জীবন্ত কন্যা সমাধিস্থ করার পৈশাচিক রীতি ও আজকের ভারত
নাসীম আরাফাত
==================================================
প্রাক-ইসলামী যুগের আরব ইতিহাসের পাতা উল্টালে শরীর শিউরে ওঠে। তাই তাকে আমরা অন্ধকার যুগ, জাহিলিয়াতের যুগ বলে থাকি। কথায় কথায় যুদ্ধ, রক্তারক্তি, হানাহানি ছিল তখনকার দিনে নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। তাছাড়া তখনকার ইতিহাসে জীবন্ত কন্যা সন্তান সমাহিত করার যে পৈশাচিক দৃশ্য ফুটে উঠে তা পাঠ করে পাষাণ হৃদয় লোকের অশ্রু সংবরণ করা ও দারুন কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। নিষ্পাপ কচি কণ্ঠের ফরিয়াদ পাষাণ পিতৃহৃদয়ে একটুও দয়ার সঞ্চার করতো না। স্বহস্তে সমাধিস্থ করে প্রসন্ন হৃদয়ে ফিরে আসতো তারা।
তখনকার দিনে নারী ছিল সমাজের লাঞ্ছনার প্রতীক। কাল পরিক্রমায় এ কন্যা শিশুই যুবতী হয়ে অজ্ঞাত যুবকের স্ত্রী হবে আর সে হবে তার শশুর। এ ধরণের চিন্তাই তাদের ধাতে সইতো না। তাই জন্মক্ষণেই কলঙ্কের এই চিহ্নকে মুছে ফেলার জন্য নবজাতককে জীবন্ত সমাহিত করতে তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হতো না।
সূরা নাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের এ বর্বরতার চিত্র নিখুত ভাবে তুলে ধরে বলেছেন, "আর তাদের কাউকে কন্যা সন্তান জন্মের সুসংবাদ দেয়া হলে তার মুখমণ্ডল মলিন হয়ে যায়, সে চিন্তা করে, লাঞ্চনা সত্ত্বেও কি তাকে জীবন্ত রেখে দিবে না মাটিতে পুতে ফেলবে। সমাধান, তাদের সিদ্ধান্ত কতই না নিকৃষ্ট।"
আরবের কয়েকটি কাবীলা এবং কিছু লোক এ নির্মম ও পৈশাচিক কাজে ছিলো খুব প্রসিদ্ধ। এই নর-পশুদের নিকট নবজাতক নিষ্পাপ সন্তানকে জীবন্ত সমাধিস্থ করা মর্যাদার বিষয় ছিল। এ নিয়ে তারা গৌরব বোধ করতো। একবার জৈনক ব্যক্তি এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম এর নিকট তার জীবন কাহিনী বলতে বলতে একথাও গর্বভরে বলে ফেললো যে, সে নিজ হাতে তার আটটি কন্যা সন্তানকে জীবন্ত সমাধিস্থ করেছে।
"শিশু হত্যার এক নির্মম কাহিনী"
--------------------------------------------------------------
বনূ তাসীম গোত্রের লোকেরা এ নির্মম অপরাধে ছিল পারদর্শী। এ গোত্রে সরদার কাইস ইবনে আছিম ইসলাম গ্রহণের পর স্বহস্তে কন্যা শিশুর জীবন্ত সমাধিস্থ করার এক করুণ কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ইয়া রাসূলূল্লাহ! একবার আমি সফরে গিয়েছিলাম। আমার অনুপস্থিতি আমার একটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে। অবশ্য আমি বাড়ি থাকলে তার কান্নার আওয়াজ শোনার সাথে সাথেই গর্তে পুঁতে তার আওয়াজ চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিতাম। স্ত্রী তাকে মাতৃমমতা দিয়ে লালিত-পালিত করতে লাগলো। কিন্তু কয়েক দিনেই তার মাতৃমমতা এতো তীব্র হলো যে আমার নির্মমতার ভয়ে তার খালার কাছে তাকে পাঠিয়ে দিল এই উদ্দেশ্যে যে, হয়তো খালার স্নেহে লালিত-পালিত হয়ে একটু বড় হলে পিতার হৃদয়েও স্নেহ দয়ার উদ্রেক হবে এবং নিস্পাপ শিশু সন্তানটিকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে।
সফর শেষে ফিরে এসে শুনলাম, আমার একটি মৃত সন্তান জন্মেছিলো। এ সময় আমি আমার কাজে খুব ব্যাস্ত। এদিকে আমার কন্যাটি তার খালার স্নেহে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। একদিন বিশেষ কারণে বাইরে কোথাও গিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী এই সুযোগে মেয়েটিকে বাড়িতে নিয়ে আসে। অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়িতে ঢুকেই দেখি, একটি ফুটফুটে সুদর্শনা চঞ্চলা শিশু কন্যা ঘরময় ছুটাছুটি করছে স্বর্গীয় এক মায়ার পরশে আমার হৃদয় মন ভরে উঠলো আনন্দে চোখ দুটি চিকচিক করে উঠলো। সচকিতা স্ত্রী তা সাথে সাথেই আঁচ করে ফেললো। বুঝলো যে পাষাণহৃদয়ে পিতৃস্নেহের বাণ ডেকেছে। আমি সুপ্রসন্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম। এ কে? কার মেয়ে, ভারী চমৎকার তো। মায়ায় মনটি আমার জয় করে ফেলেছে।
স্ত্রী তখন সব কিছু খুলে বললো। অবলী লাক্রমে স্নেহভরে আমি তাকে কোলে তুলে নিলাম। চুমু খেলাম স্ত্রী কন্যাটিকে বললো, মা এযে তোমার আব্বু। অমনি সে আমাকে আব্বু আব্বু বলে জড়িয়ে ধরল। সে যে কি সুখ, কি স্বর্গীয় আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আমি তাকে কাছে ডাকলে আব্বু আব্বু বলে কোলে ঝাপিয়ে পড়তো আর আমি তাকে বুকে চেপে ধরে স্বর্গীয় আনন্দ উপলব্ধি করতাম।
সময়ের তালে তালে সে স্নেহ-মমতার উষ্ণ পরশে প্রতিপালিত হতে লাগলো। কিন্তু মাঝে মাঝে আমার বুকের মধ্যে একটি হিংস্র পশুত্ব এসে উপস্থিত হতো। ঢুবে যেতাম কুচিন্তার অথৈ পাথরে। হায় এই মেয়ের জন্য কি আমার মান মর্যাদা সম্মান সব ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে? এইতো কিছুকাল পরে সে হবে অজ্ঞাত এক যুবকের অঙ্কসায়িনী। ঘৃণায় আমার সারা শরীর রি রি করে উঠতো। লোক সমাজে আমি মুখ দেখাবো কি ভাবে। অবশেষে আমার মিথ্যা আত্মমর্যাদাবোধ, আমার হিংস্র আত্ম অহমিকা আমাকে অন্ধ করে ফেললো। ধৈর্যের সবগুলো বাঁধ ধ্বসে পড়লো। সিদ্ধান্ত নিলাম, আজই এ লাঞ্চনা অপমানের প্রতীককে সমাধিস্থ করে আত্মপ্রশান্তি লাভ করবো। লাঞ্ছনার দরজা আজই বন্ধ করবো।
কপট মুখে স্ত্রীকে বললাম, মেয়েটিকে আজ সাজিয়ে দাও, ওকে এক নিয়ন্ত্রনে সাথে নিয়ে যাবো। স্ত্রী তাকে সুন্দর ভাবে ঝলঝলে কাপড়ে সাজিয়ে দিলো। আব্বার সাথে নিয়ন্ত্রণের সংবাদে সেও আনন্দে আত্মহারা। আমি তাকে নিয়ে এক পাথুরে অঞ্চলের দিকে রওয়ানা হলাম। মেয়েটি তখন আনন্দের অতিশয্যে লাফিয়ে লাফিয়ে কখনো আমার সামনে, কখনো আমার পিছনে, কখনো হাত ধরে চলছিলো। কিন্তু সে তো জানতোনা আমার মাঝে তখন পশুত্বের কি পৈচাশিকঝড় বইছিলো। আমি তখন ছিলাম অন্ধ মূক বধির। তার হর্ষ উল্লাস, কল কন্ঠের আব্বু আব্বু ডাক কিছুই আমাকে প্রভাবিত করেছিল না। দূরে এক জায়গায় গিয়ে থামলাম এবং দ্রুত একটি গর্ত করতে লাগলাম। আমার কান্ড দেখে মেয়েটি বিস্মিত হয়ে বললো। আব্বু! এ পাথুরে জায়গায় গর্ত করছেন কেন? নিমন্ত্রণ যাবেন না? বড্ড দেরী হয়ে যাচ্ছে যে। আমি তখন নির্বাক নিস্তব্ধ। গর্ত খননে মগ্ন। ছিটে ফোটা ধূলিকনা আমার শরীরে লাগলে অবুঝ কন্যা তা ঝেড়ে দিচ্ছিলো এবং বলছিলো, আব্বু আপনার শরীরে যে ময়লা লাগছে। গভীর গর্ত খনন শেষে আমি সেই সদাহাস্য মমতাময়ী কন্যাটি শূন্যে তুলে গর্তে নিক্ষেপ করলাম। তারপর দ্রুত মাটি ফেলে গর্তটি ভরতে লাগলাম। অসহায় অশ্রুসজল চোখে কেঁদে কেঁদে সে শুধু বলেছিল, আব্বু আব্বু এ কি করছেন? আব্বু আমি তো কোন দোষ করিনি, তবে কেন আমাকে গর্তে চাপা দিচ্ছেন?
আজও তার অসহায় অর্তধ্বনি আমাকে ব্যাকুল করে তোলে। আমি যেন উন্মাদ হয়ে যাই। কিন্তু তখন আমি এত নিষ্ঠুর এত নির্মম ছিলাম যে, আমার পাষাণ হৃদয় গলে একটুও দয়ার উদ্রেক হয়নি। বরং তাকে জীবন্ত সমাধিস্থ করে পৈশাচিক উল্লাস আর প্রশান্তি নিয়ে ফিরে এসেছি।
এ নির্মম কাহিনী শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর চক্ষূদ্বয় থেকে টপ টপ করে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছিল। গুমড়ে কেঁদে উঠেছিলেন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর বশছিলেন, যারা অন্যের প্রতি দয়াবান নয় আল্লাহ কিভাবে তাদের প্রতি দয়াশীল হবেন?
"আরেকটি মর্মন্তুদ কাহিনী"
-----------------------------------------------------------------
জৈনক ব্যক্তি জাহিলী যুগের আত্মকাহিনী এমন মর্মস্পর্শও বেদনাদায়ক ভাষায় বর্ণনা করেছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম তা শুনে অস্থির হয়ে পড়েন। সে বলছিলো, "ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা তখন ছিলাম অজ্ঞ, কিছুই জানতাম না। হাতে গড়া পাথুরের মূর্তির পূজা করতাম। শিশুক ন্যাদের জীবন্ত সমাধিস্থ করতাম। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার একটি আদরের কন্যা ছিলো। কাছে ডাকলে ছুটে এসে কোলে ঝাপিয়ে পড়তো। একদিন আমি তাকে কাছে ডাকলাম, সে আনন্দে আমার নিকট ছুটে এলো, তাকে সাথে নিয়ে আমি চলতে লাগলাম।
আমি আগে যাচ্ছিলাম আর সে পিছু পিছু উৎফুল্ল চিত্তে আসছিলো। বাড়ির অনতিদূরে ছিল একটি গভীর কূপ, কূপের নিকটে গিয়ে নিকটে গিয়ে আমি থেমে দাঁড়ালাম। সেও এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। আমি তখন তার দুহাত ধরে শূন্যে তুলে কূপে নিক্ষেপ করলাম। নিষ্পাপ শিশুটি তখন কুপের অন্ধকার থেকে শুধু আর্তচিৎকার করছিলো। বড় করুণ, হৃদয়বিদারক ছিল তার কন্ঠস্বর। সে শুধু আব্বা আব্বা বলে ডাকছিলো আর এই ছিল তার জীবনের শেষ শব্দ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এই মর্মস্পর্শী হৃদয়বিদারক কাহিনী শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দু'চোখ ছেপে অশ্রুধারা ঝরতে লাগলো। এক সাহাবী রাসূলের (সা) কান্নার দৃশ্য অসহ্য হয়ে তিক্ত কণ্ঠে বললেন, "নিষ্প্রয়োজন ও বেদনাদায়ক কাহিনী শুনিয়ে তোমরা কেন শুধু শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে কষ্ট দাও? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম একথা শুনে বললেন "হ্যাঁ ভাই, আবার তোমার আত্মকাহিনীটি শুনাও। রাসূল সাল্লাহু আলাইহিস সাল্লাম তখন আত্মহারা আকুল। কাঁদতে কাঁদতে তার শ্মশ্রু মোবারক সিক্ত হয়ে গেল।
কত শত হাজার নিষ্পাপ শিশু যে এত জুলুম নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে তার কোন ইয়ত্তা, কোনো ইতিহাস নেই যদিও সে অন্ধকার নিকষ অন্ধকার যুগে ও কিছু হৃদয়বান ব্যক্তি ছিলেন। যারা এ বর্বরতা নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা থেকে কন্যা শিশুদের রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন, কিন্তু একক ও ব্যক্তি চেষ্টা আর কতটুকু ফলপ্রসূ হতে পারে?
জীবন্ত শিশুর সমাধিস্থ করার প্রতিরোধে এক প্রশংসনীয় উদ্যোগঃ
----------------------------------------------------------------------------------
কবি ফরাজদুক আরব কবি সমাজে এক উজ্জ্বল নাম। তিনি তার দাদা সা-সার এক কৃতিত্বের জন্য দারুণ গর্বিত ছিলেন। তার দাদা জীবন্ত শিশুর সমাধিস্থ করার প্রতিরোধে এক কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। সা-সা বলেন, একবার আমি আমার দু'টি হারানো উটের তালাশে ঘুরছিলাম। দূরে একটি ক্ষীণ আলোর রশ্মি দেখতে পেলাম। উৎসুক্য মনে দ্রুত উট চালিয়ে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। মনে করছিলাম হয়তো কেউ বিপদে পড়েছে, দেখি সামান্য কোনো সহায়তা করা যায় কিনা।
গিয়ে দেখি ঝাটকা চুলের এক বৃদ্ধ ঘৃহের সামনে বসে আছে বিমূর্ষ হয়ে। আর গৃহাভ্যন্তরে কয়েকজন মহিলা প্রসব বেদনায় অস্থির এক মহিলাকে ঘিরে আছে। কুশল বিনিময়ের পর জানতে পারলাম। তিন দিন যাবত মহিলাটি প্রসব বেদনায় কাতর। ইত্যবসরে খবর এলো সন্তান হয়েছে। বৃদ্ধা তখন অস্থির, চিৎকার করে উঠল, যদি পুত্র হয় তবে রেহাই! অন্যতায় আওয়াজ শোনার সাথে সাথেই তাকে পুঁতে ফেলবো। আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললাম মহোদয়, ওকথা বলবেন না! সে তো আপনারই সন্তান। রিজিকের ব্যাপারেও আপনার চিন্তা নেই। কারণ আল্লাহ তো তার জিম্মা খোদ নিয়েছেন। বৃদ্ধা গর্জে উঠল। না আমি তাকে পুতে তবে শান্ত হবো। তাকে হত্যা করে তবে আমার প্রশান্তি। আমি এবার আরও বিগলিত বিনম্রকন্ঠে বারণ করলে বৃদ্ধা বলল, এতই যদি দরদ থাকে তবে যাও কিনে নিয়ে তাকে প্রতিপালন করো! আমি বৃদ্ধার কথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি।
আকস্মৎ বলে ফেললাম, হ্যাঁ দাও তাকে কিনেই নিব। নবজাত নিষ্পাপ শিশুটিকে কিনে এক স্বর্গীয় প্রশান্তিতে নিশ্চিত মনে ফিরে আসলাম এবং আল্লাহর সাথে ওয়াদাবদ্ধ হলাম যে এই শিশুটিকে স্নেহ-মমতা দিয়ে পালন করব এবং যখন ঐ কোন পাষাণ হৃদয় ব্যক্তি এ ধরনের পৈশাচিক কাজে উদ্যত হবে, আমি তাতে বাধা দিব প্রয়োজনে শিশুটিকে অর্থের বিনিময়ে কিনে আনব এবং স্নেহ মমতা দিয়ে লালিত-পালিত করব। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভূত হওয়া পর্যন্ত এদারা চলতে থাকে এবং এ দীর্ঘ দিন গুলোতে আমি 94 জন শিশুকে নির্দয় হাত থেকে বাচিয়েছি। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে এ প্রথা চিরতরে বন্ধ করে দেন। সমাজকে পৈশাচিকতা থেকে মুক্ত-পবিত্র করেন। তাই আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের পরিচয় দানে বলেন যে, "তারা স্বীয় সন্তানদের জন্য দোয়ার প্রাক্কালে বলবে, হে প্রভু! তাদেরকে আমাদের চোখের শীতলতা বানিয়ে দাও! আর দয়াময় আল্লাহর বান্দা তারাই যারা বলে, প্রভু! আমাদের স্ত্রীদের এবং আমাদের সন্তানদের আমাদের চোখের শীতলতা বানিয়ে দাও।"
ভারতে শিশু হত্যার নব্য পৈশাচিকতা:
--------------------------------------------------------------
সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক মানের পত্রিকা "গালফ উকলী" ভারত এক মাজলূম নারীর কাহিনী প্রকাশ করেছে। নিম্নবিত্ত মজুর পরিবারের রানী নামক এক মহিলা হাসপাতালে একটি কন্যা সন্তান প্রসব করে। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এলে কন্যা সন্তানের কথা শুনে অসন্তোষ প্রকাশার্থে পুরুষেরা গৃহত্যাগ করে চলে যায়। অতঃপর রানী নাম্নী মহিলাটি কন্যা সন্তান জন্মদানের অভিশাপ থেকে মুক্তির প্রয়াসে শাশুড়ির যোগসাজশে বিষাক্ত বস্তু পানির সাথে মিশিয়ে নবজাত শিশুকে পান করানোর সাথে সাথে শিশুটির মৃত্যু বরন করে। তারপর রাতের অন্ধকারে পার্শ্ববর্তী এক ক্ষেতে গর্ত করে শিশুটিকে চাপা দিয়ে আসে। এ নির্দয় মাতাকে যখন প্রশ্ন করা হলো, এ জঘন্য পাপ কাজে কি তুমি একটুও প্রভুকে ভয় করোনি? সে নির্দ্বিধায় উত্তরে বলল আমি তাকে বাঁচিয়ে রাখলেও তার ভবিষ্যৎ ছিল অন্ধকার। পুত্রসন্তান জন্ম না দিতে পারা আজ নারীদের জঘন্যতম অপরাধ। রানী ভাবাবেগে বল্ল, প্রভু! পুত্র সন্তান দিলে ভালো হতো, অন্ততঃ আমার জীবনটা কিছু সার্থক হত।
বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত, ভারতে এখন হাজার হাজার অসহায় মহিলা, পুরুষের অত্যাচারে, নিপীড়নে, সামাজিক লাঞ্ছনায় বাধ্য হয়ে এ ধরনের পৈশাচিক অপকর্ম সংঘটিত করেছে। অবশ্য কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক ব্যবস্থা এ জন্য অনেকটা দায়ী। কেননা ভারতে বিবাহ উৎসবে কনে গ্রহণের পূর্বে রাশি রাশি যৌতুক গ্রহণ করা হয়, যা একজন শ্রমজীবী পবিত্র পিতামাতার জন্য একেবারেই অসম্ভব। তাই কন্যাসন্তান আজ ভারতে অনাকাঙ্ক্ষিত ও ভীতিপ্রদ।
১৯৯২ সালে গোটা বিশ্বে কন্যাশিশুদের অবস্থা সম্বলিত জাতিসংঘের এক প্রেস রিপোর্টে বলা হয় যে, অত্যাধুনিক বিজ্ঞান ব্যবস্থা নারী পুরুষের মর্যাদা বৈষম্যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের বদৌলতে পিতা মাতার সন্তান প্রসবের পূর্বেই ভ্রণের লিঙ্গ নির্ধারণে সক্ষম হচ্ছে। ভারতের ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ৭৪ হাজার মা জন্মের পূর্বে ভ্রুণের সন্তানের লিঙ্গ অবগতির পর কন্যা সন্তান হওয়ার ভয়ে ভ্রুণ হত্যা করেছে।
পুত্র বা কন্যা জন্ম আল্লাহর অনুপম লীলা:
-------------------------------------------------------
সন্তান পুত্র হওয়া বা কন্যা হওয়া উভয় সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছাধীন। এতে কারো ক্ষমতা, কারো কামনা বা ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার কোনো ভূমিকা নেই। একমাত্র মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনই জানেন, কার জন্য পুত্রসন্তান কল্যাণকর হবে, আর কার জন্য কন্যা সন্তান। আল কোরআনের ভাষায়ঃ "তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাদান করে থাকেন, যাকে ইচ্ছা পুত্র দান করেন, আর যাকে ইচ্ছা কন্যা-পুত্র উভয়ই দান করেন। আর যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা বানিয়ে সন্তান হতে বঞ্চিত করেন। নিঃসন্দেহে তিনি সবকিছু জানেন এবং সবকিছুতেই সক্ষম।"
বিশ্ব নিয়ন্ত্রা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবহিত। তিনি সর্বদা বান্দার কল্যাণ কামনা করেন। তাই আল্লাহর অপর নিয়ামত 'সন্তান' চাই পুত্র হোক বা কন্যা হোক! তাতে সর্বদা সন্তুষ্ট থাকা উচিত এবং সর্বাবস্থায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা জরুরি ।
*****