JustPaste.it

মাহে শাবান ও শবে বরাতের ফজিলাত

আমীনুল ইসলাম ইসমতী

শাবান এর নামকরণঃ

          শাবান আরবী শব্দ।আভিধানিক ভাবে ছড়িয়ে পড়া, বিস্তৃতি লাভ, শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট হওয়া ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়।এ মাসে বিশ্ববাসীর প্রতি আল্লাহর রহমত ও দয়া বিস্তৃত হয় এবং মুসলমানদের প্রতি বিশ্ব প্রতিপালকের কৃপা ব্যাপক হয়ে থাকে।তাই এ মাসকে 'শাবান' নামকরণ করা হয়েছে।

          হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, " শাবানকে শাবান নামকরণ এইজন্য করা হয়েছে যে, এ মাসে যারা রোজা রাখবে  তাদের অনেক কল্যাণ ও বরকত হবে।যদ্বারা সে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে।"(ফয়যুল কাদীর)

শাবান এর ফজিলতঃ

          হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লহু আনহা থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, "রমযান আল্লাহর মাস (অর্থাৎ রমযান মাসের রোজা আল্লাহ তা'আলা ফর‍য করেছেন), আর শাবান হলো আমার মাস(অর্থাৎ এ মাসে তিনি রোজা ইত্যাদি নফল ইবাদাত হিসেবে পালন করেছেন), তাই শাবান (এর ইবাদাত গুনাহ থেকে) পরিত্রাণকারী আর রমযান হলো গোনাহ মোচনকারী।" (ফয়যুল কাদীর)

          হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লহু আনহা বর্ণনা করেন, " মহানবী সাঃ শাবানের মতো অন্য কোনো মাসে এত অধিক রোযা রাখতেন না।কেননা নবী সাঃ প্রায় পুরো শাবান মাস রোযা রাখতেন"। (বুখারী)

          হযরত উসামা বিন যায়েদ রাদ্বিয়াল্লহু আনহু বর্ণনা করেন যে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি শাবান মাসে যত পরিমাণ রোযা রাখেন অন্য কোনো মাসে তো এত পরিমাণ রোযা রাখতে দেখি না?নবী সাঃ প্রত্যুত্তরে বলেন, "এ রজব ও রমযানের মধ্যবর্তী মাস, অনেক মানুষ এ মাসে (পূণ্যকাজে) অবহেলা করে অথচ বান্দার আমলসমূহ এ মাসে রব্বুল আলামীনের সমীপে পেশ করা হয়"। (নাসায়ী)

হযরত আবু হুরায়রা রাঃ বলেন, রাসূল সাঃ বলেছেন,

          " শাবান আমার মাস, রজব আল্লাহর মাস এবং রমযান আমার উম্মতের মাস।শাবান গোনাহ দূর করে এবং রমযান (গুনাহ থেকে) পবিত্র করে"। (বায়হাকী)

          হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লহু আনহু বলেন, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, "রজব মাসের মাহাত্ম্য অন্যান্য মাসের ওপর এমন যেমন কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য সকল আসমানী কিতাবের উপর। আর শাবান মাসের ফজিলত বাকী সমস্ত মাসের ওপর এমন যেমন আমার শ্রেষ্ঠত্ব অন্য সকল নবীর উপর। এবং রমযানের ফজিলত বাকী সমস্ত মাসের ওপর এমন যেমন আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর সমূদয় সৃষ্টির উপর"। (গনিয়াতুত তালেবীন)

          পূর্ণ শাবান মাস পূণ্য ও সওয়াব অর্জনের সুবর্ণ মাস।সুতরাং সারাটি মাস আন্তরিকতার সাথে ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকা উচিত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, অনেককে শাবানের প্রথম পনের দিনে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ইবাদত বন্দেগী করতে দেখা গেলেও শেষ ভাগে তাদের মধ্যে চরম শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়।তারা মনে করে, শাবানের প্রথম পক্ষই ফযিলতময় ও বরকতপূর্ণ অথচ পূর্বোল্লেখিত হাদীস সমূহ প্রমাণ করে যে, সারাটা মাসই বরকতময়।

          ক্রমাগত ফযিলতের মাস রমযানের প্রস্তুতি হিসেবেই যে শাবান মাসের এই গুরুত্ব ও ফযিলতময় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

-লাইলাতুল বরাতের ফযিলত

          প্রতি বছর এক বার করে ঘুরে আসে এই পূণ্যময় রাত।চন্দ্র বর্ষ-পঞ্জিকার হিসাবে, অষ্টম মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতটির নাম হলো 'ভাগ্যরজনী'। হাদীসের ভাষায় এর নাম 'লাইলাতুল বারাআত' ও 'লাইলাতুন নিসফিমমিন শাবান' অর্থাৎ ভাগ্যরজনী বা শাবান মাসের মধ্যরাত।ফারসি ভাষায় বলে,'শবে বারাআত'। পরম করুণাময় আল্লাহ এ বরকতময় পবিত্র রজনীতে অসংখ্য পাপী বান্দাকে ক্ষমা করে দিয়ে জাহান্নামের বিদগ্ধ, উত্তপ্ত, ধ্বংসাত্মক অগ্নিকুণ্ড ও মর্মন্তুদ শাস্তি থেকে  মুক্তি দান করেন।ভাগ্যলিপি করেন বলেই একে 'লাইলাতুল বারাআত' নামকরণ করা হয়েছে। শাবান ও লাইলাতুল বারাআত শব্দদ্বয়ের অর্থের প্রতি লক্ষ্য করলে সহজেই এর গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুমান করা যায়। এর ফযিলত সম্পর্কে হাদীসের কিতাবে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এ সম্পর্কে মাত্র কয়েকটি হাদীস তুলে ধরলাম।আশা করি, এর দ্বারা এই রাত্রের ফযিলত সম্পর্কে আমাদের অনুভূতি আরো সজাগ হবে।

          হযরত আলী রাঃ বর্ণনা করেন,  নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, "শাবানের মধ্যবর্তী রাত্রি যখন উপস্থিত হয় তখন সে রাত্রে তোমরা জাগরণ কর এবং পরের দিন রোযা রাখ।কেননা এ রাত্রে সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ তা'আলা সর্বনিম্ন আকাশে অবতরণ করেন এবং আহ্বান জানিয়ে বলতে থাকেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে  আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো? আছে কেউ রিযিকপ্রার্থী? আমি তার রিযিক দিবো? আছে কোনো বিপদগ্রস্ত লোক? তাকে আমি বিপদমুক্ত করে  দিবো? এমনি করে ফজর পর্যন্ত আল্লাহ তা'আলা তার বান্দাদের প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ)

হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লহু আনহা বর্ণনা করেছেন,

          একদা (রাত্রে) রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘরে আগমন করে জামা কাপড় খুলতে খুলতে পুনরায় পরিধান করেন এবং ঘর থেকে বের হয়ে আসেন।আমি এই ভেবে চিন্তিত হলাম যে, তিনি হয়ত অন্য কোনো বিবির ঘরে প্রবেশ করেছেন।আমিও পিছনে পিছনে তাঁর খোঁজে বের হলাম।অনেক খুঁজে তাকে জান্নাতুল বাকীতে দেখতে পাই। তিনি সেখানে মৃত মুসলমান নর-নারী ও শহীদানের মাগফেরাত কামনায় মগ্ন।আমি মনে মনে বললাম,  হে আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!আমার পিতা মাতা আপনার প্রতি উৎসর্গ হউক।আপনি প্রতিপালকের ধ্যানে মগ্ন, ইবাদাতে ব্যাপৃত আর আমি দুনিয়ার মোহে মত্ত্ব।অতঃপর আমি দ্রুত স্বীয় কক্ষে প্রত্যাবর্তন করি এবং এ কারণে আমি ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকি।এর মধ্যে তিনি চলে আসেন এবং আমার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করেন, "হে আয়েশা, তোমার ঘন ঘন নিঃশ্বাসের হেতু কি? প্রত্যুত্তরে আমি আরজ করলাম,হে আল্লাহর রাসূল! আমার মাতা পিতা আপনার জন্য কুরবান হউক। আপনি আমার ঘরে তাশরীফ এনে জামা কাপড় খুলতে খুলতে আবার পরিধান করে বের হয়ে গেলেন, যে কারণে আমি এই ভেবে অত্যন্ত চিন্তিত হই যে, হয়ত আপনি অন্য কোনো বিবির কক্ষে গমন করেছেন।বহু খুঁজেও আপনাকে না পেয়ে অতঃপর আপনাকে দেখতে পাই যে, আপনি জান্নাতুল বাকীতে প্রার্থনায় মগ্ন।

          অতঃপর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আয়েশা! তোমার কি আশংকা হয় যে, আল্লাহর রাসূল তোমার প্রতি অবিচার করবেন? তা কখনও হতে পারে না। আসল ব্যাপার হলো, হযরত জিবরাইল আঃ আমার নিকটে এসে জানালেন যে, আজ শাবানের (১৪ই দিবাগত) ১৫ই রাত্রি। এই রাত্রিতে আল্লাহ তা'আলা কলব গোত্রের মেশ পালের অগণিত পশমের চেয়েও অধিক পাপী বান্দাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু মুশরিক, হিংসুক, আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী,

          পায়ের গিটের নিচে ইজার ( লুঙ্গি, প্যান্ট, পাজামা ইত্যাদি) ঝুলিয়ে পরিধানকারী, মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান এবং মদ্য পানকারীদেরকে আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করবেন না। হযরত আয়েশা রাঃ বললেন,  অতঃপর নবীজি আমায় সম্বোধন করে বললেন, আজ সমগ্র রজনী আমি আল্লাহর ইবাদাতে কাটিয়ে দিব।তোমার অনুমতি আছে তো?হযরত আয়েশা রাঃ আরজ করলেন, আমার মাতা পিতা আপনার প্রতি উৎসর্গ হোক!হে আল্লাহর রাসূল,নিশ্চয়ই (আমার সম্মতি আছে)।অতঃপর রাসূল সাঃ নামাজ পড়তে শুরু করেন। তিনি সিজদায় যেয়ে এত দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন যে,আমার সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলো যে, তিনি ইন্তেকাল করেছেন কি না? পরীক্ষা করে দেখার জন্য আমি তাঁর পায়ের তলায় হাত রাখি। অমনি তার পা নড়ে উঠলো। (আমার আশংকা ভুল ভেবে) আমি আনন্দিত হলাম। (বায়হাকী)

          হযরত মুয়ায বিন জাবাল রাঃ বর্ণনা করেন, রাসূল সাঃ এরশাদ করেছেন যে, "শাবানের মধ্যরাত্রিতে আল্লাহ তা'আলা সকল সৃষ্টির প্রতি তাজল্লি দান করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে মাফ করে দেন।" (তাবরানী)

-যারা লাইলাতুল বারাআতে ক্ষমা পায় না

          উপরোল্লিখিত হাদীস সহ অন্যান্য আরো হাদীস প্রমাণ করে যে, এ পূণ্যময় রজনীতেও কিছু সংখ্যক লোক আছে যারা আল্লাহর ক্ষমা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়।

          ১। মুশরিক ২। হিংসুক ৩।আত্মীয়তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী ৪। পায়ের টাখনু বা গিটের নিচে কাপড় বা প্যান্ট, পায়জামা পরিধানকারী ৫। মাতা-পিতার অবাধ্যতাকারী ৬। মদ্যপায়ী ৭। অন্যায়ভাবে হত্যাকারী ৮। অন্যায়ভাবে চাঁদা বা খাজনা গ্রহণকারী (ঘুষখোর) ৯। যাদুকর ১০।গণক ১১। হস্তরেখা দ্বারা ভাগ্য নির্ধারণকারী ১২। গায়ক ও বাদক।

          এই মহিমান্বিত রজনীতেও ওই সকল লোক মাফ পাবে না। তবে তাওবার দ্বার কারো জন্য বন্ধ নয়। যদি এসব লোক খাঁটি তাওবা করে নেয়,  আশা করা যায় করুণাময় তাদের ক্ষমা করে দিবেন। আর বান্দার হক বান্দাকে বুঝিয়ে দিতে হবে অথবা তার নিকট থেকে ক্ষমা নিতে হবে।

-প্রচলিত বিদ'আত ও বর্জনীয় কার্যাবলী

          এটি পবিত্র ও মুক্তির রজনী হওয়া সত্বেও পারিপার্শ্বিকতার কারণে তাতে কিছু বিদ'আত ও অপসংস্কৃতির প্রবেশ ঘটেছে যা একান্ত বর্জনীয়।কারণ এসব রোসম ও কার্যাবলী আমাদের ইহকাল ও পরকালের শুধুই অমঙ্গল  ও ক্ষতি ডেকে আনবে।

          ১। আতশবাজি, পটকা,গোলাবারুদ, রংবাতি ইত্যাদি ফাটানো বা পড়ানোর জন্য বয়স্ক লোকেরা বালক বালিকাদের হাতে টাকা গুঁজে দেন।যা এই পবিত্র রজনীর গাম্ভীর্য ও গুরুত্ব মারাত্মকভাবে নষ্ট করে। অযথা অর্থ ব্যয় যার অনুমতি ইসলামে নেই।এ সম্বন্ধে আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ "যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই"। (বনি ইসরাইলঃ২৭)

          দ্বিতীয়ত, আতশবাজির কারণে কোন ভয়ংকর অঘটন ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়।

          তৃতীয়ত, বাজী ফুটানোর গগনবিদারী আওয়াজ ইবাদত বন্দেগীতে বিঘ্নতার সৃষ্টি হয়।

          ২। আলোকসজ্জা এতেও অর্থের অপব্যয় হয়।

          ৩। হালুয়া রুটি পাকানো, হান্ডি বাসন বদলানো, ঘরলেপা এবং বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো এই রাতে একান্ত বর্জনীয়। কারণ প্রথমত, এতে কোন পূণ্য তো নেই উপরন্তু এতে সম্পদ ও সময়ের অপচয় হয়।