁর হলো কই!
সদিচ্ছাবশতঃ না হলেও অগত্যা বহু মুনাফিক এ সব ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকত এবং এই ধরনের বিষয়-আসয় লুফে নিয়ে সমাজে মজাদার করে ছড়িয়ে দিত। মুসলমানদের সামান্যতম দুর্বলতাটিও তারা হাতছাড়া করত না। তাদের কাজই ছিল মুসলমানদের দোষ খুঁজে বেড়ান, মিথ্যা ঘটনা রটিয়ে মুহাজির আনসারদের মাঝে দ্বন্দের সূত্রপাত ঘটানো। অমূলক অপবাদ ছড়িয়ে সাহাবীদের অমলিন চরিত্রে মলিনতার কালিমা লেপন করা। মুসলমানদের মাঝে কূটকৌশলে পারস্পরিক দন্দ সৃষ্টি করে সিসাঢালা ঐক্য নষ্ট করতে সর্বক্ষণ তারা তৎপর থাকত। সেই সময় থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত মুনাফিক চক্র মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরাতে সচেষ্ট রয়েছে। যে কারণে দু’ একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া মুসলিম উম্মাহ কখনো এক প্লাট ফরমে একতাবদ্ধ হতে পারেনি, পারছেনা।
যাক, তিনি অত্যন্ত চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। প্রিয় নবী (সাঃ) এর নিকট আসলেন। প্রিয় নবী (সাঃ)-এর নিকট জানতে চাইলেন, আমার চাচাজানের ভাগ্যে শাহাদাত নসীব হয়েছে কিনা।
জবাবে প্রিয় নবী (সাঃ) বললেন, সাধারণ শহীদকে আল্লাহ পাক যে পরিমাণ সাওয়াব দান করেন, তোমার চাচা তার চেয়ে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হয়েছেনঃ
এক. শাহাদাতের সাওয়াব।
দুই. লোকদের সমালোচনার সাওয়াব।
আল্লাহ যেভাবে জীবন গ্রহণ করে খুশী হন
কার জীবন কিভাবে এবং কার তরবারী দ্বারা গ্রহণ করবেন, তা তিনিই জানেন। এ ক্ষেত্রে মানুষের ক্ষমতা ও ইচ্ছা অকার্যকর। মানুষের কাজ হলো ভীরুতার নেকাব ছিড়ে ফেলে গাফিলীর নিন্দ্রা ত্যাগ করে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে তাঁরই হাতে জীবন সপে দিয়ে জিহাদী তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়া। এই সমর্পিত জীবন আল্লাহ কিভাবে গ্রহণ করবেন, তা তাঁরই এখতিয়ার৷
তিনি জিহাদের ময়দানে কোন কোন সাহাবীর জীবন গ্রহণ করেছেন তাঁদের শরীর বহু অংশে খণ্ডিত করে। কেউ শহীদ হয়েছেন ঘোড়ার ধারাল খুড়ে দলিত-মথিত হয়ে। কেউ শহীদ হয়েছেন পাহারাদারীর সময় অজনা তীরে বিদ্ধ হয়ে। নাক, কান, হাত, পা কর্তিত অবস্থায় কারো জীবন তিনি গ্রহণ করেছেন।
ঘোড়ার পিঠ থেকে গড়িয়ে পড়ে অনেকে শাহাদাত বরণ করেছেন। কেউ তো আল্লাহর হাতে জীবন উৎসর্গ করেছেন জিহাদের ময়দানে উপস্থিত হওয়ার পথে। স্বাভাবিক মৃত্যুই তাদের হয়েছিল এবং তাদের শেষ অসিয়ত ছিল তাদের লাশ যেন মুজাহিদ কাফেলা ময়দান পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যায়। অন্তত তাদের লাশ যেন শত্রুর মুখোমুখি ময়দানে উপস্থিত করা হয়। তারা মরেও মুজাহিদ কাফেলা ত্যাগ করতে চায়নি। জীবন্ত মুজাহিদ সাথীদের সাথে তাদের মৃতদের লাশও চলেছে জিহাদের ময়দানে শক্রর মুকাবিলার লক্ষ্যে। আমরা আমাদের জীবন আল্লাহর নিকট সমর্পণ করব, জীবন তিনি কিভাবে কোন অবস্থায় গ্রহণ করবেন, তা একান্তই তাঁর নিজস্ব ব্যাপার।
আমরা তো এতটুকু করতে ও বলতে পারি, হে আল্লাহ! আমার জীবন তোমার নিকট সমর্পণ করলাম। তুমি গ্রহণ করে নাও। অতঃপর সে যদি আমীরের আদেশে রান্না-বান্নার আঞ্জাম করতে যেয়ে চুলার আগুণে দগ্ধ হয়ে বা স্টোভ বিষ্ফোরিত হয়ে আহত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তবুও তাকে উঁচু মর্যাদার শহীদ বলতে হবে।
শত্রু মরিচায় প্রবেশ করে কাফির হত্যার পর নিজেকেও যদি জীবন দিতে হয়, ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থে নিজের অস্ত্রেও যদি নিজেকে জীবন দিতে হয়, তখন তাকে উঁচু মর্যাদার ত্যাগী শহীদই বলতে হবে।
আমাদের কাজ আল্লাহর সামনে জীবন সোপর্দ করা। এই জীবন কিভাবে তিনি গ্রহণ করবেন, সে এখতিয়ার একান্তভাবেই তাঁর। আল্লাহ আমাদের সকলকে শাহাদাত নসীব করুন।
লোকের অমূলক সমালোচনা ও শহীদের মর্যাদা
ঐ সাহাবীর দ্বিগুণ মর্যাদা ও সওয়াব পাওয়ার একটি কারণ শহীদ হওয়া। দ্বিতীয় কারণ ছিলো, কিছু লোকের তাঁর শাহাদাতের ব্যাপারে সমালোচনা করা এবং একে অমূলকভাবে বিতর্কিত রূপ দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হওয়া।
যারা মুজাহিদ ও শহীদদের মর্যাদাহানিকর সমালোচনা, তিরস্কার ও টিপ্পনি কাটে, উপরোক্ত ঘটনা তাদের জন্য অব্যর্থ মহৌঔষধ বটে। এটাও সত্য কথা, তাদের সমালোচনা দ্বারা মুজাহিদদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, উপকারই হচ্ছে বটে।
জান্নাত কখন পাবে?
আল্লাহ তাআলা মুজাহিদের জীবন ও সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে খরীদ করে নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো, তবে জীবনের বিনিময়ে উপহৃত জান্নাত তারা পাবে কবে?
এরই প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে, অবশ্যই জান্নাত আছে, তবে জান্নাতে প্রবেশাধিকার পাওয়ার পূর্বশর্ত তো পুরণ হতে হবে। এই সকল পূর্বশর্ত বর্তমান কুরআন সহ তাওরাত ও ইঞ্জিলেও উল্লেখিত হয়েছে। একথাই পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ
وعدا عليه حقا فى التوراة والانجيل والقرآن
‘তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে তিনি অবিচল।’
আল্লাহ তা’আলার এ অঙ্গীকার কেবল কুরআনেই নয় বরং রহিত হওয়া পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাত ইঞ্জিলেও উল্লেখিত হয়েছিল যে, যে আমার পথে জীবন দিবে, আমি তাকে তার জীবনের বিনিময়ে অবশ্যই জান্নাত দান করব। এ অঙ্গীকারের স্বার্থকতা সম্পর্কে পরবর্তী আয়াতাংশেই বলা হয়েছেঃ
فاستبشروا ببيعكم الذى بايعتم به
‘সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেন-দেনের উপর, যা তোমরা করছ তাঁর সাথে।’
উল্লেখ্য, পবিত্র কুরআনে পুরুষের উদ্দেশ্যে যত জায়গায় বায়’আতের কথা উল্লেখিত হয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে জিহাদের বায়’আতের কথা বলা হয়েছে, কেননা বায়’আত করে পুরুষ লোকেরা। আর তারা জিহাদ ছাড়া কিসের জন্য বায়’আত করবে-
কোন এক কবি বলেছেন-
خلق الله للحروب رجالا
ورجالا لقصعة وتريد
‘আল্লাহ তা’আলা যুদ্ধের জন্য পুরুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং কিছু পুরুষ রয়েছে যাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে, আহার গ্রহণ ও বিলাসিতায় ডুবে থাকার জন্য।’
আল্লাহ তা’আলা পুরুষ-মুমিনকে নির্বাচিত করেছেন ইসলামদ্রোহীদের মুকাবিলায় যুদ্ধ করে ইসলামকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তাই সকল মুমিনকে আল্লাহর পথে যুদ্ধে লড়তে হবে। কেননা তিনি তো এ জন্যেই মুমিনের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।
জিহাদের বায়’আত ও কুরআনের বিবরণ
পবিত্র কুরআনের তিন জায়গায় বায়’আতের কথা উল্লেখিত হয়েছে এবং তা স্পষ্টই জিহাদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে।
প্রথমঃ
فاستبشروا ببيعكم الذى بايعتم به
‘সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেন-দেনের উপর যা তোমরা, করছ তাঁর সাথে।’ (তাওবাঃ ১১১)
এ ক্ষেত্রে বায়’আত লেন-দেন ও অঙ্গীকার উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
দ্বিতীয়ঃ
ان الذين يبايعونك انمايبايعون الله يدالله فوق ايديهم
‘যারা আপনার কাছে আনুগত্যের শপথ করে, তারা তো আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে।’ (ফাতহঃ ১০)
তৃতীয়ঃ
لقد رضى اللّه عن المؤّ منين اذ يبايعونك تحت الشجرة
‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন যখন তারা বৃক্ষের নীচে আপনার কাছে শপথ করল। (ফাতহঃ ১৮)
এক্ষেত্রেও বায়’আত দ্বারা জিহাদের বায়’আত বুঝান হয়েছে। আর সাহাবীগণও সর্বক্ষেত্রে বায়’আত দ্বারা জিহাদের বায়’আতই বুঝতেন ও বুঝিয়েছেন-
نحن الذين بايعوا محمدا
على الجهاد ما بقينا ابدا
‘আমরা তারা, যারা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর হাতে শপথ গ্রহণ করেছি যে, যতদিন বেঁচে থাকি জিহাদ করব, জিহাদ ত্যাগ করব না মরণ না আসা পর্যন্ত।’
হাদীসের আলোকে জিহাদের বায়’আত
নিন্মে উল্লেখিত হাদীসটিকে সহীহ সনদে ইমাম মুসলিম, মুসনাদে কুবরা বায়হাকীসহ ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মাশামি’ ইবনে মাসউদ সালামী (রাঃ) বলেন,
“আমি আমার ভাইয়ের সাথে হযুর (সাঃ)-এর দরবারে হাজির হলাম। আমি তাঁকে বিনয়ের সাথে বললাম, আমাদেরকে হিজরাতের উপর বায়’আত করুন।
প্রিয় নবী (সাঃ) বললেন, যারা হিজরাত করেছে তাদের হিজরাত করে চলে যাওয়ার সাথে সাথে হিজরাতের প্রশ্ন শেষ হয়ে গেছে।
অতঃপর আমি প্রিয় নবী (সাঃ)-এর নিকট জানতে চাইলাম, তবে এখন আমরা কিসের উপর বায়’আত গ্রহণ করব? তিনি বললেন, ইসলাম ও জিহাদের উপর।”
এরদ্বারা বুঝা যায়, প্রিয় নবী (সাঃ)-এর নবুয়্যাত প্রাপ্তির শুরুর দিকে ইসলামের উপর বায়’আত গ্রহণ করা হত। পরবর্তী সময়ে বায়’আত গ্রহণ করা হয় কেবল জিহাদের উপর।
দ্বিতীয় আর এক রেওয়ায়েতে উল্লেখিত হয়েছে-
হযরত ইয়ালা ইবনে মাম্বাহ (রাঃ) বলেন, আমি মক্কা বিজয়ের পরের দিন প্রিয় নবী (সাঃ)-এর দরবারে গেলাম এবং তাঁকে বিনয়ের সাথে বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল! আমার আব্বাকে হিজরাতের উপর বায়’আত করুন।
প্রিয় নবী (সাঃ) বললেন হিজরাতের উপর নয় বরং তাকে জিহাদের বায়’আত করাব। কেননা, মক্কা বিজয়ের পরে হিজরাতের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে গেছে।”(সুনানে কুবরা বায়হাকীঃ পৃঃ ১৬ খঃ ৯)
বায়’আয়াতের ক্ষেত্রে মুসলমানদের সাথে উত্তম ব্যবহারের শর্ত
প্রিয় নবী (সাঃ)-এর বায়’আত গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি লক্ষণীয় বিষয় ছিলো, ‘তোমরা ঈমান গ্রহণ করো-
وأن تناصح المؤمنين
‘এবং ঈমানদারদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার কর।’
হৃদ্যতার অর্থ কখনো এ নয় যে, পৃথিবীর কোন জনপদে কোন মুসলিম নিগৃহীত হবে, নিহত হবে-আর আমরা সুখভোগ ও আয়েশ করে বেড়াব-
ঈমানদারের বাড়ী-ঘর পুড়িয়ে দেয়া হবে আর আমরা তাদের পুড়ে যাওয়া ঘরের ভস্ম ও ধোয়া চেয়ে চেয়ে দেখব-
কোন ঈমানদারকে বেঈমানেরা বন্দী ও আহত করবে আর আমরা তাদেরকে অনুযোগের সুরে নসীহত করবো, লোকটা ধরা খেতে গেলো কেন-
তাই সকল মুমিনকে ইসলামের উপর বায়’আত গ্রহণ করার সময় এ বাক্যটিও উচ্চারণ করতে হবে, (تناصح المومنين) পারস্পরিক কল্যাণ কামনা ও নিরাপত্তার সুদৃঢ় অঙ্গীকারও করতে হবে।
ইসলামী পরিভাষায় ‘নসীহাত’ বলা হয়, সকল কাজে পারস্পরে কল্যাণ কামনা করা।
সে কথাই হাদীসে এভাবে বলা হয়েছে-
المسلم اخو المسلم لا يظلمه ولا يسلمه
“এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, না নিজে অপর মুসলমানের উপর জুলূম করবে, না তাকে কাফেরদের নিকট ছেড়ে আসবে।”
সাহাবী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) বায়’আত গ্রহণ করার সময় প্রিয় নবী (সাঃ)-কে বললেন, “হে আল্লাহর নবী! আমার বায়’আতে বিশেষ কোন শর্ত সংযুক্ত করে দেন।” অতঃপর প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁর বায়’আত গ্রহণে এ বিষয়টি যুক্ত করেছেন-
وتناصح المؤ منين
‘ঈমানদারের সাথে পরস্পরে হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করবে।’
অসৌজন্যমূলক ও আপত্তিকর, হৃদয়হীন কোন ব্যবহার পরস্পরে করবে না। কোন মুসলমান দুঃখ পেলে তোমার হৃদয়ও ব্যথিত হবে, কোথাও কোন মুসলমান অত্যাচারের শিকার হলে তোমার মন কাঁদবে-তাঁর কষ্টে তুমিও ছটফট করবে।
কোন মুসলমানের বাঁচাও চিৎকার শুনলে অবশ্যই তুমি তাকে উদ্ধার করতে ছুটে যাবে। অপর ভাইয়ের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রাখবে। চিৎকারের শব্দ শুনে তার দ্রুত চলার বাহন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়ার কান দাঁড়িয়ে যাবে, সে সর্বক্ষণ সতর্ক থাকবে এবং নিজেকে প্রশস্ত রাখবে।
হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে, “মুসলমানের জীবন সবচেয়ে উন্নত যে ঘোড়ার পিঠে চড়ে সবদিকে সতর্কদৃষ্টি রাখে, উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের বেলায় গভীর খেয়াল রাখে, اذا سمعته صيحة যখনি কোন চিৎকারের শব্দ শুনে, কোন ভয়ার্ত আওয়াজ শুনে তখনি ঘোড়া দৌঁড়িয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়।
والوت مطانة
তখন তার মন বলে, এ সাহসী তৎপরতার সময় (মুমিনের কল্যাণে) যেন আমার মৃত্যু হয় এবং আমি যেন প্রকৃত মালিকের সাক্ষাতের সৌভাগ্য লাভ করি।”
যাকে বলে, জীবন বাজি রেখে মানুষের কল্যাণে ছুটে যাওয়া।
কাফিরদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ
প্রিয় নবী (সাঃ) সাহাবীর বায়’আত গ্রহণে দ্বিতীয় যে বাক্যটি সংযুক্ত করেছিলেন-
وان تفارق المشركين
‘মুশরিকদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখ।’
“মুশরিকরদের সাথে কোন প্রকারের সম্পর্ক থাকবে না। তাদের সাথে সাযুজ্য সামঞ্জস্যও থাকবে না, বন্ধুত্ব বৈবাহিক সম্পর্ক, ভোজ-নিমন্ত্রণ ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। মুশরিকদের থেকে সম্পর্কচ্যুতি ঘটাতে হবে সার্বিকভাবে। কেননা পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
وقا تلوا المشركين كافة كما يقاتلو نكم كافة
মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। (তাওবাঃ ৩৬)
জীবন ও সম্পদের কুরবানী ছাড়া কিভাবে জান্নাত লাভ হবে?
সাহাবী হযরত বশীর ইবনে মা’বাদ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এসেছিলাম ইসলামের উপর বায়’আত গ্রহণের উদ্দেশ্যে। প্রিয় নবী (সাঃ) এক এক করে বায়’আতের শর্ত সমূহ উল্লেখ করে বললেন, “আমাকে সাক্ষ্য দিতে হবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল, নামায কায়িম করতে হবে, জাকাত ও হজ্জ আদায় করতে হবে, রমযান মাসের রোযা পালন করতে হবে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করতে হবে।
অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এর ভিতর থেকে দু’টি শর্ত পালন করার আদৌ ক্ষমতা রাখি না, একটি হলো জিহাদ। কারণ আমি শুনেছি, পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে-
ومن يولهم يومئذ دبره الامتحرفا لقتال او متحيزا الى فئة فقد باء بغضب من الله
‘সেদিন যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন কিংবা দলে স্থান নেওয়া ব্যতীত কেউ তাদেরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে তো আল্লাহর বিরাগ ভাজন হবে।’ (আনফালঃ ১৬)
কেননা সে শক্রকে কেবল পিঠ দেখালো না বরং সে ইসলামের দুর্নাম করলো। তখন স্বাভাবিকভাবে লোকে মনে করবে, কাফির শক্তির ভয়ে ভীরু মুসলিম পালিয়ে যাচ্ছে। ফলে লোক ঈমান ত্যাগ করে কাফিরদের সঙ্গে যোগ দিবে। এইরূপ ঘটনা দেখার পর দুর্বল চিত্তের মুসলমানের ঈমান দোদুল্যমানতার শিকার হবে, তারা ভবিষ্যতে চরম শংকা ও নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে অস্থির হবে।
এরপর সাহাবী বল্লেন, হে আল্লাহর রাসূল! এইসব শংকা ও ভীরুতার কারণে আমি জিহাদ করতে আদৌ সক্ষম নই। আমার ভয় হয়, যুদ্ধে যোগদান করলে আমি ভয়ে পালিয়ে যাব। ফলে অবধারিতভাবে আমার উপর বর্ষিত হবে আল্লাহর ক্রোধ ও অভিশস্পাত। জিহাদ করার সামান্য সাহস আমার নেই।
দ্বিতীয়তঃ আমি যাকাত আদায়ে সমর্থ নই। উল্লেখযোগ্য কোন সম্পদই আমার নেই। মাত্র কয়েকটি ছাগল আছে। এর আয় দিয়ে কোন রকম সংসার চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
সাহাবী বলেন, আমি একথা বলার পর প্রিয় নবী (সাঃ) আমার হাত ধরে ঝাকি দেন এবং বলেন,
لا صدقة ولا جهاد فبما تدخل الجنة
‘সাদকা দিবে না, জিহাদ করবে না, মাল সম্পদ ব্যয় করবে না, জীবন দিবে না, তুমি তবে জান্নাতে প্রবেশ করবে কি করে?’
প্রিয় নবী (সাঃ)-এর মুখ থেকে এরূপ তীর্যক কথা শুনার পর তাঁর মনের সকল দুর্বলতা দূর হয়ে বলিয়ান হয়ে উঠে সুদৃঢ় অঙ্গিকার উচ্চারণে-
فبايعت على ذالك كله
অতঃপর সকল বিষয়ে আমি প্রিয় নবী (সাঃ)-এর নিকট বায়’আত গ্রহণ করলাম। (মুসনাদে কুবরা বায়হাকী পৃঃ ২০, খঃ ৯। তাফসীর ইবনে কাছীর পৃঃ ৯৩, খঃ ২)
এরদ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায়, প্রিয় নবী (সাঃ)-এর সময়ে আবশ্যিকরূপে নিয়মিত জিহাদের উপর বায়’আত গ্রহণ করা হত।
যে কারণে রাসূল (সাঃ) ঐ সাহাবীর ওযর ও দুর্বলতা গ্রহণ করেননি।
তাঁর দুর্বলতার পিছনে যুক্তিও ছিল। কিন্তু প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁর দুর্বলতা ও যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন। দুঃখের বিষয়, বহু মুসলমান এই একই যুক্তি দেখিয়ে হরদম বলে যাচ্ছে যে, তাদের ঈমান নাকি জিহাদ করার মত মযবুত এখনো হয়নি। এই শ্রেণীর লোকদেরকে উপরোক্ত সহীহ হাদীসটি গভীর মনোনিবেশের সাথে বারবার পড়ার জন্য অনুরোধ করছি। আশা করি বিষয়টা সকলেরই বুঝে আসবে। না হয় জান্নাতে যাবে কিভাবে? [চলবে]
অনুবাদঃ মনযূর আহমাদ