---ইতিহাসের পাতা থেকে ---
============================
পলাশী যুদ্ধোত্তর বিপ্লবের ধারা
গোলাম আহমাদ মোর্তজা
---------------------------★
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) মাওলানা লিয়াকত আলির নেতৃত্বও সেদিন সারা দেশকে তােলপাড় করেছিল। যে কথাকে কেন্দ্র করে তিনি জনসাধারণকে উত্তপ্ত করতে পেরেছিলেন, তা হচ্ছে-ইংরেজরা ছলে বলে সমস্ত মানুষকে খৃষ্টান করে ফেলবে; কোরআন, পুরাণ সব খতম হয়ে যাবে। একদিকে মাওলানা লিয়াকত ছিলেন বিখ্যাত বক্তা, অন্যদিকে ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী ও সংগ্রামী সংগঠক। বাগচি মহাশয়ও এর সমর্থনে লিখেছেন, “ইংরেজরা এবার স্থানীয় লােকদের জোর করে খৃষ্টান করবে, কিংবা অন্যভাবে,তাদের জাত মারবে-এই জনরবের মূলে ছিলেন চুস্রবাগের এক মেীলভী। নাম লিয়াকত আলী” (পৃষ্ঠা ১৫৩) এলাহাবাদেও এই আগুন চরম রূপ নিয়েছিল ।একদিন ইংরেজ নেতা কর্নেল সিম্পসন চমকে উঠলেন বিপ্লবীদের কামানের আওয়াজে। ঘােড়া ছুটিয়ে সেখানে গেলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তােমরা কেন এরকম করছাে?' উত্তরে সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবীরা গুলি করলেন । গুলিতে তাঁর মাথা না উড়ে টুপি উড়ে গেল। সংবাদ পেয়ে আট জন খাস ইংরেজ সৈন্য তাঁকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলো। কিন্তু গুলিবৃষ্টিতে সকলকেই নিহত হতে হলো। এরপর বিপ্লবীরা জেলখানা ভেঙ্গে কয়েদীদের মুক্ত করে দিল। রেলের কারখানা ধ্বংস করে টেলিগ্রাফের তার কেটে দিল -"দুর্গের বাইরে যেখানে যত ইংরেজ ছিল তাদের প্রায় সবাই নিহত হলো। কোতােয়ালীর মাথায় উড়লো মুসলমানদের সবুজ পতাকা। বিদ্রোহীদের তােপে রেলইয়ার্ডের ইঞ্জিনগুলাে চূর্ণ হয়ে যেতে লাগল" এরপর সেনাপতি মিঃ নীল ১৮ই জুন নানা প্রদেশ হতে ইংরেজ সৈন্য যােগাড় করে একটা বড় স্টিমারে কামান সাজিয়ে গঙ্গা নদীর দুই ধারে বেপরােয়া ভাবে গােলা বর্ষণ করতে লাগলেন। কামানের বর্ষণে নগর জনশুন্য হল, অর্থাৎ ইংরেজ প্রতিষ্ঠা করলাে তাদের পুনর্শাসন। মারাঠা নেতা নানাঃ বাজীরাও ছিলেন মারাঠা নেতা। তাঁর সঙ্গে ইংরেজদের ভাব-ভালোবাসা ছিল পুরো মাত্রায়। ইংরেজদের প্রেম কিন্তু বাজীরাওয়ের মত মৌলিক বা নির্ভেজাল ছিল না,বরং ছিল ভন্ডামির উপর সত্যের প্রলেপ।বাজীরাওয়ের ঔরসজাত পুত্র না থাকায় তিনি ইংরেজ নেতাদের অনুমতি ও প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে পালিত পুত্র নানাকে দত্তক নেন এবং মৃত্যুর পূর্বে একটা অনুরােধ পত্র লিখে রেখে যান। নানা সেই সাহসেই রাজকীয় মর্যাদা নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে সুব্যবহার করে গেছেন বরাবর। এমনকি ইংরেজদের আপদে বিপদে সৈন্য দিয়ে, অর্থ দিয়ে সর্বোতভাবে সাহায্য করে এসেছেন। দাগাবাজ ইংরেজদের দাগাবাজির ইতিহাস তাঁর জানা ছিল,কিন্তু তাঁর সঙ্গেও যে দাগাবাজি করা হবে তা তিনি কল্পনা করতে পারেন নি। বাজীরাও এর মৃত্যুর পর যখন তাঁর পিতৃস্বত্ব উপেক্ষা করা হয় তখন তিনি খুব বিপদে পড়েন । ঠিক তখন তিনি এমন একজনকে খুঁজছিলেন যিনি তাঁর পক্ষ থেকে ইংল্যান্ডে যাবেন সরাসরি আবেদন জানাতে। অবশেষে ইতিহাসে চাপা পড়া বিখ্যাত নেতা আজিমুল্লার সাক্ষাত পেলেন। আজিমুল্লাহ খুব সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলে কিন্তু খুব দরিদ্র। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে তার মাকে চাকরানীর কাজ পর্যন্ত করতে হয়েছিল । ছেলেকে মানুষ করে গড়ে তােলা ছিল তার বুক ভরা আশা । তাই শৈশবের প্রাথমিক কাজগুলাে অনেক কষ্টে তিনি সেরে রেখেছিলেন । বুদ্ধিমান বালক কিন্তু পরে বুঝতে পারলেন যে,স্কুলে লেখাপড়া করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এক ইংরেজের ভৃত্যের কাজ করতে শুরু করেন। সেই সাহেবটি ফরাসী ভাষায় ছিলেন খুব দক্ষ।আর ইংরেজী তাে তাঁর মাতৃভাষা । কিছুদিনের মধ্যে আজিমুল্লাও ইংরেজী ও ফার্সী ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন এবং সাফল্যের চিহ্ন স্বরূপ তিনি একটি স্কুলের শিক্ষক হলেন। অবশ্য শিক্ষক হবার পূর্বে তিনি সাহেবের চাকরি ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন । ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে নানা সাহেব ইংল্যান্ড যাবার জন্য তাঁকে অনুরােধ জানান। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আলাপী, মিষ্টভাষী, সুদর্শন যুবক । ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি নানার আবেদন পেশ করেন। কিন্তু তাঁকে বিফল হতে হয়। ঠিক তখন আর একজন ভারতীয় রঙ্গ বাপুজী সেতারার রাজার আবেদন নিয়ে ইংল্যান্ডে পৌঁছান। তিনিও বিমুখ হয়ে ফিরে আসতে মনস্থ করলে আজিমুল্লাহ তাঁর দ্বারা নানা সাহেবকে সংবাদ দেন যে, তাঁর দেশে ফিরতে দু'তিন বছর দেরী হতে পারে। সেই সঙ্গে আরও জানালেন, আমার কথায় যখন কাজ হলো না তখন ইংরেজকে ভারত থেকে ছাড়ানাের রাস্তা করে তবেই ফিরব'! ওদিকে বিলেতে বিদ্রোহী দলের অনেক মুসলমান ইংরেজ-ধ্বংসের কাজে সেখানে আসা যাওয়া ও ঘাঁটি তৈরীর কাজ পূর্বেই শুরু করেছিলেন। তাঁরা আজিমুল্লাকে পরামর্শ দিলেন যে, নানার দ্বারা প্রত্যেক ইংরেজ প্রেমিক হিন্দু রাজাদের বিদ্রোহী দলে আনতে পারলে প্রভূত ও দ্রুত সাফল্য পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য আজিমুল্লাও একথা ভেবেছিলেন। আজিমুল্লার মিশুকে ভাব ও সুন্দর চেহারার সুবাদে তিনি সেখানে বহু রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ও তাঁদের বাড়ীর মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করতে সক্ষম হন। দেশে ফেরার পরেও ‘ডার্লিং আজিমুল্লাহ' বলে তাঁকে অনেকে চিঠিপত্র লিখতেন তাঁদের মধ্যে অনেক রাজপরিবারের ছেলেমেয়েও ছিলেন। যেহেতু তখন সারা মুসলিম বিশ্ব তুরস্কের সুলতানকে খলিফা বলে সম্মান করতাে, তাই ইংল্যান্ড থেকে তিনি তুরস্কে গিয়েছিলেন। ওখানে গিয়ে তিনি জানতে পারলেন যে, বৃটিশরা বিশ্বের বহু জায়গায় তাদের রাজত্বে পরাজিত হচ্ছে ও মার খাচ্ছে। ওখানে থেকে তিনি রাশিয়ায় যান।টাইমস' পত্রিকার সংবাদিক মিঃ রাসেল রাশিয়ায় থাকতেন। আজিমুল্লাহ তাঁর আত্মীয় আত্মীয়াদের পত্র যােগাড় করে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে তাঁর কাছেই থাকতে শুরু করেন। মিঃ রাসেলকে তিনি 'বন্ধু' বলেন এবং তাকেও বন্ধু বলিয়ে নিলেন। পরে রাসেলের যুক্তি ও সহায়তায় তিনি রাশিয়া থেকে মিশরে যান। ওখানে প্রয়ােজনীয় প্রচার ও অপপ্রচারের কাজ সেরে শেষে ভারতে ফেরেন। আজিমুল্লা খানের কর্মজীবন ও মৃত্যু সম্বন্ধে Eighteen Fifty Seven পুস্তকের ১২৬- ১৪৫ পৃষ্ঠায় ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ সেন বিস্তারিত প্রামাণ্য তথ্য পেশ করেছেন । এবার ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ ও তাতিয়া তােপ সম্পর্কে কিছু বলছি। রাণী লক্ষ্মীবাঈ দাগাবাজ ইংরেজের কাছ থেকে যখন অত্যন্ত আঘাত পেলেন তখন স্বামীহারা রাণী তাঁর পুত্রের মুখের দিকে চেয়ে নিজেই নেতৃত্ব দিতে সংকল্প করেন। ওদিকে তাঁতিয়া তোপী ছিলেন নানার নিকটাত্মীয়। বলাবাহুল্য, কানপুর-বিঠুরের বিপ্লবে জড়িয়ে আছেন আজিমুল্লাহ, তাঁতিয়া তােপী, নানা। সেনা ঘেরাও ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত ও মজবুত। তদুপরি সাথীদের মনােবল বাড়ানাের জন্য আমি বললাম, আজ কোন ক্রেক ডাউন হচ্ছে বলে মনে হয় না। এটা সাধারণ সৈন্য ঘেরাও! সতর্কতার সাথে দু' দু'জন করে বেরিয়ে যান। অবশ্যই আমরা ব্যারিকেড ডিঙ্গিয়ে যেতে সক্ষম হবাে ।আমার কথায় সবাই আশ্বস্ত হলেন। দু দুজন করে বেরিয়ে পড়লেন। আমি আর একজন পাকিস্তানী ভাইকে সাথে নিয়ে সবার পিছনে পড়ে গেলাম। এমন সময় আমার মনে হলাে কোন কাশ্মীরী ভাইকে আমার সাথে রাখা প্রয়ােজন ছিল,কারণ এখানের পথ ঘাট আমাদের চেনা নেই।কাশ্মীরী ভাষাও আমরা জানি না।আমার যখন এ দিকটি খেয়াল হলাে, তখন সময় অনেক গড়িয়ে গেছে, এক সঙ্গীন অবস্থার মুখােমুখী আমরা।গ্রামের চতুর্দিকেই গােলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। আমাদের অনেক সাথী আর্মিদের পর্যুদস্ত করে তখন মূল ব্যারিকেড পেরিয়ে গেছে। আমি বেরনাের কোন পথ পাচ্ছিলাম না। এমন সময় কমান্ডার আবু খালেদ ভাইকে আমাদের দিকে এগুতে দেখলাম। ভাবলাম, যে দিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা তিনি করেছিলেন, হয়তাে আর্মিরা তাঁর পথ আগলে রেখেছে। আবু খালেদ ভাই এর ব্যর্থতা আমাদের জন্য বিরাট সহায়তা হিসাবে প্রতিভাত হলাে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার ফিরে এলেন কেন? তিনি বললেন, আমি গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে সেনাদের সামনে এগুতেই দেখি, সেনাদের হাতের নাগালে এসে গেছি। ওরা আমাকে হাতিয়ার ফেলে দেয়ার নির্দেশ দিল। আমি কাল বিলম্ব না করে ফায়ারিং করতে করতে এদিকে চলে এলাম। ঝুকিপুর্ণ যাত্রাঃ তিনজন একসাথে আর্মি ব্যারিকেড ডিঙ্গিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম । ঘটনা ক্রমে আমাদের তিন জনের মধ্যে মাত্র বন্দুক ছিল একটি। আমি তিন জনের অগ্রভাগে হাঁটছি। আবু খালেদ ভাই মধ্যে আর করীম ভাই বন্দুক উঁচিয়ে সবার পিছনে। আমরা অতি সন্তর্পনে পথ চলে গ্রামের শেষ প্রান্তের একটি ঘন সফেদা বাগানে এসে পৌঁছালাম । তখন রাতের আধার ফুটে সকাল হয়ে গেছে।যেই না ব্যারিকেড পেরিয়ে ওপারে যাওয়ার জন্য এলাম, আর্মিদের সাথে আমাদের চোখাচুখি হয়ে গেল। ওরা হাক দিল, "তােমরা কারা?" আমরা দৌড়ে একটি ধান খেতে লুকিয়ে শুয়ে পড়লাম। আর্মিরা আমাদের দিক লক্ষ্য করে শত শত গুলি বর্ষণ করল । কিন্তু আমাদের গায়ে লাগেনি। আর্মিরা অব্যাহত গােলা বৃষ্টি বর্ষণ করছে, এর মধ্যেই আমরা দিক বদল করে ক্রোলিং করে ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে সামনে এগুতে লাগলাম। বহুদূর পর্যন্ত ধান খেত বিস্তৃত ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যে সব বন্দুক দিয়ে আর্মিরা ফায়ার করছে সেগুলাের রেঞ্জ দেড় কিলােমিটারের বেশী নয়। এজন্য নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়ার জন্য আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি । ধান খেতে গভীর কাদায় আমরা বেশী দ্রুত অগ্রসর হতে পারছিলাম না। বার বার শক্তি হারিয়ে গতি শ্লথ হয়ে যাচ্ছিল। ভাের সাড়ে চারটা থেকে বেলা ন'টা পর্যন্ত আমরা ধান খেতের ভিতর দিয়ে ক্রলিং করছি। দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা কাদা পানিতে গড়াগড়ি করে আমাদের শরীর এত বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল যে, যে কেউ দেখলে বলত, আমরা কাদা মাটিতে বসবাসকারী কোন জীব। সাথীদের কাউকে তার পূর্বের অবয়বে সনাক্ত করা সম্ভব নয় !কাদায় ক্রোলিং করতে করতে শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে আমরা ক্রমশ প্রাণ-সস্পন্দনহীন হয়ে যাচ্ছিলাম। অনেক্ষণ পর মাথা উঁচু করে একটি টিলা দেখে প্রায় নিরাপদ দূরত্বের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি অনুমান করে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম । সামনে অগ্রসর হয়ে আবার বিপদের সম্মুখীন হলাম । সামনেই একটি সাঁকো। আমি সাঁকো পেরুতে অপারগ । আর ওদিক থেকে গোলা বর্ষিত হচ্ছে তীব্রভাবে। এমতাবস্থায় আবু খালেদ ভাই গোঁ ধরলেন- সাঁকো পেরিয়েই যেতে হবে। আমি বললাম, সাকোঁ পেরুতে যেয়ে ধরা পড়াে না, বরং দিক বদলিয়ে অন্য পথে চলুন। খালিদ ভাই বললেন, তাহলে আমরা গুলির আওতায় পড়ে যাওয়ার আশংকা আছে। শেষ তক সিদ্ধান্ত হলাে, আমরা ঘুরে যাব। একটি বড় আইল অতিক্রম করার জন্য আমরা তিনজন ৫০ গজ করে দূরত্বে থেকে রওয়ানা হলাম। যেই আমি আইলের উপর উঠলাম, অমনি এক ঝাঁক গুলি আমার পাশে এসে পড়ল। আমি এক পলকে মাটিতে শুয়ে পড়লাম । (চলবে)