রম্য রচনা
সারমেয় সন্দর্শন
আলি নাসিম হিজাজী
অভূতপূর্ব একটি আলোচনা সভা। উপবিষ্ট বিভিন্ন প্রজাতির সারমেয়গণ। সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করিয়াছেন বৃহদকায় লোমশ এ্যালসেসিয়ান, যাহার গলদেশে আনুগত্যের নিদর্শন স্থরূপ সুদৃশ্য একটি গলবন্ধ শোভা পাইতেছে। প্রধান অতিথি গ্রে-হাউন্ড প্রজাতির চিক্কন মসৃনদেহ হৃষ্টপুষ্ট যুবক কুক্কুর। বক্তা হিসাবে উপস্থিত আছেন বহু সংগ্রামের নাঁয়ক, যিনি পাড়ার মধ্যে 'বাঘা' বলিয়া পরিচিত। লালু, ভুলু, নামী-অনামী আরও অনেকে। শ্রোতা মণ্ডলীর মধ্যে দেশী সারমেয়গণের আধিক্যই পরিলক্ষিত হইতেছে।
আঙ্গুল কর্তিত কৃষ্ণকায় চতুষ্পদটি ঘোষকের ভূ মঞ্চে উপস্থিত। মতামত জাহির করিবার বক্তারা পূর্ণ স্বাধীন এবং অধিকারের কথা ঘোষিত হইল।
সভা শুরু হইল। এক্ষণে বক্তব্য পেশ করিতেছেন শীর্ণকায়, লোমহীন, রোগজীর্ণ, জীবনযুদ্ধে দীর্ণ একটি ফেঁতি। “বন্ধুগণ, ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মনুষ্য সমাজের বর্তমান হালহকীকতে আমরা শঙ্কিত, লজ্জিতও বটে। আমি শঙ্কাবোধ করিতেছি, হয়তো বা আমাদের সমাজেও ইহার প্রভাব বিলক্ষণ আসিতে পারে। স্বল্প পরিসরে আমি একটি সমস্যার কথা ব্যক্ত করিব মাত্র। সারমেয়গণ মনুষ্যদিগের দংশন করিলে জলাতঙ্ক ব্যাধিতে আক্রান্ত হইবার সম্ভাবনা থাকে। শঙ্কিত মানব সমাজ উক্ত ব্যাধির প্রকোপ হইতে রক্ষা পাইবার উন্ন ধরনের ঔষধ আবিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছে। কিনতু মনুষ্য-দংশন জনিত ব্যাধির প্রতিষেধক কোথায়? উহাদের দংশনে যে মারাত্মক যন্ত্রণা অনুভূত হয়, তাহা ভূক্তভোগীগণই কহিতে' পারিবেন।'
জনৈক শ্রোতা বলিলেন, “মনুষ্য-দংশন কথাটি বোধগম্য হইতেছেনা।’ বক্তা দৃঢ়তার সহিত কহিলেন হ্যাঁ ভাই, উহারা দংশন করিয়া থাকেন। তবে উহাদের দংশন কিঞ্চিত ভিন্ন প্রকৃতির। দংশিতজনের অন্তরাত্মা উপলব্ধি করিতে পারে ইহার হলাহল ক্রিয়া। এ ধরায় যত বিষধর আছে, তাহা অপেক্ষাও ইহার দাপট ভয়ঙ্কর। তাহা ছাড়া উহারা 'এইড্স' নামক বিপজ্জনক ব্যাধির সংক্রমণ ঘটাইতে পারে। উহাদের সংস্পর্শে আমাদের সমাজেও এই ব্যাধির বিপদ বিলক্ষণ বিকশিত হইতে পারে।
শব্দটি কর্ণকৃহরে নুতন ধ্বনিত হইতেছে। পূর্বে ইহার কথা শ্রবণ করি নাই। সম্যক বুঝাইয়া বলিলে উপকৃত হইতাম।"
বক্তা উজ্জীবীত হইয়া কহিলেন-'সমকামিতা নামক জঘন্ন যৌন জীবন হইতে এই রোগের প্রথম উৎপত্তি। শ্রুতি আছে, আমেরিকার লস এঞ্জেলস নামক স্থানে এই ব্যাধিটি প্রথম আবিষ্কৃত হয়। বলা বাহুল্য, ইহার উৎস ছিল বিক্রিত যৌন ক্রিয়া অর্থাৎ “সমকামিতা।"
শিক্ষিত গ্রে-হাউন্ড মন্তব্য করিলেন-হ্যাঁ, আমার পিতামহ উক্ত দেশ হইতে আসিয়া আমাদের সংবাদ শুনাইয়াছিলেন, লস এঞ্জেলস নাকি হোমো সেক্সের স্বর্গভূমি।’
জনৈকা একচক্ষু কানা.ফেঁতি বলিলেন, 'ছি ছি কি লজ্জার কথা, মানব সমাজে এইরূপ তাজ্জব ঘটনা ঘটে নাকি?
বক্তা কহিলেন-হ্যাঁ, ঘটে বৈকি, অনেক অদ্ভুদ ঘটনা উহাদের সমাজে ঘটে, যাহা শ্রবণ করিলে এই ধরাধামে আর তিষ্টিতে ইচ্ছা করে না। যাহা হউক, স্রষ্টার বিধান অনুযায়ী সারমেয়গণ বৎসরে একবার একটি নির্দিষ্ট সময়ে যৌন মিলন করিয়া থাকে। অবশ্যই এই মিলন স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে হইয়া থাকে। বিধাতার এই বিধানের বিরুদ্ধাচারণ আমরা কখনই করি নাই। কিন্তু মনুষ্যজাতিকে বিধাতা যৌন মিলনের যে নিয়ম কানুন নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, তাহা বহুলাংশে লংঘিত হইতেছে। নারী-পুরুষের মিলনের স্বীকৃতি হইতেছে বিবাহ। কিন্তু হায়! আজকাল উহারা বিবাহ বিধির বক্ষে পদাঘাত করিয়া 'লিভটুগেদার' করিতেছে। মনুষ্যগণ ঈশ্বরের অসীম অনুগ্রহে পৃথিবীর উৎকৃষ্ট সামগ্রী খাইতেছে, পান করিতেছে। আর নিকৃষ্টতম জীবন যাপন করিতেছে। যাহাকে যাহার খুশী ধরিতেছে, যৌন সুধা পান করিতেছে। সহজে ধরিতে না পারিলে ধর্ষণ করিতেছে, প্রমাণ লোপাট করিবার জন্য আবার নিষ্ঠুরভাবে হত্যাও করিতেছে। বিবাহিত নারী-পুরুষগণও অবৈধ যৌন কেলেঙ্কারীতে অবাধে লিপ্ত হইতেছে। জারজ সন্তানে মানব সমাজ সমাচ্ছন্ন। শত শত শহর নগরে পতিতালয় খুলিয়া উহাদের ভাষায় তাহাতে যৌন কর্মীগণ দেহ' ব্যবসায় লিপ্ত' রহিয়াছে। নারী দেহ লইয়া রমরমা ব্যবসা বাণিজ্য চলিতেছে। কায়দা করিয়া নোংরা পল্লী বা বেশ্যাখানার নাম দিয়াছে-নিষিদ্ধ পল্লী। কিন্তু প্রশাসন বকলমে উহাকে সিদ্ধ পল্লীর মর্যাদা দান করিয়াছে। গণ্যমান্য স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গের সমাগম হেতু নিষিদ্ধ পল্লীগুলি আজ সমুন্নত। ভারত উপমহাদেশে এইডস রোগটি প্রথম আবিষ্কৃত হয় তামিলনাড়ুর একটি বিখ্যাত শহরে একজন পতিতার দেহে। হু হু করিয়া এই রোগ সারা পৃথিবীতে ব্যাপৃত হইয়া পড়িয়াছে। ইহার কবলে যে কেহ কবলিত হইয়া পড়িয়াছে, তাহার পরিণতি নিশ্চিত মৃত্যু। মনুষ্য বিজ্ঞানীগণ মঙ্গলগ্রহে পাড়ি জমাইবার কৌশল করায়ত্ত করিয়াছে বটে, কিন্তু অভিশপ্ত এইডসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করিতে পারে নাই। এই রোগ নিরসনে ইহার নিরোধ লইয়া নিত্য দৌড়াদৌড়ি করিতেছে। কিনতু উচ্ছৃংখল যৌনাচার ইহার উৎপত্তি জানিয়াও তাহার কোনরূপ নিষ্পত্তি করিতেছে না। তাই বন্ধুগণ, আমরা আশঙ্কাবোধ করিতেছি, মানব জাতির এহেন দুরারোগ্য ব্যাধি আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হইতে পারে। ইহার সমাধান কি হইতে পারে তদপ্রসঙ্গে আপনাদের সুচিন্তিত মতামত প্রত্যাশা করি। ধন্যবাদ!
ফেঁতি কুত্তার ভাষণান্তে করতালি পড়িবার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, উহাদের হস্ত নাই। মনুষ্যদিগের হস্ত প্রসারিত তাই মানুষ হাততালি দিয়া থাকে।
দ্বিতীয় বক্তা হিসাবে মঞ্চে উঠে এলেন পরিচিত ‘বাঘা’। ঈশ্বরের বন্দনা করিয়া শুরু করলেন-“বন্ধুগণ, পূর্ববর্তী বক্তার বক্তৃতার প্রতিধ্বনি করিয়া আমিও মতামত পোষণ করিতেছি যে, মনুষ্য সমাজের অধঃপতন সারমেয় সমাজকে অচিরেই বিভ্রান্তির অতলে নিমজ্জিত করিয়া ছাড়িবে। এক্ষণে আমাদের সবিশেষ সাবধানতা, অবলম্বন করিতে হইবে।
এলাকায় সর্বসাধারণের নিকট আমি বাঘা" বলিয়া পরিচিত। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তি সমাজে অদ্যাপি সজ্জন বলিয়া পরিচিত বটে, কিন্তু অধিকাংশই পাপের পঙ্কিলতায় হাবুডুবু খাইতেছে। ইহাদের পাপের ফিরিস্ত--যাহা আমি দিবারাত্র অবলোকন করিতেছি, তাহার ইতিহাস বিপুল, বিশাল, বীভৎস। সংক্ষিপ্ত সময়ে. সমস্ত বর্ণনা করা সম্ভব নহে। দু'একটি ঘটনা বর্ণনা করিব মাত্র।
রাত্রদিন চোর-ডাকাত, ভাম-খট্টাস, শৃগাল ইত্যাদির অনিষ্ট হইতে এলাকাটিকে রক্ষা করিবার জন্য সাধ্যমত প্রচেষ্টা চালাইয়া থাকি। একদা নিশীথে লক্ষ্য করিলাম, কয়েকজন চোর চৌর্যকৃত দ্রব্য লইয়া দ্রুত প্রস্থান করিতেছে। নীরবে উহাদের পশ্চাৎধাবন করিলাম। কিয়ৎ দূর অনুসরণ করিবার পর দেখিলাম, উহারা একটি গভীর হোগলা ক্ষেতে প্রবেশ করিল। চুরির মাল ভাগ বাটোয়ারা করিবার নিমিত্তে নির্জন স্থানটিতে আসিয়াছে বোধ হইল। টর্চের আলো ফেলিয়া এদিক ওদিক সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছে। হঠাৎ দেখিলাম, চোর সকল হাস্যরসে চটুল মন্তব্য করিতে করিতে দ্রুতস্থান ত্যাগ করিতেছে। ইহা দেখিয়া আমি কৌতুহল বশতঃ কিঞ্চিত অগ্রসর হইয়া যে কুৎসিত দৃশ্য দেখিলাম, তাহা মুখে বলিবার নহে। হোগলা বনটি যেমন চোর ডাকাতগণের গোপন আস্তানা, তেমনি ব্যভিচারেরও গোপন লীলাভূমি বটে! সেইখানে যে পুরুষ ও নারীটিকে অভিসারে আলিঙ্গনাবদ্ধ দেখিলাম, তাহারা আমার অতি পরিচিত। উহাদের পরিচয় প্রদানে নিজেকে সংকোচবোধ হইতেছে। উহাদের মধ্যে পুরুষটি অবিবাহিত বটে, কিন্তু রমনীটি বিবাহিতা। সশস্ত্র চোরগুলি ইচ্ছা করিলে মান্যবর ব্যক্তিটিকে হটাইয়া মনের সুখে পাপিষ্ঠা গৃহবধূটিকে ভোগদখল করিতে পারিত। কিন্তু উহারা হয়তো ভাবিয়া থাকিবে যে, চুরির পাপের উপর পুনঃ ব্যাভিচারজনিত পাপ করিয়া পাপের বোঝা ভারাক্রান্ত করিয়া লাভ নাই। তাই উহারা অন্যত্র চলিয়া গেল। চোর ধরিতে গিয়া ডাকাত ধরিয়াও আমাকে খামোশ থাকিতে হইল। কেননা ইহারা জনসমাজে গণ্যমান্য বরেণ্য। ইহাদের নামে কালিমার কালি ছিটাইলে দেশ ও দশের দুর্দশার অন্ত থাকিবে না। ইহারাই রাত্রির পঙ্কিলতা ধুইয়া পবিত্র সাজিয়া দিবালোকে মঞ্চে উপস্থিত হইবে। সমাজ, সভ্যতা, নারীমুক্তি, সাম্য, স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ে বিপ্লবের গরম গরম বক্তৃতা দিয়া আদর্শবাদী সাজিবে। মানবতার মূর্ত প্রতীক হিসাবে এমন উচ্চাঙ্গের দার্শনিক কথাবার্তা বলিবে, নির্বোধ জনগণ আহ্লাদে আটখানা হইয়া করতালি ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করিবে। ইহারা কি বুঝিতে পারে নাই যে, ইহাদের গোপন ক্রিয়া-কলাপ সমাজ বুঝিতে না পারিলেও একজন বুঝিতেছেন। যিনি উহাদের বিবেক-বুদ্ধি ও মনুষ্যত্ববোধ দিয়া সকল সৃষ্টির সেরা বানাইয়াছেন এবং সৃষ্টিকুলে সম্মানিত করিয়াছেন । সুখের কথা যে, স্রস্টা আমাদের 'বিবেক' দেন নাই। বন্দুগণ, ঈশ্বরের অনুগ্রহে পুষ্ট মানবকুল আজ তাহার মর্যাদা রক্ষা করিতেছে না। এইরূপ নাফরমানগণই আমাদের সমাজের আসন অলঙ্কৃত করিয়াছেন। এক্ষণে ইহাদের আনুগত্য করা সমীচীন হইবে কিনা তাহা আপনাদের জ্ঞাতার্থে পেশ করিলাম।"
লালু নামে সারমেয়টি এরপর মঞ্চে পদার্পণ করিল। সংক্ষিপ্ত ভাষণে কহিলঃ 'মানবকুলের সন্তানসন্ততিগুলিও বড়ই দুর্বিনীত। কয়েকজন ছোড়া একবার আমার অসতর্ক মুহূর্তে আমার পশ্চাৎ দেশে কি এক তরল পদার্থ নিক্ষেপ করে। জ্বালা যন্ত্রণায় কাতর হইয়া 'দিকবিদিক জ্ঞানশৃন্য হইয়া দৌড়াইতে লাগিলাম। মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগিলাম। আমার এই করুণ অবস্থা দেখিয়া উহাদের হৃদয়ে কিঞ্চিত দয়া, মায়া বোধ হইলনা। উপরন্ত উল্লাসে ফাটিয়া পড়িল। এই গর্হিত কর্মের জন্য কেহ তাহাদের শাস্তি দিল না। সকলেই তামাসা দেখিতে লাগিল। দন্ত বিকশিত করিয়া নিষ্ঠুর হাসি হাসিতে লাগিল। উহারাই বলে, “জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"। আমার ধারণা, ইহাদের মধ্যে প্রেম নাই, ভালবাসা নাই, ঈশ্বর সেবাও নাই। ইহারা কেবল নিজ স্বার্থের পুজা করিয়া থাকে। যে ছোকরাটি এই কুকর্ম করিয়া আমাকে পীড়া দিয়েছিল, আমি তাহাকে চিনি। সুযোগ পাইলে আমি নিশ্চিত তাহাকে কামড়াইয়া দিব। আমার পশ্চাৎ দেশের কঠিন জ্বালা তখনই সে অনুভব করিতে পারিবে যখন জলাতঙ্ক ব্যাধিতে আক্রান্ত হইবে। আপনারা, বলিতে পারেন, “মানুষের কাজ মানুষ করিয়াছে কামড় দিয়াছে পায়, তাই বলে মানুষে কামড়ানো মানুষের কামড়ানো কি কুকুরের শোভা পায়"? কিন্তু আমার বক্তব্য, উহারা যদি এইডস রোগ ছড়াইতে পারে, আমরা কেন জলাতঙ্ক ছড়াইব না।'।
ইহার পর ভলু মঞ্চে আসিল। কহিলঃ 'আমরা অনেকেই স্ত্রী ডগ হিসাবে খ্যাত। অর্থাৎ আমরা রাস্তার কুকুর। আমাদের অন্ন ও বাসস্থানের কোন ঠিকানা নাই। কোনদিন খাইতে পাই, কোনদিন অর্দ্ধহারে থাকি, আবার কোনদিন অনাহারে থাকিতে হয়। এই - আমাদের জীবন, তাহাতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। হঠাৎ জাল পাতিয়া হাকাইয়া একদল মানুষ আমাদের ধরিতে আসিল। কোনক্রমে সে যাত্রা আমি পালাইয়া বাঁচিলাম। কিন্তু আমার সাথীদের পাকড়াও করিয়া নির্মমভাবে উহারা মারিয়া ফেলিল। কুকুর দ্বারা জলাতঙ্ক পরিদৃষ্টে আমাদের এই দুর্দশা, কিন্তু মানুষ আজ বেপরোয়া যৌন কেলেঙ্কারী করতঃ এইডস রোগের আমদানী করিয়াছে, ইহাতে উহাদের কি সাজা হওয়া উচিৎ আপনারাই বিষয়টির নিষ্পত্তি করুন'।
সর্বশেষ বক্তা গ্রে-হাউড মঞ্চে আসিলেন। সকলকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা প্রদান পূর্বক বক্তব্য শুরু করিলেন। বন্ধুগণ, আপনাদের বক্তব্য ও মন্তব্যগুলি এতক্ষণ যাবৎ অনুধাবন করিলাম। আমরা প্রভূভক্ত জীব। কদাচ প্রভূর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করি নাই, বেইমানী বা নিমকহারামী করি নাই। ইহাই আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য । কিনতু মানবজাতি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও তাহাদের স্রষ্টার প্রতি কি আচরণ করা উচিৎ, তাহা তাহারা হৃদয়ঙ্গম করিতে ব্যর্থ হইয়াছে। পদে পদে তাহারা এই শ্বাশ্বত সত্যটির অবমাননা করিয়া আসিতেছে। প্রভূর আনুগত্যের প্রশ্নে ইহারা বড়ই এলোমেলো। যাহা হউক এক্ষণে অন্দরমহলের একটি গোপন খবর আপনাদের সম্মুখে পেশ করিতেছি। গোপন খবর গোপন রাখাই ভালো। কেননা, যাহার অন্নে লালিত পালিত হইতেছি তাহার বদনাম ছড়াইয়া কথা চালাচালি করা বা গুজব -রটনা করা সারমেয়গণের স্বভাব বহির্ভূত, কখনই আমরা এইরূপ সংকীর্ণ কাম করি নাই।
একদা আমার গৃহকর্তা কার্যপোলক্ষ্যে কয়েকদিনের জন্য বিদেশ গমন করেন। যাইবার সময় আমার মস্তকে হস্ত বুলাইয়া কহিয়া গেলেন, 'টেক কেয়ার মাই পপি টেক কেয়ার'। প্রভুর আদেশ শিরোধার্য করিলাম। আঙ্গুল নাচাইয়া তাহার সম্মতি জ্ঞাপন করিলাম। সাহেব চলিয়া গেলেন। মেমসাহেব প্রায় একা। চাকর বাকর ছাড়া বাড়ীতে আর কেহ ছিল না। পরদিন রাত্রি কিঞ্চিত গভীর। গাড়ীর আওয়াজ শুনিয়া আন্দাজ করিলাম মেমসাহেব ফিরিতেছেন। তবুও সজাগ হইলাম, দারোয়ান গেট খুলিয়া দিল। বারান্দায় গাড়ী প্রবেশ করিল। মেমসাহেব অবতরণ করিলেন। সঙ্গে একটি অপরিচিত পুরুষ। মেমসাহেবের পদসঞ্চালনা হইতে অনুভব জন্মিল যে, মেমসাহেব ও তার সঙ্গী গ্রকৃতিস্থ নহে। অভ্যন্তরে প্রবেশ করিবার সময়ে অপরিচিত পুরুষটির প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া গর্জন করিলাম। মেমসাহেব বিরক্ত কণ্ঠে অস্ফুটভাবে কহিলেন “আঃ পপি, হি ইজ আওয়ার গেষ্ট" অতঃপর নীরব হইলাম।
সারা রাত্রি যাবৎ মেমসাহেব সেই অপরিচিত পুরুষটির সহিত কিরূপে কাটাইলেন, তাহা আপনারা অনুমান করিতে পারিতেছেন নিশ্চয়। ভাষায় ব্যক্ত করা নিস্প্রয়োজন। প্রভাত হইবার পূর্বেই নিশাচর পুরুষটি চলিয়া গেলেন বটে। বোধ হইতেছিল উচিৎ শিক্ষা দিয়া দিই। কিন্তু প্রভুর গেষ্ট অর্থাৎ সম্মানীয় ব্যক্তির প্রতি খারাপ আচরণ করা সমীচিন হইবে না মনে হইল। সাহেবের অবর্তমানে মেমসাহের যদি বিশ্বস্ত থাকিতে না পারে বিশেষ করিয়া একজন দ্বিপদী প্রাণী। অথচ আমি চতুষ্পদী হইয়া উক্ত নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাইলে নিশ্চিত সাজা পাইতে হইবে। যদি প্রভুর আমানতের খেয়ানত করি কিংবা বিশ্বস্ততার কোনরূপ অবমাননা করি তাহা হইলে কষাঘাতে জর্জরিত হইতে হইবে। গভীরভাবে চিন্তা করিলে মনে হয়, সত্যিই মনুষ্যগণ কি জটিল প্রাণী। একজনের খায় অন্যজনের মনোরঞ্জন করে। জগৎকে ন্যায়নীতি শিক্ষা দিয়া থাকে। কিন্তু নিজেরাই নীতি বর্হিভূত কাজ করিয়া থাকে। সহজ সরল পথ থাকা সত্ত্বেও ইহারা বক্রপথে পরিক্রমা করে। ইহারা অনেক কিছু লালন করে কিন্তু পালন করেনা । ইহাদের বুদ্ধি আছে শুদ্ধি নাই। যে পাত্রে খাদ্য গ্রহণ করে সে পাত্র ছিদ্র করিয়া ছাড়ে। ইহারা নিজেদের স্বাধীন বলিয়া দাবী করে কিন্তু স্বাধীনতার মর্যাদা বুঝে না। ষোল আনা অধিকার আদায় করে কিন্তু কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর থাকে। ভাবিতে অবাক লাগে, বিশ্বপ্রভু কিরূপে ইহাদের আশরাফুল মাখলুকাত করিলেন। যাহা হউক ইহাদের যাবতীয় খারাবী থাকিলেও জগৎ প্রভূ ইহাদের আনুগত্য করিবার জন্য বিধান দিয়াছেন। সুতরাং বিশ্বনিয়ন্তা খোদার নাফরমানী আমরা কিছুতেই করিতে পারিনা। যিনি ইহাদের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মর্যাদা দিয়াছেন, তাঁহার উপরই ইহাদের বিচারের ভার ছাড়িয়া দেওয়া ব্যতীত আমাদের কোন গত্যন্তর নাই। এই বলিয়া সকলকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন পূর্বক বক্তব্য সমাপ্ত করিলাম'।
- সভাপতি এ্যালসেসিয়ান সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনপূর্বক কহিলেনঃ “সমস্ত বক্তার বক্তব্য ও শ্রোতৃমণ্ডলীর অভিমত শ্রবণ করিয়া মনুষ্যজাতি তথা আমাদিগের মুনিবগণের চরিত্র সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা করিতে পরিয়াছি। যদিও সর্বস্তরের সমাজে মিলামিশা করিবার সুযোগ আমার নাই, তথাপি আপনাদের সুচিন্তিত অভিমত ইহতে আমার ধারণা পরিষ্কার । তবে আফসোস এই মানব সমাজের জন্য। কারণ ইহাদের সব কিছুই আছে তবুও ইহারা সর্বহারা। দেখুন ঈশ্বর ইহাদের কিরূপ মর্যাদা দানে ভূষিত করিয়াছেন। তামাম সৃষ্টিকুল ইহাদের সেবার নিমিত্তে নিয়োজিত । ইহারা ইহার বিনিময়ে কেবল এক স্রষ্টার আনুগত্য করিবে। কেবল তাহারই কাছে মাথা নত করিবে। কিন্তু বারে বারে মনুষ্যজাতি স্রষ্টার নাফরমানী করিয়া সৃষ্টির পূজা করিতেছে। খোদার দাসত্ব ছাড়িয়া প্রবৃত্তির দাসত্ব করিতেছে। সাপ, ব্যাঙ, বানর, হনুমান ইত্যাদির পূজা করিতেছে। একদিন আমাদেরও পূজা করিবে। যাহারা এক আল্লহর পূজা করিতেছে বলিয়া দাবী করে, তাহাদের বোজর্গগণ আমাদের খুব ঘৃণা করিয়া থাকেন। আমাদিগের দেখিলেই সাত হাত দূরে সরিয়া যান। কারণ তাহাদের দৃষ্টিতে আমরা হইতেছি নাপাক। কিন্তু যখন ইহারা বাতিল পোরস্তগণের গৃহে মুরগ-মাসাল্লা গোস্ত-পরাটা উদরস্থ করেন তখন উহা পাক হয় কিরূপে? যখন পুত্রদিগের সাদী মোবারকে পাত্রী পক্ষ হইতে মোটা টাকা কান মলিয়া লয় কিংবা মিথ্যার আশ্রয় লইয়া সন্তান লাভ ও সকল মনস্কামনা পূর্ণ হইবার তাবিজ বিক্রয় করিয়া হাজার হাজার টাকা পকেটে ভরে তখন তাহা পাক হয় কিরূপে। আসলে ইহাদের অন্দরমহল নাপাক হইয়া গিয়াছে শুধু বর্হিমহলটিতে গুলাব পানি আতর ইত্যাদি দ্বারা সুগন্ধ ছড়াইয়াবার চেষ্টা করিতেছে। হায়, অন্দর যাহার দুর্গদ্ধময় বাহিরে সুগন্ধি প্রলেপে তাহা কি দূর করা যায়? যায় না। সুতরাং বন্ধুগণ, দুঃখ করিবার কিছু নাই। আমাদের যাহারা নাপাক -বলেন তাহারা কতটা পাক আছেন, তাহা মাপিবার যন্ত্র থাকিলে মাপিয়া বলিয়া দিতাম। যাহা হউক, ইহাদের অধঃপতন ইহাদেরই ধ্বংস করিবে। আমাদের চিন্তা করিয়া লাভ নাই। তাহা ছাড়া চিন্তা করিয়াও কিছু করিবার ক্ষমতা আমাদের নাই। ইহাদের কাজ ইহাদের করিতে দিন। উপরওয়ালার হাতে সঁপিয়া দিন। ইহারা ইহাদের প্রভুর প্রতি বেইমান হইতে পারে। আমরা হইব কেনঃ “কেউ অধম হইলে আমরা উত্তম হইব না কেন।”