মুজাহিদে আযান
জিহাদ ত্যাগ করার পরিণাম
মাওলানা মাসউদ আযহার
এমন সোনালী যুগও অতীত হয়েছে, যখন পারস্যের সেনাপতি রুস্তম মুসলিম সেনাদের বলেছিল, “তোমরা দেশে ফিরে যাও। অন্যথায় তোমাদেরকে টুকরো টুকরো করব।” তখন মুসলিম সেনাপতি সাঈদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস মতান্তরে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ তিরস্কার করে রুস্তমকে বলেছিলেন, আমরা নিরস্ত্র হাতে এখানে এসেছিলাম, তোমার এ হুমকীর আগেই আমাদের পলায়ন করা উচিৎ ছিল। যখন পালাইনি তখন যুদ্ধ ক্ষেত্রে বুঝা যাবে কার মুরোদ কতটুকু।”
কোন এক কাফির সম্রাট মুসলিম সেনাপতি খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ)-কে তিরস্কার করে বলেছিল, আরে! কি জন্য এসেছ তমরা আমাদের দেশে?” খালেদ ইবনে ওয়ালিদ অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় তাকে বললেন, “তোমাদের রক্তের স্বাদ নেশা ধরিয়েছে আমাদের মনে। তাই ছুটে এসেছি তোমাদের দেশে।” সম্রাট অবা তাকিয়ে রইল। এ কথা শুনে আর কিছুই রেরুল না তার মুখ থেকে।
একবার রোমীয় বাদশাহ নাকুর মহামতি হারুনুর রশীদের নিকট এই মর্মে পত্র লিখলঃ “আমরা আপনাকে এ পর্যন্ত বহু ট্যাক্স দিয়ে এসেছি, এখন থেকে আর ট্যাক্স দেব না। আজ থেকে আমরা স্বাধীন।” পত্রের উত্তরে হারুনুর রশীদ লিখলেনঃ
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
হারুনুর রশীদ-এর পক্ষ থেকে রুমী সারমেয় নাকুরের প্রতি। আমি তোমার পত্রের লিখিত উত্তর দিচ্ছি না। আমার উত্তর স্বচক্ষে দেখতে পাবে।”
অতি দ্রুত ও অল্প সময়ের মধ্যে হারুনুর রশীদ নাকুরের আঙ্গিনায় পৌঁছে গেলেন। হঠাৎ স্বসৈন্য সম্রাটকে দেখে চুক্তি ভঙ্গকারী বিদ্রোহী নাকুর কিংকর্তব্য বিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইল। সম্বিত ফিরে এলে নাকুর হারুনুর রশীদ এর পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইল এবং পুনরায় ট্যাক্স দেয়ার অঙ্গীকার করল।
আমরাও তাদের সহযাত্রী
আরব, আফ্রিকা, আমেরিকা, পাকিস্তান, হিন্দুস্তান ও বাংলাদেশের যুবক-তরুনরা যদি ইসলামের জন্য আফগান ভুমিতে এক কাতারে দাঁড়িয়ে জীবন দিতে পারে, তবে আমি ও আপনি পারব না কেন? আমরা তো তাদেরই সহযোগী সহযাত্রী ছিলাম। এক তাবুতে রাত কাটিয়েছি। এক দস্তরখানে ভাত খেয়েছি। ইনশা আল্লাহ্ আমরাও অস্ত্র হাতে কাশ্মির, ফিলিস্তিন, মেন্দানাও, চেচেনিয়া ও আরাকানে সকলে একতাবদ্ধ হয়ে কাফির জালিমের মুকাবিলায় যুদ্ধ করব। দুশমন মারব। আল্লাহ্র পথে নিজেরাও মরব। তখন আমরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করবঃ “হে আল্লাহ্! তোমার হাতে যখন জীবন সোপর্দ করলাম তখন একথা ভাবি না যে, আমার শরীরের কোন স্থানে আঘাত লাগল।”
প্রকাশ্য পাপ
জিহাদ পরিত্যাগ করা এক মস্ত বড় পাপ। বর্তমান মুসলিম উম্মাহ শুধু জিহাদ পরিত্যাগের পাপেই লিপ্ত নয়, বরং তাদের অনেকে জিহাদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাপেও লিপ্ত রয়েছে। এই ধরনের লোকদেরকে মুনাফিক আখ্যায়িত করে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ পাক বলেছেন, ওরা নিজেরা জিহাদে তো যায়-ই না, পরন্তু অন্যদেরকেও জিহাদে যাওয়া থেকে বারণ করে থাকে। তাই বলা হয়েছেঃ
“পেছনে থেকে যাওয়া লোকেরা আল্লাহ্র রাসুল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসে থাকতে পেরে আনন্দ লাভ করছে এবং জান-মাল দ্বারা আল্লাহ্র পথে জিহাদ করতে অপছন্দ করছে।”
মুনাফিকরা অন্যদেরকে বারণ করে বলছেঃ
‘এ গরমের মধ্যে অভিযানে বের হয়ো না।‘
আল্লাহ্ বলেন, ‘(হে নবী!) তাদের জানিয়ে দিন, জাহান্নামের অগ্নির উত্তাপ প্রচন্ডতম। (তমরা জিহাদ পরিত্যাগ করার পাপদ্বারা যে আগুন প্রজ্বলিত করেছো।)
প্রকাশ্যে ও দম্ভভরে যে পাপ করা হয়, তার শাস্তি বড়ই কঠিন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানুবী দাড়ি সম্পর্কিত এক আলোচনায় এ হাদিসখানা উল্লেখ করেছেন, প্রিয় নবী (ﷺ) বলেছেন, “গোটা উম্মতকে ক্ষমা করা হবে। কিন্তু যারা প্রকাশ্যে ও দম্ভভরে পাপ করে তাদের ক্ষমা নেই।”
আমরা জিহাদ পরিত্যাগ করেছি এবং একে গর্বের বিষয় মনে করছি। উপরন্তু এ কঠিন অপরাধের জন্য আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করছি না। এ পাপের অনুশোচনায় দু’ফোটা অশ্রুও আমাদের চখ থেকে ঝরে না। জিহাদ ত্যাগ করার অপরাধের কথা স্বীকার করে দু’হাত তুলে কোন দিন কি আমরা আল্লাহ্র দরবারে এ কথা বলেছিঃ ওগো মাওলা! এ যাবত এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাতে ভীষণ অবহেলা করেছি আমরা, তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও।
পক্ষান্তরে নবীজি (ﷺ) যে কাজ করতে বারন করেছেন, আমরা সেসব হরদম করে যাচ্ছি। জৈনক সাহাবী একবার কোথাও সবুজ-শ্যামল মনোরম বাগানঘেরা এক গুহা দেখে বললেন, আমি লোকালয় ছেড়ে এ গুহায় অবস্থান করব। এ গুহায় বসে একাগ্রচিত্তে বেশী পরিমাণে আল্লাহ্র যিকির ও ইবাদতে মশগুল থাকব। নবীজি (ﷺ) তার এ সংকল্পের কথা জানতে পেরে বললেন, “আমি ইহুদী অথবা খৃষ্ট মতবাদ নিয়ে প্রেরীত হইনি। আমি তো এসেছি মিল্লাতে হানীফ নিয়ে। শোন হে লোক সকল ! সে সত্ত্বার শপথ করে বলছি, যার হাতে আমার জীবন, এক সকাল বা এক বিকাল আল্লাহ্র পথে জিহাদ করা দুনিয়া ও তার মাঝে অবস্থিত সবকিছু থেকে উত্তম।”
কাযী এয়াজ মালেকী (রাহঃ) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন, কাউকে যদি পৃথিবীর যাবতীয় ধন-সম্পদ দেয়া হয়, আর যদি সে ব্যক্তি তার সমুদয় সম্পদ আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে দেয়, তার এ আমল মুজাহিদের একটি সকালের সমানও হবে না।
আমরা কী করছি
পবিত্র কুরআনের সূরা ‘মুহাম্মাদ’- এর অপর না ‘কিতাল’। উক্ত সূরার একখানা আয়াত পড়ে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। ঐ আয়াত এত কঠিন শাস্তির ঘোষণা সত্বেও মুসলমানদের মাঝে কোনরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় না। প্রিয় নবী (ﷺ)-এর মক্কী জীবনে বহু মজলুম মুসলমান আকূল হৃদয়ে প্রার্থনা করতেন, হে আল্লাহ্! কাফিরদের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ, তুমি আমাদেরকে জিহাদ করার অনুমতি দাও! নবীজির সমীপেও তারা ব্যাথাভরা হৃদয়ে আবেদন জানাতেন, আমাদেরকে জিহাদ করার অনুমতি দিন। এই প্রেক্ষাপট মনে করিয়ে দিয়ে আল্লাহ্ পাক সূরা কিতালে বলেন, “যখন জিহাদের স্পষ্ট নির্দেশ সম্বলিত বিধান অবতীর্ণ হয়, তখন যে সব লোকদের মনে (কিফাকের) ব্যাধি রয়েছে-তাদের দেখতে পাবেন, তারা আপনার দিকে মৃত্যুর ভয়ে মুর্ছাপ্রাপ্ত মানুষের মত চেয়ে আছে।”
আসলে মুনাফিকদের গুড়গুড়, ঘোমটাবাজী আর ফিসফিসানি ধরনের কর্মকান্ডে আল্লাহ্ পাকের ক্রোধ জাগ্রত হয়। হবেই বা না কেন, কিছু লোক রাসূলের আহ্বান শুনে দৃঢ় মনে জিহাদের ময়দানে ছুটে যায়। কেউ নববধূ ও বাসর উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়ে আল্লাহ্র দুশ্মনের মুকাবিলায় স্বয়ং রাসূল (ﷺ) ও রণাঙ্গনে রক্ত ঝরাচ্ছেন, এমন সঙ্গীন সময়ে তথাকথিত কিছু দুর্ভাগা মুসলমান জিহাদকে এড়িয়ে ঘুরঘুর ফিসফিস করছে। জিহাদের আদেশ তারা শুনেও শুনছে না যেন। এদেরকে উদ্দেশ্য করেই রাগান্বিত হয়ে আল্লাহ্ বলেছেন, “ধ্বংস হক এসব লোক।” দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক হলেও আমাদের চিন্তা, কর্মকান্ডে কিন্তু তাদেরই অনুসরণ পরিলক্ষিত হয়। জিহাদের আলোচনা শুনলে আমরা ঘুর ঘুর গুজ গুজ করি , সুযোগ বুঝে মুজাহিদদের তিরস্কার করি। অথচ জিহাদের নির্দেশ জানার পর তাতে অংশ গ্রহণ না করলে তজ্জন্য আল্লাহ পাক কঠিন শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন।
এ কথা আমাদের ভালভাবে জেনে নেয়া উচিৎ, জিহাদ তথাকথিত কোন রাজনৈতিক কর্মকান্ড নয়-আল্লাহর এক অলংঘণীয় বিধান, একটি গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ ইবাদাত। যে বিধান ও ইবাদাতের কথা পবিত্র কুরআনের এক ষষ্ঠমাংশ জুড়ে ব্যাপকভেবে আলোচিত হয়েছে।
মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ইবাদত কাকে বলে? যে কাজকে প্রিয় নবী (ﷺ) ভালবেসেছেন, নিজে যা করেছেন, যা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং যা করতে আদেশ করেছেন কেবল তাই ইবাদাত বলে বিবেচিত হয়।
অতএব, যা ইবাদাত তাই আমি করব। এটা আমার দায়িত্ব, আমার সৃষ্টির উদ্দেশ্যও তাই। কেউ না করলেও আমি তা করব। ইবাদাতকারীর ত্রুটির কারণে কোন ইবাদাতের ব্যাপারে অনীহা প্রদর্শন করা যায় না। নামাযীদের পারস্পারিক দ্বন্দের কারণের নামায ফরজ হওয়া রহিত হয় না। তাহলে আমাদের কিছু লোক এ অজুহাত দেখিয়ে জিহাদ থেকে কিভাবে বিমুখ থাকছে যে, মুজাহিদদের মাঝে দ্বন্দ দেখা যাচ্ছে?
কেউ বলছেন, মুজাহিদরা আপোষে মারামারি করে, তাদের মাঝে বহু গর্হিত ও অন্যায় দেখা যাচ্ছে। অতএব আমি জিহাদ করব না। অনাকাংখিত হলেও মানুষের মাঝে পরস্পরে দ্বন্দ থাকা স্বাভাবিক, পাপ ও অন্যায় করা আরো স্বাভাবিক। কেননা মানুষ এসব এড়িয়ে চলার ব্যাপারে নিতান্তই দুর্বল। আর মুজাহিদরা তো অতিমানব নন। তাই তাদের ভিতরও দুর্বলতা থাকা অস্বাভাবিক নয় মোটেই। অতএব এসব অজুহাত দেখিয়ে জিহাদ থেকে বিমুখ থাকা মোটেই সংগত নয়-বরং তা হবে এক মারাত্মক অপরাধ।
আমাদের জেনে রাখা উচিৎ, আল্লাহ্ পাক মুজাহিদদের পাপ মাফ করে দেয়ার জন্য অত্যন্ত সহজ পথ তৈরী করে রেখেছেন। তাহলো, প্রিয় নবী (ﷺ) বলেছেন, “শহীদের প্রথম রক্তের ফোটা মাটিতে পড়া মাত্র তার সকল পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়।” (কানযুল উম্মালঃ ২১০ প্রঃ ৪র্থ খঃ)
আমাদের কি অবস্থা হবে, আমরা জিহাদ ত্যাগ করে যে পাপের ভাগী হয়েছি, সেদিকে কি একবারও লক্ষ করেছি? আমরা তো কখনো জহাদে যাওয়ার সংকল্পও করিনি, যা মুনাফিকের অন্যতম আলামত। আমরা তো জীবনে কখনো বন্দুক ও তরবারী ছুঁয়েও দেখিনি। অস্ত্র কাকে বলে তাও জানি না। অথচ নবীজি (ﷺ) সাতাশ বার অস্ত্র হাতে শত্রুর মুখোমুখি রণাঙ্গনে অবতরণ করেছেন। আর আমরা রাসূল (ﷺ)-এর এই মহান আমলটিকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছি। ভেবে দেখেছি, আমরা কত বড় পাপি! অথচ মুজাহিদদের পাপ খুব করে আমাদের চোখে পড়ে। নিজেরা যে কত বড় পাপি সে ব্যাপারে আমরা একেবারেই উদাসীন।