JustPaste.it

সত্যের সন্ধানে

 

ইসাবেলা

মূলঃ মাওলানা আব্দুল হালীম শরর লখনভী

অনুবাদঃ মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক

=====================================================================

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 

        কর্ডোভার উদ্যান হতে বের হয়ে ইসাবেলার সর্বপ্রথম চিন্তা এই হল যে, মুসলমানদের সাথে মােকাবিলার জন্য কোন খৃস্টিয় ধর্মবেত্তাকে প্রস্তুত করা কর্তব্য । তাই ঘরে ফেরার পূর্বে তার কলেজের অধ্যাপকের নিকট পৌঁছল এবং আদ্যোপান্ত ঘটনা তার নিকট ব্যক্ত করল  । অধ্যাপক প্রবর স্বয়ং একজন পাদ্রী এবং যীশুর খােদায়িত্বের দর্শনে বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন । তিনি ইসাবেলার অস্বস্তি দেখে তাকে বহুত তিরস্কার করলেন এবং বললেন “ইহা কি এমনই কোন প্রশ্ন যার জন্য এত অস্থির হতে হবে? ইসাবেলা ওমর লাহমীর লিখিত সে চিঠি অধ্যাপককে দেখালো । যাতে সে লিখে দিয়েছিল যে, যদি খৃস্টানগণ তার প্রশ্নের মীমাংসা করে দিতে পারে তবে সে তার সাথীগণসহ খৃষ্ট ধর্মগ্রহণ করবে । ” চিঠিখানা পাঠ করে অধ্যাপক আলােচ্য ব্যাপারে সম্মুখে অগ্রসর  হওয়ার প্রয়ােজন উপলব্ধি করলেন এবং এও বুঝতে সক্ষম হলেন যে, ব্যাপারটি সাধারণ নয় । অতএব, আরও কতিপয় বিখ্যাত ধর্মবেত্তার সহায়তারও বিশেষ প্রয়ােজন । অতঃপর অধ্যাপক ইসাবেলাকে সান্তনা দিয়ে বিদায় করলেন এবং বলে দিলেন, আগামীকল্য দ্বিপ্রহর পর্যন্ত আলােচনার সময় এবং স্থান নির্ধারণ করে দেয়া হবে ।

 

        ইসাবেলা বিদায় গ্রহণ করে চিন্তিত হৃদয়েই গৃহে গিয়ে পৌঁছল এবং সারারাত তার নেহায়েত অস্থিরতার মধ্যে কাটল । ঐ এক চিন্তাই তার মস্তিষ্কে বারংবার আঘাত করতে লাগল যে, আগামী কল্য পরিস্থিতি কোনরূপ ধারণ করবে? যদি আমাদের ধর্মবেত্তাগণ মুসলমানদের অভিযােগের মীমাংসা করে দিতে অক্ষম হন তবে সমগ্র স্পেনের খৃস্টানদের নাক চির তরে কর্তিত হবে । কোন প্রকারে রাত্রি অতিবাহিত হল  । ইসাবেলা তার প্রাতঃ কৃত্যাদি সমাপনান্তে বাইবেল হস্তে গবেষণায় নিবিষ্ট হল  । দিবা, দ্বিপ্রহর অতিবাহিত হওয়ার পর সে তার দুইজন সহচরীসহ অধ্যাপক মহােদয়ের গৃহাভিমুখে যাত্রা করল । পৌঁছার পর তারা দেখতে পেল শহরের বড় বড় পাত্রী তথায় জমায়েত হয়েছেন এবং সকলেই যেন অপর কারাে জন্য অপেক্ষমান  ।

 

        ইতিমধ্যে একজন বিশিষ্ট পাদ্রী শুভাগমন করলেন এবং সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করার মহান দায়িত্ব তার উপরই ন্যস্ত হল  । অতঃপর ইসাবেলার অধ্যাপক মহােদয় দণ্ডায়মান হয়ে যীশুর গুণকীর্তন সমাপনান্তে এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে এক বক্তৃতা প্রদান করলেন । বক্তৃতায় তিনি পরিস্থিতির মােকাবিলা করার জন্য এবং সকল বিধর্মী মুসলমানকে খৃস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টায় অসীম সাহসের সাথে অগ্রসর হওয়ার জন্য উপস্থিত ধর্মবেত্তাগণকে আহ্বান জানালেন ।

 

        জনৈক পাদ্রীঃ আমি তাে ধারণা করেছিলাম, কোন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের জন্যই আমাদের আহ্বান করা হয়েছে, কিন্তু এখানে পৌঁছে বুঝতে পারলাম অতি সাধারণ ব্যাপার  । ঐ বিধর্মীদের এখনই এই স্থানেই ডাকিয়া আনা হোক আমাদের মধ্য হতে যে কেহ তাদের অভিযােগের সীমাংসা করে দেবে । ”

 

        দ্বিতীয় পাদ্রীঃ ব্যাপারটিতাে মােটেই গুরুত্বপূর্ণ নহে । কেননা, মুসলমানদের সাথে বিতর্ক আমাদের অহরহই হয়ে থাকে; কিন্তু, যেহেতু ব্যাপক প্রচারিত হয়েছে যে, মুসলমানদের কোন অভিযােগের উত্তর খৃস্টানদের নিকট নেই । কাজেই ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । বেশ, আলােচনার জন্য একটি সময় এবং স্থান নির্ধারণ করতঃ মুসলমানদের জানিয়ে দেয়া হােক ।

 

       জনৈক খৃষ্টানঃ আগামীকল্য রবিবার! বড় গীর্জায় এলাকার সমস্ত খৃস্টান সমবেত হবে । কাজেই মুসলমানদের একটু সকালে সকালে গীর্জায়ই ডেকে আনা হােক  । হয়ত খােদাওন্দ যীশু তাদের সুপথ প্রদর্শন করবেন  ।

 

       জনৈক পাত্রীঃ আপনার প্রস্তাবটি নেহায়েত যুক্তিপূর্ণ । ইসাবেলার পিতা স্বয়ং বড় গীর্জার প্রধান যাজক; কাজেই তার সাথে যােগাযােগ করা এবং আলােচ্য ব্যাপারে তাঁর সম্মতি লাভ করাও আমাদের জন্য সহজতর হবে । কেননা তিনিই হবেন আমাদের এবং মুসলমানদের মধ্যে আলােচনার মাধ্যম ।

 

       দ্বিতীয় পাদ্রীঃ ইসাবেলার পিতা সমগ্র স্পেনের প্রধান পাদ্রী । আর সকলেই জানে যে, আজ খৃস্টধর্মের সুক্ষ্ম তত্ত্ব ও গুপ্ত ভেদ সম্বন্ধে তার চেয়ে অধিক অভিজ্ঞ আর কেহই নেই  । অতএব এ ব্যাপারে তার সহায়তা অত্যন্ত জরুরী ।

 

        মীখাইল (ইসাবেলার অধ্যাপক)ঃ তাতে কোনই সন্দেহ নেই । মােটকথা সমবেত সকলেই প্রস্তাবটি সমর্থন করল এবং মােকাবেলার জন্য দিন ধার্য হল রবিবার  । ইসাবেলার কথায় অধ্যাপক মীখাইল ওমর লাহমীর নামে একখানা চিঠিও লিখে দিল, যাতে সে নির্বিঘ্নে গীর্জায় প্রবেশ করতে পারে । সূর্য অস্তমিত হওয়ার প্রায় দুই ঘন্টাকাল বাকী আছে  । ইসাবেলা উদ্যানে যাওয়ার পূর্বে তার জরুরী কর্মগুলি সমাধা করে নিল । ইতােমধ্যে তার দুইজন সহচরীও এসে পৌঁছল সে তাদের, সঙ্গে নিয়ে সানন্দে উদ্যানের দিকে যাত্রা করল ! উদ্যানে পৌঁছে দেখতে পেল ওমর লাহমী! ও মাআ'য তাদের আরাে কতিপয় সঙ্গী সহ তথায় মৌজুদ । ইসাবেলা স্বহস্তে অধ্যাপক মীখাইলের লিখিত চিঠিখানি ওমর লাহমীকে প্রদান করল । তা’ উন্মুক্ত করতঃ তারা সকলেই পাঠ করল  ।

 

       মাআযঃ (ইসাবেলাকে লক্ষ্য করে) আপনি যে কষ্ট স্বীকার করেছেন তজ্জন্য আপনাকে ধন্যবাদ । আপনার এই প্রচেষ্টার ফলে যদি আমাদের উভয় পক্ষের কারাে হৃদয় সত্যের আলােকে উদ্ভাসিত হয় তবে এর প্রতিদান আলাহ্ তায়ালা সর্বপ্রথম আপনাকেই প্রদান করবেন  ।

 

       ওমর লাহমীঃ (সাথীদের লক্ষ্য করে) এই ভদ্রমহিলা খৃস্টিয় ফিল ছফা এবং যীশুর খােদায়িত্বের দর্শনে অভিজ্ঞ । দেখুন, এর আন্তরিক প্রেরণা কত মহৎ । আমাদের কুফরীর অন্ধকার হতে উদ্ধার করার জন্য কত চেষ্টা করছেন ।

 

       ইসাবেলাঃ আমি আমার খােদা ও যীশুর এক নগণ্য সেবিকা মাত্র । আপনারা আমাদের আহ্বানে যে সাড়া প্রদান করেছেন সেজন্য আপনাদের জানাই ধন্যবাদ!

 

       জনৈকঃ মুসলিমঃ আস্তাগফিরুল্লাহ্! দেখুন, খৃষ্টানগণ কত বড় মুশরেক, যীশুকে বলে খােদা! নিশ্চয়ই এদের জ্ঞান-বুদ্ধি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে; নতুবা জন্ম মৃত্যুর অধীন এক জন মানুষকে............. ।

 

       ওমর লাহমীঃ আপনি তো এইখানেই বিতর্ক আরম্ভ করে দিলেন, ইহার মীমাংসা তো আগামী কল্য বড় গীর্জার অভ্যন্তরে ঘটিবে । (ইসাবেলাকে লক্ষ্য করে)  আপনি আমাদের পক্ষ হতে পাদ্রী সাহেবগণকে এ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত করে দিবেন যে,

 

       আমরা প্রাতেঃ নাশতা ইত্যাদি সমাধান করে বড় গীর্জায় হাজির হব । অতঃএব ইসাবেলা অন্যান্য দিনের নয় উদ্যানে বসে আলাপে মশগুল না হয়ে আপন সহচরিগণসহ উদ্যান হতে বাহির হয়ে গৃহাভীমুখে যাত্রা করল । কেননা তাকে গৃহে ফিরে পরদিনের সভার এন্তেযাম ও জরুরী পরামর্শ করতে হবে  ।

 

প্রথম অধিবেশন

        ইসাবেলা ঘরে পৌঁছে নিজ কাজে ব্যস্ত হল । অপরদিকে ওমর লাহমী এবং মাআ'যও গৃহে পৌঁছে কোরআন হাকীম এবং বাইবেল নিয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন । যে সকল জরুরী পয়েন্টে আলােচনা করতে হবে তা সংক্ষেপে নােট করে নেন । আজ রবিবার । প্রাতেঃই জানা গেল, অদ্যকার এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের খবর কর্ডোভা নগরীর আবাল-বৃদ্ধ বনিতা কারোই কর্ণে পৌঁছতে বাকি নেই । সকলে দলে দলে গীর্জায় যাত্রা করল । কতিপয় বিশিষ্ট মুসলিম ব্যতীত অন্য কোন মুসলমানকে গীর্জায় প্রবেশ করতে দেয়া হবে না । ফলে অগণিত মুসলমান গীর্জার বহিরাঙ্গণ হতেই নিরাশ হৃদয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয় । ওমর লাহমী, মা'আয এবং কর্ডোভার কতিপয় উলামায়ে ইসলাম গীর্জার দ্বারে পৌঁছালেন । কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রাপ্ত হওয়ার পর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন । তারা দেখলেন, কর্ডোভার বিখ্যাত পাদ্রীগণ, মুসলমানেরা যাতে খৃষ্টধর্মের ছায়ায় স্থানলাভ করতে পারে তদুদ্দেশ্যে সেজদার অবস্থায় নিপতিত, প্রার্থনায় রত আছেন । কিছুক্ষণ পর আলােচনা শুরু হল । ইসাবেলা এবং তার সহচরিগণ সকলেই সভায় উপস্থিত ।

 

       মীখাইলঃ জানতে পারলাম, খৃষ্টধর্ম সম্পর্কে আপনাদের অন্তরে কিছু সন্দেহের উৎপত্তি হয়েছে, তার নিরসনকল্পে আপনারা এখানে শুভাগমন করেছেন । আর এ ওয়াদা করেছেন যে, সঠিক উত্তর পেলে আপনারা ইসলাম পরিত্যাগ করে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করবেন ।

 

       ওমর লাহমীঃ খৃষ্টানদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও তাদের ধর্মের শিক্ষা সম্বন্ধে আমাদের কোনরূপ সন্দেহ নেই, বরং আমাদের ইয়াকীন এবং দৃঢ় বিশ্বাস, আপনাদের ধর্মটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন । যদি আপনারা নিজ ধর্মবিশ্বাসের যৌক্তিকতা প্রদর্শন এবং সন্তোষজনক উত্তর প্রদানে সক্ষম হন, তবে নিশ্চয়ই আমরা সকলে নিঃসন্দেহে আপনাদের ধর্ম গ্রহণে প্রস্তুত রয়েছি ।

 

        অতঃপর অধ্যাপক মীখাইল পাদ্রীগণের মধ্য হতে জনৈক প্রবীণ ব্যক্তিকে আলােচনায় অংশ গ্রহণ করতে ইঙ্গিত করলেন । তিনি কালবিলম্ব না করে ওমর লাহমীর সম্মুখে এসে উপবেশন করলেন । এই প্রবীন পাদ্রীসাহেবের নাম পিটার্স । আরবী ভাষা এবং ইসলামী ধর্মগ্রন্থে বিশেষ পারদর্শি বলে তার অসম্ভব রকম খ্যাতী রয়েছে । ইসলামের বিরুদ্ধে কতিপয় পুস্তক প্রণয়ন করে । তিনি খৃষ্টান জগতে বিশেষ গৌরবের আসন দখল করে আছেন । মােটকথা সমগ্র মুসলমানদের সাথে তর্কযুদ্ধে মােকাবেলা করার জন্য তিনিই সুযােগ্য ব্যক্তি । তিনি ওমর লাহমীর সাথে বিশেষ গাম্ভীর্য সহকারে ও মুরুব্বীয়ানা ভঙ্গিতে আলােচনায় প্রবৃত্ত হলেনঃ আমি শুনতে পেলাম, খােদাওন্দ প্রেরিত পল শরীয়তকে অভিশাপ বলে ব্যক্ত করেছেন, যে সম্বন্ধে আপনার এক বিরাট অভিযােগ । যাহোক, টা তাে একটা আনুসঙ্গিক প্রশ্ন; বুনিয়াদী বা মৌলিক বিষয়ের ওপর আলােচনা হওয়া কর্তব্য ।

 

        আপনারা মুসলমান এবং কুরআনের ওপর বিশ্বাসী; কাজেই খােদাও যীশু এবং খৃষ্ট ধর্মের ফয়সালা আপনাদের কুরআন দ্বারা হওয়াই সমীচীন ।

 

       ওমরঃ আমি তাে আমার চিঠির মাধ্যমে পূর্বেই আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করে দিয়েছি, আপনি আপনার বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেও তা স্বীকার করেছেন । অথচ আপনি এখন অন্য বিষয়ের আলােচনার অবতারণা করতে উন্মুখ  । আমি লিখে দিয়েছি, শরীয়ত এবং অভিশাপ সম্বন্ধে আলােচনা হবে, এখন তাতে আপনার আপত্তির কি কারণ থাকতে পারে?

 

       পিটার্সঃ 'আমরা আপনার আসল প্রশ্নের জবাব দিতে ও প্রস্তুত, তবে প্রথমে মৌলিক বিষয়ের সমাধান হােক এবং তাও আপনাদের কুরআন দ্বারাই করা হবে । খােদাওন্দ যীশুকে আপনাদের কুরআনে কি রহুল্লাহ কলিমাতুল্লাহ বলা হয় নি? তার সম্বন্ধে কি কুরআনে লেখা হয় নি যে, তিনি মৃতকে জিন্দা করতেন? অতএব যদি আপনাদের ঈমান কুরআনের উপর থাকে, তবে যীশুর ইবনুল্লাহ’ (খােদার পুত্র) হওয়ায় আপনাদের সন্দেহ কেন?

 

       ওমর লাহমীঃ আপনি তো একটি স্বতন্ত্র বিতর্ক শুরু করে দিলেন, যার সাথে আজকের আলােচনার দূর-দূরান্তের সম্পর্কও নেই । আমাদেরকে তাে শুধু শরীয়ত এবং অভিশাপের সম্পর্কটি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই এখানে আহ্বান করা হয়েছে । যদি আপনার উক্ত বিষয়ে কিছু বলবার থাকে, তবে বলুন; নতুবা আমাদের বিদায় দিন ।

 

       পিটার্সঃ আমি আপনাদেরই কুরআন আপনাদের সম্মুখে পেশ করছি এবং চাচ্ছি যে, প্রথমে মৌলিক বিষয়ের সমাধান হয়ে যাক, কিন্তু আপনি মূল থেকে সরে গিয়ে শাখা প্রশাখায় বিচরণ করতে চাচ্ছেন । এর দ্বারা নিঃসন্দেহে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এর কোন জবাব আপনার নিকট নেই ।

 

       ওমরঃ বেশ কথা ! আপনি মৌলিক বিষয়ের আলােচনা করতে চান, অথচ আপন ধর্ম গ্রন্থাদি হতে দূরে থেকে এবং কুরআনের আশ্রয় গ্রহণ করে? যদি মৌলিক বিষয়ে আলােচনা করতে হয়, তবে আসুন সর্বপ্রথম এই আলােচনা হােক যে, হযরত আদম (আঃ) গােনাহ করেছিলেন কি না । যদি তিনি গােনাহ করে ছিলেন বলে সাব্যস্ত হয়, তবে এই কথার উপর আলােচনা হবে যে, ঐ গােনাহ বংশানুক্রমে মানব জাতির মধ্যে সংক্রমিত হয়ে আসছে কিনা ! অর্থাৎ আদমের গােনাহের দরুণ সমস্ত মানুষ স্বভাবতঃ ও জন্মগত ভাবেই গােনাহগার হয়ে পড়েছে কিনা? যদি তরুণ সমস্ত মানুষ গোনাহগার হয়ে থাকে বলে প্রমাণিত হয়, তবে আলোচনা হবে যে, গােনাহ কি ভাবে বিদূরিত হতে পারে? অতঃপর যীশুর বেগােনাহ্ বা নিষ্পাপ হওয়া সম্বন্ধে বাইবেল অনুযায়ী আলােচনা হবে । এরপর আপনাকে প্রমাণ দিতে হবে যে, যীশু ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন এবং সমস্ত বেগােনাহ মানুষের পরিবর্তে তিন দিন পর্যন্ত জাহান্নামে অবস্থান করেছেন । কোরআন আপনাদের সম্বন্ধে কি বলে সে আলােচনা নিষ্প্রয়ােজন, আপনাদের দাবী বাইবেল দ্বারাই প্রমাণীত হওয়া বিধেয় ।

 

       পিটার্সঃ আপনার সমস্ত কথাই বেকার । আমরা তাে কোরআন দ্বারাই প্রমাণ করবো যে, যীশু রূহুল্লাহ এবং কলেমাতুল্লহ ছিলেন, তিনি মৃতকে জীবিত করেছেন, অতএব খৃষ্ট ধর্ম সত্য ।

 

       ওমরঃ বেশ, আমি এ ব্যাপারে (ইসাবেলার দিকে ইঙ্গিত করে) আপনাকে বিচারক মনােনীত করলাম । এখন আপনাকেই ফয়সালা করতে হবে যে, আমি আপনার চিঠির জবাবে কি লিখেছিলাম এবং আপনারা কেন আমাদেরকে এখানে আহবান করেছেন?

 

       ইসাবেলাঃ আসল আলােচ্য বিষয় তো এটাই যে, শরীয়ত অভিশাপ কিনা । যদি অভিশাপ হয়, তবে এর অনুসরণ করে খৃষ্টানগণ কেন অভিশপ্ত হচ্ছে? কিন্তু শ্রদ্ধেয় পিটার্সের কথাও অমূলক নয় । তবে এতে আমার ফয়সালা হলাে প্রথমে আপনার অভিযােগেরই জবাব দেয়া হােক,

 

        অতঃপর শ্রদ্ধেয়- পিটার্স কুরআন হতে যে প্রশ্ন করবেন তার জবাব দিবেন  ।

 

       ওমরঃ আলােচ্য বিষয় নির্ধারিত থাকা সত্বেও আপনাকে অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপারে আলােচনার স্বাধীনতা দেয়া আমার খুশীর উপর নির্ভরশীল  । যা হােক, আমি আপনার নিকট ওয়াদা করছি, যদি আপনি আমার প্রশ্নের সমাধান দিতে পারেন, তবে আমি আপনাকে স্বাধীন মত প্রশ্ন করবার অনুমতি দেব । কিন্তু আমার দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমরা যখন খৃষ্টান হয়ে যাব, তখন আর অতিরিক্ত প্রশ্নের কি প্রয়ােজন থাকতে পারে?

 

       পিটার্সঃ আচ্ছা, জনাব! আপনার প্রশ্নটি একটু খুলে বর্ণনা করুণ যেন তার উদ্দেশ্য সবিস্তারে প্রকাশ হয় ।

 

       ওমরঃ আপনি আমার এক একটি কথার জবাব ক্রমান্বয়ে দিতে থাকুন; তা হলে আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য সবিস্তারে প্রকাশ পাবে । বলুন, ওল্ড টেষ্টামেন্টে উল্লেখিত “তুমি ব্যভিচার করাে না, চুরি করাে না, নরহত্যা করাে না , প্রতিবেশীকে দুঃখ দিও না" ইত্যাদি আদেশসমূহ শরীয়ত সম্পর্কিত কিনা?

 

       পিটার্সঃ অবশ্যই এগুলি শরীয়ত সম্পর্কিত আদেশ ।

 

       ওমরঃ আর শরীয়ত সম্পর্কে পলের ফতােয়া কি?

 

       পিটার্সঃ 'ফতােয়া' কি তা বুঝতে পারলাম না ।

 

       ওমরঃ আপনি আমার কথা খুব ভালভাবেই বুঝতে পেরেছেন, অবশ্য জবাব প্রদানে দ্বিধায়পতিত হয়েছেন । পল শরীয়তকে অভিশাপ বলেছেন কিনা, একথার জবাব দিন!

 

       পিটার্সঃ পল শরীয়তকে এই অর্থে অভিশাপ বলেছেন যে, শরীয়তের মগজ বা সার বিষয় স্বয়ং যীশুর রূপ ধারণ করে আগমন করেছে । এমতাবস্থায় মগজ পরিত্যাগ করে ছিলকা কামড়াতে থাকা মূর্খতা নয় কি?

 

       ওমরঃ আমিও এটাই বলতে চাই যে, পল শরীয়তকে দেহ এবং যীশুকে আত্মা আখ্যায়িত করে শরীয়তকে অভিশাপ বলেছেন । আর যেহেতু আপনারই স্বীকৃত মতে ওল্ড টেষ্টামেন্টের ঐ আদেশগুলি শরীয়ত সম্পর্কিত; অতএব হত্যা, চুরি, ব্যাভিচার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকাও অভিশাপ ।

 

       পিটার্সঃ আসল কথা হলাে, পবিত্র আত্মার শুভদৃষ্টির সহায়তা ব্যতীত এই সব সুক্ষ তত্ত্ব বােধগম্য হওয়া আপনার জন্য অসম্ভব । আর কোন বিষয় কারাে বােধগম্য না হলেই তা ভুল বলে প্রমাণিত হয় না । খােদাওন্দ প্রেরিত পল শুধু বাহ্যিক শরীয়তকে অভিশাপ বলেছেন, সর্বপ্রকার শরীয়তকে নয় ।

 

       ওমরঃ যথার্থ বলেছেন! পল দৈহিক শরীয়তকে অভিশাপ বলেছেন এতে কোনই সন্দেহ নেই । এখন আপনি বলুন, ব্যভিচার, চুরি, পিতামাতার অবাধ্যাচরণ ইত্যাদি হতে বিরত থাকা কি দৈহিক বা বাহ্যিক শরীয়তের বিষয় নয়?

 

       পিটার্সঃ আপনি ঐ এক কথার ওপরই দাঁড়িয়ে আছেন । জেনে রাখুন, পলের মুকাবিলায় যীশুর বাক্যই অগ্রগণ্য । আর যীশু বলেছেন,“তােমরা শরীয়তের ব্যবস্থানুযায়ী কার্য কর । ” (মথিলিখিত বাইবেল দ্রষ্টব্য) ।

 

       ওমরঃ আপনার কথায় প্রমাণিত হল যে, মানুষের মুক্তির জন্য শরীয়ত ব্যবস্থা পালন অত্যাবশ্যকীয় । যদি এ কথা সত্য হয়, তবে আপনারা আপনাদের খোদা ওন্দের পূত্রকে ক্রুশে হত্যা করে পাপের প্রায়শ্চিত্তের কাহিনী কেন রচনা করেছেন? শরীয়তের ব্যবস্থানুযায়ী চলাই যদি আবশ্যকীয় হয় তবে এই অনর্থক প্রায়শ্চিত্তের ঝামেলা খাড়া করার কি প্রয়ােজন? যীশুও আত্মহত্যা করে বা নিহত হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে যাওয়ার পরেও কি শরীয়ত ব্যবস্থার নির্দেশ মােতাবেক চলার প্রয়ােজন বাকী রয়ে গেল?

 

পিটার্সঃ আমাদের খােদাও তার ব্যবস্থার নির্দেশ মােতাবেক চলার , আদেশ আমাদের দিয়েছেন বলেই আমরা তদ্রুপ চলি  । এ ব্যতীত আমরা আর কিছুই জানি না । অবশ্য প্রায়শ্চিত্ত ব্যতীত শুধু শরীয়তের অনুসরণ দ্বারা মুক্তি পাওয়া যাবে না ।

 

       ওমরঃ তবেত মুসা, দাউদ, সােলায়মান, আইয়ূব, ইউসূফ, নুহ এবং অন্যান্য আম্বিয়া (আঃ) ও তাদের উম্মতগণ মুক্তি পাবেন না বলে প্রতীয়মান হয় । কেননা তাদের নিকট শরীয়ত ব্যতীত মুক্তির অন্য কোন ব্যবস্থা ছিল না  ।

 

       পিটার্সঃ খােদাওন্দ যীশুর পূর্বে মুক্তির ব্যবস্থা শরীয়তই ছিল, কিন্তু তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার দ্বারা উক্ত নিয়ম পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে এবং এই প্রায়শ্চিত্তই সাব্যস্ত হয়েছে মুক্তির উপায় ।

 

       ওমরঃ আপনি সর্বপ্রথম পলের বাক্যানুযায়ী শরীয়তকে অভিশাপ বলে স্বীকার করেছেন । অতঃপর অভিশাপ হওয়া অস্বীকার করেছেন, কিন্তু এই শরীয়তই যে একমাত্র মুক্তির ব্যবস্থা এখন -একথা স্বীকার করতে আপনি সম্মত নন । আপনি কি আপনার পূর্ববর্তী কোন মহৎজনের বাক্যকে আপনার দাবীর স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করতে পারেন?

 

       একব্যক্তিঃ মহােদয়গণ! আসল কথা হলাে এই সব বিষয়ের আলােচনা সম্পূর্ণ ধর্মহীনতা । এর সম্পূর্ণই গুপ্তভেদ সম্পর্কিত ব্যাপার । খােদাওন্দ প্রেরিত পল শরীয়তকে নিঃসন্দেহে অভিশাপ বলেছেন এবং বাস্তবেও তা অভিশাপ, কিন্তু আপনারা এইসব গুপ্ত ভেদ বুঝবার যােগ্যতা রাখেন না । আমাদের মুক্তির একমাত্র উপায় যীশুর খােদায়িত্ব এবং তার প্রায়শ্চিত্ত  । কেননা তিনি গােনাহ থেকে মুক্ত এবং পবিত্র দেহ বিশিষ্ট খােদা ছিলেন  ।

 

       দ্বিতীয় ব্যক্তিঃ নিজেরা আপোসে ঝগড়া বাধাইও না ! তােমরা তাে শ্রদ্ধেয় পিটার্সের কথার প্রতিবাদ শুরু করে দিয়েছ ।

 

       ওমরঃ গলদ এবং ভিত্তিহীন কথার পরিণতি এইরূপই হয়ে থাকে । এখন আপনাদেরই আর এক ব্যক্তি যীশুর প্রায়শ্চিত্ত এবং খােদায়িত্বের বিতর্ক শুরু করে দিয়েছেন । প্রথমে শরীয়ত এবং অভিশাপের ব্যাপার শেষ হতে দিন ।

 

       পিটার্সঃ আপনাকে সঠিক জবাব দেয়া হয়ে গিয়েছে । এখন এক সপ্তাহের সময় দেয়া যাচ্ছে যদি এই সময়ের মধ্যে আপনার অন্তরের খটকা বিদূরীত না হয়, তবে পুনরায় আসতে পারেন ।

 

       ওমরঃ আপনি শরীয়তকে অভিশাপ মনে করেন না । আর আপনারই অপর ভাই বলছেন, শরীয়ত অবশ্যই অভিশাপ এবং পল যা লিখেছেন তা সম্পূর্ণ সত্য  । এখন বলুন, আপনাদের উভয়ের মধ্যে কার কথা সত্য?

 

       পিটার্সঃ যারা খৃষ্টধর্মের গুপ্ত ভেদ সম্বন্ধে এরূপ বলে তারা অজ্ঞ । অতএব আপনি তাদের কথার প্রতি মােটেই লক্ষ্য করবেন না  ।

 

       ওমরঃ (ইসাবেলাকে উদ্দেশ্য করে) আপনি বলুন, এই উভয়ের মধ্যে কে সত্য? আর শরীয়তকে অভিশাপ লেখার ব্যাপারে বাস্তবেই কি পল ভুল করেছেন?

 

       ইসাবেলাঃ আমি তো আপনাদের আলােচনা শ্রবণ করবার উদ্দেশ্যে এখানে আগমন করেছি মাত্র । কাজেই কোন পক্ষের ব্যাপারেই দখল দিতে আমি অক্ষম । অবশ্য আমি আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মহােদয় সমীপে আবেদন করছি যে, তিনি তাঁর শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার সাহায্যে অত্র সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করুন । কেননা আমাদের সম্মানিত অতিথির কথা আর কি বলব? আমি নিজেই এখনও এ সম্বন্ধে বুঝতে সক্ষম হই নি ।

 

 

═──────────────═