JustPaste.it

আমরা যাদের উত্তরসূরি

-আল্লামা শাহ আহমদ উসমানী রহঃ

অনুবাদঃ মোহাম্মদ সালমান।

==============================================================

          আরাম-আয়েশ মানব জীবনের সবচাইতে বড় শত্রু। এটা হতে পারে যে, সাপ মানুষের সবচেয়ে বড় দুশমন হওয়া সত্ত্বেও যদি কোন সময় মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করে বসে এবং তাকে দংশন করা থেকে বিরত থাকে বা এরকম হতে পারে যে বিষ তার উপর কোনো প্রতিক্রিয়া করে নাই এবং মানুষ বিষ পান করার পরেও বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু কোনো কওম এবং গোষ্টি আরাম-আয়েশ এবং আরম্ভর প্রিয়তার মধ্যে ডুবে গেলে, কঠোর পরিশ্রম করে এবং সাধারণ জীবনযাপন থেকে দূরে সরে গেলে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে কোনরকম সম্মানের জীবন দান করেন না। আরাম প্রিয়তা এবং মানব জীবনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। জীবনের জন্য আরাম-আয়েশ তালাশ করা মানুষের জন্য এক চিকিৎসা বিহীন রোগ এবং আরাম-আয়েশের উপস্থিতি মানুষের ইজ্জত এবং সম্মানের জন্য মওতের পয়গাম সরূপ। উপরে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত বাক্যগুলি বলে ছিলেন খ্যাতনামা দার্শনিক আলিম এবং চিন্তাবিদ আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী।

জন্ম:

          শাইখুল ইসলাম মাওলানা সাব্বির আহমেদ উসমানী ১৩০৫ হিঃ ১০শে মুহাররম মোতাবেক ১৮৮৭ইং। সারে বিজনৌরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হযরত মাওলানা ফজলুর রহমান।হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু পর্যন্ত তার বংশ পরস্পরায় মিলিত হবার কারণে তিনি তার নামের শেষে ওসমানী শব্দ ব্যবহার করেন। মাওলানা ফজলুর রহমান ঐ সময় বিজনৌর শিক্ষা বিভাগের ডেপুটি ইন্সপেক্টর ছিলেন। তিনি সে যুগের খ্যাতনামা ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ছিলেন। দিল্লি কলেজের অধ্যাপক মাওলানা মামলুক আলীর নিকট থেকে তিনি বিশেষ সুবিধা লাভ করেন। হযরত মাওলানা ফজলুর রহমান এই কলেজের ডিগ্রীপ্রাপ্ত ছিলেন। ফারসি ভাষায় তার প্রচুর দখল ছিল এবং এ বাসায় তিনি প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছিলেন। কর্মজীবনে তিনি ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট এর অধীনে শিক্ষা বিভাগে চাকরি করতেন এবং শেষের দিকে ডেপুটি ইন্সপেক্টর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চাকরি জীবন শেষে দ্বীনি এবং ইলমি কাজে নিজেকে জড়িত রাখেন এবং বিশেষ করে হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা মোঃ কাশেম নানুতুবী রহমতুল্লাহি এর সাথে বিশ্ব বিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলেন। ১২৮৩ থেকে ১৩২৫ পর্যন্ত দারুল উলুম এর উন্নতিকল্পে জীবনকে ওয়াক্ফ করে দেন। হযরত মাওলানা হাবিবুর রহমান ওসমানী এবং মুফতি আজিজুর রহমান তারই অপর দুই সুযোগ্য পুত্র।

শিক্ষা:

          দেওবন্দের জনাব হাফেজ মোহাম্মদ আজম সাহেবের নিকট ছয় বছর বয়সে হযরত মাওলানা সাব্বির আহমদ উসমানীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় এরপর ১৩১৫ হিজরীতে তিনি দারুল উলুমে উর্দু ফার্সি পড়া শুরু করেন। ১৩১৮ হিজরীতে তার আরবি পড়া শুরু হয় এবং দারুল উলুমের তৎকালীন খ্যাতনামা ওস্তাদগন এর নিকট পড়াশোনা করেন। হযরত ওসমানী ছিলেন খুবই ধীশক্তি সম্পন্ন। প্রতি ক্লাসেই তিনি প্রথম হতেন এবং শতকরা নিরানব্বই নম্বর পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতেন। ১৩২৫ হিজরীতে কোরআন হাদিস এবং বিভিন্ন শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান নিয়ে তিনি দাওরায়ে হাদিস (টাইটেল) পাস করেন। শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান হযরত মাওলানা গোলাম রসুল সাহেব হযরত মুফতি আজিজুর রহমান সাহেব হযরত মাওলানা মুরতাজা হাসান চাঁদপূরী এবং হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আহমদ সাহেব প্রমুখ বিখ্যাত আলেম তার ওস্তাদ ছিলেন।

বিবাহ:

          হযরত মাওলানা সাব্বির আহমেদ উসমানী তার জীবনে ১৯০৫ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি চিরজীবন নিঃসন্তান ছিলেন। এজন্য নিজের আত্মীয় স্বজনদের আওলাদেরকে এবং বিশেষ করে মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে নিজের সন্তানের মত দেখতেন এবং তাদের খুবই মহব্বত করতেন।

অধ্যাপনা:

          দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে কোরআন হাদিসে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পর আল্লামা ওসমানী তার অর্জিত জ্ঞান গবেষণাকে আদর্শ আলিম তৈরির উদ্দেশ্যে ব্যয় করার জন্য অধ্যাপনার মহান দায়িত্বকে বেছে নেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই খুবই ধীশক্তি সম্পন্ন ছিলেন এবং ছাত্র জীবন থেকেই তিনি অন্যান্য ছাত্রদের পড়াতেন। ছাত্ররা তার কাছ থেকে কিতাব বুঝার জন্য ভিড় জমাতো। এজন্য মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি সকলের নিকট পরিচিত ছিলেন। ১৩২৫ হিজরীতে দারুল উলুমে লেখাপড়া শেষ করার পর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাদের যোগ্য সাগরিদকে তার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিয়ে তাকে ১৩২৬ হিজরীতে দারুল উলুমে অধ্যাপক নিযুক্ত করেন। এ সময় তিনি সিনিয়র অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনা শুরু করেন।

মাদ্রাসা ফতেহচুরিতে:

          হযরত মাওলানা উসমানী দারুল উলূম অধ্যাপনা শুরু করার পর দিল্লির বিখ্যাত মাদ্রাসার জন্য একজন যোগ্য প্রধান শিক্ষকের প্রয়োজনের কথা জানিয়ে মৌলভী আব্দুল আহাদ সাহেব দেওবন্দের তৎকালীন মুসলিম জনাব হযরত মাওলানা হাবিবুর রহমান সাহেব ওসমানীর নিকট আকুল আবেদন জানান। মুহতামিম সাহেব যিনি হযরত ওসমানীর বড় ভাই ছিলেন। তিনি তাকে এ পদের জন্য যোগ্য মনে করে ফতেহচুরী মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেন। ১৩২৮ হিজরী পর্যন্ত তিনি সেখানে হাদিস এবং তাফসীরের দারস দেন। এসময় আল্লামা ইব্রাহীম বিয়াভীও মাদ্রাসার অধ্যাপক হয়ে আসেন। মাওলানা ওসমানী বক্তৃতা ও কলমের মাধ্যমে এবং অধ্যাবসায় অল্প সময়ের মধ্যে সুধীসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

পুনরায় দেওন্দে:

          আল্লামা সাব্বির আহমাদ উসমানীর মত সুদক্ষ আলিমের প্রয়োজন ছিল এশিয়ার আল-আজহার দারুল উলুম দেওবন্দের। এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেই মজলিসে শুরায় মাওলানাকে দারুল উলুম ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে তিনি ১৩২৮ হিজরীর প্রথম দিকে পুনরায় দারুল উলুমে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এবং উপরের দিকে কিতাব পড়া শুরু করেন।১৩৩৮ হিজরীতে হযরত শাইখুল হিন্দ হজে যাওয়ার পর আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী হযরত শাইখুল হিন্দ এর স্থলাভিষিক্ত এবং প্রধান অধ্যাপক মনোনীত হন। তিনি বুখারী ও তিরমিজী পড়ানো শুরু করেন। তখন হযরত মাওলানা সাব্বির আহমদ সাহেব মুসলিম শরীফ পড়াতেন। এভাবে হযরত শাইখুল হিন্দ এর উপস্থিতিতে ওসমানী সাহেব সাত আট বছর হাদিস অধ্যাপনা করে আসছিলেন। তিনি সাধারণত মুসলিম এবং আবু দাউদ শরীফের দারস দিতেন। ঐ সময় হযরত শাইখুল হিন্দের পরে এই দুই ব্যক্তিত্বই হাদীস শাস্ত্রের এসব বিখ্যাত কিতাবের দারস দানের বেশি যোগ্য ছিলেন বলে মনে করা হয়।

আল্লামা ওসমানী প্রথম জীবনে দর্শন এবং ইলমে কালাম মোতাবেক ফালসাফা প্রভৃতি শাস্ত্রের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন। পরে আস্তে আস্তে কোরআন এবং হাদিসের দিকে দৃষ্টি দেন। এবং শেষ জীবনে কোরআন এবং হাদিসের দরস তাদরিস এবং গবেষণায় কাটিয়ে দেন।

ডাবেলের জামিয়া ইসলামিয়া:

          আল্লামা উসমানী দারুল উলুম দেওবন্দের খুবই সুনামের সাথে অধ্যাপনায় রত ছিলেন, কিন্তু ঐ সময় দুর্ভাগ্যক্রমে মাদ্রাসার কয়েকজন খ্যাতনামা ওস্তাদের সাথে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। যার ফলে আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী, মাওলানা বদরে আলম মিরাঠী, মাওলানা সিরাজ আহমদ, মাওলানা হিফযুর রহমান, মুফতি আতিকুর রহমান এবং আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী প্রমূখ ওলামায়ে কেরাম গুজরাটের ডাভেল জামিয়া ইসলামিয়ায় গমন করেন। মাদ্রাসায় পূর্বনাম ছিল "তালিমুদ্দিন" অল্প সময়ে দলের ক্ষুদ্র মাদ্রাসাটি একটি উন্নতমানের মাদ্রাসায় পরিণত হয় এবং ঐ এলাকায় শিরিক,বিদআত এবং বদ-দ্বীনি,রুসুম-রেওয়াজ দূরীভূত হয়। ১৩৪৬ হিজরীতে এ মাদ্রাসাতেও শাহ কাশ্মীরিই বুখারী এবং তিরমিজী পড়াতেন। এবং হযরত উসমানী মুসলিম শরীফ বাইযাবি এবং তাফসীরের কিতাব পড়াতেন। ১৩৫২ হিজরীতে হযরত আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি ইন্তেকাল করলে মাওলানা ওসমানী শাইখুল হাদিস নিযুক্ত হন এবং বুখারী তিরমীজির দরস দেওয়া শুরু করেন। ডাভেলের অবস্থানকালে তিনি মাদ্রাসার অধ্যাপনার সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকায় সফর করতেন এবং ওয়াজ-নসিহত এর মাধ্যমে তাবলীগের দায়িত্ব আদায় করতেন।

পুণরায় দেওবন্দ:

          দারুল দেউবন্দ থেকে আল্লামা শাহ কাশ্মিরী এবং মাওলানা সাব্বির আহমদ উসমানী সহ কতিপয় খ্যাতনামা ওলামায়ে কেরাম ডাভেল মাদ্রাসায় চলে যাওয়ার পর শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী র.কে শাইখুল হাদিস নিযুক্ত করা হয়। আর এটা বাস্তব যে শাহ্ সাহেব এবং উসমানী সাহেবের চলে যাওয়ার পর শাইখুল হাদিস পদের জন্য হযরত মাদানীর উত্তম আর কোন ব্যক্তিত্বের আশা করা মুশকিল ছিল। কিন্তু দারুল উলুম দেওবন্দের মত ইউনিভার্সিটির জন্য আল্লামা উসমানীর মত খ্যাতনামা সকল বিষয়ে দক্ষ ও যোগ্য আলীমের অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।

          এবং এই ব্যাপারটি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তীব্রভাবে অনুভব করেছিল। অবশেষে মাদ্রাসার তৎকালীন পৃষ্ঠপোষক হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহঃ এবং মজলিশে শুরার আরো কয়েকজন সদস্য আপ্রাণ চেষ্টায় হযরত মাওলানা উসমানী দারুল উলূমের সদর মোহতামিমের পদ গ্রহণ করতে রাজি হন। মোটকথা ১২৫৪ হিঃ মোতাবেক ১৯৩৯ ইং তাকে সদর মুহতামিম বানানো হয়। ঐ সময় তিনি ডাবেল মাদ্রাসার দায়িত্বেও ছিলেন এবং দারুল উলুমেরও দেখাশুনা করতেন। তিনি এ পদে ১৩৬২ হিজরী মোতাবেক ১৯৪৪ইং পর্যন্ত সমাসীন ছিলেন।

          দেউবন্দে তৎকালীন মুহতামিম হাকীমুল ইসলাম হযরত মাওলানা ক্বারী মোঃ তৈয়ব সাহেবের যুগ দারুল উলুমের সোনালী যুগ! তা সত্ত্বেও আল্লামা ওসমান এর মত ব্যক্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তাকে দারুল উলুম সদর মোহতামিম বা ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করা হয়। হযরত ওসমানীর আমলে দারুল উলুম এর বহু উন্নতি সাধিত হয়।

দেওবন্দে স্থায়ীভাবে অবস্থান:

          দারুল উলুম দেওবন্দের সদর মুহতামিম পথ গ্রহণ করার পর মজলিশে শুরা সদস্য গনের ইচ্ছা ছিল যে হযরত ওসমানী স্থানীয়ভাবে দারুল উলুমে অবস্থান করুক। কিন্তু যেহেতু তিনি ডাভেল মাদ্রাসায়ও দায়িত্বে ছিলেন। এজন্য বেশিরভাগ সময়ে তাঁকে ডাভেলে থাকতে হয়। দারুল উলুম এর দায়িত্ব গ্রহন করার ছয় বছর পর তিনি ডাভেল থেকে বিদায় নিয়ে স্থায়ীভাবে দারুল উলুমে চলে আসেন।

পুনরায় ডাভেলে:

          দারুল উলুমের সদর মোহতামিম হওয়ার পর বিভিন্ন অসুবিধার কারণে বিরক্তি হয়ে ১৩৬২হিঃ শাবান মাসে তিনি এই পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর ১৩৬২ হিঃ ১৯৪৪ইং ২৪শে রবিউল আওয়াল থেকে ডাভেলের মাদ্রাসার পুনরায় হযরত ওসমানীর দ্বারা শুরু হয়। ১৩৬৩ হিজরীর শাবান মাসে ডাভেল থেকে কোন কাজে দেওবন্দ আসলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক বছর অসুস্থ অবস্থায় দেওবন্দে কাটান।

আল্লামা ওসমানীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা:

          উপমহাদেশের মুসলমানদের সাথে তুরস্কের খুবই সৎভাব ছিল। এজন্য ১৩৩০ হিজরী মোতাবেক ১৯১২ সালে বলকান যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় মুসলমানগন খুবই ক্ষুব্ধ হয় এবং ওলামায়ে দেওবন্দ এই ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান রঃ দারুল উলুমের ছাত্র এবং অধ্যাপকগণ এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আল্লামা ওসমানী যেহুত দারুল উলূমের সুযোগ্য ছাত্র এবং পরবর্তী জীবনে খ্যাতনামা অধ্যাপক আলেম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন এ সূত্রে তিনিও নীরব ভূমিকায় থাকেন্নি। বরং আস্তে আস্তে ১৩৩১ হিঃ এর প্রারম্ভ থেকে তিনি রাজনীতির ময়দানে পদচারণা শুরু করেন। তুরস্কের হিলালে আহমার বা রেডক্রস সোসাইটির সাহায্যের জন্য তিনি ব্যাপক প্রচেষ্টার পর বেশ কয়েক হাজার টাকা সংগ্রহ করে দেন।

          হযরত শাইখুল হিন্দের দীর্ঘ চার বছর কারাভোগের পর ১৯২০সালে ভারতে ফিরে আসার পর থেকে মাওলানা ওসমানী সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। এই সময় উপমহাদেশের রাজনীতির ময়দান খুবই উত্তপ্ত। খেলাফত আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। ইংরেজ শাসকদের ভিতর নড়বড়ে হয়ে উঠেছিল। এ সময় হযরত শাইখুল হিন্দ অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে কোরআন হাদিসের আলোকে একটি ফতোয়া জারি করেছিলেন। আর এ ফাতওয়াটি তৈরি করেছিলেন আল্লামা ওসমানী। এ ফাতওয়াটি আগুনের উপর ঘি ঢেলে দেওয়ার কাজ করে।

          মাল্টা জেল থেকে ফিরে আসার পর হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান বৃদ্ধ বয়সে মাওলানা ওসমানী কে সাথে নিয়ে ভারতের বড় বড় শহরগুলোতে সফর করেন এবং বক্তৃতা করেন। এসব জলসায় হযরত ওসমানী শাইখুল হিন্দের মিশন কে এগিয়ে নিয়ে যেতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। অসহযোগ আন্দোলন এবং খেলাফত আন্দোলন সহ মুসলমানদের সকল প্রতিষ্ঠানে ইংরেজদের চক্ষুশূল হয়ে দাড়ায়। এজন্য তখনই একটি স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য মাওলানা মোহাম্মদ আলী জাওহারের নেতৃত্বে কাজ করতে হয়। এবং এটি আলীগড়ে স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এবং আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির কিছু ছাত্র এ অগ্রণ্য সাহসী ভূমিকা পালন করে। জামিয়া মিল্লিয়া নামে এ ভার্সিটির উদ্বোধন করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় হযরত শাইখুল হিন্দকে। অসুস্থ অবস্থায় শাইখুল হিন্দ আলীগড়ে যে জামিয়া মিল্লিয়া উদ্বোধন করে বটে। তবে তার অসুস্থতার কারণে আল্লামা ওসমানী উদ্বোধনী ভাষণ দেন জামিয়া মিল্লিয়া কে পরে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়।

          আল্লামা উসমানী ১৯৪৯ সালে থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ এর সাথে জড়িত ছিলেন। এবং দেশকে স্বাধীন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। তিনি জমিয়তে কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। জমিয়তের কোন কোন কাজের ব্যাপারে নীতিগতভাবে তার বিরোধও ছিল। বিশেষ করে হিন্দুদের সাথে ইসলামের সবকিছু বিলিয়ে দিতে তিনি মোটেও রাজি ছিলেন না। মোটকথা এই দীর্ঘ সময়ে তিনি তাঁর ক্ষুরধার বক্তৃতা এবং লেখনীর মাধ্যমে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সদস্য হিসেবে খুব বড় ধরনের খেদমত আঞ্জাম দেন।

          ১৯৪৫ সাল থেকে আল্লামা ওসমানীর রাজনৈতিক তৎপরতা এক ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। এসময় মুসলিম লীগ কংগ্রেসের বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কংগ্রেস ছিল বহুজাতিক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক দল। অপরদিকে মুসলিম লীগ ছিল শুধু মুসলমানের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। যার লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের স্বতন্ত্র রক্ষার জন্য পাকিস্তান অর্জন। মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে গোটা উপমহাদেশে এক নতুন জোয়ার সৃষ্টি হয়। হযরত উসমানী এ সময় অসুস্থ ছিলেন। যার ফলে প্রায় এক বছর তিনি ডাভেলের মাদ্রাসায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। সুস্থ হবার পর আল্লামা উসমানী পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এবং ১৯৪৫ সালে কলকাতায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামে পাকিস্তান আন্দোলনের লক্ষ্যে একটি সংগঠনের ভিত্তি রাখেন। তিনি মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার স্বার্থে সকল মুসলমানকে মুসলিম লীগে যোগদানের আহ্বান জানান।

আল্লামা উসমানী পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রঃ হযরত উসমানীকে মোবারকবাদ জানান।

পাকিস্তান আন্দোলনে আল্লামা উসমানীর অবদান:

          পাকিস্তান আন্দোলনে কামিয়াব করার জন্য মাওলানা ওসমানীর অবদান অবিস্মরণীয়। তার মত খ্যাতনামা আলীমের মুসলিম লীগের প্রতি ঝুকে যাওয়ার ফলে মুসলমানদের চিন্তাধারাকে অতি সহজে পাকিস্তানের দিকে ফেরানো সহজ হয়। সারা ভারতে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য ঝটিকা সফর করেন। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান, মাওলানা ওসমানীকে তাদের পথপ্রদর্শক মনে করতেন।

          দেশ বিভক্তির পূর্বে জাতীয় এবং প্রাদেশিক এসেম্বলি ইলেকশনে মাওলানা ওসমানীর প্রচেষ্টায় মুসলিম লীগ যথেষ্ট সফলতা লাভ করেন। ইলেকশনের সময় নবাবজাদা লিয়াকত আলী ছিল জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের খ্যাতনামা নেতা। মোহাম্মদ আহমদ কাসেমীর ও কংগ্রেসের সাথে খুব ভাব ছিল। নেহেরু প্যাটেল প্রমূখ রাজনিতিবিদদের সাথেও ছিল ভালো সম্পর্ক। ইলেকশনের প্রচারণা তখন তুঙ্গে। আল্লামা ওসমানী তার সর্বশক্তি নিয়ে ময়দানে নেমে পড়লেন। মাঠে ময়দানে গ্রামে-গঞ্জে মানুষকে মুসলিম লীগের বাক্সে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেন।

          সারা ভারতে মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভূমি পাকিস্তান অর্জনের জন্য তিনি প্রজ্জলিত করেন তাদের মশাল। ইসলামের পতাকা উড্ডীন করার জন্য মুসলিম যুবকেরা বলতো "সিনেমে গুলি খায়েঙ্গে আউর পাকিস্তান বানায়েঙ্গে" যাহোক সবাই এই আশ্চর্য হয়ে গেল যখন দেখা গেল কংগ্রেসের সেই মুসলিম লীগ ২১২ ভোট বেশি পেয়ে নবাবজাদা লিয়াকাট আলি খান নির্বাচিত হন। চারদিকে আনন্দের স্রোত বয়ে যায়। এসব সফলতার মূলে ছিল আল্লামা ওসমানীর ঐকান্তিক সাধনা ও মেহনত।

পাকিস্তানের পথে:

          আল্লামা ওসমানী ১৯৪৭সালে দেশ বিভক্তি পর পাকিস্তানে হিজরত করেন। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির তিনি সভাপতি নিযুক্ত হন। এবং শাসনতন্ত্র এসেম্বলিরও সদস্য মনোনীত হন। পাকিস্তানি ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি পাকিস্তানি বহুদ্বিনী সামাজিক এবং রাজনৈতিক খেদমত আঞ্জাম দেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট করাচিতে তিনি প্রথম পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেন। পাকিস্তান সরকারের ওপর তার বিরাট প্রভাব ছিল। তাকে একজন ইসলামী চিন্তাবিদের সাথে রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হিসেবে গণ্য করা হতো।

ইন্তেকাল:

          পাকিস্তানের জামিয়া আব্বাসীয় ভাওয়ালপুর একটি প্রাচীন দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষাব্যবস্থা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিল। ভাওয়ালপুর রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জামেয়ার উন্নতিকল্পে মাওলানা ওসমানীকে দাওয়াত দেয়া হয়। তিনি দাওয়াত গ্রহণ করেন এবং ভাওয়াল্পুর উপস্থিত হন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের সাথে আলোচনা শুরু হয়েছে মাত্র। হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং কয়েক ঘন্টা অসুস্থ হওয়ার পর ১৯৪৯ সালের ১৩ ই ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। ভাওয়াল্পুর থেকে জানাজার পর তার লাশ করাচিতে আনা হয় এবং মোহাম্মদ আলী রোডের নিকটে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।