JustPaste.it

কাকে বন্ধু নির্বাচন করবেন এবং কেন করবেন

–মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন

=================================================

 

        “বন্ধুত্ব” আল্লাহ তাআলার বিশেষ একটি গুণ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা'আলা বলেছেনঃ “তোমরা আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতি সঞ্চার করেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই (তথা বন্ধু) হয়ে গিয়েছ।” (আলে ইমরান আয়াত ১০৩)

 

        মহানবী (সঃ) বলেনঃ “আল্লাহ্ তা'আলা যার মঙ্গল কামনা করেন, তাকে ভালাে একজন বন্ধু দান করেন।” কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বলবেন, “তারা আজ কোথায়, যারা আমার খোশনুদীর জন্য একজন আরেকজনকে ভালােবাসত? তারা আজ আমার রহমতের ছায়ায় আশ্রয় পাবে। যেখানে আমার রহমতের ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া নেই।”

 

        কিয়ামতের দিন সাত শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর নিকট আশ্রয় পাবে। তন্মধ্যে একপ্রকার হলাে এমন দুই বন্ধু যারা জীবনে-মরণে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পারস্পরিক বন্ধুত্ব বজায় রাখে। রাসূলে আকরাম (সঃ) বলেছেনঃ “ভালােবাসা এবং ঘৃণা দু’-ই আল্লাহর খাতিরে হওয়া চাই।”

 

        হযরত সুলায়মান (আঃ) বলেছেনঃ “তোমার পরিচিত হাজার মানুষের মধ্যে একজনই হবে তোমার বন্ধু।”

 

        হযতর ঈসা (আঃ) বন্ধু সম্পর্কে : বলেছেনঃ “বন্ধু হলাে এক দুর্লভ জিনিস, যা লাভ করা সুকঠিন কিন্তু হারানো অতি সহজ। সাবধান! তোমার প্রিয়জনকে যে ভালােবাসে না তুমি তাঁর সাথে বন্ধুত্ব করো না। তুমি কি জান যে, বন্ধু বলতে কি বুঝায়? বন্ধু হলাে আত্মার চিকিৎসক। রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে অভিজ্ঞ ডাক্তারের যেমন অভাব তেমনি এমন বন্ধুর সংখ্যাও নিতান্তই কম, যিনি তোমার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সম্যক অবগত এবং তোমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সদা সচেষ্ট।”

 

        “তোমার বন্ধু এমন হতে হবে যে, সে যেমন তোমাকে সংশোধন করার চেষ্টা করবে তেমনি নিজে সংশোধিত হওয়ার ব্যাপারেও তৎপর থাকবে এবং সে এই কামনা করবে তুমি যেন আল্লাহর মহব্বতের খাতিরে দুনিয়ার সব কিছুই ত্যাগ কর, তেমনি সেও এজন্য প্রস্তুত থাকবে প্রয়োজনে আল্লাহর খাতিরে তুমি তাকেও ত্যাগ করবে।”

 

        “আল্লাহর সাথে যার ভালােবাসা নেই সে নিজেকে ভালােবাসতে পারেনা, আর যে ব্যক্তি নিজেকে ভালােবাসতে পারে না সে অন্যকে ভালােবাসবে কি করে? এটা নিতান্তই অসম্ভব। সুতরাং কারো সাথে . বন্ধুত্ব করার আগে তাঁর বংশ-মর্যাদা, বাড়ি-গাড়ি, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য না করে বরং দেখতে হবে, সে আল্লাহকে কতটুকু ভয় করে, দুনিয়ার সাথে তাঁর সম্পর্ক কি রকম, সৎকাজের প্রতি সে কতটুকু অনুপ্রাণিত। আর সে নিজের সুখ-ভোগের ব্যাপারে খুব বেশী সজাগ কিনা। এই নিয়ম পালন করলে তুমি সহজে সঠিক বন্ধুর সন্ধান পেয়ে যাবে। যদি দেখ যে, সে আল্লাহকে সর্বাপেক্ষা বেশী ভয় করে, দুনিয়ার ভোগ বিলাসকে ঘৃণার চোখে দেখে, সদা নেক কাজে তৎপর থাকে এবং নিজের জীবনের শত্রুর ন্যায় নিজের শরীরকে সুখ দেয়ার পরিবর্তে এর প্রতি শত্রুতা রাখে, তবেই তুমি তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে পারো। তবে বন্ধুর সাথে এমন সম্পর্ক রাখা যাবে না যে, তোমার সবটুকু ভালােবাসা তার জন্যই নিবেদিত থাকে। কারণ এমন হলে তা প্রতীমা পূজারীর পর্যায়ে এসে দাড়ায়। বরং বন্ধুকে সবসময় আল্লাহর এক বিশেষ দান রূপে বরণ ও মূল্যায়ন করতে হবে।”

 

        “যে ব্যক্তি একজন খাটি বন্ধু লাভ করল, সে যেন জান্নাতের একটি নেয়ামত লাভ করল। বরং এটাই হলাে জান্নাতের চাবিকাঠি।”

 

        হযরত ঈসা (আঃ) আরও বলেছেনঃ “ধোকাবাজদের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা কর এবং আল্লাহ তাআলার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোল। ধোকাবাজদের সাহচর্য ত্যাগ কর এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে আত্ম নিয়োগ কর।”

 

        হযরত ঈসা (আঃ) -কে একবার জিজ্ঞাসা করা হলাে, হে রূহুল্লাহ! আমরা কার সাহচর্য গ্রহণ করব? উত্তরে তিনি বললেনঃ “তোমরা এমন লােকের সাথে উঠাবসা কর, যাদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়, যাদের মুখ নিসৃত বানী তোমার জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করে এবং তাদের আমল দেখে তোমার জান্নাত লাভের উদগ্র আগ্রহ জাগে।”

 

        জনৈক মনীষী বলেনঃ “এমন লােককে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর যার মধ্যে পাঁচটি গুণ পাওয়া যায়ঃ

        (১) জ্ঞান

        (২) নেক আমল

        (৩) গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এবং গুনাহের কাজকে ঘৃণা করা

        (৪) কুফর থেকে দূরে থাকা ও (৫) নির্লোভ হওয়া।”

 

        “নির্বোধের বন্ধুত্ব কখনো কল্যাণকর হয়।। বরং এর পরিণাম সর্বদা মন্দই হয়ে থাকে।”

 

        আলকামা নামক এক মনীষী মুমূর্ষ অবস্থায় বন্ধু সম্পর্কে বলেনঃ “বৎস! তুমি যদি কারো সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে চাও, তাহলে এমন ব্যক্তিকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, তুমি যতক্ষণ তাঁর সঙ্গে থাকবে সে তোমাকে পাপ ও অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা করবে, তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে, তোমাকে সাহায্য সহয়োগিতা করবে, তোমার ভালাে কাজের প্রতি লক্ষ্য রাখবে, তোমাকে গুনাহের কাজ হতে বিরত রাখবে, তোমার আবেদন রক্ষা করবে। বিপদাপদে তোমার সাথে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করবে, তোমার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে, তুমি কোন কাজ করার ইচ্ছা করলে তোমাকে সদুপদেশ প্রদান করবে এবং তোমাদের দু’জনের মাঝে মতবিরোধ দেখাদিলে সে তোমার মতকে তার মতের উপর প্রাধান্য দিবে।”

 

        আলকামার এই উপদেশ শুনতে পেয়ে খলীফা মামুন জিজ্ঞাসা করলেন, আমি এমন বন্ধু কোথায় খুঁজে পাব? উত্তরে ইয়াহইয়া বললেনঃ “আলকামার এই নসীহতের অর্থ হলাে, আমাদের নিঃসঙ্গ থাকা উচিত।”

 

        ইমাম জাফর সাদেক (রহঃ) বলেনঃ পাঁচ শ্রেণীর লােকের সাথে বন্ধুত্ব রাখা উচিত নয়ঃ (১) মিথুক — যে তোমাকে মরিচিকার ন্যায় ধোঁকা দিবে (২) নির্বোধ যে তোমার কোন উপকার করতে ব্যর্থ (3) কৃপণ যখন তুমি তার সাহায্য প্রার্থনা করবে সে তোমাকে ছেড়ে সরে দাড়াবে। (৪) কাপুরুষ — তুমি বিপদে পড়লে যে তোমাকে একাকী ফেলে নিরাপদে কেটে পড়বে ও (৫) ইতর ধোঁকাবাজ – যে একটুকরো রুটির বিনিময়ে তোমাকে বিক্রি করে দিতে পারে।

 

        সহল অব টষ্টর বলেনঃ “তিন প্রকার মানুষের সাহচর্য বর্জন করা অপরিহার্য্য।

        (১) অত্যাচারী শাসক, যে আল্লাহকে ভুলে যায়।

        (২) দাম্ভিক আলিম ও

        (৩) মূর্খ সুফী।”

 

        অন্য এক বুযুর্গ বলেন, “যার বন্ধু নেই তাঁর জীবনটাই নিরানন্দ। মানুষ হলাে বৃক্ষের ন্যায়। কোন বৃক্ষ হয় ফলবান, কোন বৃক্ষ হয় ছায়াদার এবং কোন কোন বৃক্ষ ফল ও ছায়া উভয় দান করে। আবার কোন কোন বৃক্ষ কাঁটা আর ঝােপ ঝাপ সৃষ্টি ছাড়া কোন উপকারে আসে না। তদ্রুপ এক শ্রেণীর বন্ধু দুনিয়া আখেরাত উভয় জগতেই রহমত লাভের কারণ হয়, আবার কেউ শুধু দুনিয়াতেই উপকারে আসে, আবার কারো দ্বারা দুনিয়াতেও কোন উপকার হয় না এবং আখেরাতেও নয়। এরা মূলত মানুষরূপী বিচ্ছু।”

 

        মাওলানা রুমী (রহঃ) বলেনঃ “এক বন্ধুর নিকট আরেক বন্ধু তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় হয়ে থাকে এবং বন্ধুর দেয়া কষ্ট তার নিকট মোটেই কষ্টকর বলে মনে হয় না। মূলত বন্ধুর পক্ষ থেকে আসা বিপদ ও জ্বালাতনে সন্তুষ্ট থাকতে পারাই সত্যিকার বন্ধুত্বের প্রমাণ। বন্ধুত্ব হলাে স্বর্ণের ন্যায় আর পরীক্ষা হলাে অগ্নিতুল্য। খাঁটি সোনা আগুনে পুড়েই সঠিক রং ধারণ করে এবং নির্ভেজাল বলে প্রমাণিত হয়।”

 

        মাওলানা রূমী অন্যত্র বলেনঃ “বন্ধুত্ব ভালােবাসার চেয়েও একটি উত্তম বিষয়ের নাম।”

 

        নুমান ইবনে আইয়ুব আল আবদী তাঁর ছেলেদেরকে উপদেশ দান প্রসঙ্গে বলেছেনঃ “বন্ধুকে যাচাই করে না দেখা পর্যন্ত তার বন্ধুত্বের উপর ভরসা করো না, দুনিয়াতে-মতলববাজ স্বার্থপর বন্ধুর সংখ্যাই বেশী। আর খাঁটি, নিঃস্বার্থ ও বিশ্বস্ত বন্ধুর খুবই অভাব। সুতরাং এমন লােককে বন্ধু নির্বাচন করো যে দুঃসময়ে তোমার উপকারে আসবে।”

 

        প্রাচ্যের বিখ্যাত কবি আলতাফ হুসাইন হালী বন্ধু প্রসঙ্গে বলেছেন, “ইউসুফ (আঃ) কে নিক্ষেপিত কুপটি থেকে সদা এই আওয়াজ ভেসে আসছে যে, পৃথিবীতে ভাইয়ের সংখ্যা অনেক হলেও বন্ধুর সংখ্যা নিতান্তইনগণ্য।”

 

        বন্ধুত্ব সম্পর্কে বাতলীমুস বলেনঃ “তিন ব্যক্তি আমার বন্ধুঃ (১) যে আমাকে ভালােবাসে (২) যে আমাকে ঘৃণা করে এবং (৩) যার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। এই তিন ব্যক্তিকে আমার ভালােবাসার কারণ হলােঃ প্রথম ব্যক্তি আমাকে ভালােবাসা শিক্ষা দেয়, দ্বিতীয় ব্যক্তি আমাকে সাবধান হওয়ার জন্য সতর্ক করে, আর তৃতীয় ব্যক্তি আমার মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা জন্ম দেয়।”

 

        আবু আলী সীনা বলেনঃ “এক জ্ঞানী ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলাে যে, ভাই এবং বন্ধু এই দুজনের মধ্যে কে উত্তম? উত্তরে তিনি বলেনঃ ভাই উত্তম, যদি সে বন্ধু হয়।”

 

        হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “বদকারদের সাথে বন্ধুত্ব করবে না, কারণ সে তোমাকে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করে ফেলতে পারে। মিথুকের সাথে বন্ধুত্ব করা ঠিক নয়, কারণ মিথ্যুক হলাে মরিচিকার ন্যায়। সে দূরের বস্তুকে নিকটে নিয়ে আসবে আর নিকটের বস্তুকে দূরে নিয়ে যাবে।”

 

        শেখ সাদী (রহঃ) বলেনঃ “সেই বন্ধু নির্ভর যোগ্য নয় যে তোমার শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব রাখে। সেই ব্যক্তি নিতান্ত ইতর, অভদ্র, অকৃতজ্ঞ ও নিমকহারাম যে সামান্য ব্যাপারে দীর্ঘদিনের বন্ধুকে ত্যাগ করে এবং দীর্ঘদিনের অনুগ্রহ ও অবদানকে ভুলে যায়।”

 

        তিনি আরও বলেন, “একশত বছর অগ্নি পূজা করেও যদি তুমি সেই আগুনে ঝাপ দাও তবুও সে তোমাকে না পুড়িয়ে ছাড়বে না। হিংস্র প্রাণী এবং শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব রাখাও ঠিক তদ্রুপ।”

 

        “বন্ধু কারাগারেও উপকারে আসে . আর দস্তরখানায় শত্রুকেও বন্ধু বলে মনে হয়।”

 

        অবশেষে একটি প্রবাদ উল্লেখ করে আলোেচানার ইতি টানছিঃ “সত্যিকার বন্ধুর হাতের আঘাতও আংগুরের ন্যায় সুস্বাদু এবং মজাদার”।

 

*****