মরণজয়ী মুজাহিদ
মল্লিক আহমাদ
সারওয়ার
(১৩)
কমাণ্ডার নির্দেশ দিলেন, আমাদের অবশিষ্ট সবগুলি কামান অচল করে দেয়া হোক। যাতে শত্রু বাহিনী সেগুলি দিয়ে আমাদের উপর অতিরিক্ত আক্রমণ চালাতে না পারে। এরপর তিনি সূর্যাস্তের অপেক্ষা করতে লাগলেন। যেন রাতের আধারে নিরাপদে সরে যাওয়া যায়।
মিনিট কয়েক পর কমাণ্ডার শত্রুর ট্যাঙ্ক বহরকে মারকাযের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন। এর সাথে শত্রুর গোলাও এসে পড়ছে। কমাণ্ডার মুজাহিদদের উদ্দেশ্য করে বললেন, বের হওয়ার রাস্তা শত্রুর ট্যাঙ্ক বহরের দখলে চলে গেছে। তাই আপনারা সবাই ধীরে ধীরে পিছনের পাহাড়ে আরোহন করুন এবং চূড়ার নিকটবর্তী বৃক্ষের আড়ালে আশ্রয় নিন।
ধীরে ধীরে সবাই ক্রোলিং করে পিছু হাঁটছিলেন। যাতে দুশমন তাদের দেখে না ফেলে। অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে। এ সময় মারকাজের দিকে বোমারু বিমানও ধেয়ে আসে। বোমারু বিমান হতে রশ্মী বোমা নিক্ষেপ করা হয়। তার আলোয় গোটা এলাকা দিনের মত আলোকিত হয়ে উঠে।
মুজাহিদরা মহা সংকটে পড়ে যান। শত্রুর দৃষ্টিতে পড়ার আশংকা দেখা দেয়। দুটি রশ্মী বোমা শূন্যে ঝুলে থাকে। দূর থেকে মুজাহিদরা দেখছিলেন, শত্রু ট্যাংক ক্যাম্পের গেইটে পৌঁছে গেছে। বোমারু বিমান খুব নীচে দিয়ে ঘোরাঘুরি করছে।
তখন আলী তার ক্লাশিনকভ তাক করল। কমাণ্ডার ফায়ার করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু তার পূর্বে আলীর গুলিতে রশ্মী বোমা ফেটে যায়। পরক্ষণেই আলী দ্বিতীয় ফায়ার করে আরেকটি রশ্মী বোমা অকেজো করে দেয়। কমাণ্ডার মুজাহিদদের লক্ষ্য করে বললেন, এক্ষুণি এ স্থান ত্যাগ কর। এখানে এখন প্রচন্ড বোম্বিং হবে।
মুজাহিদরা অন্ধকারের ভিতর এক দৌড়ে বেশ দূর চলে আসেন। ঘন গাছপালার আড়ালে লুকিয়ে পড়েন। শত্রুর বোমারু বিমান আবার প্রচন্ড বোম্বিং শুরু করে। মুজাহিদরা পূর্বের স্থানে থাকলে এতক্ষণে কারও জীবিত থাকা সম্ভব ছিল না। মুজাহিদদের ধারণা ছিল, বোমারু বিমানের ঝাক পুনরায় আসবে, বহুক্ষণ অপেক্ষার পরও বোমারু বিমান ফিরছে না দেখে মুজাহিদরা পাহাড় ছেড়ে নিচে নামতে শুরু করেন। সবাই সতর্ক পদে অবতরণ করছে। কারণ রুশী কমাণ্ডোদের হামলার ভয় আছে।
অর্ধেক পাহাড় অবতরণের পরই তাদের আশংকা বাস্তবে রুপ নেয়। নীচের দিক থেকে ফায়ারিং শুরু হয়ে যায়। সবাই সটান হয়ে শুয়ে পড়ে ক্রলিং বন্ধ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। চীফ কমাণ্ডার ভাবছিলেন, আহত মুজাহিদ এবং রেডিও ষ্টেশনবাহী ওয়াগানের কি হল কে জানে। মুজাহিদরা আশংকা করছিলেন, কমাণ্ডোরা তাদের পিছু নেবে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না।
অর্ধরাতের পর মুজাহিদরা কমাণ্ডোদের অবস্থানের দিক থেকে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। এর ক্ষনিক পর ওখান থেকে দৌড়-ঝাপের শব্দ ভেসে আসে। আলীর ধারণা ছিল, কোন মুজাহিদ গ্রুপ রুশী কমাণ্ডোদের উপর হামলা করেছে। তাই আমাদের উচিত ঐ গ্রুপকে সাহায্য করা। কিন্তু কমাণ্ডার বললেন, এটা আমাদের ফাঁদে ফেলার উদ্দেশ্যে শত্রুর কোন ষড়যন্ত্র নয় তো? আলী ও অন্যান্য মুজাহিদরা বললেন, এ স্থান থেকে বেরুতে হলে আমাদের বিপদের মোকাবিলা তো করতেই হবে। কমাণ্ডার অস্ত্র শস্ত্রের হিসাব নিয়ে মুজাহিদদের মতামতের উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
মুজাহিদদের তিন গ্রুপে ভাগ করা হয়। যাতে সবাই এক সাথে আটকা না পড়ে। এরপর ধীরে ধীরে সবাই কমাণ্ডোর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। আলী ও তার গ্রুপের মুজাহিদরা অল্প দূরে যেতেই দেখতে পেলেন, দুটি ছায়া তাদের দিকে দৌড়ে আসছে। আলী তাদের দেখতেই ফায়ার করে বসে। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তখনই তাদের দিক থেকে আওয়াজ আসল, আমরা মুসলমান। এই অচেনা লোক দু'জন ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফারসী ভাষায় কথা বলছিল। তারা আরও বললো, আপনারা মুজাহিদ হলে আমাদের উপর ফায়ার করবেন না। আমরা দু'জন মুসলমান রুশী সৈন্য। গোলা বারুদ নেই আমাদের কাছে। শুধু ক্লাশিনকভ আছে। তা এখনই আপনাদের হাতে তুলে দিচ্ছি।
আলীর এক সঙ্গী বললো, এদের কথায় বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। আলী বললো, না, রুশীরা মুসলমান বাসিন্দাদেরকে আফগানীদের সাথে জোর পূর্বক যুদ্ধ করতে বাধ্য করছে। তাই তাদের উপর গুলি করা ঠিক হবে না। পরন্তু এখন এ দু'জন নিরস্ত্র। আলী রুশী দু'জনকে লক্ষ্য করে বললো, আপনারা চলে আসুন এদিকে। আলীর কথা শুনে তারা দৌড়ে আসে। ঠিক সে মুহূর্তে একটা বিস্ফোরণ ঘটে। দু'জনের একজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
ওদিক থেকে আওয়াজ আসল, আমার সাথী মারাত্মক আহত হয়েছে। অনুগ্রহপূর্বক আমাকে একটু সাহায্য করুন। আলী ও তার সাথীরা তার দিকে দৌড়ে যায়। আহত রুশীর এক পা সম্পূর্ণ উড়ে গেছে। আহত লোকটির জন্য কি করা যায় তা ভেবে পাচ্ছিল না। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হওয়াতে বাঁচার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। আলী নিজের কাপড় ছিঁড়ে তার আহত স্থান বেঁধে দেয়। কিন্তু রক্ত ক্ষরণ বন্ধ হলো না। লোকটি ব্যাথায় কোঁকিয়ে উঠছিল। মুহূর্ত কয়েক পর সে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললোঃ
" আমার মুসলমান ভাইগণ! আল্লাহর শোকর, আমার অন্তিম আশা পূর্ণ হয়েছে। আল্লাহর কাছে আমি দু'আ করেছিলাম, আমাকে মুজাহিদদের সঙ্গী হওয়ার তাওফিক দাও। আজ আমি মুজাহিদদের সাহচার্যপই মৃত্যুবরণ করছি। এটুকু বলে আলীর হাত ধরে চুমু খেতে থাকে। এরপর আবার বললো, " মুজাহিদ ভাইয়েরা! অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত জিহাদ করে যাবে। রুশী মুসলমানদের আযাদী পর্যন্ত লড়ে যাবে। আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন।"
সবাই নির্বাক হয়ে যায়। এরপর আহত লোকটির মুখে ক্ষীণ 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ' উচ্চারিত হয়। পরক্ষণেই তার মাথা এক দিকে কাঁত হয়ে পড়ে। সঙ্গিটি তাকে ঝাপটে ধরে কাঁদতে থাকে। আলী ও অন্যান্য মুজাহিদদের চোখও অশ্রুসজল হয়ে উঠে। শহীদ রুশী লোকটির সঙ্গী কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেছিলো, "বন্ধু আমার! তুমি রুশী মুসলমানদের আযাদী পর্যন্ত আমার সাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলে। কিন্তু যাত্রালগ্নেই বিদায় নিয়ে চলে গেলে। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনের অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার মিশন নিয়ে অগ্রসর হব। যদিও একাকী যুদ্ধ করতে হয়।"
আলী তার কাঁধে হাত রেখে বললো, রুশী বন্ধু আমার! আমরাও তোমার সাথে থাকব। তুমি একা নও। আলমে ইসলামের প্রতিটি আযাদী প্রিয় মানুষ তোমার সঙ্গে থাকবে। কারও অশ্রু ঝরা দু'আ, কারও সম্পদ আর কারও প্রাণ বিসর্জন দেয়ার কুরবানী তোমার সঙ্গী হবে। আমাদের সবার মঞ্জিল, আমাদের চলার পথ, আমাদের আল্লাহ, আমাদের দ্বীন, আমাদের দুশমন এক ও অভিন্ন। তাই প্রতিটি আফগানী হবে তোমার চলার পথের একান্ত বন্ধু।
আলী রুশী লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার এ সঙ্গীটি কিভাবে আহত হল? উত্তরে সে বললো, আমরা আফগান কমাণ্ডোদের অস্ত্রের ডিপো ধ্বংস করে কমাণ্ডোদের হত্যা করে মুজাহিদদের সাথে মিলিত হবার জন্য এদিকে দৌড়ে আসার সময় আমাদেরই বিছানো মাইনের উপর অজান্তে পা পড়ে যায়। ফলে এ এক্সিডেন্ট ঘটে যায়, বাকী কথা পরে বলবো। এখন আমাদের কোন নিরাপদ স্থানে পৌঁছা উচিত। কমাণ্ডোদের আরেক গ্রুপ নিকটেই অবস্থান করছে। তারা হামলা করতে পারে এই আশংকায়। শহীদের লাশ উঠিয়ে সবাই নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়।
ক্ষণিকপর সবাই অন্য এক ক্যাম্পে পৌঁছান। আশপাশের সব ক্যাম্পের কমাণ্ডারদের তাৎক্ষণিকভাবে তলব করা হয়। মুজাহিদদের প্রধান সমস্যা হল রুশীদের হাত থেকে হেডকোয়ার্টার পুনঃরুদ্ধার করা। সব কমাণ্ডার স্বীয় মুজাহিদদের নিয়ে উপস্থিত হলে জরুরী মিটিং শুরু হয়ে যায়। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হওয়ায় আলীকে বিশেষ ভাবে ডাকা হয়। অধিকাংশ কমান্ডারের মতামত হলো, একমাস অপেক্ষা করে আরও প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু আলী বললো, অনতিবিলম্বে বরঞ্চ আজই আমাদের হামলা করা উচিত। কারণ, আমরা যেমন হঠাৎ হামলায় পর্যদস্তু হয়েছি ঠিক তেমনি আচানক হামলায় শত্রুও ঘায়েল হবে। আলীর পুরানো সঙ্গী মুজাহিদরা তার কথায় সায় দেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল, সূর্যাস্তের পর আজই আক্রমণ করা হবে।
মুজাহিদদের সংখ্যা পাঁচ হাজারে গিয়ে পৌঁছেছে। আজ সবাই পরাজয়ের কালিমা মুছে ফেলতে দৃঢ় প্রত্যয়ী। আল জিহাদ, আল জিহাদের শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। এ সময়ে চীফ কমাণ্ডার তার ঘাড়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় উপস্থিত হন। তাকে দেখেই সব মুজাহিদ তার পাশে সমবেত হয়। কমাণ্ডার তাদের উদ্দেশ্যে করে বললেন, দ্বীন ও ইসলামের নিবেদিত প্রাণ মুজাহিদ ভাইয়েরা আমার। দুশমনের সহসা হামলায় আমরা তেমন সুবিধে করতে পারি নি। তবে অল্প সংখ্যক হওয়া সত্ত্বেও মুজাহিদদের সাহসী প্রতিরোধ প্রশংসনীয়। এখন আমরা পাঁচ হাজার হলেও দুশমন আমাদের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি। তবে বন্ধুরা! আল্লাহর সুসংবাদ শুনুন, 'বহু সময় ছোট দল আল্লাহর হুকুমে বিরাট দলের উপর বিজয়ী হয়।' তাই আমরাও আল্লাহর উপর আকূল ভরসা আর অসীম হিম্মত নিয়ে দুশমনের গর্ব ধূলায় মিশিয়ে দিব। ইনশাআল্লাহ।
তার বক্তৃতা শেষ হতেই 'নাসরুম মিনাল্লাহ ওয়া ফাতহুন কারীব' শ্লোগানে আসমান কাঁপিয়ে মুজাহিদরা শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়েন।
শত্রু বাহিনী মুজাহিদদের এই আচানক আক্রমণে টিকতে না পেরে উর্ধ্বশ্বাসে ভাগতে শুরু করে। কয়েক হাজার নিহত এবং পাঁচশত বন্দী হয়। গণীমত ও অস্ত্র শস্ত্র সহ ক্যাম্প পুনঃরুদ্ধার হয়। সবাই শুকরিয়ার সেজদায় লুটিয়ে পড়েন। ১০০ মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন।
পূর্বোল্লেখিত রুশী মুসলমান সেনাকেও মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। তার নাম আব্দুর রহমান।
আলী ও আঃ রহমানের মাঝে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। আব্দুর রহমান তার জীবনের ইতিহাস আলীকে শুনাতে থাকে।[চলবে]
অনুবাদঃআবূ উসামা