পবিত্র কোরআনের অলৌকিক বৈশিষ্ট্য।
-হাকীমুল ইসলাম ক্বারী মোঃ তাইয়্যেব (রাহঃ)
বক্তার বক্তব্যে ফুটে ওঠে তার প্রচ্ছন্ন অবস্থানঃ
কোরআনুল কারীম আল্লাহ তাআলার কালাম। যে কোনো কালাম বা কথার একপ্রকার প্রতিক্রিয়া থাকে। আর বক্তা যে বৈশিষ্ট্যের হয় তার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া ও সে পর্যায়ের। কেউ যদি আল্লাহ তাআলার সত্ত্বা ও তার গুণাবলীর প্রতি লক্ষ্য করে, তার অন্তর দৃষ্টি দ্বারা আল্লাহর সত্ত্বাকে অবলোকন করতে চায়, তাহলে তার আল্লাহর বাণী কোরআনুল কারীম কে অত্যন্ত গুরুত্ব ও নিবিষ্ট মনে পাঠ করতে হবে। তবে সে আল্লাহ তাআলার সত্ত্বাকে অনুভব করতে পারবে।
বাদশাহ আলমগীরের এক কন্যা ছিলেন, নাম জেবুন্নেসা। তিনি রাজকুমারী হওয়ার পাশাপাশি একজন উঁচু দরের কবি ও ছিলেন। আলমগীরের রাজসভায় যখন অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের রচনাবলী পাঠ করা হতো, তখন রাজকুমারী জেবুন্নেসার রচনা ও গুরুত্বের সাথে শোনানো হত। বড় বড় কবিগণ তন্ময় হয়ে তাঁর কবিতা স্রবন করতেন। জেবুন্নেসার রচনা ছিল খুবই উচ্চ মানের। জেবুন্নেসার পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনা প্রতি আসক্ত হয়ে বাদশাহ আলমগীরের আকেল খান নামক এক সভাসদ একদিন বলে ফেললেন, আফসোস! আমি যদি জেবুন্নেসাকে একবার দেখতে পেতাম।
আকেল খানের এই উদগ্র আকাঙ্ক্ষার কথা শাহী মহলেও পৌঁছালো। জেবুন্নেসা নিজেও তার প্রতি আকেল খানের আসক্তির কথা জানতে পারলেন। কিন্তু সেকালে শাহী মহলে এমন কঠিন সুব্যবস্থা ছিল যে, শাহী মহলের কোন নারীর পক্ষে পর পুরুষের সাথে সাক্ষাত করার ইচ্ছাকে কল্পনা বলা যায় মাত্র। ফলে জেবুন্নেসা আকেল খানের আসক্তির মূল্যায়ন করে তার উদ্দেশ্যে দুটি পংক্তি লিখে পাঠালেনঃ
অর্থাৎ, "আমি আমার কথা মালায় লুকিয়ে থাকি,
যেমন গন্ধ ফুলে লুকিয়ে থাকে।
যে আমাকে ভালবাসে,
আমার কাব্যে সে আমাকে খুঁজে পাবে।"
আল্লাহ তা'আলার কালাম পবিত্র কোরআন ও তদ্রুপ। যে আল্লাহকে ভালোবাসে, সে কোরআনুল কারীম তেলাওয়াত করলে তাতে মহামহিমান্বিত আল্লাহর সত্ত্বাকেই অনুভব করতে পারবে।
আল্লাহর দর্শন লাভ ইবাদতের মুল লক্ষ্যঃ
আল্লাহর দিদার কামনা করে না এমন বান্দা খুঁজে পাওয়া যাবে না। সকল বান্দাই আল্লাহকে দেখতে চায়। আল্লাহর দিদার লাভ এর শুপ্ত আসা সে তার মনে লালন করে এবং এজন্যই আল্লাহর এবাদত করে। আল্লাহর দিদার লাভের আশা পোষণ করা কোনো অন্যায় বাসনা নয় বরং শরীয়তের বিধান মানুষেরে এ আকাঙ্ক্ষাকে অনুমোদন করে। কেবল অনুমোদন করে না বরং উৎসাহ যোগায়। তাই বলা হয়েছেঃ
"তোমরা আল্লাহর ইবাদত-নামাজ এমন ভাবে করো, যেন তোমরা আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তোমার মনের অবস্থা এমন না হয়, তাহলে অন্তত এতটুকু মনে করো যে, আল্লাহ তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।"
এ দেখার প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করা হয়েছে এর মর্মার্থ হল, ইবাদত করার প্রকৃত অর্থ আল্লাহর দিদার লাভ। নামাজের মাধ্যমে প্রত্যেক বান্দাকে এই ক্ষমতা আত্মস্থ করার প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, বাহ্যত মানুষ নামাজে দাড়িয়ে মুসললার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহর কুদরতি অবয়বের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধন করার ইচ্ছা রাখে। তাই কায়মনোবাক্যে মানুষ নামাজ আদায় করলে সত্যিই একদিন আল্লাহর নূর তার দৃষ্টিতে ভেসে উঠবে। আল্লাহর সত্ত্বার প্রকাশ ও মুখোমুখি হওয়ার জন্যই মানুষের এতো এবাদত, এতো নামাজ সালাত। নামাজে তাই মানুষকে এই প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যে, তুমি আল্লাহকে দেখছো এবং কোরআন তেলাওয়াতের তার অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলার গুণাবলী প্রকাশ করছ। এভাবে মনোযোগ সহকারে নামাজ আদায় করলে একদিন সে আল্লাহর নূর দেখতে পাবে নিশ্চয়।
হৃদয়ের গভীর প্রেম প্রেমাস্পদের মিলনকে অপ্রতিরোধ করে তুলে
এটা স্বতসিদ্ধ ব্যাপার যে, কোন বস্তুর ভালোবাসা হৃদয়ে স্থান করে নিলে সর্বদা তার অবয়ব চোখের সামনে ভাসতে থাকে।
এক বুজুর্গ ব্যক্তির দরবারে কয়েকজন লোক হাজির হন। তারা বুযুর্গ ব্যক্তির কাছে বায়াত হওয়ার পর তিনি তাদেরকে নীরবে জিকির করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু একজন মুরীদ কিছুতেই জিকিরের প্রতি পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না। বুযুর্গ ব্যক্তি অনেক তদবির করেও সেই মুরীদকে জিকিরে মনোযোগী করাতে ব্যর্থ থাকেন। শেষতক তাকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার অন্তরে কি অন্য কোন জিনিসের মহাব্বত বিরাজ করছে? মুরীদ বলেন মহিষের মহাব্বত আমি অন্তর থেকে দূর করতে পারছিনা। বুযুর্গ তাকে একটি কামরায় নিয়ে বললেন, ঠিক আছে তুমি এখানে বসে তোমার প্রিয় মহিষের ধ্যান করতে থাক। বুযুর্গের ইচ্ছা ছিল ধ্যান করতে করতে যখন মহিষের মহব্বত তার অন্তরে গেঁথে যাবে তখন তিনি মুরিদের ধ্যানের গতি আল্লাহর দিকে ঘুরিয়ে দেবেন।
ওই ঘরে বসে মুরীদ ব্যক্তি এক টানা চল্লিশ দিন মহিষের ধ্যান করলেন। চল্লিশ দিন পূর্ণ হওয়ার পর বুযুর্গ ঘরে প্রবেশ করে বললেন এবার তোমার চিল্লা পূর্ণ হয়েছে। চলো বাইরে যাই। লোকটি দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। বুযুর্গ বললেন কি হলো? আসছো না কেন? মুরীদ বললেন, দরজার সামনে মহিষ দাঁড়ানো।
এক টানা চল্লিশ দিন মহিষের ধ্যান করার পর লোকটির দৃষ্টির সামনে শুধু মহিষই ভাসতে থাকলো। বুযুর্গ যখন দেখলেন, মুরীদের ধ্যান স্থির হয়েছে, তখন নিজ আধ্যাত্মিক শক্তি বলে তিনি মুরীদের ধ্যানকে আল্লাহর দিকে ঘুরিয়ে দিলেন।
মূলতঃ মানুষ মনে মনে গভীর ভাবে যে বিষয়টিকে অত্যন্ত ভালবাসে সেটি বাস্তব চিত্র ধারণ করে তার দৃষ্টির সামনে ফুটে ওঠে। তাই নামাজি ব্যক্তি তার নামাজে কেরাত পড়ার সময় গভীরভাবে আল্লাহর ধ্যান করবে। এভাবে যখন তার হৃদয়ে আল্লাহর প্রেম গেঁথে যাবে, দেখবে আল্লাহ মহিমা তাজাল্লী তার দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে।
এজন্য আমি বলছি যে ব্যক্তি আল্লাহর দিদার লাভে আগ্রহী সে যেন কোরআনুল কারীম তিলাওয়াত করার সময় আল্লাহর গুণাবলী ও তার সত্ত্বার প্রতি গভীর ভাবে খেয়াল করে। তাহলে সে দুনিয়াতে আল্লাহর নূর ও আখেরাতে আল্লাহর দিদার লাভ করতে পারবে।
কোরআনুল কারীম কে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা মনে করে পাঠ করা এবং বুঝতে চেষ্টা করাঃ
বুঝার চেষ্টা না করে কোরআনুল কারীম শুধু তেলাওয়াত বা পাঠ করলেও সওয়াব হবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কোরান মানবের একমাত্র বিশুদ্ধ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে তার প্রতিটি কথা মনোভাব নিয়ে পড়া দরকার। কোরআন সকল মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয় সংবিধান। আর সংবিধান এজন্য পাঠ করা হয় না যে, শুধু এটা আওড়িয়ে যাবে। বরং এতে কি বলা হয়েছে, কি আমাকে করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা জানার উদ্দেশ্যে পাঠ কর। যারা এই মহতী উদ্যোগ নিয়েছেন, যারা কুরআন বুঝার চেষ্টা করেছেন তাদের সৌভাগ্য বলতে হবে।
বক্তব্যের বক্তার আপন সত্ত্বার অভিব্যক্তি ঘটেঃ
হাদীস শরীফে কোরআনুল কারীম সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ "কোরআন দ্বারা তোমারা বরকত অর্জন কর, কেননা এটা আল্লাহর নিজস্ব বক্তব্য।"
বক্তার অন্তরের উপ্ত আবেগ ও ইচ্ছা বক্তব্যের মাধ্যমে ভাষায় রূপ ধারণ করে। যেমন আমি যদি কোন হাসির কথা বলি আপনারা এখনই অট্টহাসিতে ফেটে পড়বেন। কিন্তু এই হাসি কেবল কথামালার প্রভাব নয় বরং যে হাস্যরস আমি অন্তরে সুপ্ত করে রেখেছি মূলত তা এর প্রতিক্রিয়া ও বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আপনার যদি ইচ্ছা হয়, আজ অমুককে হাসাবো বা কাঁদাবো। তাহলে আপনি তাকে এমন কথা বলবেন যে, সে হেসে লুটিপুটি খাবে, আবার পরক্ষণেই এমন কথা বলবেন যাতে লোকটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আমি বলব এ হাসানো কাঁদানো শুধু শব্দের প্রভাবে নয় বরঞ্চ আপনার ভিতরে হাসানো কাঁদানোর যে আবেগ ও ইচ্ছা কাজ করছে সেটাই আসল শক্তি। সেই আবেগ ও বোধ শক্তিকে ভাষার আবরণে আপনি উপস্থাপন করেছেন মাত্র। ঠিক তেমনি আল্লাহ তায়ালার পবিত্র সত্ত্বা ও তার গুণাবলী তার পবিত্র কোরআনুল কারিমে প্রচ্ছন্ন করে রেখেছেন। এভাবে তিনি তাঁর সত্ত্বাকে মানুষের কাছে প্রকাশ করেছেন। যে ব্যক্তি পরম আগ্রহ ও ধ্যানের সাথে কোরআন পাঠ করবে সে আল্লাহর লুকায়িত মহিমা উদ্ধার করতে সক্ষম হবে। আল্লাহর যাবতীয় নিদর্শন সে এই কালামে পাক থেকে বুঝে নিতে সক্ষম হবে। কেননা বক্তব্য বক্তাকেই ধারণ করে।
পবিত্র কোরআন আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সহায়কঃ
হাদিসের ভাষ্য মতে বুঝা যায়, যে ব্যক্তি আল্লাহর কালাম পবিত্র কোরআনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে, সে আল্লাহর সত্ত্বার পরিচয় লাভে ধন্য হয়েছে। এরপর আল্লাহর সত্ত্বা যখন তার দৃষ্টিতে ভেসে উঠবে তখন বুঝা যাবে যে, আল্লাহর বৈশিষ্টাবলীর সাথে বান্দার পরিচয় ঘটেছে।
কোরআন আল্লাহর মহান দান। এই পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর দান। এই জমিন, আসমান, চাঁদ, সূর্য সবই আল্লাহর ইচ্ছায় অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বে এসেছে। তবে এগুলো আল্লাহর পবিত্র সত্ত্বা থেকে সরাসরি অস্তিত্বে আসেনি। কিন্তু কোরআন আল্লাহর পবিত্র সত্ত্বা থেকে সরাসরি উৎসারিত। তাই আল্লাহর পবিত্র কালামের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারী আল্লাহর জাতের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনকারীর নামান্তর। পবিত্র কোরান আল্লাহর রশি, এই রশির দ্বারা আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে টেনে নিজের দিকে নিতে চান।
শেখ মহীউদ্দীন ইবনুল আরাবী (রহ) ছিলেন একজন উঁচু স্তরের সাধক ব্যক্তি ও বুযুর্গ পুরুষ। তিনি বলেন (তার কথাটি কোরআন-হাদিস দ্বারাও সমর্থিত) আসমান ও আসমানের মধ্যে বান্দার জন্য যতগুলো মাধ্যম দ্বারা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছানো যায়, এর সবগুলোই ভ্রান্ত ও জাহান্নামের মাধ্যম, কিয়ামতের দিন এগুলো দ্বারা শুধু আগুন আর কষ্টই পাওয়া যাবে।"
আমাদের বুঝতে হবে বর্তমানে আমরা জাহান্নামের পথে চলছি। আল্লাহ তা'আলা কোরআনুল কারীমে যে রশি পৃথিবীতে লটকিয়ে দিয়েছেন যদি এই রশিকে আমরা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে পারি কেবল তাহলেই আল্লাহ তাঁর বান্দাকে রশি ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন। এ কথাটাই পবিত্র কোরআনে এভাবে বলা হয়েছেঃ "আল্লাহর রশিকে তোমরা মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধর" কোরআনের এই রশিকে আসমান থেকে জমীনে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। একে যারা আকড়ে থাকবে রশির টানে তারা দুনিয়ার জাহান্নাম থেকে জান্নাতে চলে যাবে। কাফেরদেরকে আর জাহান্নামে পাঠানোর প্রয়োজন হবেনা। কারন এরা তো জাহান্নামেই রয়েছে। তাই মু'মিনদেরকে এ জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর রশি তথা কোরআনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকা প্রয়োজন।
আল্লাহর এ রশি অন্তরের বিশ্বাস দিয়ে ধরা যায়, বাহ্যিক হাত দিয়ে ধরা যায় নাঃ
আল্লাহর প্রেরিত কোরআনের রজ্জু তো আর কোন পাট, রেশম সূতার তৈরি রশি নয় যে, এটাকে হাত দ্বারা স্পর্শ করা যায়। বিশ্বাসের দ্বারা যে ব্যক্তি কোরআনের রশিকে নিজের জীবনের সব কাজে সম্পৃক্ত করেছে, সেই নিজেকে কোরআনের সাথে যুক্ত করেছে এবং কোরআন তার হৃদয়ের সাথে বাধা রয়েছে। এই আধ্যাত্মিক রশি দ্বারা যে আল্লাহর সত্ত্বা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে সেই সকল দুষ্কর্ম ও পাপাচার থেকে মুক্ত থাকবে।
মু'মিনের প্রধান লক্ষ্য আল্লাহর দিদারে ধন্য হওয়াঃ
মানুষ কোন অতি প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে দূর থেকে দেখে তার সাথে মিলনের আশায় ব্যাকুল হয়ে পড়ে। তখন সে তার কাছে গিয়ে প্রথমে মুসাফাহা (করমর্দন) করে, তারপর মুয়ানাকা (কোলাকুলি) করে তৃপ্ত হয়। মুসাফাহা মুয়ানাকার মাধ্যমে সে প্রিয় ব্যক্তির হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নিতে চায়। এভাবে মানুষ যাকে ভালোবাসে সে তার সবকিছুকেই আত্মস্থ করতে আগ্রহ বোধ করে। ঠিক তেমনি আল্লাহ তা'আলা কোরআনকে শুধু মৌখিক পাঠ করার জন্য নাযিল করেননি। এটাকে জীবনের সর্ববিষয়ে রূপায়িত করার জন্য নাজিল করেছেন। যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করে, তার বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝে, নিজের জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল-কোরআনের আঙ্গিকে সাজিয়ে তোলে আল্লাহ তাকে অবশ্যই এর রশি দ্বারা টেনে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন। তখন তার সাথে সাক্ষাত ঘটবে, কোলাকুলিও হবে। পরম তৃপ্তিভরে আল্লাহর কোলে বসতেও পারবে।
হাশরের দিনে মানুষ বিভিন্ন দলে বিভক্ত থাকবেঃ
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, কেয়ামতের দিন আমলের ভিত্তিতে মানুষকে বিভিন্ন দলে ভাগ করা হবে। যারা পাপী পাপের ধরন ও শ্রেণী অনুসারে তাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দেয়া হবে। নেককার লোকদের মধ্যে তেমনি নেক আমলের পর্যায় অনুসারে বিভক্ত করা হবে। সকল ব্যভিচারকারীদেরকে একটি দলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। চোরাকারবারীদের হবে একটি ভিন্ন দল। নেক আমলের মধ্যে যারা বেশি নামাজের প্রতি নিষ্ঠাবান তাদেরকে নামাজীদের দলভুক্ত করা হবে। রোজার প্রতি যারা বেশী যত্নবান ছিলেন তাদেরকে রোজাদার দলভুক্ত করা হবে। যে সর্বদা সত্যাশ্রয়ী ছিল তাকে সত্যবাদীদের দলে রাখা হবে। দুনিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে কোটি কোটি মানুষকে বহু দলে ভাগ করা হবে। যেমন যারা দুনিয়াতে অন্ধ ছিল তাদেরকে একদল ভুক্ত করা হবে এবং বলা হবে, তোমরা দুনিয়াতে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত থেকে বঞ্চিত ছিলে, কোন বস্তু দেখতে পাওনি, আজ দুচোখ ভরে আমাকে দেখ। অফুরান্ত জীবনের জন্য তোমাদের দৃষ্টিশক্তি দেয়া হলো, তা তো আর কোনদিন নষ্ট হবে না, তা কেউ আর কেড়ে নিবেনা। সকল অন্ধ বনী-আদম সেই দলে থাকবে এবং হযরত শোয়াইব (আঃ) কে সকল অন্ধদের নেতা বানিয়ে দেয়া হবে। (কারণ তিনি জীবনের শেষ ভাগে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন।) হযরত শোয়াইবের হাতে থাকবে একটি সাদা পতাকা, এটি সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করবে। আল্লাহ তাদেরকে আরশের ডান দিকে অসংখ্য নিয়ামতে পরিপূর্ণ স্থানে মেহমান হিসাবে অবস্থান করতে বলবেন।
অন্ধ লোকেরা যখন আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতে পরিপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়ে পুরো দৃষ্টি দিয়ে আল্লাহর দিদার করবে, তখন আলেমদের দল এগিয়ে এসে বলবেন, হে প্রভু! ওরা দুনিয়াতে অন্ধ ছিল, ওরা আমাদের কথায় ও চেষ্টায় তোমার উপর ধৈর্য ধারণ করেছিল, তুমি তাদেরকে নিয়ামতের দ্বারা সৌভাগ্যবান করেছ। অথচ আমাদেরকে এখানে দাঁড়িয়ে রেখেছ। আল্লাহ তাদের অন্ধদের প্রতি লক্ষ্য করে বলবেন, আলেমদেরকে বলতে দাও, তাদের কথার জবাব না দিয়ে তোমরা নিজ অবস্থানে অবিচল থাকো
এরপর আল্লাহ তায়ালা কুষ্ঠ রোগীদের ডেকে আনবেন। তাদেরকে দুনিয়ার মানুষ ঘৃণা করে দূরে সরে থাকতো। কিয়ামতের দিন সকল মু'মিন কুষ্ঠরোগীর সারা শরীর পূর্ণিমার চাঁদের মত আলোকোজ্জ্বল থাকবে এবং হযরত আইয়ুব (আঃ) কে এই রোগে দীর্ঘ ভোগান্তি পোহানোর জন্য তাকে এদের নেতা বানিয়ে দিবেন। তাকে একটি সবুজ পতাকা দেয়া হবে এবং সকল কুষ্ঠরোগীদের বলা হবে তোমরাও আরশের ডান পাশে এসো!
এ সময় আবার আলেমগনের দল এগিয়ে এসে আল্লাহকে বলবেনঃ হে প্রভু! তুমি অন্ধ ও কুষ্ঠরোগীদের আরশের ছায়ায় বসিয়ে দিলে আর আমাদের কিছুই বললে না। তখন আল্লাহ কুষ্ঠরোগীদের বলবেন তোমরা তাদের কথার প্রতি লক্ষ করো না, নিজ অবস্থানে চলে যাও। এভাবে যখন সকল অসহায় ও যাতনা ভোগীকারীদের প্রাপ্য দেয়া শেষ হবে, তখন আল্লাহ আলেমদের প্রতি লক্ষ্য করে বলবেন, তোমরা তো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য নও। তোমাদের দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছিল জগতের মানুষের হেদায়েতের জন্য। পরের উপকারের জন্য-নিঃস্বার্থ হাসিলের জন্য নয়। এখানে দাঁড়াও, যখন সকল পাপীর সুপারিশ করা শেষ হবে তখন তোমাদের যাওয়ার সময় হবে। এরপর ওলামায়েকেরাম দাঁড়িয়ে গুনাহগার মানুষের জন্য সুপারিশ করবেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের সুপারিশে মুক্তি পাবে। তখন আল্লাহ বলবেন, এখন তোমাদের কাজ পূর্ণ হলো দুনিয়াতে তোমরা মানুষকে পথ দেখিয়েছ আর এখানে সুপারিশ করেছ। তোমরা আমার কাছে মর্যাদা প্রার্থনা করেছিলে, যাও তোমরাও আরশের ডানপাশে চলে যাও। তোমাদের কাজ ছিল দুনিয়ার সকল পাপী বান্দার যখন সুপারিশ শেষ হবে তখন নিজেদের অবস্থানের চিন্তা করা। তাদের স্থান হবে আল্লাহর অতি নিকটে। কারণ দুনিয়াতে তারা আল্লাহর অস্তিত্ব গভীরভাবে অনুভব করেছে, কবর তারা আলোকিত রেখেছে। হাশর ময়দানে ও তারা জ্যোতির্ময় থাকবে। ফলে আরশের ডানপাশে আল্লাহর সবচেয়ে নিকটে তারা স্থান পাবে।
পবিত্র কোরআনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন সৌভাগ্যের বিষয়ঃ
আপনি কোরআন পাঠ করে কোরআনের মাহাত্ম ও বৈশিষ্ট্য নিজের অন্তরে গেঁথে নিবেন। তখন ঈমান মজবুত হবে, কোরআনের বরকত ও জ্যোতি অন্তরে প্রবেশ করবে। সেই কোরআনের জ্যোতি কবরে অবলোকন করবেন, হাশর ময়দানেও দেখবেন কোরআনের আলোর ঝলক। তারপর আল্লাহর 'আমার ডান পাশে এসে যাও' এই আহবানের মাধ্যমে বান্দার সকল আশা পূর্ণ হবে। আল্লাহর দিদার লাভ করে মানুষ হবে তৃপ্ত। আল্লাহর সাথে মহা মিলনের প্রত্যাশায় তার ডান পাশে অবস্থান গ্রহণ করবে। মোটকথা এ সকল আশা আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা একমাত্র কোরআনুল কারিমের অনুসরণের মাধ্যমে পূর্ণ হতে পারে। অতএব যারা কোরান পড়ার, বুঝার ও সে অনুযায়ী জীবন চালাতে চেষ্টা করেছেন, তারা নিঃসন্দেহে অতি সৌভাগ্যবান।
পবিত্র কোরআন একটি বিপ্লবী মহা গ্রন্থঃ
কুরআনুল কারীম একটি বৈপ্লবিক গ্রন্থ। কোরআন মানুষের অন্তর পরিবর্তন করে, চেতনা ও বিশ্বাসে বিপ্লব কটায়। যারা কোরআন স্পর্শ করেনি, কোরআনের সান্নিধ্যে আসেনি তারা কোরআনের শক্তি, মাহাত্ম, বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারে না। যেমন কোন ঔষধ যত উপকারী আর দামীই হোক না কেন, যে পর্যন্ত তা ব্যবহার না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এর কোন ক্রিয়া হবেনা, উপকার সম্পর্কে উপলব্ধি করা যাবে না। যারা কোরআনুল কারীম থেকে দূরে সরে থাকে, কোরআন পাঠ করে না, কোরআনের বৈপ্লবিক বাণী শ্রবণ করে না, কোরআনের সান্নিধ্যে আসে না, তারা এর জ্যোতির্ময় আলো থেকে বঞ্চিত থাকবে। কোরআন মানুষের বাহ্যিক অবয়ব যেমন পাল্টে দেয়, তেমনি তার অন্তরে পরিবর্তন ঘটায়। জাহেলিয়াতের জামানায় যারা অহর্নিশি মারামারি চুরি-ডাকাতি বদমায়েশিতে ডুবে থাকতো, যারা জাহেল, অসভ্য ও অমানুষ হিসাবে আখ্যা পেয়েছিল, কোরআন তাদের কে বানিয়েছে ইতিহাসের সম্মানিত সাহাবী। এই কোরআন একটি জাহিলি যুগের সকল অন্যায় অপকর্ম দূর করে তাকে পরিণত করেছে সর্বশ্রেষ্ঠ যুগে।
যে সকল লোক অজ্ঞতার তিমিরে নিমজ্জিত ছিল কোরআনকে অবলম্বন করার পর তারা বিশ্বের সকল জ্ঞানী ও পন্ডিত সমাজের ওস্তাদে পরিণত হয়েছেন। তারা সাধক আরেফ ও পীর মুর্শিদের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সারা দুনিয়ায় তাদের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। জগতের মানুষ পেয়েছে তাদের নিকট থেকে হেদায়েতের আলো। যে লোকেরা সামান্য দুটি পয়সার জন্য অবলীলায় ডাকাতি করত, কোরআনের পরশে তারা টাকার পাহাড় মাড়িয়ে গেলেও তা স্পর্শ করে দেখে না।
হযরত আলী (রাযিঃ) এর একটি ঘটনাঃ
হযরত আলী (রা) একবার খাজাঞ্চিখানায় গেলেন। বায়তুলমাল তথা খাজাঞ্চিখানায় সোনার স্তুপ পড়েছিল, লক্ষ লক্ষ টাকা জমা হয়েছিল বায়তুল মালে। তিনি এ সকল সম্পদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন "হে দুনিয়া! প্রতারণা অন্য কাউকে দিতে পার, আলীকে নয়। আলী তোমার প্রতারণার শিকার হবে না।" তখনই তিনি বায়তুলমালের ব্যবস্থাপককে ডেকে নির্দেশ দিলেন এখনই এ সব মাল গরীবদের মাঝে বন্টন করে দাও। রাত ভর গরীবদের মধ্যে লক্ষ লক্ষ টাকার বন্টন করে দেয়া হল। যে সকল লোক সামান্য একটি টাকার জন্য অপরকে হত্যা করতে পারত সেই লোকেরা লক্ষ লক্ষ টাকা হাতে পেয়ে ও একটু তাকিয়ে দেখল না। কে এনেছে তাদের মধ্যে এই পরিবর্তন? কিভাবে তারা পরিবর্তন হলো সোনার মানুষে? মানবতার প্রতি তাদের এই ব্যাকুলতা কোত্থেকে উদয় হলো? নিশ্চয়ই এসব পরিবর্তন ও চরিত্রবান হওয়ার পিছনে পবিত্র কোরআনের প্রভাব সুস্পষ্ট। কোরআন তাদের বানিয়েছে সর্বকালের আদর্শ অনুকরণীয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ রুপে। তারা আধার ছেড়ে উঠে এসেছেন বহু উচু মর্যাদার আসনে।
অনুবাদঃ আহমদ আল ফিরোজী