সর্বোত্তম মানুষঃসর্বোত্তম আদর্শ
এস এম শাহজাহান তালুকদার
===========================================================
সর্বোত্তম মানুষ সর্বোত্তম আদর্শের প্রতিষ্ঠাতা, হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনচরিত আমাদের চলার পাথেয় এবং সমগ্র মানবজাতির জন্যে অনুসরণীয়। তিনিই আমাদের রাসূলুল্লাহ যিনি মানব জাতির কল্যাণে এসেছিলেন। তাঁর আগমন সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকে তাদের কাছে এক রাসূল প্রেরণ কর যে তােমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট আবৃত্তি করবে, তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদের পবিত্র করবে।” (সূরা বাকারাঃ ১২৯ আয়াত)
আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)- এর জন্মের প্রায় চার হাজার বছর আগে হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আঃ) আল্লাহর কাছে উক্ত আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদন আল্লাহ তা'আলা কবুল করেছিলেন এবং তাঁদের বংশধর থেকে বিশ্বের শেষ ও চিরন্তন দ্বীনের বার্তাবাহক, আদর্শ রূপায়ক হিসেবে নবী করীম (সঃ) দুনিয়ায় এলেন মানব জাতির কল্যাণে, স্বীয় প্রভুর বাণী প্রচারে এবং জীবন-যাপনের দৃষ্টান্ত স্থাপনে। আমরা তাঁরই উম্মত-মুসলমান। নবী রসূলগণের পরিচয় এবং দায়িত্ব সম্পর্কে কুরআনে বিশেষ ভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। কেননা, মানবজাতি আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষগণ সম্পর্কে অতীতে নানা ভ্রান্তির শিকার হয়েছে এবং তার পরিণতিতে আল্লাহর একত্ববাদ হয়েছে ম্লান। নানা কুসংস্কারে জর্জরিত হয়েছে মানবজাতি! তাদের পদস্খলন এবং নৈতিকতার বিপর্যয় ঘটেছে। অস্বীকার করেছে প্রতিপালকের প্রদান অস্তিত্বকে কিংবা তাঁর শক্তি-ক্ষমতায়, গুণে-মাহাত্মে্য অংশীদার করেছে অন্যকে -কতবার পূজায় হয়েছে আত্মনিমগ্ন। তাই পবিত্র কুরআনে মানুষের নবী সম্পর্কে সুস্পষ্ট পরিচিতি দেয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যত মানবজাতি যাতে ভুলপথে নিজেদের ধ্বংস না করে সেজন্যে অতীত ইতিহাসকে উপস্থাপন করা হয়েছে। আসমানী কিতাবসমূহের মধ্যে আল-কুরআনই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং পূর্ণাঙ্গ। আর আদর্শিক দৃষ্টান্তের বাস্তব রূপায়ন হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। তাই পবিত্র কুরআন- এর নির্দেশিত পথ এবং রসূলের (সঃ) বাস্তবায়িত জীবনকে আমাদের জানা এবং সেই মতে ইবাদত-বন্দেগী, স্বীকৃতি করার মাধ্যমে স্রষ্টার বিধি-বিধান মেনে চলতে হবে। এই বিধি-বিধানের নামই হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম আল্লাহর মনােনীত একমাত্র দ্বীন, এই দ্বীন বা জীবনব্যবস্থাই সঠিক মানবিক মূল্যবােধ জাগ্রত করে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ
“তােমাদের (কল্যাণের জন্যে) আজ আমি তােমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম। আমার নেয়ামতকে তােমাদের প্রতি সুসম্পন্ন করলাম আর ইসলামকে তােমাদের ধর্ম (দ্বীন) হিসেবে মনােনীত করলাম।” [সূরা মায়েদাঃ ৩ আয়াত) আমাদের জন্যে এই সুসংবাদ-বাণী বহন করেছেন, হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। বিদায় হজ্জের দিনে তাঁর ওপর এই ওহী নাযিল হয়। তিনি ওহীর মাধ্যমে আল্লাহর বাণী লাভ করেছেন এবং সমগ্র মানবজাতিকে তা জানিয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহর মনােনীত ধর্মের বিধি-বিধানকে নিজের জীবনে বাস্তবে পালন করে আমাদের জন্যে উত্তম মানুষের আদর্শ (মডেল) স্থাপন করেছেন। মহান আল্লাহ তা'আলা আমাদের প্রতিপালক। আমরা তাঁকে সনাক্ত করতে পারি কিভাবে তা পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে হবে প্রথমে আর তারপই তাঁর ইবাদতে মশগুল হতে হবে। আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেনঃ “আর (দেখ) তাঁর নির্দশনসমূহের মধ্যে রয়েছে রাত্রি ও দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তােমরা সূর্যকে সিজদা করবে না, চন্দ্রকেও নয়। বরং সিজদা করবে একমাত্র সেই আল্লাহকে যিনি ঐসবকে সৃষ্টি করেছেন, যদি তােমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে ইচ্ছুক হও।”
পবিত্র কুরআনে আরও বলা হয়েছেঃ “নিশ্চয় তােমাদের প্রভু-প্রতিপালক হচ্ছেন সেই আল্লাহ যিনি আকাশ ও পৃথিবীকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরসের ওপর আরূঢ় হয়েছেন। তিনি রজনীর দ্বারা দিবসকে সমাচ্ছন্ন করেন, যে মতে তারা ত্বরিৎ গতিতে একে অন্যের অনুসরণ করে চলে। আর সৃষ্টি করেছেন। সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজিকে স্বীয় নির্দেশের অনুগতরূপে। (জেনে রাখ!) সৃষ্টি করার হুকুম প্রদানের মালিক মুখতার একমাত্র তিনিই। সর্বজগতের অধিস্বামী : সেই আল্লাহ মহাপবিত্র।” [সূরা আ'রাফ : ৫৪ আয়াত]
আমরা একমাত্র এই মহাপবিত্র সর্বজগতের অধিস্বামী আল্লাহর ইবাদত করবাে এবং সেই ইবাদতের প্রকরণসমূহ হচ্ছেঃ
১. ইসলাম- আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি নিজেকে সমর্পণ,
২. ঈমান-বিশ্বাস স্থাপন করা,
৩. ইহসান- আল্লাহকে হাজের নাজের জেনে ইবাদত করা, দয়া-দাক্ষিণ্য ও সহানুভূতি প্রদর্শন, উপকার সাধন,
৪. দোয়া-প্রার্থনা, আহবান,
৫. খওফভয়-ভীতি,
৬. রেজা-আশা আকাংখা,
৭. তাওয়াক্কুল-নির্ভরশীলতা, ভরসা,
৮, রগবাৎ -অনুরাগ, আগ্রহ,
৯. রাহবাৎ-ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা,
১০. খুশু-বিনয়-নম্রতা,
১১. খাশিয়াত-অমঙ্গলের আশঙ্কা,
১২. ইনাবাত-আল্লাহর অভিমুখী হওয়া, তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তিত হওয়া,
১৩, ইন্তে’আনাত-সাহায্য প্রার্থনা করা,
১৪, ইস্তে-আযা- আশ্রয় প্রার্থনা করা,
১৫. ইস্তেগাসাহ-নিরুপায় ব্যক্তির বিপদ উদ্ধারের জন্যে আশ্রয় ও ভাবনা, ১৬.যাবাহ-আত্মদান বা কুরবানী,
১৭, নযর-মানত করা।
এছাড়াও অন্যান্য যে পদ্ধতিসমূহ নির্দেশিত হয়েছে তা সব কিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে, কেবলমাত্র তাঁরই জন্যে। তাঁরই কাছে আমাদের সবকিছু চাইতে হবে। এসবই কার্যে পরিণত করে আল্লাহর বান্দারূপে তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। এটাই হচ্ছে ইবাদতের আসল কথা। এই ইবাদত আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। নির্ভুলভাবে তিনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছেন-সঠিক কল্যাণের জন্যে। মানবজাতির মুক্তির জন্যে। বিপদে-আপদে সর্বদাই শরণাপন্ন হয়েছেন মহান আল্লাহর। আল্লাহর হকুমকে, তাঁর প্রণীত আইনমালাকে, জীবনবিধানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মরুররাজ্যে, কোন শক্তির ভয়ে, জীবনের মায়ায় কিংবা লােভের বশীভূত হয়ে আল্লাহর দেয়া বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করা থেকে বিরত হননি। তিনি সারা জীবন অসত্যের মুকাবিলা করেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন; গরীব-দুঃখী মানুষের সমস্যা নিরসনে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন-ভালাে বেসেছেন। তিনি আল্লাহর দ্বীনকে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে বিকশিত করার জন্যে-জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করেছেন। সুখ-বিলাস, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করেছেন। তিনি শুধুমাত্র বার্তাবাহক ছিলেন, যে বার্তা তিনি মানবজাতির জন্যে এনেছেন তা নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আল্লাহর বিশ্বাসকে এবং সেই বিশ্বাসের সম্পূরক ইবাদতকে সমন্বিত করেছেন জীবনে। এখানেই আমাদের জন্যে রেখে গেছেন মূল্যবান শিক্ষা। এই শিক্ষা হচ্ছে—শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার একত্বে বিশ্বাস করলেই মুসলমান হওয়া যায় না, মুসলমান হতে হলে ইবাদতেও তাঁর একত্বকে শামিল করতে হবে। ইবাদতই হচ্ছে সামগ্রিক জীবনধারা-জীবনচরিত। শুধুমাত্র মহান আল্লাহ তা'আলার একত্বে বিশ্বাস স্থাপন করলেই সফলকাম, উত্তম। মানুষ হওয়া যায় না কিংবা প্রকৃত মু'মীন হওয়া যায় না কিংবা মুসলমানের মধ্যে দাখিল হওয়া যায় না-
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ "(হে রসূল) তুমি জিজ্ঞেস করঃ (হে মুশরিকগণ,) যিনি আসমান ও যমীন থেকে তােমাদেরকে রুযীর সংস্থান করে দেন কে সেই (পাক পরওয়ারদিগার), কে তিনি যিনি শ্রবণ ও দর্শনের প্রকৃত অধিকারী? এবং কে সেই মহান স্রষ্টা) যিনি জীবন্তকে মৃত হতে আবির্ভূত করেন, আর কে-ইবা সেই মহান সত্তা যিনি মৃতকে জীবন্ত থেকে বহির্গত করেন? এবং কে (প্রভু যিনি কুদরতের সকল ব্যাপারকে সুনিয়ন্ত্রণ করেন? তারা নিশ্চয় তৎক্ষণাৎ জওয়াব দিবেঃ আল্লাহ। তুমি বলঃ এই স্বীকারােক্তির পরেও তােমরা সংযত হয়ে চল না কেন?” [সূরা ইউনুসঃ ৩১ আয়াত]
পবিত্র কুরআনের সূরা মু'মিনুন-এর ৮৪-৮৯ আয়াতে বলা হয়েছেঃ“ জিজ্ঞেস করঃ এই যে যমীন এবং এতে অবস্থিত পদার্থগুলাে এসব কার? যদি তােমাদের জ্ঞান থাকে। তারা নিশ্চয় বলবেঃ ‘আল্লাহর'। বলঃ তবুও কি তােমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? জিজ্ঞেস করঃ কে এই সাত আসমানের প্রভু পরওয়ারদিগার? কে মহিমান্বিত আরশের অধিপতি? তারা নিশ্চয় বলবেঃ আল্লাহ। বল? তবুও কি তােমরা সংযত হবে না? জিজ্ঞেস করঃ সৃষ্টির প্রত্যেক বিষয় ও বস্তুর উপর সার্বভৌম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে কার ? এবং সকলকে আশ্রয় দান করে থাকেন কে? অথচ কারও আশ্রিত হতে হয় না যাঁকে, কে তিনি? (বলে দাও) যদি তােমাদের কিছু জ্ঞান থাকে। তারা নিশ্চয় বলবেঃ তিনি আল্লাহ। বলঃ তাহলে কোথায় যাচ্ছ তােমরা (সম্মােহিত হয়ে) ?”
পবিত্র কুরআনের এই আয়াতগুলাে পরিস্কারভাবে প্রমাণ করে যে, এক আল্লাহর বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়। ইসলাম-পূর্ব জ্ঞানী মানুষরা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করতো-কিন্তু তারা তাই বলে মুলমান হয়নি। তাদেরকে মু'মীন মানুষ বলা হয়নি, তাওহীদবাদীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কারণ, তারা তাওহীদের ইবাদত প্রতিষ্ঠিত করেনি। তারা ইবাদতে আল্লাহর একত্ববাদকে অস্বীকার করে মুশরিক-কাফেরে পরিগণিত হয়েছিল। আমাদের নবী-হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাদেরকে তাওহীদে ইবাদতের দিকে আহবান করেছিলেন। ইবাদতে আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠিত না হলে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসের কোন মূল্য নেই। এই হচ্ছে ইসলামের মুল কথা। আর এই বিশ্বাসে একত্ববাদ ও ইবাদতে একত্ববাদের সমন্বিত জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। তিনি যে বার্তা এনেছিলেন কিংবা তাঁকে যে বার্তা প্রদান করা হয়েছিল তা এই এবং তিনি তা স্বীয় জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় সমাজ – জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাওহীদ- এ রবুবিয়াত ও তাওহীদ-এ ইবাদত হচ্ছে আত্মা এবং খাঁচার ন্যায় রেল সড়কের দু’টি লৌহ-পাতের মতাে। একটি ছাড়া অপরটি মূল্যহীন। আর দু’টির সমন্বয়ই হচ্ছে ফলদায়ক। আমাদের নবী করীম (সঃ)-এর জীবনী এখানেই তাৎপর্যপময়, এখানেই আমাদের আদর্শিক মহামানব তিনি যিনি বিশ্বাস এবং কাজের সমন্বয় করে আল্লাহর বিধি-বিধানকে স্বীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং সমস্ত মানবজাতির জন্যে প্রতিষ্ঠিত করতে যুদ্ধ-জিহাদ করেছেন। ক্ষীণকণ্ঠস্বরে শুধুমাত্র আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপনের নজির স্থাপন করেননি -যা আজকাল আমাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে। আমরা কোটি কোটি মুসলমান, (হয়তাে বা অধিকাংশই) নামধারী শুধুমাত্র লেবাসে কিংবা বিশ্বাসে। মূলতঃ ইবাদতে আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি আমাদের মধ্যে আর তার জন্যে শতকোটি মুসলমান বর্তমান যুগে অসহায় বােবার মতো ইসলামের আদি দুশমনের হাতে নাস্তনাবুদ হচ্ছি। আমরা মুসলমান জাতি, যারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতি-কিন্তু মুষ্টিমেয় তৌহিদবিরােধী, ইসলাম বিরােধীদের হাতে পরাস্ত। এর কারণই হচ্ছে- আমরা মূল থেকে সরে গেছি। কান্ড ছেড়ে শাখা -প্রশাখায় ভর করেছি-কিংবা উদ্ভাবন করে নিয়েছি তৃতীয় কোন পথ।
অথচ পবিত্র কুরআনে আমাদের পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছেঃ "নিশ্চয়ই (জানিও) আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরীক করার যে পাপ তা তিনি ক্ষমা করেন না, এছাড়া অন্য যে কোন পাপ তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দিবেন, বস্তুতঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শরীক করে সে তাে উদ্ভাবন করে নিয়েছে এক গুরুতর পাপ।” [সূরা নিসাঃ ৪৮ আয়াত]
আমাদের মধ্যে প্রবেশ করেছে এই গুরুতর কোন পাপ এবং আমাদের এই হীন পরিণতির জন্যে দায়ী আমাদেরই সৃষ্ট কোনাে তৃতীয় পথ! আজকাল আমরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছি- এক মুসলমান আরেক মুসলমানের রক্তপানে তৃপ্তি পাচ্ছে। আল্লাহর যমীনের অধিকারিত্ব নিয়ে যুদ্ধ করছে-আর সে যুদ্ধে কে মরছে? বােমার আঘাতে কার শিশুপুত্র-কন্যা ধুলিস্মাৎ হচ্ছে? কার তেলাধার ধ্বংস হচ্ছে, আর ক্ষতি হচ্ছে কোন জাতির? আমরা তা আদৌ ভাবছি না। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছি। শয়তান আমাদের সুদৃঢ় রাস্তার ওপর আস্তানা গেড়েছে। নানাভাবে নানা কায়দা-কানুন রপ্ত করে যুগে যুগে মানুষের শত্রু শয়তান তার সৃষ্ট কৌশলের শিকারে পরিণত করছে মানুষকে, মুসলমানকে। আর এই সুযােগ পাচ্ছে তার কারণ আমরা দুর্বল ঈমানের পথকে বেছে নিয়েছি। আখিরাতের চাইতে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়েছি। আখিরাতের সুখ-শান্তির চাইতে দুনিয়ার সুখ-শান্তি-বিলাসিতাকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করছি। দূরে সরে গেছি আল্লাহ তা'আলার নির্দেশিত পথ থেকে এবং আদর্শ মহামানব মানুষের নবী (সঃ)-এর জীবনব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করিনি নিজেদের মধ্যে। শুধুমাত্র ক্ষীণকণ্ঠে আমরা মুসলমান-আল্লাহর প্রতি ঈমানদার। আমাদের ঈমান রাস্তার কাঁটা সরানাের মতো ক্ষীন ঈমানে পরিণত হয়েছে। বস্তুতঃ ইহলৌকিক জীবনের মায়ায়, অমর জীবনকে তুচ্ছ করছি। এই সুযােগে শত্রু শয়তান দ্রুততার সঙ্গে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলছে। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শিক্ষাকে আমরা ভুলে গেছি। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যে সত্যের আলােকবর্তিকা নিয়ে এসেছিলেন এবং যে মহান জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, আলাে এবং জীবনব্যবস্থাকে আমরা আমাদের জীবনে, সমাজে পারিনি প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি ব্যক্তিস্বত্তা বিকশিত করতে-আল্লাহর প্রদত্ত বিধি-বিধানকে পালনে হয়েছি গাফিল। ফলতঃ আজ দিকে দিকে লক্ষকোটি মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকলেও তা অত্যন্ত নিস্তেজ, জীর্ণ, যার মধ্যে নেই বলিষ্ঠতা, নেই উজ্জ্বলতা। আমরা মহানবী (সঃ)- এর আদিষ্ট জীবন-যাপনের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত না করে অন্যজাতির সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, চলন-বলন কাজ-কর্ম, ধ্যান-ধারণা, চিন্তাচেতনাকে অবলম্বন করছি। আর তার পরিণতিতে আমরা লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার হচ্ছি। আমাদের অধঃপতন রুখতে হলে, আল্লাহ এবং রসূল হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর নির্দেশিত পথে জীবন-যাপন করতে হবে। আমাদের হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর প্রতিষ্ঠিত জীবন-ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরতে হবে। তিনি যেভাবে নিজে জীবন-যাপন করতেন আমাদেরও সেই ভাবে জীবন-যাপন করতে হবে। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ছিলেন সত্যবাদী এবং সত্যবাণীর বাহক, আল্লাহ কর্তৃক একমাত্র মনােনীত দ্বীনের বার্তাবাহক রসূল এবং সর্বোত্তম মানুষ। তিনি বলেছেন, 'যে উপার্জিত খাদ্য খায় না সে উত্তম মানুষ হয় ’।
প্রিয় নবী (সঃ) শারীরিক পরিশ্রম করে খাদ্য-সংগ্রহ করতেন এবং অপরকেও সৎপথে পরিশ্রম করে উপার্জন করতে বলেছেন।
হযরত জাবির (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত-নূরনবী (সঃ) বলেছেন, 'যার জমি আছে তার উচিত তা চাষাবাদ করা অথবা তার ভাইকে দেয়া যদি সে উক্তভাবে জমির সদ্ব্যবহার করতে অস্বীকার করে, তবে নিষ্ফলভাবে তার জমি আঁকড়িয়ে বসে থাকুক। রাফে ইবনে খাদীজ (রাঃ) বলেছেন, আমরা মদীনাবাসী অধিকাংশ লােকই কৃষি কাজের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতাম। আমাদের কেউ কেউ নিজের জমি অপরকে বর্গা দিতাে। বর্গা দেয়ার নিয়ম ছিল এই রকমঃ জমির মালিক বলতাে-এই জমিখানা আমার, আর এই জমিখানা তােমার অর্থাৎ বর্গাদার যে পরিমাণ জমিতে মালিককে ফসল জন্মিয়ে দিতাে তার পারিশ্রমিক স্বরূপ সমপরিমাণ অন্য একখানা জামিতে সে নিজে ফসল জন্মিয়ে নিতাে। ফলে কখনাে কখনাে এমন হতাে যে, একখানা জমিতে ফসল জন্মিত, অন্য খানাতে জন্মিত না। এরূপ ক্ষতিকর প্রথা নবী (সঃ) রহিত করে দিয়েছিলেন। নবী করীম (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে জুলুম করে অন্যলােকের একহাত পরিমাণ জমি দখল করে, কিয়ামতের দিন তার গলায় পৃথিবীর সপ্তস্তরের মাটির ভার পরিমাণ শিকল লাগানাে হবে।
উপার্জন-জীবিকা নির্বাহের প্রধান শর্ত এবং আমাদের দৈনন্দিত জীবনে জীবিকা। সংগ্রহই বেঁচে থাকার জন্যে সবচাইতে প্রয়ােজনীয় কাজ। জীবন ধারনের জন্যে প্রয়ােজনীয় খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ এবং সেই সংগ্রহের মধ্যে, সততাকে অবলম্বন করতে পারলে সারা জীবনই ব্যার্থ। অর্থাৎ যে সব খাদ্যবস্তু গ্রহণ করে মানুষ বেঁচে থাকে তা সৎউপায়ে অর্জিত না হলে ব্যক্তির জীবনের সমস্ত উপাসনা, বিশ্বাস-ইবাদত- বন্দেগীর কোনাে মূল্য থাকে না। আর এই উপার্জন যাতে সঠিকভাবে সেজন্যে ‘ইসলাম’- এর বিধি-বিধানকে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) নিজে জীবনে এবং তাঁর সাহাবীদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আমাদেরও সেই বিধান কায়েম করা এবং তার সঠিক প্রয়ােগের মাধ্যমেই জীবন ব্যবস্থা গড়ে তােলা প্রয়ােজন। হযরত হুযায়ফা (রাঃ) বলেছেন, “রক্তের মূল্য, কুকুরের মূল্য এবং ব্যাভিচারিণীর উপার্জন গ্রহণ করতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। সুদ যে দেয়, যে উকি ধারণ করে অথবা যে উকি ধারণ করায় এবং চিত্রকর-সকলকেই তিনি অভিসম্পাত দিয়েছেন।”
হযরত ওয়াসেলা (রাঃ) বলেছেন, ‘আমি রসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি-যে ব্যক্তি বিক্রয়ের বস্তুর দোষ থাকলে তা ক্রেতাকে না জানিয়ে বিক্রয় করে, সে সর্বদা আল্লাহর গজবে পড়ে থাকে, অথবা ফেরেশতাগণ সর্বদা অভিশাপ দিতে থাকে। হযরত ইবনে উমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত-নূরনবী (সঃ) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি চড়া দামের আশায় চল্লিশ দিন খাদ্যদ্রব্য বিক্রয় না করে আটকিয়ে রাখে, সে (এই শয়তানী মনােবৃত্তির জন্যে) আল্লাহর ক্রোধভাজন হলাে এবং আল্লাহ তার প্রতি অতিশয় অসন্তুষ্ট হলেন। এছাড়াও রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, ‘হারাম খাদ্য দ্বারা পুষ্ট হয়ে যে শরীর বর্ধিত হয়েছে, তা কখনাে জান্নাতে প্রবেশ করবে । হারাম খাদ্যে পুষ্ট শরীরের সমস্ত মাংশের জন্যে জাহান্নামই অধিক নিকটবর্তী বাসস্থান। আমাদের অবশ্যই আল্লাহর দ্বীনের যাবতীয় নির্দেশ পালনসহ হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর আদেশ নির্দেশ এবং তাঁর প্রতিপালিত জীবন-ব্যবস্থাকে নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠা করার যত্ন নিতে হবে। আর নিজেদের গড়ে তুলতে হবে সত্যিকার মুসলমান হিসেবে, সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে সাম্য-ভ্রাতৃত্ব সৌহার্দ্য স্থাপন করার শপথে আমাদের নৈতিক মনােবলকে বলীয়ান করতে হবে।
*****