নব্য ফেরাউনদের রুখতেই হবে
===================================================
পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বিশ্ব রাজনীতিতে মারাত্মক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করেছে। এতদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকা এই দুই পরাশক্তি বিশ্বে নিজ নিজ প্রভাব বিস্তার, পণ্য বাজার দখল, মারণাস্ত্র উৎপাদন প্রতিযোগিতা, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সামরিক ঘাটি নির্মাণ, মহাকাশে ম্যারাথন দৌড় প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে দাপাদাপি গুতোগুতির আসর বেশ জমিয়েছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতার মাঝ থেকে সোভিয়েত ইউনয়নের ছিটকে পরার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে জিতে গেল। বিজয়ের পর জর্জ বুশ সাহেব ভেবে বসলেন যে, বিশ্ব এখন আমার মুঠোয়। আমিই এখন বিশ্বের একচ্ছত্র মোড়ল। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমের সাবইকে এখন আমার কথায় ওঠ বস করতে হবে। অর্থাৎ তিনি ফেরাউনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাতারাতি বিশ্বের অঘোষিত খোদা বনে গেলেন!
কিন্তু বিনা যুদ্ধে এত বড় প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করেও বুশ সাহেব সুখে নিন্দ্রা যেতে পারলেন না। জাকার্তা থেকে ডাকার পর্যন্ত কতগুলি মানুষ আল্লাহ্ এর নাম জপ করছে। রাসূলের (সাঃ) আদর্শ আকড়ে ধরে আছে। ওরা জাগছে! সেকুলারিজম, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের ছড়া শুনিয়ে ওদের আর ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাচ্ছে না। অদ্ভুত ওদের চরিত্র। অতীতের ন্যায় যে কোন সময় ওরা অঘটন ঘটিয়ে বসতে পারে। বীর পুরুষ (!) জর্জ বাবুর সিংহ চিত্তে এক অজানা আশঙ্কা খচ খচকরে বিধতে থাকে।
না, এ হতে পারে না। পৃথিবীকে বগলদাবা করে রাখতে হলে, পৃথিবীর মানুষের ওপর খোদায়ীত্ব জাহির করতে হলে, ওদের সমূলে বিনাশ করতে হবে। প্রভুর মর্জি বুঝতে পেরে উজির-নাজির, সেনাপতি-সৈন্যবাহিনী, পাইক-পেয়াদা, গোয়েন্দা সংস্থা, প্রচার মাধ্যম সবকিছু একযোগে হুমরি খেয়ে পড়ল মৌলবাদী মুসলমানদের ধূলোয় মিশিয়ে দেয়ার মিশন নিয়ে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এই ফেরাউনও তার মিশন শেষ করতে পারলেন না। তবুও তিনি অল্প সময়ে কম করে ছাড়েননি। অবাধ্যতার শাস্তি স্বরূপ লিবিয়াকে বিশ্ব থেকে এক ঘরে করে ছেড়েছেন। ইরাকীরা আঙ্গুল উচিয়ে কথা বলার স্পর্ধা দেখিয়েছিলো, গোলামীর জিঞ্জর ভেঙ্গে ওদের মাথা উঁচু করে দাড়াবার শখ চেপেছিল। বলে একেবারে ধ্বংসস্তুপের নীচে ওদের কবর দিয়ে ছেড়েছেন। বসনিয়ার মুসলমানরা স্বাধীন হতে চাইছে বলে কৌশলে ওদেরও বিনাশ করার সুযোগ করে দিলেন হোয়াইট উলফ সার্বদের। এক ফেরাউন বিদায় নিয়েছে নতুন ফেরাউন মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। পুরাতন ফেরাউনের পথ ধরে এ ফেরাউনও “মুসলিম দমন মিশন” আরও বেগবান করার উদ্যোগ নিয়েছে। ঢালাও ভাবে মুসলমানদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ প্রমাণ করার অপচেষ্টা তারই আগাম পূর্বাভাষ মাত্র।
সদ্য সমাপ্ত আফগান জিহাদ থেকে প্রত্যাগত বিভিন্ন দেশের মুজাহিদরা দেশে প্রত্যাবর্তন করলে তাদের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে ইসলামী আন্দোলন নতুন প্রাণ লাভ করে, নতুন ধারায় গতিশীল হয় জিহাদী আন্দোলন। মুজাহিদদের জিহাদী চেতনার ফলে আজ মিশরের জামায়াত আল-ইসলামীয়াহু, ইখওয়ানুল মুসলেমীন, ফিলিস্তিনে হামাস, আলজেরিয়ায় সালভেশন ফ্রন্ট, পাকিস্তান ও কাশ্মীরে হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী, আল জিহাদ, আল বারক, হিযবুল মুজাহিদীন ও মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইখওয়ানুল মুসলেমীন স্থবির হয়ে পড়া মুসলমানদের মধ্যে জিহাদী চেতনার সঞ্চার করে চলছে সব রকম দমন-পিড়ন উপেক্ষা করে ৷ নব্য ফেরাউনরা মুজাহিদের এ তৎপরতা সহ্য করতে পারছে না। তারা স্পষ্টতই এর মধ্যে ক্রসেডকালীন আরব ও তুর্কী যোদ্ধাদের প্রতচ্ছিবি দেখতে পাচ্ছে আর আতঙ্কে তড়পাচ্ছে, ঐ বুঝি মুজাহিদরা পুরো আরব আজমকে নিয়ে পাশ্চাত্যের ওপর চড়াও হল ভেবে। ফেরাউনের ঘরে ফেরাউন হন্তা মুসা (আঃ) যেমনি লালিত, পালিত হয়েছিলেন, তেমনি আধুনিক ফেরাউনদের ‘আতঙ্ক’ মুজাহিদরাও আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য পাকিস্তান এসে অত্যাধুনিক ট্রেনিং নেয়ার সুযোগ পেয়েছিল। ইতিহাসের পুণরাবৃত্তি কত চমৎকার ভাবেই না ঘটল।
তবুও ওরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। লিবিয়া, ইরান, সুদানকে সন্ত্রাসবাদী বলার ধৃষ্টতা দেখায়। পাকিস্তানের পিঠেও ‘সন্ত্রাসবাদী’ একটা হাপ মারার জন্য সিল-স্ট্যাম্প নিয়ে প্রস্তুত। নিউ ইয়ার্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে বোমা হামলার জন্য মুসলমানদের জড়িত করার প্রণান্ত চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার মিথ্যে সন্দেহে মিশরের জামায়াত আল ইসলামীয়ার প্রাণপ্রিয় নেতা যুক্তরাষ্ট্রের স্বেচ্ছা নির্বাসন জীবন যাপনকারী অন্ধ খতীব শেখ ওমর আবদুর রহমানের বহিষ্কার দণ্ড ঘোষিত হয়েছে। ভারতে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ ঘটনার জন্য পাকিস্তান ও ভারতীয় মুসলমানদের দায়ী করে তাদেরও সন্ত্রাসী খেতাব দেয়ার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন বলে শুনা যাচ্ছে! ফিলিস্তিনের হামাস, কাশ্মীরের হরকত ও আল-জিহাদ ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করেও মুসলমান হওয়ার দোষে তারাও সন্ত্রাসী! আলজেরিয়ার সালভেশন ফ্রন্ট তাদের বিজয়কে অন্যায় ভাবে ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই করছে বলে তারা ‘মৌলবাদী’ ‘সন্ত্রাসী’ উভয় খেতাবই লাভ করেছে।
কিন্তু ভারত কাশ্মীরে এবং ইসরাইল অধিকৃত আরব ভূখণ্ডে যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালাচ্ছে, ভারতের শীব সেনারা দাঙ্গার সময় মুসলমানদের যেরূপ নির্বিচারে হত্যা করছে এবং শীবসেনা নেতা বলরাম থাকার অসভ্যেরমত মুসলমানদের ভারত থেকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেয়ার দম্ভ প্রকাশ করলেও কিন্তু তার সাম্প্রদায়িকও নয় এবং সন্ত্রাসী অপরাধ থেকেও পবিত্র থেকে যাচ্ছে। কত পরিষ্কার ওদের বিশ্লেষণ-বিচার। বিশ্বের বুকে মুসলমানদের ঢালাও ভাবে ‘সন্ত্রাসী’ ‘সাম্পদায়িক’ ‘মৌলবাদী’ আখ্যা দিয়ে তাদের বিশ্ব শান্তি, সভ্যতার জন্য বিপজ্জনক প্রমাণ করার খেলায় মেতে উঠেছে। এই ফেরাউন ও হাম্মানরা বিশ্বকে বোঝাচ্ছে, মুসলমানদের হাতে পারমানবিক বোমা, আত্মরক্ষার জন্য ব্যাপক আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র থাকাটা ঝুকিপূর্ন, বিশ্ব শান্তির জন্য তা বিপজ্জনক। নিজের হাতে কারি কারি পারমানবিক বোমা থাকলেও কোন দোষ নেই, তাতে নাকি শান্তির গেড়ো আরও মজবুত হবে। তাই পাকিস্তান, ইরান, লিবিয়াকে নিয়ে এত হৈ চৈ। ফেরাউন তার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পকেট সংস্থা জাতিসংঘকে ব্যবহার করে পাকিস্তান, ইরান, লিবিয়া, সুদানকে ইরাকের পথের পথিক বানানোর তয় তদবির করছে।
তাই যদি হয়, নিজের দেশ, জাতি, ধর্মকে রক্ষার জন্য লড়াই করে কোন মুসলমান যদি সন্ত্রাসী হয় তবে আমেরিকা রাষ্ট্রটি হবে মহা সন্ত্রাসী। ওদের স্বাধীনতা যুদ্ধটিই ছিল এক মহা সন্ত্রাস, ১৭৮৬ সালের ৪ঠা জুলাই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন না করে ‘সন্ত্রাস দিবস’ পালন করা উচিত। হিরোসিমা, নাগসিকার মহা অপরাধের জন্য হাজার বছর কান ধরে বিশ্ববাসীর নিকট ক্ষমা চাওয়া উচিত।
যুগে যুগে ফেরাউনরা অন্যায়কে ন্যায় আর ন্যায়কে অন্যায় বলে চালাতে চেয়েছে। আধুনিক বড় ফেরাউনটিও নিজেকে ন্যায়ের প্রতীক, বিশ্ব শান্তির মহাদূত ঘোষণা করে পূর্বের সূর্যকে পশ্চিমে উদিত করার স্পর্ধা দেখাচ্ছে। আর আমরা তা বুঝেও কিসের যেন ভয়ে বসে বসে ঝিমাচ্ছি। আমাদের বুঝতে হবে, ওরা বিশ্ব শান্তির নয় অশান্তির শিরোমনী। ওদের হাতে বিশ্ব কখনও নিরাপদ নয়। বিশ্বের শান্তি বজায় রাখার দায়িত্ব আল্লাহ মুসলমান জাতির ওপর ন্যাস্ত করেছেন। আমাদের গাফলতির জন্য ছোট জাতের বাচ্চারা বিশ্বের মোড়ল সেজে বসেছে। আমাদের দায়িত্ব আমাদেরই বুঝে নিতে হবে। আমরা যতই দায়িত্ব পালনে গাফলতি করব কুচক্রীরা ততই অশান্তি সৃষ্টি করবে। মুহাম্মদী ঈমান আর ইসমাঈলী কোরবানী নিয়ে আমাদের ফেরাউনের মোকাবিলায় অবতীর্ণ হতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায়। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। ফেরাউনরা দরিয়ায় ডুবে মরে আর মুসার বাহিনী লাভ করে গৌরবময় বিজয়। এটাই দুনিয়ার ইতিহাস।