দারুল ইসলাম
ও দারুল কুফর
উস্তাদ আহমাদ নাবিল হাফিজাহুল্লাহ
******************************
প্রতিটি রাষ্ট্র হয়ত দারুল ইসলাম হবে নয়ত দারুল কুফর হবে। এ ব্যাপারে জুমহুর উম্মতের ঐকমত বিদ্যমান। কোন রাষ্ট্র দারুল ইসলামও নয় আবার দারুল কুফরও নয় তা কখনই হতে পারে না।
আল্লামা কাসানী রহঃ বলেনঃ-
تَصِيرُ الدَّارُ دَارَ إسْلَامٍ أَوْ دَارَ كُفْرٍ
“দার” হয়ত দারুল ইসলাম হবে নয়ত দারুল কুফর হবে ...... (বাদাইউস সানায়ে’, পরিচ্ছেদঃ কিতাবুস সিয়ার অধ্যায়ঃ মা’নাদ দারাইন দারিল ইসলাম ওয়া দারিল কুফর)
হ্যাঁ তবে দারুল কুফর আবার মৌলিক ২ ভাগে বিভক্তঃ-
(১) দারুল হারব। (যাদের সাথে মুসলিমদের কোন সন্ধি বা চুক্তি নেই)
(২) দারুল আহাদ। (যাদের সাথে মুসলিমদের সন্ধি বা চুক্তি আছে)
ইবনে আব্বাস রাদিঃ বলেনঃ-
"كان المشركون على منزلتين من النبي صلى الله عليه وسلم والمؤمنين، كانوا مشركي أهل حرب يقاتلهم ويقاتلونه، ومشركي أهل عهد لا يقاتلهم ولا يقاتلونه"
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুমিনদের কাছে মুশরিদের অবস্থান ছিল দুধরণের। কিছু মুশরিক ছিল যুদ্ধরত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন তারাও তাঁর বিরদ্ধে যুদ্ধ করতো। আর কিছু মুশরিক ছিল চুক্তিবদ্ধ। তিনিও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন না তারাও তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত না। (সহীহ বুখারী, কিতাবুত তালাক, অধ্যায়ঃ নিকাহু মান আসলামা মিনাল মুশরিকাত ...,)
উপরোক্ত বর্ণীত হাদীস থেকে দারুল কুফর দুভাগে বিভক্ত হওয়া স্পষ্ট রূপে বুঝে আসে।
ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ বলেনঃ-
والكفار إما أهل حرب وإما أهل عهد
কুফফার হয়ত যুদ্ধরত হবে নয়ত চুক্তিবদ্ধ হবে। (আহকামু আহলিয যিম্মাহ, খণ্ড-২ পৃষ্ঠা-৪৭৫)
দারুল কুফর কখন দারুল ইসলাম হয়?
দারুল কুফর কখন দারুল ইসলাম হবে এ ব্যাপারে হানাফী ফুকাহাগনের মাঝে কোন দ্বিমত বিদ্যমান নেই। কিন্তু দারুল ইসলাম কখন দারুল কুফর হয় এ ব্যাপারে দ্বিমত বিদ্যমান।
আল্লামা কাসানী রহঃ বলেনঃ-
لَا خِلَافَ بَيْنَ أَصْحَابِنَا فِي أَنَّ دَارَ الْكُفْرِ تَصِيرُ دَارَ إسْلَامٍ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْإِسْلَامِ فِيهَا وَاخْتَلَفُوا فِي دَارِ الْإِسْلَامِ ، إنَّهَا بِمَاذَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ ؟
আমাদের ফুকাহাদের মাঝে এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই যে, দারুল কুফর শুধুমাত্র ইসলামের আহকাম বাস্তবায়নের মাধ্যমেই দারুল ইসলামে পরিণত হয়। তবে তাদের দ্বিমত হচ্ছে- দারুল ইসলাম কীভাবে দারুল কুফর হয় সে ক্ষেত্রে। (বাদাইউস সানায়ে’- পরিচ্ছেদঃ কিতাবুস সিয়ার- অধ্যায়ঃ মা’নাদ দারাইন দারিল ইসলাম ওয়া দারিল কুফর)
ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়াতে একই মত উল্লেখ করা হয়েছেঃ-
اعْلَمْ أَنَّ دَارَ الْحَرْبِ تَصِيرُ دَارُ الْإِسْلَامِ بِشَرْطٍ وَاحِدٍ ، وَهُوَ إظْهَارُ حُكْمِ الْإِسْلَامِ فِيهَا
মনে রাখবে, দারুল হরব শুধুমাত্র একমাত্র শর্তে দারুল ইসলামে পরিণত হবে, আর তা হচ্ছে, সেখানে ইসলামের আইন বাস্তবায়িত থাকা। (ফাতাওয়ায়ে আলামগিরী, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২২৩)
আলাউদ্দীন হাসকাফী রহঃ আদ-দুররুল মুখতারের মধ্যে বলেছেনঃ-
ودار الحرب تصير دار الإسلام بإجراء أحكام أهل الإسلام فيها
দারুল হারব দারুল ইসলামে পরিণত হয়, সেখানে ইসলামের আইন জারি করার মাধ্যমে। (দেখুনঃ- ফাতাওয়ায়ে শামী, কিতাবুল জিহাদ, বাবুল মুসতামিন )
এ ব্যাপারে পুরো উম্মতের ইজমা বিদ্যমান, দারুল কুফর শুধুমাত্র ইসলামী আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমেই দারুল ইসলাম হবে। উপমহাদেশকে উলামায়ে হিন্দ দারুল হারব ফাতওয়া দিয়েছেন। যা সকলেই জানি। কেউ যদি সেই ফাতওয়াকে সঠিক বলে মেনে নেয় তাহলে তাকে উম্মতের এই ইজমা আবশ্যকীয় ভাবে মানতে হবে যে- "ইসলামী আইন বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত উপমহাদেশের কোন রাষ্ট্র দারুল ইসলাম হিসাবে পরিগণিত হবে না। "
দারুল ইসলাম যেভাবে দারুল কুফর হয়-ইমাম আবূ হানীফা রহঃ এর মতঃ
দারুল ইসলাম কখন দারুল কুফর বলে গণ্য হবে, এ ব্যাপারে আমাদের ইমামদের মাঝে দ্বিমত আছে। এ ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা রহঃ বলেনঃ-
إنَّهَا لَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ إلَّا بِثَلَاثِ شَرَائِطَ ، أَحَدُهَا : ظُهُورُ أَحْكَامِ الْكُفْرِ فِيهَا وَالثَّانِي : أَنْ تَكُونَ مُتَاخِمَةً لِدَارِ الْكُفْرِ وَالثَّالِثُ : أَنْ لَا يَبْقَى فِيهَا مُسْلِمٌ وَلَا ذِمِّيٌّ آمِنًا بِالْأَمَانِ الْأَوَّلِ
তিনটি শর্তে দারুল ইসলাম দারুল কুফরে পরিণত হবে।
এক, তাতে কুফরী বিধান নাফেয থাকা।
দুই, দারুল কুফরের পার্শ্ববর্তী হওয়া। (অর্থাৎ পাশে কোন দারুল ইসলাম না থাকা)
তিন, মুসলিম ও জিম্মিরা পূর্বে প্রদান কৃত নিরাপত্তার ন্যায় নিরাপদ না হওয়া। (ইসলামী শাসন থাকা অবস্থায় যেমন নিরাপদ ছিল তেমন নিরাপদ না হওয়া) (বাদাইউস সানায়ে’-পরিচ্ছেদঃ কিতাবুস সিয়ার - অধ্যায়ঃ মা’নাদ দারাইন দারিল ইসলাম ওয়া দারিল কুফর)
ইমাম আবু হানীফা রহঃ দারুল কুফরে পরিণত হবার যে তিনটি শর্ত বর্ণনা করেছেন তার প্রতিটি শর্ত বর্তমান প্রায় সকল মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রে পাওয়া যায়। কেননা এসমস্ত রাষ্ট্র কুফফারদের বিধান দ্বারা পরিচালিত। আর ইসলামী খিলাফাত বা শাসন থাকা অবস্থায় মুসলিমরা যে নিরাপত্তার মধ্যে ছিল তার শত ভাগের এক ভাগ নিরাপত্তার মধ্যেও মুসলিমগণ নেই। যা দিবালোকের উজ্জ্বল সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট। তবে দিনের বেলা কেউ চক্ষু বন্ধ করে থাকলে তা ভিন্ন কথা। আর আমাদের পার্শ্ববর্তী এমন কোন রাষ্ট্রও নেই যা ইসলামী আইন দ্বারা পরিচালিত। তাই কেউ যদি ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর মতকেও গ্রহণ করে তথাপি এ ধরণের রাষ্ট্রকে দারুল ইসলাম বা দারুল আমান বলার সুযোগ নেই।
আমাদের আহনাফ ফুকাহায়ের মত হচ্ছে, মুসলিম মুজাহিদীন যদি কোন দারুল কুফরে আক্রমণ চালায়- অতঃপর কাফেরদের পরাজয় ঘটে, মুজাহিদীনরা বিজয় লাভ করলেও ইসলামী আইন বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত তা দারুল ইসলামে পরিণত হবে না। দারুল ইসলাম হবার এক মাত্র শর্ত হচ্ছে, দ্বীন কায়েম করতে হবে। দ্বীন কায়েমের আগে তা দারুল ইসলাম হবে না।
ইমাম আবূ হানীফা ও আবূ ইয়ূসুফ রহঃ এর মতে, দারুল কুফরে গনিমত বণ্টন জায়েজ নেই। কিন্তু দেখা যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বার বিজয়ের পর সেখানেই গণিমত বণ্টন করেছেন। এই মাসআলা আলোচনা করতে গিয়ে শামসুল আয়িম্মাহ ইমাম সারাখসী রহঃ বলেনঃ-
وأما خيبر فإنه افتتح الأرض وجرى فيها حكمه فكانت القسمة فيها بمنزلة القسمة في المدينة وقسم الغنائم فيها قبل أن يخرج منها ففي هذا دليل أن الإمام إذا افتتح بلدة وصيرها دار إسلام بأجراء أحكام الإسلام فيها فإنه يجوز له أن يقسم الغنائم فيها وقد طال مقام رسول الله صلى الله عليه وسلم بخيبر بعد الفتح وأجرى أحكام الإسلام فيها فكانت من دار الإسلام
আর খায়বারের ব্যাপারটি হচ্ছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খায়বার বিজয় করেছেন। সেখানে তাঁর বিধান (ইসলামী বিধান) জারি করেছেন। তাই সেখানে গণিমত বণ্টন মদিনায় বণ্টনের অনুরূপ। খায়বারে গণিমত বণ্টন থেকে প্রমাণিত হয়, যখন ইমাম কোন অঞ্চল বিজয় করবেন এবং ইসলামী শাসন জারি করার মাধ্যমে তাকে দারুল ইসলামে পরিণত করবেন, তখন ইমামের জন্য সেখানে গণিমত বণ্টন করা জায়েজ। খায়বার বিজয়ের পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেথায় দীর্ঘ সময় অবস্থান করেছেন এবং সেখানে ইসলামী বিধান জারি করেছেন। ফলে তা দারুল ইসলামে পরিণত হয়েছিল। (আল-মাবসূত, খণ্ড-১০, অধ্যায়ঃ কিতাবুস সিয়ার-গণিমতের বণ্টন)
ইয়ামানের নুজাইর অঞ্চল বিজয়ের ব্যাপারে শামসুল আয়িম্মাহ ইমাম সারাখসী রহঃ বলেনঃ-
إنهم فتحوا ولم تجر احكام الاسلام فيها بعد
وبمجرد الفتح قبل اجراء احكام الاسلام لا تصير دار اسلام
সাহাবায়ে কেরাম নুজাইর বিজয় করেছেন। কিন্তু বিজয়ের পর পরেই (সাহায্যকারী অপর বাহিনী যুক্ত হবার আগে) সেখানে ইসলামী বিধান বাস্তবায়ন করেননি। আর শুধুমাত্র বিজয়ের মাধ্যমে, ইসলামী শাসন জারি করার পূর্বে কোন রাষ্ট্র দারুল ইসলাম হয় না। (আল-মাবসূত, খণ্ড-১০, অধ্যায়ঃ কিতাবুস সিয়ার-গণিমতের বণ্টন)
নোটঃ উলামায়ে হিন্দ উপমাহাদেশকে দারুল হারব ঘোষণা করে ছিলেন। সুতরাং দারুল হারব তখন পর্যন্ত দারুল ইসলাম হবেনা যতক্ষণ না সেখানে ইসলামী শাসন বাস্তবায়িত হয়। যদি মুসলিমগণ যুদ্ধ করে অথবা অন্য কোন ভাবে কোন অঞ্চল নিজেদের অধীনে নেয় তা দারুল ইসলামে পরিণত হবে না যতক্ষণ না সেখানে ইসলামী বিধান বাস্তবায়ন করা হয়। এটাই ফিকহে হানাফীর গ্রহণযোগ্য মত।
জুমহুরের অভিমত
জুমহুর ফুকাহা রহঃ এর অভিমত হচ্ছে, দারুল কুফর যেভাবে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দারুল ইসলাম হয় একই ভাবে দারুল ইসলাম, দারুল কুফরে পরিণত হয় কুফরী আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে। শাফী মাযহাবের কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেন, তাদের মত হচ্ছে কোন রাষ্ট্র একবার দারুল ইসলাম হলে আর কখনো দারুল কুফর হবে না। সেটা দারুল ইসলাম হিসাবেই গণ্য হবে। ফিকহে শাফীর অনুসারী অন্য ফকীহ আবার তাদের এই মতের বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন।
জুমহুর আয়িম্মায়ের নিকট, রাষ্ট্র যে আইন দ্বারা পরিচালিত হবে সেটা সেই রাষ্ট্র হিসাবেই গণ্য হবে, ইসলামী আইন দ্বারা হলে দারুল ইসলাম। কুফরী আইন দ্বারা পরিচালিত হলে দারুল কুফর।
আহনাফ রহঃ দের অভিমতঃ
ইমাম আবূ ইয়ূসুফ ও মুহাম্মাদ রহঃ এর অভিমত-
ইমাম কাসানী রহঃ বলেনঃ
وَقَالَ أَبُو يُوسُفَ وَمُحَمَّدٌ - رَحِمَهُمَا اللَّهُ : إنَّهَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْكُفْرِ فِيهَا
আর ইমাম আবূ ইয়ূসুফ ও মুহাম্মাদ রহঃ এর মত হচ্ছে, কুফরি বিধান নাফেযের মাধ্যমে দারুল ইসলাম দারুল কুফরে পরিণত হবে। (বাদাইউস সানায়ে’- কিতাবুস সিয়ার- অধ্যায়ঃ মা’নাদ দারাইন দারিল ইসলাম ওয়া দারিল কুফর)
ফাতাওায়ে আলমগিরীতে সাহেবাইনের এই মতকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছেঃ –
وَقَالَ أَبُو يُوسُفَ وَمُحَمَّدٌ - رَحِمَهُمَا اللَّهُ تَعَالَى - بِشَرْطٍ وَاحِدٍ لَا غَيْرَ ، وَهُوَ إظْهَارُ أَحْكَامِ الْكُفْرِ ، وَهُوَ الْقِيَاسُ
আর আবূ ইয়ূসুফ ও মুহাম্মাদ রহঃ বলেন- “শুধুমাত্র একটা শর্তই প্রযোজ্য অন্য কোন শর্তের প্রয়োজন নেই। আর তা হচ্ছে কুফরী আইন কার্যকর করা।” আর এই মতটাই যুক্তিযুক্ত। (ফাতওয়ায়ে শামী, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়ঃ ফী-মা তাসীরু বিহী দারুল ইসলাম ওয়া দারুল হারব)
ইমাম সারাখসী রহঃ সহেবাইনের মতের ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেনঃ
لان البقعة انما تنسب الينا أو إليهم باعتبار القوة والغلبة فكل موضع ظهر فيه حكم الشرك فالقوة في ذلك الموضع للمشركين فكانت دار حرب وكل موضع كان الظاهر فيه حكم الاسلام فالقوة فيه للمسلمين
কোন অঞ্চল আমাদের সাথে সম্পৃক্ত ধরা হবে নাকি কাফেরদের সাথে সম্পৃক্ত ধরা হবে তা নির্ধারিত হবে শক্তি ও কর্তৃত্বের প্রতি লক্ষ্য করে। কোন রাষ্ট্রে যদি শিরকের বিধান কার্যকর থাকে সেখানে মুশরিকরা শক্তিশালী বলে বিবেচিত হবে। ফলে তা দারুল হারব হবে। কোন রাষ্ট্রে যদি ইসলামী বিধান কার্যকর থাকে সেখানে মুসলিমরা শক্তিশালী বলে বিবেচিত হবে। (আল-মাবসূত, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়ঃ মুয়ামালাতু জাইশিল কুফফার)
ইমাম সারাখসী রহঃ এর মতের বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে আমরা দিন পার করছি। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম কিন্তু বিধান চলছে শিরক ও কুফরের। যার ফলে আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইজ্জত রক্ষার্থে রাজপথে নামলে আমাদের বুকে ধেয়ে আসছে বুলেট। আমাদের উপর বিস্ফোরিত হচ্ছে গ্রেনেড। ইতিহাসকে নিস্তব্ধ করে এমন জঘন্য ও নগ্ন ভাষায় মুহাম্মাদে আরাবীর ইজ্জতে আক্রমণকারীর হত্যাকারীদের শাস্তি হচ্ছে ফাঁসি। আর জঘন্য সেই মুরতাদ হচ্ছে “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ”। তাই বিধান চলে যাদের শক্তি ও কর্তৃত্ব বাস্তবেই তাদের।
ইমাম মালিক রহঃ এর মতঃ
ইমাম মালিক রহঃ মক্কা বিজয় হওয়ার পূর্বের হুকুম বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
وكانت الدار يومئذ دار حرب لأن أحكام الجاهلية كانت ظاهرة يومئذ
তখন ঐ অঞ্চল (মক্কা) দারুল হারব ছিল। কেননা তখন (মক্কায়) জাহিলিয়্যাতের বিধিবিধানই বিজয়ী ছিল। (আল-মুদাউওনাতুল কুবরা, অধ্যায়ঃ ফী আবীদি দারিল হারব ইউসলিমুনা ফী-দারিল হারব)
মক্কা বিজয়ের পূর্বে ইমাম মালিক রহঃ মক্কাকে দারুল হারব আখ্যায়িত করতেছেন। আর এর কারণ হিসাবে উল্লেখ করতেছেন ‘মক্কা জাহিলিয়্যাতের বিধানের অধীনে থাকা’। ফিকহে মালেকির অনুসারী অন্যান্য ফুকাহা রহঃ একই মত ব্যক্ত করেছেন।
ফুকাহায়ে হানাবেলা রহঃ
কাজী আবূ ইয়া’লা রহঃ বলেনঃ-
كل دار كانت الغلبة فيها لأحكام الكفر دون أحكام الإسلام فهي دار الكفرة
যে দারের মধ্যে ইসলামী আইনের চেয়ে কুফরি আইন প্রকট হবে তা দারুল কুফর হিসাবেই বিবেচ্য হবে। (আল-মুতামাদ ফী উসুলিদ দ্বীন-২৭৬)
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ বলেনঃ
قال الجمهور: دار الإسلام هي التي نزلها المسلمون وجرت عليها أحكام الإسلام، وما لم تجر عليه أحكام الإسلام لم يكن دار إسلام وإن لاصقها، فهذه الطائف قريبة إلى مكة جدا ولم تصر دار إسلام بفتح مكة وكذلك الساحل
জুমহুরের অভিমত হচ্ছে- দারুল ইসলাম হচ্ছে ঐ রাষ্ট্র যার অধিবাসীরা মুসলিম এবং তাতে ইসলামী বিধান বাস্তবায়িত। যে রাষ্ট্রে ইসলামী বিধান বাস্তবায়িত নেই তা দারুল ইসলাম নয় যদিও বা তা দারুল ইসলামের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র হয় না কেন। তয়েফ মক্কার অতি নিকটের একটি অঞ্চল কিন্তু মক্কা বিজয়ের পরও তা দারুল ইসলামে পরিণত হয়নি। একইভাবে সাহেল। (আহকামু আহলিয যিম্মাহ, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৬৬)
শায়েখ মানসূর আল-বুহূতী রহঃ বলেনঃ
وتجب الهجرة على من يعجز عن إظهار دينه بدار الحرب وهى ما يغلب فيها حكم الكفر
দারুল হারবে যে নিজের দ্বীনকে প্রকাশ করতে অক্ষম তার উপর হিজরত ওয়াজিব। আর দারুল হারব হচ্ছে যেখানে কুফরী বিধান প্রবল। (কাশশাফুল কেনা’, কিতাবুল জিহাদ-প্রথম অধ্যায়)
আল্লামা ইবনে মুফলিহ রহঃ আল-হাম্বালী বলেনঃ-
فكل دار غلب عليها أحكام المسلمين فدار الإسلام، وإن غلب عليها أحكام الكفار فدار الكفر، ولا دار لغيرهما
যে রাষ্ট্রের মধ্যে মুসলিমদের বিধান বাস্তবায়িত তা দারুল ইসলাম আর যে রাষ্ট্রের মধ্যে কুফরী বিধান বাস্তবায়িত তা দারুল কুফর। এই দুইয়ের বাইরে কোন দার (রাষ্ট্র) নেই। (আল-আদাবুশ শরই্য়্যা, অধ্যায়ঃ ফী-তাহকীকি দারিল ইসলাম ওয়া দারিল কুফর)
আল্লামা আলাউদ্দীন আল-মারদাবী রহঃ বলেনঃ
ودار الحرب ما يغلب فيها حكم الكفر
দারুল হারব হচ্ছে ঐ রাষ্ট্র যা কুফরী আইন দ্বারা শাসিত। (আল-ইনসাফ, কিতাবুল জিহাদ-প্রথম অধ্যায়)
সমকালীন ইসলামিক চিন্তাবিদ
সায়্যেদ কুতুব রহঃ বলেনঃ
ينقسم العالم في نظر الإسلام وفي اعتبار المسلم إلى قسمين لا ثالث لهما: الأول دار إسلام، وتشمل كل بلد تطبق فيه أحكام الإسلام، وتحكمه شريعة الإسلام سواء كان أهله كلهم مسلمين، أو كان أهله مسلمين وذميين، أو كان أهله كلهم ذميين ولكن حكامه مسلمون يطبقون فيه أحكام الإسلام، ويحكمون بشريعة الإسلام .. فالمدار كله في اعتبار بلد ما دار إسلام هو تطبيقه لأحكام الإسلام، وحكمه بشريعة الإسلام.
الثاني: دار حرب، وتشمل كل بلد لا تطبق فيه أحكام الإسلام، ولا يحكم بشريعة الإسلام، كائناً أهله ما كانوا، سواء قالوا: إنهم مسلمون، أو أنهم أهل كتاب أو أنهم كفار، فالمدار كله في اعتبار بلد ما دار حرب هو عدم تطبيقه لأحكام الإسلام، وعدم حكمه بشريعة الإسلام،
ইসলামের দৃষ্টিতে ও মুসলিমের বিবেচনায় বিশ্ব দুভাগে বিভক্ত। যার তৃতীয় কোন ভাগ নেই।
প্রথমঃ দারুল ইসলাম। আর তা হচ্ছে ঐ রাষ্ট্র- যেথায় ইসলামী আইন বাস্তবায়িত। ইসলামী শরীয়ত দ্বারা পরিচালিত। চাই তার সকল জনগণ মুসলিম হোক। বা মুসলিম ও যিম্মি উভয় মিলিত হোক। অথবা সকল জনগণ যিম্মি হোক কিন্তু শাসক হোক মুসলিমরা। যারা সেথায় ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করে। ইসলামী শরীয়ত দ্বারা ফায়সালা করে। দারুল ইসলাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, ইসলামী আইন বাস্তবায়িত হওয়া ও ইসলামী শরীয়ত দ্বারা বিচার ফায়সালা করা।
দ্বিতীয়ঃ দারুল হারব। আর তা হচ্ছে প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড যেথায় ইসলামী আইন বাস্তবায়িত নয়। যা ইসলামী শরীয়ত দ্বারা পরিচালিত হয় না। চাই তার জনগণ যারাই হোক না কেন। চাই তারা বলে- তারা মুসলিম। বা তারা আহলে কিতাব অথবা তারা (অন্য) কাফের। কোন রাষ্ট্রকে দারুল হারব নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, ইসলামী আইন বাস্তবায়িত না থাকা। ইসলামী শরীয়ত দ্বারা বিচার ফায়সালা না করা। (তাফসীর ফী-যিলালিল কুরআন, সূরা মায়েদা-২৭-৪০ আয়াতের তাফসীর দেখুন)
মুহাম্মাদ কুতুব রহঃ বলেনঃ
والذي عليه جمهور العلماء أن الدار تأخذ وصفها من غلبة الأحكام عليها ـ أي بصرف النظر عن عقائد أهلها ـ فالأرض التي تحكمها شريعة الله فهي دار إسلام، ولو كان أغلب سكانها غير مسلمين، كما كانت الهند خلال ثمانية قرون من الحكم الإسلامي، وأغلب سكانها المجوس عباد البقر. كذلك الأرض التي لا تحكمها شريعة الله فهي دار حرب ولو كان أغلب سكانها مسلمين،
জুমহুর উলামার মত হচ্ছে, দার নির্ধারিত হবে তা কোন বিধান দ্বারা শাসিত তার প্রতি লক্ষ্য করে। অর্থাৎ ঐ ভূখণ্ডের মানুষ কোন বিশ্বাসের তা বিবেচ্য হবে না। যে রাষ্ট্র আল্লাহ্ তায়ালার শরীয়ত শাসিত হবে তা দারুল ইসলাম যদিও বা তার অধিকাংশ অধিবাসী অমুসলিম হয়। যেমন অষ্টম শতাব্দীতে ইসলামী শাসনকালে হিন্দুস্তানের অবস্থা ছিল। অধিকাংশ জনগণ ছিল গো-পূজারী মাজুসী। অনুরূপ যে রাষ্ট্র আল্লাহ্ তায়ালার শরীয়ত দ্বারা শাসিত নয় তা দারুল হারব। যদিও তার অধিকাংশ জনগণ মুসলিম হয়। (ওয়া’কেউনাল মুয়াসের (واقعنا العاصر) ,পৃষ্ঠা-৪২৭)
উস্তায আব্দুল কাদের আউদাহ রহঃ এর অভিমতঃ
دار الكفر تشمل كل البلاد غير الإسلامية التي لا تدخل تحت سلطان المسلمين، أولا تظهر فيها أحكام الإسلام، سواء أكانت هذه البلاد تحكمها دولة واحدة، أو تحكمها دول متعددة، ويستوي أن يكون بين سكانها المقيمين إقامة دائمة مسلمون أولا يكون، مادام المسلمون عاجزين عن إظهار أحكام الإسلام
দারুল কুফর হচ্ছে এমন সকল অইসলামিক অঞ্চল সমূহ যা মুসলিমদের অধীনে নেই। অথবা যেথায় ইসলামী বিধান কার্যকর নয়। চাই উক্ত অঞ্চল সমূহ কোন এক রাষ্ট্র দ্বারা শাসিত হোক অথবা একাধিক রাষ্ট্র দ্বারা। চাই সেখানের স্থায়ী অধিবাসী মুসলিম হোক বা অমুসলিম। যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলিমগণ ইসলামী বিধান কার্যকর করা থেকে অপারগ হয়।
(আত-তাশরি’উল জিনায়ী আল-ইসলামী-التشريع الجنائي الإسلامي, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৭৫)
উম্মতের নির্ভরযোগ্য মুজতাহিদ উলামা-ফুকাহা রহঃ এর কিতাব অধ্যয়নের পর, আমরা দারুল ইসলাম ও দারুল কুফরের উপরোক্ত পরিচয় পাই। তাই আমরা ইহাই গ্রহন করি ও বিশ্বাস করি। শরয়ী কোন সিদ্ধান্ত নিজ প্রবৃত্তি থেকে আমদানি না করে শরীয়তের মাসদার থেকে আহরণ করি। আমাদের আহরণে যদি কোন ভুল হয়ে যায়, আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জাতের কাছে ক্ষমা চাই। প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে পানাহ চাই। কোন ভাই! যদি শরয়ী দলীল দ্বারা আমাদের ভুল ধরিয়ে দেন ইনশাআল্লাহ্ আমারা প্রসস্থ হৃদয়ে তা গ্রহণ করব। কারণ আমরা কোন ব্যক্তি-মতের পুজারি না বরং শরীয়তের অনুসারী। আমরা ইনশাআল্লাহ্ হৃদয় থেকে ঐ ভাইয়ের জন্য দুয়া করব।
দারুল মুয়াদায়াহ(دار الموادعة) /দারুল আহাদ (دار العَهْد)/ দারুল আমান (دار الأمن)
দারুল কুফর যদি মুসলিমদের সাথে চুক্তিবদ্ধ না হয় তাহলে তা হারবী রাষ্ট্র বা দারুল হারব হিসাবেই গণ্য হবে। আর চুক্তি বা সন্ধি থাকলে তা 'দারুল আহাদ' (চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্র) বলে গণ্য হবে।
ফুকাহায়ে আহনাফ মুসলিমদের সাথে চুক্তিবদ্ধ দারুল কুফর এর ক্ষেত্রে ‘দারুল মুয়াদায়াহ’ (সন্ধির আওতাধীন রাষ্ট্র) পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। (দেখুনঃ শারহু সিয়ারীল কাবীর, খণ্ড-৫, অধ্যায়ঃ বাবুল মুয়াদায়াহ। বাদায়েউস সানায়ে’, কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়ঃ মা ইয়া’তারিদু মিনাল আসবাবিল মুহাররমাহ লিল-কিতাল)
“দারুল আমান” শব্দটি পরিভাষা হিসাবে মুতাকাদ্দিমীন মুতায়াখখিরীন মুজতাহিদ ফুকাহাগন ব্যবহার করেননি। তবে বর্তমান অনেককে এই পরিভাষা ব্যবহার করতে দেখা যায়। যদি “দারুল আমান” পরিভাষাটি দ্বারা উদ্দেশ্য হয় ‘দারুল মুয়াদায়াহ’ বা ঐ দারুল কুফর যার সাথে মুসলিমদের সন্ধি বা চুক্তি আছে তাহলে তো তা ঠিক আছে। কিন্তু যদি তা দ্বারা উদ্দেশ্য হয় ভিন্ন কিছু তাহলে তাদের জন্য জরুরী হবে এর পক্ষে শরয়ী নির্ভরযোগ্য দলীল পেশ করা।
মুরতাদ শাসনাধীন রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি
মুরতাদ যদি কোন ইসলামী রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করে শাসন করে তাহলে তা দারুল কুফরে পরিণত হবে। তবে তাদের সাথে সন্ধি/চুক্তি করা যাবে কিনা এই ব্যাপারে ফুকাহাদের মাঝে দ্বিমত আছে, অনেকে সন্ধি করতে নিষেধ করেছেন ---
আল্লামা মাওয়ারদী রহঃ বলেনঃ
ولا يجوز إقرار المرتد على ردته بجزية ولا عهد، ولا تؤكل ذبيحته، ولا تنكح منه إمرأة
জিযিয়া বা চুক্তির মাধ্যমে মুরতাদকে স্বীকৃত দেয়া বৈধ নয়। তার জবেহ খাওয়া যাবে না। তার সাথে কোন মেয়ের বিবাহ জায়েয নেই। (আল-আহকামুস সুলতানিয়্যাহ)
তবে যদি তাদের সাথে যুদ্ধের শক্তি না থাকে তাহলে হানাফী ফুকাহাদের নিকট নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তি জায়েয। আর শক্তি থাকলে জায়েয নয়। ইমাম হাসকাফী রহঃ বলেনঃ
و نصالح المرتدين لو غلبوا على بلدة وصارت دارهم دار حرب لو خيرا بلا مال وإلا يغلبوا على بلدة (لا) لان فيه تقرير المرتدين على الردة وذلك: لا يجوز.
মুরতাদরা যদি কোন অঞ্চল কবজা করে নেয় তবে ঐ দখলকৃত অঞ্চল দারুল হারব হয়ে যায়। যদি কল্যাণ দেখি তাহলে আমরা তাদের সাথে সন্ধি করব। কোন অর্থ ছাড়া। আর যদি তারা কোন অঞ্চল দখল করতে না পারে তাহলে তাদের সাথে চুক্তি করা যাবে না। কেননা চুক্তির মাধ্যমে মুরতাদকে তাদের রিদ্দার ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেয়া হবে আর এটা জায়েয নেই। (আদ দুররুল মুখতার, কিতাবুল জিহাদ, খণ্ড-৪,পৃষ্ঠা-৩১০)
শামসুল আয়িম্মাহ সারাখসী রহঃ বলেনঃ-
ولا بأس في هذه الحالة بموادعة المرتدين الذين غلبوا على دارهم لأنه لا قوة للمسلمين على قتالهم فكانت الموادعة خيراً لهم
এই অবস্থায় (দুর্বলতার সময়) মুরতাদদের সাথে সন্ধি করতে কোন সমস্যা নেই। যারা তাদের অঞ্চল কবজা করে নিয়েছে। কেননা তাদের সাথে যুদ্ধের শক্তি মুসলিমদের নেই। তাই তাদের সাথে চুক্তি করাই কল্যাণকর হবে। (শারহু সিয়ারীল কাবীর, বাবুল মুয়াদায়াহ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৪ )
ইমাম সারাখসী রহঃ আরও বলেনঃ
وبعد ما غلبوا على دارهم فقد صارت دارهم دار الحرب حتى إذا وقع الظهور عليهم يكون مالهم غنيمة للمسلمين
মুরতাদরা যখন নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে তখন তাদের অঞ্চল দারুল হারবে পরিণত হয়। আর যখন আবার তাদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন হবে তখন তাদের মাল গণিমতে পরিণত হবে।(শারহু সিয়ারীল কাবীর, বাবুল মুয়াদায়াহ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৪ )
ইমাম কাসানী রহঃ বলেনঃ
وتجوز موادعة المرتدين إذا غلبوا على دار من دور الإسلام ، وخيف منهم ، ولم تؤمن غائلتهم لما فيه من مصلحة دفع الشر للحال ،
মুরতাদরা যদি মুসলিমদের কোন ভূখণ্ড দখলে নেয়। অতঃপর তাদের থেকে বিপদের আশংকা করা হয় ও তাদের বিপর্যয় থেকে নিরাপদ না থাকা যায়, তাহলে তাদের সাথে চুক্তি জায়েয আছে। কেননা এর মাঝে তাৎক্ষণিক বিপদ প্রতিহতের কল্যাণ নিহিত। (বাদাইউস সানায়ে’, কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়- ফী-বায়ানী মা ইয়া’তারিদু মিনাল আসবাবিল মুহাররমাহ লিল-কিতাল)
নোটঃ
(১) মুরতাদরা মুসলিমদের কোন অঞ্চল কবজা করলে তা দারুল কুফর হয়ে যাবে।
(২) মুসলিমদের দুর্বলতার সময় তাদের সাথে চুক্তি ও সন্ধিতে আসা আহনাফের নিকট জায়েয।
যুদ্ধ না করে সন্ধির শর্ত
কাফির ও মুরতাদদের সাথে যুদ্ধ না করে সাময়িক চুক্তির ক্ষেত্রে আহলুল ইলম বেশ কয়েকটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। যার মাঝে কিছু শর্তের ব্যাপারে তারা মুত্তাফিক (ঐকমত) কিছু শর্তের ব্যাপারে মুখতালিফ (ভিন্নভিন্ন মত পোষণকারী)। আমরা এখানে শুধু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ফিকহে হানাফীর আলোকে উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ্।
প্রথম শর্তঃ
মুসলিমরা দুর্বল হতে হবে। যুদ্ধ করার শক্তি না থাকতে হবে। যুদ্ধের শক্তি থাকলে সন্ধি বা চুক্তি করা যাবে না।
ইমাম সারাখসী রহঃ বলেনঃ
قال أبو حنيفة - رضي الله عنه - : لا ينبغي موادعة أهل الشرك إذا كان بالمسلمين عليهم قوة لأن فيه ترك القتال المأمور به أو تأخيره وذلك مما لا ينبغي للأمير أن يفعله من غير حاجة قال الله - تعالى - : { وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ } الأنفال الاية 139
আবু হানীফা রাদিআল্লাহু আনহু বলেনঃ- মুশরিকদের সাথে সন্ধি করা যাবে না, যখন মুসলিমরা মুশরিকদের তুলনায় শক্তিশালী হবে। কেননা সন্ধির মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালার নির্দেশিত বিধান কিতাল তরক করতে হয়। অথবা বিলম্ব করতে হয়। আর কোন আমীরের জন্য প্রয়োজন ছাড়া এটা করা যাবে না। আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ
“আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে”। (শারহু সিয়ারীল কাবীর, বাবুল মুয়াদায়াহ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৩)
দ্বিতীয় শর্তঃ
সন্ধি করার মাধ্যমে জিহাদ ত্যাগ উদ্দেশ্য হবে না। বরং জিহাদের জন্য আরও বেশী শক্তি অর্জনের জন্যই সন্ধি করতে হবে। যাতে জিহাদের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হবার অবকাশ পাওয়া যায়।
ইমাম কাসানী রহঃ বলেনঃ
وشرطها الضرورة ، وهي ضرورة استعداد القتال ، بأن كان بالمسلمين ضعف ، وبالكفرة قوة المجاوزة إلى قوم آخرين ، فلا تجوز عند عدم الضرورة ؛ لأن الموادعة ترك القتال المفروض ، فلا يجوز إلا في حال يقع وسيلة إلى القتال ؛
সন্ধির শর্ত হচ্ছে, জরুরত। অর্থাৎ ‘কিতালের জন্য প্রস্তুত হবার প্রয়োজন’টা সামনে চলে আসা। অর্থাৎ মুসলিমরা যদি দুর্বল হয়। আর কাফেরদের অন্য সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণের শক্তি থাকে। কেননা সন্ধির মাধ্যমে ফরয কিতাল তরক করা হয়। তাই সন্ধি শুধু সেই প্রেক্ষাপটে জায়েয হবে যা কিতাল পর্যন্ত পৌঁছার মাধ্যম হবে। (বাদাইউস সানায়ে’, কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়- ফী-বায়ানী মা ইয়া’তারিদু মিনাল আসবাবিল মুহাররমাহ লিল-কিতাল)
তৃতীয় শর্তঃ
আজীবনের জন্য করা যাবে না। বরং তা নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত হতে হবে। এই সময়ের ব্যাপারে ফুকাহাদের মাঝে দ্বিমত আছেন। কেউ বলেছেন ৪ মাস। কেউ ২ বছর, কেউ ১০ বছর সর্বোচ্চ। তবে ফিকহে হানাফীর গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে ততদিন রাখা যাবে যত দিন এর মাঝে মুসলিমদের কল্যাণ থাকবে।
ইবনে হুমাম রহঃ বলেনঃ
وَلَا يَقْتَصِرُ الْحُكْمُ وَهُوَ جَوَازُ الْمُوَادَعَةِ عَلَى الْمُدَّةِ الْمَذْكُورَةِ وَهِيَ عَشْرُ سِنِينَ لِتَعَدِّي الْمَعْنَى الَّذِي بِهِ عَلَّلَ جَوَازَهَا ، وَهُوَ حَاجَةُ الْمُسْلِمِينَ أَوْ ثُبُوتُ مَصْلَحَتِهِمْ فَإِنَّهُ قَدْ يَكُونُ بِأَكْثَرَ بِخِلَافِ مَا إذَا لَمْ تَكُنْ الْمُوَادَعَةُ أَوْ الْمُدَّةُ الْمُسَمَّاةُ خَيْرًا لِلْمُسْلِمِينَ فَإِنَّهُ لَا يَجُوزُ
সন্ধি জায়েয হবার হুকুম উল্লেখিত ১০ বছর সময়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ হবে না। যে কারণে সন্ধি জায়েজ করা হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে চুক্তি বারান-কমানো যাবে। তবে শর্ত হচ্ছে, মুসলিমদের জরুরত ও তাদের কল্যাণ বিদ্যমান থাকা। তাই কখনও সময় বেশীও হতে পারে। তবে যদি সন্ধি বা উল্লেখিত সময় মুসলিমদের জন্য কল্যাণকর না হয় তাহলে তা জায়েয হবে না। (ফাতহুল কাদীর, পরিচ্ছেদঃ কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়ঃ বাবুল মুয়াদায়াহ)
বুরহানুদ্দীন মারগিনানী রহঃ বলেনঃ
وإن صالحهم مدة ثم رأى نقض الصلح أنفع نبذ إليهم وقاتلهم
যদি তাদের সাথে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সন্ধি করা হয় অতঃপর দেখা যায় চুক্তি ভেঙ্গে ফেলাটাই উত্তম তাহলে তাদেরকে চুক্তি ভেঙ্গে ফেলার সংবাদ পৌঁছাবে। এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। (আল-হেদায়া, কিতাবুস সিয়ার, বাবুল মুয়াদায়াহ)
নোটঃ
শরীয়তের মধ্যে আসল হচ্ছে হারবীদের সাথে কিতাল করা। তবে শর্ত সাপেক্ষে কখনো কখনো সন্ধি করাও জায়েয আছে। সন্ধির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জিহাদের জন্য যাতে মুসলিমগণ প্রস্তুতি নেবার অবকাশ পায়।
চুক্তিবদ্ধ কাফেরকে সামরিক সহায়তাঃ
ইমাম ইবনে হুমাম রহঃ বলেনঃ
وَلَا يَنْبَغِي أَنْ يُبَاعَ السِّلَاحُ مِنْ أَهْلِ الْحَرْبِ وَلَا يُجَهَّزُ إلَيْهِمْ لِأَنَّ النَّبِيَّ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ نَهَى عَنْ بَيْعِ السِّلَاحِ مِنْ أَهْلِ الْحَرْبِ وَحَمْلِهِ إلَيْهِمْ ، وَلِأَنَّ فِيهِ تَقْوِيَتَهُمْ عَلَى قِتَالِ الْمُسْلِمِينَ فَيُمْنَعُ مِنْ ذَلِكَ وَكَذَا الْكُرَاعُ لِمَا بَيَّنَّا ، وَكَذَلِكَ الْحَدِيدُ لِأَنَّهُ أَصْلُ السِّلَاحِ ، وَكَذَا بَعْدَ الْمُوَادَعَةِ ؛ لِأَنَّهَا عَلَى شَرَفِ النَّقْضِ أَوْ الِانْقِضَاءِ فَكَانُوا حَرْبًا عَلَيْنَا ،
হারবীদের নিকট অস্ত্র বিক্রি করা তাদেরকে অস্ত্রে সজ্জিত করা যাবে না। কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারবীদের নিকট অস্ত্র বিক্রি করতে ও রপ্তানি করতে নিষেধ করেছেন। কেননা এর দ্বারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদেরকে শক্তিশালী করা হবে। তাই তা নিষেধ। একই ভাবে ঘোড়া, লোহাও কেননা অস্ত্রের মূল সেটাই।
অনুরূপ সন্ধির পরও জায়েয নেই। কেননা সন্ধি ভঙ্গে গেলে বা ভেঙ্গে দিলে তারা আমাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করবে। (ফাতহুল কাদীর, পরিচ্ছেদঃ কিতাবুস সিয়ার, অধ্যায়ঃ বাবুল মুয়াদায়াহ)
ইমাম সারাখসী রহঃ বলেনঃ
ولا يمنع التجار من حمل التجارات إليهم إلا الكراع والسلاح والحديد لأنهم أهل حرب وإن كانوا موادعين ألا ترى أنهم بعد مضي المدة يعودون حربا للمسلمين
ব্যবসায়ীদেরকে দারুল আহদের অধিবাসীদের কাছে ব্যবসায়ী পণ্য রপ্তানি করতে নিষেধ করা হবে না। তবে ঘোড়া অস্ত্র লোহা রপ্তানি করতে পারবে না। কেননা তারা হারবী। যদিও এখন চুক্তিবদ্ধ। তুমি কি জাননা! সময় শেষ হবার পর তারা পুনরায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। (আল-মাবসূত, কিতাবুস সিয়ার খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-৮৮)
---------------------