দেশে দেশে ইসলাম
দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলমানদের
প্রশংসিত অবস্থান এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যত
নাসীম আরাফাত
=========================================
ম্যান্ডেলা। নেলসন ম্যান্ডেলা। একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। একটি অগ্নি শিখা। নির্যাতিত নিপীড়িত মানবতার আশা ও আস্থা। অবহেলিত কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাধীনতার প্রতীক। এক আপোষহীন নেতা। ইস্পাত কঠিন তাঁর মনোবল। এখন তিনি দক্ষিন আফ্রিকার নির্বাচিত প্রসিডেন্ট।
ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস আজ বিজয় আনন্দে মুখর। কিন্তু ক’জনে জানে, বিশলক্ষ অকুতোভয় মুসলমানও ছিলো এই দলের অগ্রসৈনিক। যারা বুলেটের পিচ্ছিল পথে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছে স্বাধীনতা লাল গোলাপ ছিনিয়ে আনতে। যারা ছিলো জানবাজ, মরণজয়ী। তা ছাড়া এটাও কি কম আশ্চর্যের কথা যে, বর্তমান সরকারের মন্ত্রীসভার চারজন মন্ত্রীই মুসলমান। তাও আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, আইন ও বিচার মন্ত্রী এবং প্রাদেশিক বিষয়ক তদন্ত মন্ত্রী মত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সংসদে রয়েছে পঞ্চাশেরও বেশী মুসলিম সংসদ সদস্য।
আজ দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলমানরা গর্বিত, পুলকিত। তাদের বিশ্বাস, তারা দুর্দম গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এক উজ্জ্বল জ্যোর্তিময় ভবিষ্যতের দিকে। ইতিমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলমানরা কিছু কিছু অঞ্চলে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। শুনলে আশ্চর্য হবেন, দক্ষিণ আফ্রিকার দক্ষিনাঞ্চলীয় প্রশিদ্ধ ঐতিহাসিক শহর কেপটাউনে মালেশিয়ান ও আঞ্চলিক মুসলমানদের মালেশিয়ান ও আঞ্চলিক মুসলমানদের সংখ্যা ৬০% পৌঁছে গেছে। মুসলমানরা আজ রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ামকশক্তি হয়ে দাড়িয়েছে। তাদের সন্তুষ্ট করতে, তাদের দাবী আদায়ের জন্য সবগুলো রাজনৈতিক দলই সদা তৎপর, অত্যন্ত উদগ্রীব এবং আন্তরিক।
আজ থেকে তিনশত বছর পূর্বে দক্ষিন আফ্রিকার দুর্গম অঞ্চল মুসলমান মুবাল্লিগরা ঈমানের দাওয়াত নিয়ে আগমন করেন। ইন্ডিয়ান ও মালেশিয়ান মুসলমানরাও তখনই দক্ষিন আফ্রিকায় আগমন করে। তারা স্থানীয় বর্বর অসভ্য প্রায় মানুষদের মাঝে চির সত্য, ন্যায় ও সভ্যতার আলোক মশাল তুলে ধরেন। ফলে স্থানে স্থানে তার অপূর্ব সুহফা দেখা দেয়। মুসলমানদের সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে আজো দক্ষিন আফ্রিকার মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষায় সবার শীর্ষে। অত্যন্ত আনন্দের কথা, শিক্ষিত মুসলমানরা বিভিন্নভাবে ঐকবদ্ধ শক্তি রূপে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। যেমন দক্ষিন আফ্রিকায় ১২ সহস্র কিছু বেশী চিকিৎসক আছে। অথচ ইসলামিক মেডিকেল এসোশিয়েশন নামে মুসলিম চিকিৎসকদের স্মিতির সদস্য সংখ্যা বার শত জন প্রায়।
অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে তুলনা করলে এ সত্যটি প্রতিয়মান হয় যে, দক্ষিন আফ্রিকায় মুসলমানরা আজ আর কোন ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। অথচ ইতিপূর্বে বৈষম্যপূর্ণ আইনের কারণে মুসলমানরা ব্যবসা বানিজ্যে পূর্ণ স্বাধীনতা পায়নি কখনো। এমনকি শহরের বানিজ্যিক এলাকায় স্থানীয় মুসলমানদের তেমন সুযোগ ছিলো না। ফলে উন্নতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে তারা জায়গায় জায়গায় বাঁধা প্রাপ্ত হতো, তারা ব্যাংক ঋণ নিতে পারতো না। স্টক একচেঞ্জেরও সদস্য হতে পারতো না। কিন্তু মুসলিম জাতি কখনো হতাশ হয় না, তাই আল্লাহ্র অসীম রহমতের ভরসায় মাটি কামড়ে তারা পড়েছিলো। তারা বিহস্বাস করতো যে, স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য আবার উদিত হবেই।
দক্ষিন আফ্রিকার মেঘলা আকাশে আজ উদিত হয়েছে মুক্তি অ স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। মুসলমানরা এখন দূর্বার। সর্বত্র তাদের অবাধে পদচারনা। মুসলমান ব্যবসায়ীদের হাতে এখন প্রচুর সুযোগ। বহু অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক আজ মুসলমান। ন্যাশনাল ক্লথ ফাউন্ডেশন দক্ষিন আফ্রিকার এক নাম করা প্রতিষ্ঠান। জনাব ওয়াহেদ সাহেব এর ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি আবার ফরেষ্ট ন্যাশনাল ব্যাংকের ডাইরেক্টরও বটে।
কিছুদিন আগেও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা ছিলো দক্ষিন আফ্রিকার মুসলমানদের একটা দুরাশা, দুঃস্বপ্ন মাত্র। কিন্তু আজ তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। সেখানে আল বারকা ও ইসলামী ব্যাংক নামে দুটি ব্যাংক ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত এই ব্যাংক দুটি অভাবনীয় সফলতার সাথে দৃপ্ত পদে দূর্বার গতিতে সম্মুখ সফরে এগিয়ে চলেছে। আসুন ব্যাংক দু’টির ডাইরেক্টরদের ভাষ্য শিনি। তারা বলেছেঃ আমরা যুগপৎ ব্যাংক গুলোকে ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী চালাচ্ছি এবং রাষ্ট্রের উন্নতি অগ্রগতির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছি। এদিকে প্রশাসন ও ইসলামী ব্যাংকগুলোর সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। তাই প্রশাসনও চায় সাড়া দেশব্যেপি ইসলামী ব্যাংকের শাখা ছড়িয়ে পড়ুক। এতেই দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি।
কঠোর পরিশ্রমী ও নিরলস দক্ষিন আফ্রিকার মুসলমানরা শিল্প সামগ্রী উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই। ইসলামী ব্যাংকগুলোর সহায়তায় গড়ে তুলছে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রেও তারা শীর্ষ স্থানটি প্রায় ছুই ছুই করছে। চারন ভূমি গুলোতেও মুসলমান রাখালদের প্রাধান্য লক্ষ করার মত।
আটলান্টিক মহা সাগরের সৈকতে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী শহর কেপটাউন। এ শরেই বিগত ২রা এপ্র মুসলিম আগমনের তিনশত বৎসর পূর্তি উৎসব পালন হলো মহা সমারোহে। সাদা ধব ধবে পোষাকে এক লাখ মুসলমানের এই বিরাট সমাবেশ ছিলো এক দর্শনীয় এবং আনন্দ দায়ক সমাবেশ। আনন্দের আতিযগ্যে কেউ কেউ একে হজ্জ্বের মহা সমাগমের সাথে তুলনা করতেও দ্বিধা বোধ করেনি। শহরের ব্যস্ততম পথগুলো অতিক্রম কালে তাদের মুখে ছিলো তাকবীরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আর তাসবীহের সুমধুর গুঞ্জন। এই অভিনব দৃশ্য, এই মনোমুগ্ধকর অভূতপুর্ব সমাবেশ, এই সুন্দর শৃঙ্খলা দক্ষিনাফ্রিকার সর্বত্র সৃষ্টি করেছে এক মধুময় আবহ।
আরো সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে যখন যোহরের নামাজের সময় মুসলমানরা শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। তারা দলে দলে নামযে দাড়িয়ে নামায আদায়ে নিমগ্ন হয়েছে। দক্ষিন আফ্রিকার কোন ধর্ম এতো সুন্দর উপমার অবতারণা করতে পারে নি। পারে নি মুসলমানদের মত এতো ঐক্য, এতো ভ্রাতৃত্ব এতো শৃঙ্খলার পরিয়চ দেখাতে।
সেদিনই সন্ধায় গডহোপ সেন্ট্রাল ময়দানে এলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। জাভার মুসলিম মুবাল্লিগ শাইখ ইউসূফের প্রশংসাবাদ ও গুণকীর্তন করা ও মুসলমানদের সাথে আন্তরিক সাক্ষাৎকার মিলিত হওয়া জন্য। তাই বহু মুসলীম এসে সমবেত হলো গডহোপ সেন্ট্রাল ময়দানে। ম্যান্ডেলার ভাষন শুনবে। তাকে একনজর দেখবে। মুসলিম নবজাগরনে তার প্রতিক্রিয়া শুনবে।
ম্যান্ডেলা সুন্দর বক্তৃতা দিলেন। শাইখ ইউসূফের প্রচুর প্রশংসা করলেন। বললেন, আপনারা বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমি অকপটে, এ চির সত্যকে গোপন করতে পারবে না যে, শাইখ ইউসূফই হলেন আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ও নির্যাতন চির অবসানের মূল শক্তি। শাইখ ইউসূফসহ অন্যান্য মুসলিম নেতারা আমাকে আমার কারাবরণ কালে ও দেশান্তরিত হওয়ার সময় আমাকে সর্বাত্তক সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। আমার মনে সাহস জুগিয়েছেন। সম্মুখ যাত্রাকে আরো নিশ্চিত, দৃঢ় ও শক্তিশালী করেছেন। সাইখ তুযান সাঈদের নাম নিয়ে বলেন, আজ এই আনন্দ ঘন মূহুর্তে তিনি নেই। তিনি শাহাদাত বরণ করেছেন। কিন্তু তার আন্তরিকতার কথা আজো ভুলতে পারছি না। তারপর ম্যান্ডেলা সমেবেত বিশাল জনতার সম্মুখে প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হন যে, দক্ষিন আফ্রিকায় মুসলমানদের জীবন ধারা তাদের ধর্মীয় বিধি বিধান অনুযায়ী পরিচালনার সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিয়ে-শাদী, তালাক, মিরাছ ইত্যকার বিষয় তাদের উপর অন্যজাতির আইন বা প্রথা চাপিয়ে দেয়া হবে না।
বক্তৃতা চলাকালে ম্যান্ডেলা অকপটে বলেন, মুসলমানদের নবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) ন্যায় ও ইসসাফের ভিত্তিতে এক পবিত্র সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য আগমন করেছিলেন। তখন জনতার মূহুর্মূহু তাকবীর ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে চার দিক মুখরিত হয়ে উঠে। ঐতিহাসিক এই মহা সমাবেশে উপস্থিত মেহমানদের মধ্য থেকে মালেশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী দাতুক ছারী নজীব ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধিদলের প্রধান ডক্টর আহমদ নূরানীও বক্তৃতা দেন।
দক্ষিন আফ্রিকায় ক্ষমতার রদবদলের সাথে সাথে মুসলমানদের উন্নতি অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। সংখ্যালঘু শেতাঙ্গদের নির্যাতন নিপীড়ন ও অত্যাচারে উন্মুখ পেশী-শক্তি চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে। মানুষের মাঝে ফিরে এসেছে শান্তির ফুরফুরে বায়ুপ্রবাহ। এদিকে ম্যান্ডেলাও জনগণের মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বদ্ধ পরিকর। তিনি ঘোষণা করেছেন, দক্ষিন আফ্রিকায় সকল ধর্মের লোকদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদানের ব্যবস্থা তিনি অবশ্যই করবেন।
দক্ষিন আফ্রিকার মুসলমানদের বর্তমান পরিস্থিতি ও তাদের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পেছনে যে বিষয়টি লক্ষ্যনীয় তাহলো তাদের মুসলিম জাতীয়তাবোধ ও ঐক্যবদ্ধতা। তাই আজকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিপীড়িত মুসলমানদের মাঝে যদি মুসলিম জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয় এবং অবশ্যই গোটা মুসলিম বিশ্ব তাদের হৃত মর্যাদা ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারবে।
*******************************