JustPaste.it

নবীন মুজাহিদদের পাতা

 

রাসূলকে যেভাবে আবু জাহেল চিনেছিল

আবু সালেহ

=====================================================================

 

        রাতের শেষ প্রহর । চারিদিকে আবছা অন্ধকার । পূর্বাকাশে একটি ক্ষীণ আলোর রেখা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে । আবু কুবাইশ পর্বত কোলের পাখ পাখালিরা এখনো জেগে উঠে নি । জেগে উঠে নি ঘুমন্ত মক্কার লোকেরা । নীরব নিস্তব্ধ । এটা যেন নিঝুম পুরীর এক যাদুর দেশ । এক মায়াময় দেশ ।

 

        এমনই স্বর্গীয় মূহুর্তে  বাইতুল্লায় নামাজে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত সুললিত ও  মধুর কন্ঠে কুরআন পাঠ করছেন রাসূল ( সাঃ) । শব্দের তালে তালে ঢেউ তুলে মন্থর গতিতে পাঠ করে চলেছেন ।

 

        বাইতুল্লাহর চারিদিক থেকে চারটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে এলো রাসূলের দিকে । অত্যন্ত সন্তর্পণে আত্মহারা হয়ে  তেলাওয়াত শুনতে লাগলো । শব্দের ঝংকারে ভাব-গাম্ভীর্যতায় তন্ময় হয়ে রইলো বহুক্ষণ । তবুও যেন তার মাধূর্য শেষ হয় না । ইতোমধ্যে আবছা অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে । দূর থেকে পাখির কাকলী ভেসে আসছে । খেজুর পাতায় বাতাসের কানাকানি শুনা যাচ্ছে । আর কাল ক্ষেপণ করা নিরাপদ নয় ভেবে তারা খুব সন্তর্পণে আবছা অন্ধকারে মিশে গেল । আঁকা বাঁকা গলিপথ ধরে ফিরছিল তারা । কিন্তু অবাক কান্ড!কিছুদূর অগ্রসর হতেই ছায়ামূর্তিগুলো মুখোমুখি হয়ে গেলো ।

 

        বিস্ময়ে বিমূঢ় সবাই । মুখ চাওয়া চাওয়ি শেষে পরিচয় হলো । এরা আরবের শ্রেষ্ঠ, শীর্ষস্থানীয় চার সরদার । রাসূলের ঘোর দুশমন । এরা আবু সুফিয়ান, আবু জাহেল, আখনাস ইবনে শুরাইক ও হালিফ বিন যোহরা । দিনের আলোতে যদিও এরা রাসূলকে এরা পাগল, মাতাল, যাদুকর, কবি বলে গালি-গালাজ করে কিন্তু রাতের আঁধারে শাশ্বত সত্যের আহ্বানে দূর্বার আকর্ষণে ছুটে আসে অর্গল খুলে । দাঁড়ায় রাসূলের অদূরে, আড়ালে, আবডালে । প্রত্যেকে ভেবেছিল বুঝি একাই এসেছে তাঁর তেলাওয়াত শুনতে । কিন্তু অকস্মাৎ এ সাক্ষাতে তারা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল । অপরাধ ও লজ্জাবোধে তারা এতোটুকুন হয়ে গেল । অবনত মস্তকে আর কখনো না আসার প্রতিজ্ঞা করে আপন গন্তব্য পথে ফিরে গেল ।

 

        পরের দিন, নিঝুম রাত । আবার চার সর্দার খুব সন্তর্পণে এগিয়ে এলো বাইতুল্লাহর দিকে । মনে শংকা ও ভয়ের তোলপাড় সত্ত্বেও কুরআনের প্রতি তীব্র আকর্ষণ, তার সুর মূর্ছনায় ব্যাকুল আত্মহারা হয়ে ছুটে এলো । তন্ময় হয়ে রাসূলের কন্ঠ নিসৃত কুরআনের তেলাওয়াত শুনতে লাগলো । ফেরার পালা । আবারও দেখা হলো পরস্পরে চার জনের । লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে আবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো ।

 

        দিন গড়িয়ে রাত এলো । এলো অন্ধকার, নিস্তব্ধতা । কর্ম ক্লান্ত মক্কার লোকেরা ঘুমে অচেতন । কিন্তু কুরাইশ সেই চার সরদারের চোখে কোনো ঘুম নেই । মায়াভরা আয়াতগুলো তাদের মনে দারুণ কৌতূহল সৃষ্টি করেছে । মূর্তি পূজার অসাড়তা তাদের নিকট স্পষ্ট হয়ে গেছে । আজও তারা এলো অত্যন্ত সন্তর্পণে  বাইতুল্লাহর সেই পরিচিত স্থানগুলোতে । রাত ভর রাসূলের মধু ঝরা কন্ঠের তেলাওয়াত শুনে ফেরার পথে আজও দেখা হলো তাদের কিন্তু আজ আর কিছু বলার নাই । আর কতো দিন এভাবে চলবে । যদি এ কান্ড ফাঁস হয়ে যায় তবে যে আর রক্ষা নেই । মানুষ আস্থা হারাবে । নেতৃত্ব ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে । তাই একজন দৃঢ় কন্ঠে বলল, না;এভাবে আর হচ্ছে না । এসো আমরা শপথ করি লাত ও মানাতের নামে, প্রচন্ড শপথ । আর কখনো কোনো দিন আমাদের কেউ আসবে না ।

 

পরদিন সকালে আখনাস ঘুম থেকে জেগে উঠলো । ভারী আনচান করছে তার মনটা । ভারী উতলা । একি বলছে মুহাম্মদ মিথ্যার ঘোর অন্ধকারে সত্যের আলো ফেলে যেন তার মন সম্মুখে যেতে চায় । কিন্তু পারছে না । বন্ধু আবু সুফিয়ানের নিকট এলো, বলল, 'আবু হানজালাহ মুহাম্মাদের অনেক কথা তো শুনলে, কি বুঝলে বলো তো দেখি?'আবু সুফিয়ানের কন্ঠে দোটানা আত্মবিশ্বাস । বলল, 'শুনো, আখনাস, আমি যা শুনেছি তার একাংশ মর্মসহই বুঝেছি । বাকি অংশের কিছুই বুঝি নাই' ।

 

        আবু সুফিয়ানের কথায় পরিতৃপ্ত হলো না । শান্ত হলো না তার মন । ছুটে গেল সর্দার আবু জাহেলের নিকট । বলল, 'আবু হেকাম, মুহাম্মাদের তো অনেক কথা শুনলে, মর্ম কি বুঝলে বল দেখি'? আবু জাহেল চিন্তার সাগরে ডুবে গেল । ক্ষণকাল পর মাথা নেড়ে বলল, 'হ্যাঁ শুন, । আমার মনে হয় তা ঐশী বাণী ছাড়া কিছুই না । তবে কথা হলো, আমরা আর বনু আবদে মান্নাফ এখন মর্যাদার লড়াইয়ে ব্যস্ত । দেখো না, তারা কাঙালি ভোজ করে তাই আমরাও তা করি । তারা জনগণের সেবা করে তাই আমরাও তা করি । তারা দান-সাদাক্বাহ করে তাই আমরাও তা করি । তাদের পায়ে পায়ে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছিলাম । কিন্তু যখনই তারা দাবী করল আমাদের মাঝে নবী আছে । তখন আমরা হেরে গেলাম । কারণ আমাদের তো আর নবী নেই । সুতরাং কিছুতেই আমরা তার অনুসরণ করবো না, বিশ্বাসও করবো না ।

 

তথ্যসূত্রঃ সীরাত ইবনে হিশাম

 

═──────────────═

 

 

 

আযানের পূর্ণতা

রুবাইয়াত আল ইমাম

-----------------------------------------------------------------

        আযান শোনে নি এমন লোক পৃথিবীতে কমই আছে । এখন আমরা যে আযান শুনি তা হুট করে একদিনেই হয়ে যায় নি । এর পেছনে একটি সুন্দর ঘটনা আছে । সেই ঘটনাটা কী?শুনতে চাও??ঠিক আছে আরেকদিন না হয় শুনাবো কেমন,আজ তোমাদের আরও একটি সুন্দর ঘটনা বলি, শোনো । অবশ্য এটিও ওই আযান নিয়েই ।

 

        আমরা যারা নামায পড়ি তারা তো দিনে পাঁচ পাঁচ বার আযান শুনি । তাই না?খুব ভোরে যখন আধো আলো আধো অন্ধকার থাকে, সূর্য যখন পূর্ব আকাশে উঠি উঠি করে, সেই পাখি ডাকা ভোরে আমরা যে নামায পড়ি তার নাম কি? বলতে পারো?ঠিক বলেছ । তার নাম 'সালাতুল ফাজর' বা ভোরের নামাজ ।

 

        যারা আল্লাহকে ভালোবাসে, তাকে মানে, ভয় করে । যারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে ভালোবাসে, ইসলামকে যারা মেনে চলে, আল্লাহ তাদেরকে বলেছেন মুত্তাকী । মুত্তাকীরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন । এ সময়ের আবহাওয়া স্বাস্থ্যের জন্যও খুব ভালো । আরামদায়ক ও উপাদেয় । তোমরা কিন্তু এই সময়ে ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ হাঁটবে । তো যা বলছিলাম, এই ফজর নামাযে যে আযান দেয়া হয় তার সাথে অন্য নামাযের আযানের সাথে এক জায়গায় পার্থক্য আছে । কোথায় বলতে পারো?

 

        হ্যাঁ, 'আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম' বাক্যটি ফজরের আযানে বেশি । প্রথম দিকে কিন্তু এটি ফজরের আযানেরও অংশ ছিল না । তাহলে এটি এলো কোথা থেকে? সে কথাই বলছি শোনঃ

 

        খুব ভোরে । সূর্যি মামা তখনো জেগে উঠে নি । যাকে বলে কাক ডাকা ভোর । তারও কিছুক্ষণ পূর্বে ঘুম থেকে জেগে উঠেন বিলাল (রাঃ) । উঠে কিছুক্ষণ মরুভূমির মুক্তাঙ্গনে হেঁটে বেড়ান । নির্মল ঠান্ডা বাতাস নেন বুক ভরে । তারপর মেসওয়াক করেন । অজু সেরে মিনারে উঠেন । মসজিদে নববীর মিনার । আযান দেন । সেদিনও দিলেন । মুসল্লীরা একে একে মসজিদে এলেন । পূর্বাকাশ ফর্সা হলো । আশ্চর্য!নিত্য দিনের মতো রাসূল (সাঃ)  এলেন না । তিনি আসেন সবার আগে । এটাই ঘটে আসছে । ব্যতিক্রম ঘটলো সেদিন । তিনি এলেন না ।

 

        অবাক হলো সবাই । সময় চলে যাচ্ছে কিন্তু তিনি আসছেন না । সবাই অধীর ভাবে অপেক্ষা করতে লাগলেন । এদিকে লাল রক্তিম আভা ছড়িয়ে সূর্যি মামা উদয়ের বাণী ঘোষণা করছে । নামাযের সময় চলে যেতে বসেছে । অথচ নবী (সাঃ) এর দেখা নেই । সবাই ভাবনায় পড়ে গেলেন । সাহাবীরা এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছেন । সবার মুখে শঙ্কার ছবি । না, তবুও নবীজির দেখা নেই । শেষে আবু বকর (রাঃ)  উমার (রাঃ) কে বলেই ফেললেন, "উমার, নবীর খবর নিয়ে এসো । তিনি হয়ত এখনো ঘুম থেকে উঠেন নি । তুমিই নবীজির নিকট সবচেয়ে বেশি প্রিয় । সত্য-মিথ্যার ব্যাপারে তুমিই নবীর পরে বেশী পার্থক্যকারী । তুমিই নবীজিকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে ডেকে আনো । তুমিই এ কাজ করতে পারো । স্বয়ং নবীজি তোমাকে ফারুক উপাধি দিয়েছেন, তুমি যাও ।

 

        মসজিদে নববীর অদূরে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) এর গৃহ । সেখানেই নবীজি (সাঃ) ঘুমিয়ে ।

 

        হযরত উমার (রাঃ) বললেন, 'না, হে আবু বকর না । আমি এ করতে পারি না । আল্লাহর নবীর ঘুম আমি ভেঙ্গে মহা পাপী হতে চাই না । আমি তা পারবো না । সাহসে কুলাবে না । বরং তুমিই যাও । তুমিই নবীজির অধিক প্রিয় । তুমিই তো নবীর সেই হিযরতের নিঃসঙ্গ সময়ের বিশ্বস্ত সাথী । গিরি গুহার প্রহরী । সাপের দংশন সহ্য করেও তুমি তার ঘুম ভাঙ্গাও নি । আজ আমি কীভাবে তা করবো বলো?তুমিই হযরতের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসী । তিনি তোমাকে স্বয়ং 'সিদ্দিকে আকবার' উপাধী দিয়েছেন । তুমি তার শ্বশুর । তুমিই যাও ভাই । তুমিই তা করতে পারো ।  

 

        হযরত আবু বকর (রাঃ)ও তার অপারগতার কথা জানালেন । দু'জনে হযরত উসমান (রাঃ) কে বললেন, 'ভাই, উসমান! তুমি নবী (সাঃ) এর জামাতা । মুসলমানদের মধ্যে বড় ধনী । তুমিই যাও,নবীর ঘুম ভাঙ্গাও ।

 

        কিন্তু হযরত উসমানও তার ব্যর্থতার কথা জানিয়ে দিলেন । এবার সবাই গেলেন হযরত আলীর কাছে । বললেন, 'আলী!তুমি নবীর অত্যন্ত স্নেহের পাত্র । নবীজির কলিজার টুকরা ফাতিমার স্বামী তুমি । বীর, শেরে খোদা । তুমিই যাও,নবীর ঘুম ভাঙ্গাও । নামাজের সময় চলে যায় । দেরী করো না, যাও ।

 

        হযরত আলী (রাঃ) বললেন,' আমি যে-ই হই না কেন আল্লাহর নবীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারবো না । তবে বেলালকে পাঠাও, সে-ই পারবে । গেলেন সবাই বেলালের নিকট । বললেন, 'তুমি মুয়াজ্জিন । তোমাকে নবীজি খুবই ভালোবাসেন । তুমি যাও, নবীকে ডেকে আনো' ।

 

        প্রথমে রাজী না হলেও সবার অনুরোধ তিনি ফেলতে পারলেন না । গেলেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও । ভয়ে ভয়ে গেলেন নবীর গৃহ দ্বারে । কিন্তু করাঘাত করার সাহস হলো না । হাত পা আরষ্ট হয়ে গেলো । মুখে কথা বের হয় না ।

 

        ঝিমধরে গেলো মাথায় । কেমন একটা অপার্থিব ভাব । কি করা যায় ভাবছেন । এমনি সময় তার মুখ থেকে বের হলোঃ'আস সালাতুম খাইরুম মিনান নাউ-উ-ম' ।

 

        এই আহ্বান কানে যেতেই মহানবী ঘুম থেকে উঠলেন । দেখলেন, বেলাল তার সুমধুর সুললিত কন্ঠে  এই বাক্য বলছেন । নবী খুশি হয়ে বেলালকে আলিঙ্গন করলেন এবং তখন থেকে সুন্দর এই বাক্যটি ফজরের নামাযের আযানে নিয়মিত বলার জন্য নির্দেশ দিলেন । সেই থেকে এখনো ফজরের আযানে নির্মল হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন মুয়াজ্জিন । আল্লাহর প্রতি বান্দার অর্ঘ নিবেদনের জন্য । আহ্বান জানায় আল্লাহর পথে, কল্যাণের পথে ।  

 

        ছোট্ট বন্ধুরা তোমরা কি এই বাক্যটির বাংলা অর্থ বলতে পারো?না--আমিই বলে দেবো । ঠিক আছে শোনোঃ " আস সালাতুল খাইরুম মিনান নাউম" এর অর্থ "ঘুম থেকে নামায উত্তম" ।

 

═──────────────═