আমরা যার উত্তরসূরী
যুহদ ও তাকয়ার মূর্তপ্রতিক সাহাবী আবূ যার গিফারী (রাঃ)
========================================================================
মক্কার বশ দূরে অবস্থিত অয়াদ্দান উপ্ত্যকায় কবীলায় গিফারের নিবাস আবূ যর গোত্রের একজন তরুণ প্রাণ সত্যান্বেষী । আঁধার কালীমায় লেপ্টে থাকা পৃথিবীর পরিবেশে তিনি অতিষ্ট হয়ে পড়েছে, তাই খুঁজে ফিরেন একটু দিশারী আলো। একদিন মক্কায় নতুন নবীর সংবাদ শুনে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ভাই আনীসকে মক্কা পাঠালেন। আনীস এসে জানালো, ‘সে ব্যক্তি নির্মল চরিত্রের অধিকারী, মানুষকে ত্নি সত্য কররেম্র প্রতি ডেকে থাকেন। তার মুখে এমন মিধুর কথা শুনেছি যা কোন কবি বা জ্যোতিষীর কথা নয়।‘ ইন্তু এ সংক্ষিপ্ত স্নগবাদে আবু যরের পিপাসা মিটল না, তাই সত্যের দিশারীর খোঁজে নিজেই মক্কা পৌঁছলেন। আলী (রাঃ) এর সাথে পরিচয় হলে তিনি আবূ যরকে দরবারে রিসালাতে নিয়ে এলেন।
হকের দিশারী নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে পেশ করলেন, এটাই ইসলামি ইতিহাসের প্রথম সালাম। নবীজি (ﷺ) সালামের জবাব দিয়ে কুশল বিনিময় করলেন, তারপর সুমিষ্ট কন্ঠে কোরআন তিলাওয়াত আবু যরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তওহীদ ও ঈমানের এ দরদী আহ্বান আবূ যরের দিলে সঞ্চিত তিমিরে করল প্রচন্ড আঘাত। উচ্চ কন্ঠে ঘোষনা দিলেন, ‘ আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু- নবীজি (ﷺ) নির্যাতনের আশংকায় তাকে বললেন, এ সগ্নবাদ গোপন রেখে বাড়ী চলে যাও। কিন্তু আবূ যরের মনের সব ভীতী আর শংকা দূর হয়ে গিয়েছিল। বিনীত কন্ঠে আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ) তাওহীদের কালেমা কে কাফেরদের মজলিসে স্পষ্ট ভাবে ঘোষনা দেব, তাতে আমার এ জীবন উৎসর্গ হলে তা আমার জন্য সৌভাগ্য। নবীজি (ﷺ) প্রিয় সাথীর এ জজবা দেখে দেখে আর কিছু বললেন না।
আবূ যর (রাঃ) দৃঢ় পদে মসজিদে হারামে এসে ঘোষনা দিলেন, আশহাদু আল্লা…… তার বজ্র কঠিন কন্ঠের শাহদাত প্রতিধ্বনিত হল মসজিদের দেয়াল ও কাবার আঙ্গিনায়, তীর হয়ে বিঁধল হাজার দেবতা পূজারীদের পাজরে। শুরু হয়ে গেলো প্রহার, আঘাতের প্রচন্ডতায় তিনি জ্ঞান হারালেন, আব্বাস (রাঃ) এসে কাফেরদের ক্ষান্ত করলেন।পরদন হারামের অন্দরে আবার শোনা গেলো আবু যরের কন্ঠে শাহাদাতের ঘোষনা, নির্যাতনও চলল সমান ভাবে। কিন্তু সত্যের অবিনাশী শক্তিতে সরব হয়ে উঠা কন্ঠকে তারা অবদমিত করতে পারেনি।
হকের ঘোষোনা দিয়ে নবীজির দরবারে ফিরলে নবীজি (ﷺ) শুধালেন, আবূ যর, আমি কি তোমায় এ কথা গোপন রাখতে বলিনি? আবু যর বললেন, ইয়া রাসুল্লাল্লাহ! আমার মনে সত্য ঘোষনার তীব্র বাসনা ছিল তা আমি পূর্ণ করেছি। নবীজি বললেনঃ যা দেখেছো ও শিখেছ তা তোমার কওমের নিকট পৌছিয়ে তাদের ইসলামের দাওয়াত দাও , আল্লাহ্ পাক তোমায় সফল করবেন। এবং ইনতেজারে থাক, আল্লাহ্ আমায় বিজয় দান করলে এখানে আবার ফিরে আসবে। আঁধারের পর্দা হটাতে আবু যর (রাঃ) ফিরে আসলেন, কওমের মাঝে,ভ আই ও আম্মাকে তাওহীদের দাওয়াত দিলে তারা সানন্দে ইসলাম কবুল করল, আর এ ছোট্ট কাফেলাটির গিফার গোত্রের অধিকাংশই মুসলমান হয়ে গেল, নবীজি (ﷺ) মদীনায় হিজরতের পর গিফার গোত্রের লোকেরা নবীজি (ﷺ) এর সাক্ষাত করলে নবীজি তাদের সমাদর করলেন, এবং বললেন, “গিফারুন গাফফারাহুমুল্লাহু” অর্থ্যাৎ গিফারী লোকদিগকে আল্লাহ্ পাক ক্ষমা করুন।
খন্দকের যুদ্ধ পর্যন্ত আবু যার (রাঃ) নিজ কবীলায় অবস্থান করেন। এ দীর্ঘ বিরহ আর সইল না, খন্দকের পরই তাই নবীজির সোহবত পেতে মদীনা পৌছলেন। নবীজি (ﷺ) এর কাছে আরজ করলেন, আমি জীবনের বাকি সময় আপনার খেদমতে কাটাবো। নবীজি (ﷺ)ও সহাস্যে অনুমতি দিলেন। এসময় হতে ওফাত পর্যন্ত তিনি নবীজির খেদমত, এলম অর্জন, দাওয়াত ও জিহাদে মশগু থাকেন। বিভিন্ন জিহাদে তিনি নবীজির সাথে ছিলেন, বিশেষতঃ তাবুকের যুদ্ধে। ১০ হিঃ নবীজির ওফাতের পর তার বিচ্ছেদ ও বরকত পূর্ণ মজলিসের ছোয়া না পেয়ে বিরহ ব্যথায় ভরে উঠে তার মন, তাই মদীনা হতে শাম চলে গেলেন, তিনি ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতের শেষ পর্যন্ত ওখানে থেকে উসমান (রাঃ) এর খিলাফতের প্রারম্ভে দামেস্ক গমন করেন। কিন্তু বেশি সেখানে থাকতে পারেনি, দামেস্কবাসীদের আয়েশ ও ইশরতের মোহ দেখে যুহদ প্রিয় , আবূ যার (রাঃ) এর পাশে মদীনার আবাল বৃধ একত্রিত হতে শুরু করে।
সকাল-সন্ধ্যা তার ঘরে ভীড় লেগে থাকে এ ছাড়া মদীনাতেও তিনি সামন্য আয়েশ-আরামের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেন। মদীনাবাসীদের সম্পদ ভোগ ও ব্যবহার যদিও বৈধতার সীমা লংঘন করেনি বরং তা বৈধই ছিল। বস্তুতঃ তাদের সাথে আবূ যার (রাঃ) এর মতবিরোধের কারণ এইটাই যে তার মত ছিল, নবীজি (ﷺ) আবু বকর ও উমার (রাঃ) এ জমানার মতই সম্পদ ভোগ করতে হবে। নববী অর্থনীতির সফেদ রেখা হতে এক চুলও এদিক সেদিক হয়া চলবে না। একদিকে মানুষের ভীড় অপর দিকে (তার দৃষ্টিতে) বিলাসিতা দুরকরণে নির্জন ও যুহদ প্রতিয় আবু যার (রাঃ) মদীনা ছেড়ে রাবাদার নির্জন পল্লীতে চলে যান সেখানেই ৩২ হিজরিতে তার ইন্তেকাল হয়।
দুটি কথাঃ আবু যার (রাঃ) এর মৃত্যু সন উদঘাটিত হয়েছে কিন্তু তার জন্ম তারিখ সম্পর্কে ইতিহাস নীরব। তার প্রকৃত নাম ‘জুনদুব’ । পিতার নাম ‘জুনাদা’। আবু যার (রাঃ) হলো তার উপনাম আর উপাধি ছিল শায়খুল ইসলাম।
গুণাবলীঃ আবু যার গিফারী (রাঃ) অত্যন্ত মিতভাষী ও নির্জন প্রিয় ছিলেন। তাবুকের যুদ্ধে নবী আলাইহিস সালাম মুজাহিদ কাফেলা নিয়ে মঞ্জিল পানে রওয়ানা হয়ে যান। কিন্তু উট অসুস্থ থাকায় আবু যার (রাঃ) নবীজিকে বললেন উটটি সুস্থ হলেই আমি আপানার সাথে মিলিত হব। পরে উট আর সুস্থ হল না।তাই সামান পিঠ নিয়ে আবু যার (রাঃ) একাকি পদব্রজেই রওয়ানা হলেন, বহু কষ্টে এই মর্দে মুমিন তাবুক পৌছলেন। নবীজি (ﷺ) তাকে দূর হতে দেখে স্বাগতঃ উচ্চারণ করলেন “আল্লাহ্ আবু যারকে রহম করুন, সে একাকী আসছে, একাকী তার মওত হবে এবং নিসংগ ভাবেই কেয়ামত দিবসে সে উঠবে”। এ ঘটনায় খোদার রাহে আবু যার (রাঃ) এর ত্যাগ ও সাধনা চিত্রটি সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে।
যুহদ ও তাকওয়া ছিল আবু যার (রাঃ) এর অন্যতম বৈশিষ্ট। সঞ্চয় করে ধন সম্পদের পাহাড় গড়ে তা আগলে রাখা ও বিলাসিতা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না বা অন্য কেউ করুক সেটাও তার পছন্দনীয় ছিল না। তবে ব্যক্তি মালিকানাকে তিনি অবশ্যই সমর্থন করতেন। দানশীলতায় তার হাত ছিল উদার-উন্মুক্ত। তার জীবন জিবিকার ছিল অত্যন্ত সাদা-মাটা কয়েকটা উট ছিল, এগুলো তার আয়ের উৎস। একবার সুলাইম গোত্রের এক ব্যক্তি আবু যার (রাঃ) এর খেদমত ও তার উট চরানোর অনুমতি চাইল, তিনি এশর্তে অনুমতি দিলেন, কোন বস্তু ছদকা করতে বললে আমার সর্বোত্তম বস্তু সদকা করবে। লোকটি এতে সম্মত হল। একদিন আবু যার (রাঃ) সংবাদ পেলেন, কিছুলোক অনাহারী তাদের খাদ্য প্রয়োজন। তিনি খাদেমকে বললেন, একটি উট নিয়ে আস। খাদেম প্রয়োজনের কথা ভেবে সবচেয়ে ভাল উটটি নিয়ে আসল।
আবু যার বললেন তুমি খিয়ানিত করছ। খাদেম ব্যপারটি বুজগতে পেরে ভালো উটটি নিয়ে আসল। এরপর সেটা জবেহ করে নিজের বাড়ী সহ সবার বাড়ীতে সমান ভাগে বন্টন করে দিলেন। আবু যার (রাঃ) খদেমকে বললেন তুমি আমার প্রয়োজনের কথা ভেবে ভাল উটটি আননি। বলতো দেখি, আমার প্রয়োজনের দিন কোনটি। আমরা প্রয়োজনের দিন হল সেটা যেদিন একাকী আমাকে কবরে যেতে হবে। শুনে রাখ সম্পদের অংশীদার হল তিনজন (১) তাকদীর বা ভাগ্য যা সব ধরনের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়। (২) উত্তারাধিকারি, যে সদা তোমার মৃত্যু কামনায় থাকে। (৩) তুমি নিজে, অতএব অধিক সম্পদ তোমার ভান্ডারে সঞ্চিত করে নাও। এজন্যই আমার উতকৃষ্ট প্রিয়তর সম্পদকে সঞ্চয় করছি যা রক্ষিত থাকবে, কাজে আসবে পরকালের কঠিন সময়ে।
একবার সিরিয়ার শাসনকর্তা আবূ যরের (রাঃ) খিদমতে তিনশ দিনার পাঠইয়ে বললঃ এগুলো আপনার যরারতে ব্যয় করবেন। তিনি দিনার ফিরিয়ে দিয়ে বললেনঃ শামের শাসনকর্তা কি আমায় সবচেয়ে হেয় মনে করে? অর্থ্যাৎ সম্পদকে আবু যর মর্যাদার মাপকাঠি ভাবতেন না এবং এর কোন মোহও তার মনে ছিল না। তাই শাসনকর্তা দিনার পাঠানোতে তিনি মর্মাহত হয়ে একথা বলেন। এ হল আবু যর (রাঃ) এর সুবিশাল যিন্দেগীর তাকওয়া, যুহদ ও দানশীলতার কিঞ্চিৎ ঝিলিক। এসব ঈমানী গুণাবলীর কারনেই তার দুনিয়াকে দুপায় দলে জান্নাতী পথের রাহগীর হতে পেরেছিলেন।
মর্যাদার ভূবনঃ মানাযির আহমদ গিলানীর মতে আবি যার (রাঃ) ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে পঞ্চম ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইসলাম পূর্ব যুগেও এক আল্লাহ্র বন্দেগী করতেন।
বিলাস বিমুখিতা ও যুহদ প্রিয়তার গুন দেখে নবীজি (ﷺ) তার প্রশংসা করে বলেনঃ আবু যার হল মাসীহু হাযিহিল উম্মাদ বা এ উম্মতের ঈশা মসীহ আর সত্যবাদীতার প্রশংসা করে নবীজি বলেনঃ আবূ যারের চেয়ে অধিক সত্যবাদী কোন ব্যক্তিকে উপরের আকাশ ছায়া দেয় নি, এবং এ যমীন বুকে ধারণ করেননি।
আবু যার (রাঃ) নবীজ (ﷺ) কে সীমাহীন ভালোবাসতেন, তদ্রুপ নবীজিও নবীজিওতাকে ভালোবাসতেন গভীরভাবে। আবূ যার (রাঃ) এর সাথে সাক্ষাত হলেই নবীজি (ﷺ) তার সাথে মুসাফাহা করে কুশল বিনিময় পূর্বক মৃদু হাসতেন ও আনন্দ প্রকাশ করতেন।
তিনি বহু সংখ্যক (২৮১) হাদীস বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে ৩২ টি হাদীস বোখারী ও মুসলিম শরীফে স্থান লাভ করে। তিনি ইসলামী অর্থনীতির শাস্ত্রবীদ ছিলেন। তাকে ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর সমকক্ষ গন্য করা হত। বদরের যুদ্ধে যদিও তিনি শীরক ছিলেন না তথাপী উমর (রাঃ) তাকে বদরী সাহাবীদের ন্যায় ৫ শত দেরহাম ভাতা দিতেন। যতুর রাকা গমন কালে নবীজি (ﷺ) তাকে খলীফা বানিয়ে দায়িত্ব দিয়ে যান, এটা তার প্রশাসনিক যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচায়ক। (সমাপ্ত)
*****