JustPaste.it

ধারাবাহিক নিবন্ধন

 

কেন এবং কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তালেবান?

আবূ মাহমুদ

____________________________

মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ অতি অল্প সময়ে তালেবানকে বিপুল বিজয় দিয়ে পুরষ্কৃত করেছেন। এই অভাবিতপূর্ব অস্বাভাবিক বিজয়ে দুনিয়ার মানুষ অবাক হয়ে পরস্পরে জিজ্ঞাসা করছে, মাদ্রাসার এই যুবক ছেলেগুলো অপ্রতিরোধ্য গতিতে কিভাবে বিশাল দেশটাকে দখল করে নিচ্ছে? তারা ভাবতে থাকে,  ক্রমে তাদের মনে সংশয় দানা বাঁধে,  বড় কোন বহিঃশক্তি পিছনে থেকে এদের সাহায্য করছে কি? যদি তা-ই হয়, তবে তালেবানের ছ্দ্মাবরণে তারা কি পূর্ববর্তী মুজাহিদ শক্তিকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে? এবং বহিঃশক্তির উপর নির্ভরশীল তালেবানকে এক পর্যায়ে স্তব্ধ করে দিয়ে মুজাহিদদের অসামান্য কুরবানী, আফগান জাতির অবর্ণনীয় ত্যাগ-সাধনা ভূলুণ্ঠিত করে কোন অপশক্তি ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করছে কি? বিশ্বের মানুষ আরো ভাবছে, এত অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ তালেবান কোথায় পাচ্ছে? মাদ্রাসার এই ছাত্ররা অস্ত্র চালনাই বা শিখল কার কাছে? তাদের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশাল যুদ্ধের খরচ বহন করছে কে? এছাড়াও বহুপ্রশ্ন ও অভিযোগ শুনা যাচ্ছে। এখন এর জবাব দেয়ার চেষ্টা করব।

অভিযোগ করে বলা হচ্ছে 'তালেবান' হলো মাদ্রাসার সহজ-সরল ছাত্রের কাফেলা। ইংরেজী  এরা আদৌ জানে না,আধুনিক যুগে কিভাবে এরা রাষ্ট্র চালাবে?

আফগানিস্তানের এক শিক্ষিত লোক অত্যন্ত চিন্তিত অবস্থায় ঘরোয়া আলাপচারিতায় এক পর্যায়ে স্ত্রীকে বললো,আমি ভেবে কুল পাচ্ছি না যে, তালেবানরা আদৌ ইংরেজী জানে না, এরা দেশটাকে চালাবে কিভাবে?

দ্বীনদার, সুশিক্ষিতা ও চটপটে স্মার্ট মহিলা গভীর আত্নবিশ্বাসের সাথে জিজ্ঞেস করলো, প্রিয়তম, বলো, তালেবানরা আফগানিস্তানে কি ও কোন ধরনের আইন জারী করতে চাচ্ছে?

স্বামী বললো, তারা তো ইসলামী আইন জারীর কথা বলছে?

স্ত্রী বললো, তবে! চিন্তার কি কারণ থাকতে পারে? কুরআন, হাদীস ও ইসলামী শরীয়াত সম্পর্কে এই তালেবান ও তাদের বিজ্ঞ শিক্ষকগণই তো সর্বাপেক্ষা ভালো ধারনা রাখেন। ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনায় কেন তাদের সমস্যা হবে? হ্যাঁ, যদি এমন হতো যে, তারা ইংরেজদের আইন কায়িম করতে চাচ্ছে, তবে তা তাদের জন্য সংকটের কারণ হতে পারত। কিন্তু তারা তা চাচ্ছে না, তারা চাচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী রাষ্ট্র চালাতে। তবে কেন তাদের রাষ্ট্র চালাতে অসুবিধা ও সংকটের সৃষ্টি হবে? আমি বিশ্বাস করি,  ইসলামী আইনে অভিজ্ঞ আলিমগণ অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই রাষ্ট্র পরিচালনায় সফল হবেন।

মহাসংকটে নিপতিত থেকেও জনগণের গভীর আস্থা ও ভালোবাসা সম্বল করে তালেবান অত্যন্ত সফলতার সাথে দেশ চালাতে ও আমজনতাকে সন্তুষ্ট  করতে সক্ষম হয়েছে। তারা একদিকে যুদ্ধ করছে অপর দিকে বিজিত এলাকায় দ্রুত শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের সাথে সাথে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় আত্ননিয়োগ করছে। পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধ বিধ্বস্ত কোন দেশে এর নযীর আছে?

তারা যুদ্ধ করছে, একই সাথে বিজিত এলাকায় শক্ত হাতে অপরাধ দমনে এগিয়ে আসছে, শরীয়াত বিরোধী সকল কর্মকাণ্ড নির্মূল করছে, ধ্বংস হয়ে যাওয়া অবকাঠামো নির্মাণে নিয়োজিত রয়েছে, কৃষি উন্নয়নে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে, ভেঙ্গে পড়া অর্থব্যবস্থা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতোর চেষ্টা করছে, ভুল তথ্য প্রচারকারী সংবাদ মিডিয়া ও সমালোচকদের দাঁত-ভাঙ্গা জবাব দিচ্ছে; চৌকস তালেবানদের তৎপর কর্মক্ষমতার ফলে বিশ্ব দরবারে তাদের ভাবমূর্তি প্রতিদিন উজ্জ্বল হচ্ছে। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত একটি কাফেলার এই বিপুল সফলতাকে অবশ্যই কেরামত বলতে হবে। কেননা আধুনিক কালের ইতিহাসে এর দ্বিতীয় কোন নযীর নেই।

তবু সমালোচকেরা বলছে, তালেবানের কাছে এত ভারী ও অত্যাধুনিক অস্ত্র কোত্থেকে আসছে? এসব অস্ত্র এই ছাত্ররা কোথায় চালান শিখেছে?

এদের উদ্দেশ্যে দু'চার কথা বলা দরকার মনে করছি, যা বাস্তব ও শতভাগ সত্য তা-ই বলছি।

সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তানে এত বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ এনে জমা করেছিল যে, তা কল্পনা করাও দুষ্কর ব্যাপার। চৌদ্দ বছর ব্যাপী জিহাদের বিভিন্ন পর্যায়ে মুজাহিদ কমান্ডারগণ অস্ত্রসমূহ বাইতুল মালে জমা না দিয়ে নিজেদের অধিকারে রেখে দেন। তালেবানদের অপ্রতিরোধ্য বিজয়ের সময় ঐসব অস্ত্র তাদের দখলে আসে।

প্রত্যক্ষদর্শী পাকিস্তানের একজন সাংবাদিক ও লেখক আলিম বলেছেন, তালেবানের নেতৃত্বে জালালাবাদ বিজয়ের সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। সেখানের একটি সেনাছাউনি থেকে তালেবানের দেড়শত ট্যাংক হস্তান্তর হয়।আমার এক তালেবান শিষ্য শখ করে আমাকে একটি ট্যাংকে তুলে দেয়। জালালাবাদের ফাঁকা রাস্তা ও ময়দানে চার- পাঁচ মাইল পর্যন্ত তীব্র গতিতে ছুটে চললাম। সে আমাকে বললো, ওস্তাদজী! পৃথিবীর কোন দেশের ট্যাংক ঘন্টায় চল্লিশ মাইলের বেশী গতি সম্পন্ন নয়। কিন্তু রাশিয়ার তৈরী এই ট্যাংকগুলো ঘন্টায় একশত মাইল চলতে সক্ষম। অন্যান্য দেশের ট্যাংক দশ জাম্পার বিশিষ্ট  হয়ে থাকে। রাশিয়ার তৈরী এই ট্যাংকগুলো বিশ জাম্পার বিশিষ্ট।

আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল সামরিক ছাউনী এখন তালেবানের দখলে। তাদের দখলকৃত সকল অস্ত্র বাইতুল মাল - এ জমা করেছে।তালিবানের দখলকৃত এলাকায় কোন বেসামরিক লোকের হাতে এখন আর অস্ত্র নেই। যারা অভিযোগ করছেন, তালেবানরা অস্ত্র পেল কোথায়? এবার তারাই বলুন, কোথা থেকে অস্ত্র এসেছে তালেবানের হাতে।

এবার আসুন তালেবানরা কিভাবে অস্ত্র চালান শিখেছে সে প্রসঙ্গে। আফগানীদের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যাদের সামান্য ধারনা আছে, অবশ্যই তারা এ ধরনের অভিযোগ করবে না। তারা জানে, বয়ঃপ্রাপ্ত প্রতিটি আফগানীকে বাধ্যতামূলক দু'বছর সামরিক ট্রেনিং গ্রহণ করতে হচ্ছে। রুশ আগ্রাসনের পর থেকে মুজাহিদ কমান্ডারদের নেতৃত্ব এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এইসব ব্যবস্থার অধীনেই তালেবানরা অস্ত্র চালাতো শিখেছে। আজ পর্যন্ত আঠারটি বছরের মধ্যে চৌদ্দটি বছর যারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তি রাশিয়ার মুকাবিলায় যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে তাদের কি সামরিক ট্রেনিং নিতে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে হবে বা বিদেশী ওস্তাদ- বিশেষজ্ঞ ডেকে আনতে হবে? বরং যুদ্ধজয়ের কৌশল শিখতে হলে তালেবানের কাছেই সবাইকে  যেতে হবে। তারাই এ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিজয়ী শক্তি।

তবে যারা একেবারেই তরুণ,  যুদ্ধে অংশ গ্রহণের অনুমতি যারা কেবল পেয়েছে, তারা জরুরী ভিত্তিতে মাত্র কয়েকদিনে অস্ত্র চালান শিখে নিচ্ছে।

ঐ সাংবাদিককে এক মাদ্রাসা ছাত্র কমান্ডার- ট্রেনিংক্যাম্পে অবস্থানকালীন সময়ে বলেছে, আমি মাত্র সাত দিনে ট্যাংক চালাতো শিখেছি। সে তাঁকে ট্যাংক চালিয়ে দেখিয়েছে। সেই যুবকের সাহস ও দক্ষতা দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ঐ সাংবাদিক। তবে যুদ্ধ- বিমানের অধিকাংশ পাইলট জহির শাহ আমলের নিয়োগ-প্রাপ্তদের মধ্যে  যারা অকম্যুনিষ্ট ছিলো তারা। আমল- আখলাক,  আচার-ব্যবহার ও পোষাক-পরিচ্ছেদে এরা এখন ইসলামে নিবেদিত সম্পূর্ণ মুসলমান।

অনেককে আবার বলতে শেনা যায়, তালেবানযুদ্ধের এই বিশাল ব্যয়ভার কে বহন করছে? গরীব আফগানীদের পক্ষে বিশাল দেশব্যাপী রক্তক্ষয়ী এই বিস্তৃত যুদ্ধ পরিচালনার বাইরের কোন শক্তির সাহায্য তারা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

এবার দেখা যাক তারা খাদ্য- বস্ত্র কোথায় পায়।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখিত সাংবাদিক তালেবান নেতৃবৃন্দের কাছে প্রশ্ন করলে তারা জানান, আমরা তালিবে ইলম- মাদ্রাসা ছাত্র। আফগান সমাজে নিয়ম রয়েছে, মাদ্রাসার ছাত্ররা এলাকার প্রত্যেক মুসলিম পরিবারের নিকট থেকে সামর্থ্যনুযায়ী চাঁদা বাবদ রুটি- তরকারী পেয়ে থাকে। এই রুটি খেয়ে তারা দিন যাপন করে। তালেবান সরকারের প্রত্যেক গভর্নরও এই নিয়মে মহল্লা থেকে খানা- খাদ্য সংগ্রহ করে থাকেন। এর সত্যতা সম্বন্ধে তখন আমি নিশ্চিত হয়েছি, যেদিন লোগার প্রদেশের গভর্নর মৌলভী আব্দুল করীমের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়।সে বলেছে, গত বছর বকরা ঈদের দিন প্রথম যখন আমরা এখানে আসি, তখন আমাদের নিকট খাবার কিছুই ছিল না। ফলে আমরা মহল্লা থেকে চাঁদা চেয়ে লোক পাঠালাম। একদিনের কয়েকটি পুরাতন রুটি তারা আমাদের জন্য পাঠিয়ে দিল। তা-ই খেলাম। আল-হামদুলিল্লাহ, হেরাতে বিজয়ের পর আমাদের এই কঠিন খাদ্য ও আর্থিক সংকট দূর হয়েছে। এখন আমাদের না খেয়ে থাকতে হয় না। খাওয়ার জন্য কিছু না কিছু জুটে যায়।

লোগারের গভর্নরের কথা নিঃসন্দেহে সত্য ছিল।সাংবাদিক বলেন, কেননা এর কিছুদিন পর আমরা এক প্রতিনিধি দল সহ ফারাহ গিয়েছিলাম। তখন এ প্রদেশটি বিজয় হয়েছে মাত্র। সিশানডান্ডের বিমান ঘাঁটিও তালেবানের দখলে এসে গিয়েছিল। প্রতিনিধি দলের সাথে পাকিস্তানের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব মাওলানা মুফতী নিজামুদ্দিন ও মুফতী আব্দুর রহীম সাহেবের পিতাও ছিলেন। রাতের খানার জন্য তালেবান মুজাহিদরা যে রুটি আমাদের সামনে রাখে তা ছিল আটার ভূষি দিয়ে তৈরি, অত্যন্ত শক্ত। মনে হচ্ছিল, এগুলো আট-দশ দিন আগের তৈরী। আমরা অতি কষ্টে তা- চিবিয়ে খেলাম। দ্বিতীয় দিন দুপুরের সময়েও ঐ ধরনের রুটি নুন-চা দিয়ে কোন রকম খেয়ে নিলাম। অনেক তালেবানের ভাগ্যে এই ভূষার রুটিও জোটে না।আমাদের গাড়িটি নতুন ছিল, নতুন গাড়ি দেখে ক্ষুধার্ত তালেবানরা কাছে এসে জিজ্ঞেস করত, খাবার কিছু আছে কিনা, থাকলে দাও, আমরা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত।

কিছুদিন পর খানা-খাদ্যহীন কপর্দকশূন্য তালেবানের হাতে কিছু ট্যাক্স ও খাজনা আসতে থাকে। হেরাতের সীমান্ত দিয়ে উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে আমদানীর মালামাল পরিবহন করা হত। এরপর কান্দাহার বিমান বন্দরে ব্যবসায়ীরা দুবাই থেকে মালামাল আনা- নেওয়া শুরু করে। এ থেকে কিছু ট্যাক্স তারা পেতে থাকে। এভাবে তালেবানরা পরনির্ভর না হয়ে নিজ চেষ্টা ও উদ্যোগে সামগ্রিক সংকট দূর করতে সচেষ্ট রয়েছে। এখন তাদের খাদ্য-সংকট নেই বললেই চলে। শেষ কথা হলো এবং এটাই চরম সত্য যে, তালেবানরা জুটলে খায় এবং শোকর করে, না জুটলে তুষ্ট মনে ধৈর্য অবলম্বন করে। বেতন ভাতাহীন স্বেচ্ছাসেবী ও যুদ্ধবিজয়ী এই অপ্রতিরোধ্য কাফেলা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ইসলামের প্রথম যুগের উজ্জ্বল সোনালী ইতিহাস।

অনেকে আবার এক কাঠি এগিয়ে জায়িয- না জায়িযের প্রশ্ন তুলে বলে, এক মুসলমানের সাথে অপর মুসলমানের পরস্পরে যুদ্ধ করা জায়িয আছে? তালেবানরা পূর্ববর্তী জিহাদকালীন সময়ের মুজাহিদ কমান্ডারদের মুকাবিলায় কেন যুদ্ধ করছে?

অনেকের কাছে প্রশ্নটি জটিল মনে হতে পারে। তবে যারা আফগানিস্তানের তালেবান আবির্ভাব পূর্ববর্তী সময়ের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত, তারা চট করে এর উত্তর দিয়ে ফেলবেন। কিন্তু আমরা এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দেওয়াসহ কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করতে চাচ্ছি।

তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের সাথে সংঘাতে জড়াতোর আগ্রহ আদৌ তালেবানের ছিল না। সরকারকে সংশোধনের বহু চেষ্টা তারা করেছে। তালেবানরা বিশ্বাস করে, ষোল লক্ষ আফগানীর জীবন কুরবানী দেওয়ার উদ্দেশ্য কোন দলকে ক্ষমতায় বসান ছিলো না। বুরহানুদ্দীন, মাসউদ ও হেকমতিয়ারকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর আসনে সমাসীন করার জন্য তারা চৌদ্দ বছর যুদ্ধ করে নি। তারা জিহাদ ও যুদ্ধ করেছিল কুফরী শক্তির পরাজয় ঘটিয়ে দেশে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে চরম ব্যর্থতা ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।

তালেবান লক্ষ্য করল, বর্তমান নেতৃত্বের হেয়ালীপনা ও ভুল সিদ্ধান্তের ফলে জনসাধারণের মনের আকাঙ্ক্ষা ভেস্তে যাচ্ছে। মুজাহিদদের অসামান্য বিজয়ের বিপুল সাফল্য ও সম্ভাবনা এদের হাতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বুরহানউদ্দীন-হেকমতিয়ারের পারস্পরিক যুদ্ধ-সংঘাত মুজাহিদদের স্বপ্নের সৌধ ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিচ্ছে। সংকট দিন দিন ঘনিভূত হচ্ছে। এদের অপতৎপরতায় পবিত্র জিহাদ কলঙ্কিত হচ্ছে। এদের ভ্রষ্ট পররাষ্ট্রনীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার ফলে আফগানিস্তানের উপর আগ্রাসী কম্যুনিস্টদের অপচ্ছায়া ও ভারত-রাশিয়ার অনাকাঙ্খিত মাতব্বরি ও অনধিকার চর্চা স্পষ্ট লক্ষ করা যাচ্ছিল। জনগণ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছিলো,  যে হায়েনাদের দীর্ঘ চৌদ্দ বছর ব্যাপী নির্মম অত্যাচার ও ধ্বংস তান্ডবে আমাদের ষোল লক্ষ তাজা প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো, সেই ঘাতক ও তার দোসরদের সাথে এখনই তাদের এত মাখামাখি কেন! জনগণ ভেবে পেরেশান হচ্ছিলো,  আমরা দ্বিতীয় কোন ষড়যন্ত্র -জালে আটকা পড়ে যাচ্ছি না তো! দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি ঘটছিলো। দেশ থেকে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা উধাও হয়ে গিয়েছিলো। বুরহানুদ্দীন, হেকমতিয়ার ও মাসুদের কমান্ডারগণ নিজ নিজ এলাকার মালিক মোখতার হয়ে দাঁড়াল। অজস্র অত্যাধুনিক অস্ত্র তাদের নিকট ছিল। জনগণের হাতে হাতে অস্ত্র দেখা যাচ্ছিল। লুট, চুরি, ডাকাতী, রাহাজানী, ছিনতাই ও নারীর সম্ভ্রমহানীর ঘটনা প্রচন্ডভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিলো। আম - জনতা অস্ত্রবাজদের নিকট সম্পূর্ণ জিম্মী হয়েছিল। এই ভয়াবহ অসহ্যকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য কেউ কি তাদের দিকে এগিয়ে আসবে না? একটি সম্ভাবনাময় বিজয়ী জাতি কি লম্পট- লুটেরাদের হাতে লুণ্ঠিত ও ধর্ষিতা হয়ে গুমরে কেঁদে কেঁদে বিলুপ্ত হয়ে যাবে?

জাতির এমন দুর্বিষহ ও কঠিন সময়ে ঘুরে দাঁড়াল তালেবান। একজন মাদ্রাসা প্রধানের নেতৃত্বে সংগঠিত হলো কিছু জানবাজ মুজাহিদ ছাত্র। তারা দেশকে ডাকাত,  লুটেরা ও লম্পটদের দখল থেকে মুক্ত করার জন্য বলিষ্ঠ শপথে,  কঠিন প্রত্যয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ হলো।দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে অপারেশন শুরু হলো। অপরাধীকে বন্দী করে বিচারের ব্যবস্থা করা হলো।এভাবে শান্তি ও নিরাপত্তার অন্বেষায় শুরু হলো এক নতুন অভিযান।

তালেবানরা আগে কোন নেতা ও নেতৃত্বের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েনি। প্রথম তারা নেতাদের নিকট পয়গাম পাঠিয়েছে, আপনারা নিজ এলাকায় ইসলামী আইন জারী ও জননিরাপত্তা - শৃঙ্খলা ব্যবস্থা করুন। তারা অত্যন্ত ব্যথা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শান্তির স্বপক্ষে থেকে আঞ্চলিক নেতাদের নিকট দরদী মন নিয়ে আলিমদের প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে উপরোক্ত পয়গাম পেশ করেছে এবং সর্বশেষ পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক নেতাদের চরম স্বেচ্ছাচারিতা ও ব্যর্থতার ফলে তারা বলেছে, শান্তি, শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার স্বার্থে তোমাদের সকল অস্ত্র আমাদের নিকট আমানত রেখে দাও। নেতৃত্ব তোমাদের হাতেই থাক। তবে তোমাদের নিজ এলাকায় অবশ্যই শরীয়তের আইন সম্পূর্ণরুপে কায়িম করতে হবে।কেননা আফগান জিহাদের অঙ্গীকার ও উদ্দেশ্য এটাই ছিল। এ ব্যাপারে কারো শৈথিল্য জাতি আর এক মুহূর্ত বরদাশত করবে না।

তারা আরো বলেছিলো, তোমাদের হাতের অস্ত্রগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা থাকবে। তালেবানের এ প্রস্তাব যদি অন্যান্যরা গ্রহণ করত,  তবে তাদের সাথে যুদ্ধ করার আদৌ প্রয়োজন ছিলোনা।

তালেবানরা যুদ্ধে আগ্রহী ছিল না আদৌ। তারা শান্তির অন্বেষায় উদগ্রীব ছিল। আলিমদের প্রথম প্রতিনিধি দলের প্রস্তাব গ্রহণে তারা ব্যর্থ হলে পুনরায় দ্বিতীয় প্রতিনিধি পাঠিয়ে তাদেরকে পয়গাম গ্রহণ করে নিতে অনুরোধ করা হত। যেখানে তালেবানের প্রস্তাব ও অনুরোধ গৃহীত হয়েছে, সেখানে পারস্পরিক যুদ্ধ কেউ কল্পনাও করেনি। যুদ্ধ তখনই হয়েছে, যখন তালেবানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কেবল সে ক্ষেত্রেই তালেবান ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুলুম- ফাসাদ নির্মূলে অবাঞ্চিত নেতৃত্বের মুকাবিলায় যুদ্ধে লড়েছে। প্রায় সর্বক্ষেত্রে যুদ্ধের ফলাফল তালেবানের পক্ষে এসেছে।

এ ক্ষেত্রে যে অভিযোগটি বিরাট আকারে উত্থাপন করা হচ্ছে যে, যাদের সাথে যুদ্ধ করা হচ্ছে তারা মুসলমান এবং পূর্ববর্তী মুজাহিদ দল।অতএব তাদের সাথে তালেবানের সংঘাতে লিপ্ত হওয়া কি ঠিক হয়েছে?

যাদের মনে এখতো এ ধরনের প্রশ্ন উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে, তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যারা ইসলামের আবেদন ও মুসলমানের আকাঙ্ক্ষা ভুলুন্ঠিত করে দ্বীন ও ঈমান বিক্রি করে দেয়, যাদের কাছে আল্লাহর আনুগত্যের চেয়ে ক্ষমতার মসনদ কাঙ্ক্ষিত হয়ে দাঁড়ায়, যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভুলে গিয়ে পার্থিব স্বার্থে আকুণ্ঠ নিমজ্জিত হয়, জাতি যাদেরকে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন করার অপরাধে প্রত্যাখ্যান করেছে, যাদের চরম ব্যর্থতার ফলে দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে ফেতনা- ফাসাদের উদ্ভব ঘটেছে তাদের ক্ষমতায় থাকার কি অধিকার আছে? আফগানিস্তানে যা ঘটেছে ও ঘটছে তা এই অসহনীয় পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া মাত্র। সময়ের অনিবার্য দাবী এটাই ছিল।

আহমাদ শাহ মাসউদ, হেকমতিয়ার,  বোরহান উদ্দীন রব্বানী মুসলমান বটে,  তবে তাদের চারিত্রিক স্খলন ও নৈতিক দুর্বলতা ছিল নীতিভ্রষ্ট ইয়াজিদ, হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ, আবু মুসলিম খোরাসানী ও খলিফা মনসুরের অনুরুপ।

এরা আল্লাহর বিধান ও অঙ্গীকার উপেক্ষা করে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নিষ্পাপ মুসলিমকে বলির পাঠার ভূমিকায় নিক্ষেপ করেছিল। কুরআনের হাফেজ ও আলিম ওলামাকে নির্বিবাদে হত্যা করেছিল, ক্ষমতার মসনদ নিষ্কন্টক রাখার জন্য, ক্ষমতা পাকা করার জন্য কুফরী শক্তির সহযোগিতা ও আশ্রয় নিয়েছিল এরাই। বড় জঘন্য এদের প্রবৃত্তি। ইতিহাস এদের কালো তালিকায় চিহ্নিত করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয়নি।

সবাই জানে, এরা তালেবানকে জব্দ করার জন্য আফগানের মাটিতে অনুপ্রবেশ করার আহ্বান জানিয়ে ছিলো ভারত, রাশিয়া, তাজিকিস্তান ও তুর্কি সৈন্যদেরকে। তালেবান রাশিয়ার যে অস্ত্র বোঝাই বিমান অবতরণে বাধ্য করেছিল, সে অস্ত্র তারা এনেছিল তালেবানকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য নয় কি? ভারতীয় পাইলট,  সেনা সদস্য ও অন্যান্য ভারতীয় সামরিক সরঞ্জাম যা তালেবান  কাবুলে জব্দ করেছে, তা কি কুফরী শক্তিকে প্রশ্রয় দেয়ার স্পষ্ট দলীল নয়? ইরানের মিসাই ও যে সব সেনা সদস্য ধরা পড়েছে তা কি গভীর ষড়যন্ত্রের পূর্বাভাস নয়? রুশ প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন পার্লামেন্টে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিল, রব্বানী সরকার আমাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সহযোগী শক্তি। প্রথমেও এর প্রতি আমাদের নৈতিক সমর্থন ছিল, আগামীতেও সে সমর্থন অব্যাহত থাকবে। এর দ্বারা স্পষ্ট প্রতিভাত হয়, রব্বানী সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও একটি বারের জন্য দেশে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার সামান্য আন্তরিকতার পরিচয় দেন নি কেন। আফগানিস্তানকে কোন আঁধারে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিলো রব্বানী।

ভারত নিজে স্বীকার করেছে, তার বিমান কাবুল বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিলো। কেন এসেছিল ভারতীয় বিমান?

বিবিসি বলেছিল, ইরানের অস্ত্র বোঝাই বিমান প্রতিদিন বাগরাম বিমান বন্দরে অবতরণ করছে। যুদ্ধ- বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে অস্ত্রের চালান এনে কি কান্ড ঘটাতে চেয়েছিল তারা? রব্বানীর মতলব কি ছিলো? ইসলাম ও মুসলিম শত্রুতায় বিশ্বখ্যাত এ সব অপশক্তির সহযোগিতা নিয়ে কি করতে চাচ্ছিল মাসুদ - রব্বানী? এসব ঘটনার পরে কিভাবে কোন যুক্তিতে আপনি রব্বানী হুকুমতকে মুসলমানের সঠিক নেতৃত্বদানকারী সরকার বলবেন?

ইয়াযীদের বিরুদ্ধে হযরত হুসাইন (রাঃ) এর স্বশস্ত্র মুকাবিলা যদি শরীয়তে জায়িজ হয়ে থাকে, তবে কোন যুক্তিতে বলা হবে যে,  তালেবানের এ যুদ্ধ বৈধ নয়?

- বাকী কথা আগামী সংখ্যায়