দেশে দেশে ইসলাম
উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার স্বাধীন মুসলিম দেশ মালিঃ অতীত ও বর্তমান
নাসীম আরাফাত
========================================================================
মালি প্রজাতন্ত্র, উত্তর - পশ্চিম আফ্রিকার একটি স্বাধীন - মুসলিম দেশ। স্বাধীনতা আর রুক্ষতা, আদ্রতা আর শুষ্কতার দেশ। দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি আর উচ্ছল বারিধারার দেশ। প্রকৃতির এই অপূর্ব মিলন মোহনায় অবস্থিত এদেশটির ভূগর্ভ অত্যন্ত সমৃদ্ধ, মূল্যবান খনিজ দ্রব্যে ভরপুর। স্বর্ণ, ফসফেট, ইউরেনিয়াম, তামা, লোহা, টিন, বক্সাইট ও ম্যাঙ্গানিজের বহু খনি ছড়িয়ে আছে দেশটির এখানে সেখানে বিভিন্ন স্থানে। শুধুমাত্র কালানা স্বর্ণ খনিতেই মওজুদের পরিমাণ ৩০,০০০ কেজি ।
ভূগর্ভের তুলনায় ভূপৃষ্টও কম সমৃদ্ধ নয়। প্রচুর পরিমাণ ধান, তুলা জোয়ার, কাসাভা, বাদাম ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। জনগণের ৯০% জন কৃষিজীবী। নাইজার ও সেনেগাল নদীতে স্থানে স্থানে বাঁধ প্রকল্পের মাধ্যমে সেচের ব্যবস্থা করে কৃষি শিল্পের উন্নতি সাধন করা হয়েছ । মৎস্য শিল্প ও পিছিয়ে নেই। সেনেগাল ও নাইজার নদী থেকে মৎসাহরণের জন্য কপোটি ও সেগু নামে দু'টি সমবায় সংস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এ সমবায় প্রকল্প প্রায় ৩০,০০০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে।
আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত এই দেশটির আয়তন ৫,২,৪৩৭ বর্গমাইল । ৫৮ লক্ষ জনগণের ৮৫ % ই মুসলমান। সুদূর আফ্রিকার এই দুস্তর - বন্ধুর জনপদে ইসলামের আগমন ও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার বিকাশ বিস্তৃতি ও সংগ্রামী ঐতিহ্যের ইতিহাস বড়ই বেদনা বিধুর। কালের স্রোতে যদিও তা ইথারে মিশে গেছে। কিন্তু আজও জীবন্ত ভাস্বর হয়ে আছে বিভিন্ন স্মৃতি চিহ্ন আর জনশ্রুতিতে।
ইসলামের আগমনঃ
নবম ও দশম শতাব্দীতে মালিতে ইসলামের আগমন ঘটে। বিচ্ছিন্নভাবে বহু মুবাল্লিগ ইসলামের উদাত্ত আহবান নিয়ে। হাজির হয় এ ভূখণ্ডে। সেই দূর্গম অঞ্চলের বিভিন্ন গোত্র ও সর্দারগণ অম্লান বদনে ইসলাম ধর্মের দীক্ষা লাভ করেন। ১২ শ শতাব্দীতে অকুতোভয় বীর মোজাহিদ ইউসুফ ইবনে তাশফীনের নেতৃত্বে এক দুর্ধর্শ বাহিনী মালিতে আসে এবং তা পদানত করে আলজেরিয়া থেকে ঘানা পর্যন্ত এক বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সূচনা করে। সুদৃঢ় ও মজবুত এই সাম্রাজ্য ও কাল পরিক্রমায় দুর্বল ও শক্তিহীন হয়ে পড়ে। ফলে ১৪ শত শতাব্দীর উষালগ্নেই তাতে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয় এবং মালি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
১৩১২-১৩৩৭ সাল ছিলো মালির উন্নতির স্বর্ণযুগ । তখন মানসা রাজারা মালি শাসন করছিলো। তারা ট্রান্স সাহারা ও নাইজার নদী হতে সেচের মাধ্যমে কৃষি বিপ্লব সাধন করে এবং মালির অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত ও সুদৃঢ় করে। মানসা রাজা মুসার শাসনামলে মালি গৌরবের চরম শিখরে পৌঁছে । শিক্ষা - দীক্ষা, সাহিত্য - সংস্কৃতিতে তারা আফ্রিকা মহাদেশে এক অপূর্ব নজীর স্থাপন করে। মালির এই সুখ্যাতি ও যশের আকর্ষণে বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুততা ছুটে আসেন রাজা মাসনা সুলায়মানের রাজধানী টিম্বাকুটে। মালি দেখে ইবনে বতুতা খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু বিধাতার চির বিধানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আবার নির্জিব হয়ে পড়ে এই প্রতাপশালী রাজারা। রাজ্যের শাসন কাঠামো অত্যন্ত শিথিল হয়ে যায়। দেখা দেয় দেশ জুড়ে চরম নৈরাজ্য আর অরাজকতা!
মালির এই চরম দুর্দিনে এগিয়ে আসে মোঙ্গাই বংশ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তারা মোঙ্গাই সালতানাতের (১৪০০-১৫৮৫) সূচনা করে। ক্রমাগত প্রায় দুইশত বৎসর তারা মালি শাসন করে। এদের মধ্যে আশাকিয়া মুহাম্মদ তুরে (১৪৯৩-১৫২৮) ছিলেন সবচেয়ে দুর্দশী ও বিখ্যাত।
১৫৯৮ সালে মরক্কো মোঙ্গাই সালতানাতকে আক্রমণ করে তা পদানত করে এবং একাধারে দুইশত বৎসর (১৫৯০-১৭৮০) মালি শাসন করে। মরক্কোর এই শাসনামল ছিলো খুবই দুর্বল ও শক্তিহীন। বিভিন্ন কারণে জনগণের মাঝে অসন্তোষের মাত্রা ছিলো চরমে। ফলে মালিসহ সাহারার দক্ষিণাঞ্চলীয় মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে ভাঙন সৃষ্টি হয়। তোকিলোর ( Tukulor ) কবিলার এক মুজাহিদ সংস্কারক আলহাজ্ব উমর নেতিয়ে পড়া দুর্বল সাম্রাজ্যকে একটি শক্তিশালী ইসলামী সাম্রাজ্যে পরিণত করতে ঝাপিয়ে পড়েন। ঐক্যবদ্ধ এক শক্তিশালী বাহিনী তৈরী করে তিনি সশস্ত্র আন্দোলনে অবতীর্ণ হন। তিনি ১৮৬২ সালে সিগোলা পদানত করে ১৮৬৩ সালে টিম্বাকু আক্রমণ করেন। বিজয়ের পরে বিদ্রোহীদের কঠোর হস্তে দমন করতে আরম্ভ করেন কিন্তু মালি আকাশে সেই সোনালী সূর্য উদয়ের পথেন কালো মেঘে ঢেকে যায়। অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে তিনি শাহাদত বরণকরেন। এরপর নেমে আসে চরম নৈরাজ্য ও অরাজকতা। অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে তার অবকাঠামো। নিস্তেজ হয়ে পড়ে তার মহীধারের মত বিশাল অবয়ব।
সাম্রাজ্যবাদের লোলুপ থাবাঃ
এমনি এক সুযোগের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে বসেছিলো ফ্রান্স। নখর ধারাচ্ছিলো সে। লালসা ঝড় ছিলো। বিলম্ব সইছিলো না মোটেই। তাই হিংস্রো রক্তাক্ত থাবা মেলে। অগ্রসর হলো মালির অসহায় গণ মানুষের দিকে।
১৮৮০ সালের শুরু থেকেই ফ্রান্স ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু সচেতন জনতা রুখে দাড়ায়। এই সাম্রজ্যবাদী শক্তিকে প্রতিহত করতে তারা পথে পথে দৃঢ় প্রতিরোধ ও প্রবল বাধা সৃষ্টি করে। ইমাম সামেরী তুরের জিহাদী আন্দোলন (১৮৮২-১৮৯৮) তখন তুঙ্গে উঠে। তিনি তার মানস - সন্তানদের নিয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন এবং মালি, সেনেগাল আনার ভোল্টা নিয়ে একটি শক্তিশালী মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠার বাস্তব ভিত্তিক নকসা তৈরী করেন। মুজাহিদ বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণে জায়গায় জায়গায় ফ্রান্স পর্যদস্ত হতে থাকে। ইতিমধ্যে তিনি সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে ধরা পড়েন। ফ্রান্স তাকে দেশান্তরীত করে। ফলে নেতাহীন 'আন্দোলন’ তার তেজ - উদ্যমতা হারিয়ে ফেলে ।
১৮৯৮ সালে ফ্রান্স সিকাশ পুর আক্রমণ করে তা ছিনিয়ে নেয়। ফলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল গুলোও ফ্রান্সের অনুগত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মালি সাম্রাজ্যবাদের করতলগত হয় এবং দীর্ঘ ২৬ বৎসর ফ্রান্স মালি শাসন করে। কিন্তু মালির স্বাধীনতা প্রিয় জনগণ কিছুতেই বিদেশী শত্রু শক্তিকে সহ্য করতে পারছিল না। তাই আবার শুরু হয় আন্দোলন । শুরু হয় গণবিস্ফোরণ। কেঁপে উঠে মালির জনপদ আর রাজপথ। শেষে বাধ্য হয়ে ১৯৬০ সালে মালি পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে।
স্বাধীনতা উত্তর মালি ও তার সমস্যাঃ
স্বাধীন মালির প্রথম প্রেসিডেন্ট মাদিবো ফরাসী গণতন্ত্র রক পরিত্যাগ করে সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুকে পড়ে এবং এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কয়েম করে। কিন্তু অর্থনৈতিক নানা সমস্যা ও মুদ্রাস্ফীতির চাপে সে আবার ফরাসী ব্লকে ফিরে আসে। ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট মাদিবো সংসদ বাতিল করে দেয়, ফলে দেশে অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। সুযোগ সন্ধানী সেনা অফিসাররাএই সুযোগে এক সফল অভ্যুত্থান ঘটায় ও ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। এক শক্তিশালী মিলিটারী কমিটি কায়েম করে সংবিধান বাতিল করে দেয় এবং সকল রাজনৈতিক দলগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
এরপর থেকে সামরিক বাহিনী মালির সাধারণ জনগণের বুকে চেপে বসে। সামরিক ছত্রছায়ায় যুলুম চলতে থাকে। সামরিক নেতৃত্বেরও বার বার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে জনগণের প্রচণ্ড চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মুসা ত্রাওবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
এরপর থেকে দুর্গম চড়াই উত্রাই আর ভয়ঙ্কর বাধা বিপত্তি লংঘন করে ক্রমে মালি। সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছো।
প্রকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতা সত্ত্বেও আজ মালি একটি দরিদ্র রাষ্ট্রের মধ্যে গণ্য। অন্তর্বিরোধ তার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিয়েছে। আজও মালি তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে অর্থনৈতিক কারণে বিদেশী ঋণ ও সাহায্যের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বহির্বিশ্ব ও শত্রু শিবিরের অশুভ তৎপরতা ও রাষ্ট্রীয় অন্তর্বিরোধের এর অন্যতম কারণ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো চায়, যেন মালির জনগণ ইসলামী শিক্ষা - দীক্ষা, ইসলামী অনুপ্রেরণা ও ঈমানী বলে বলিয়ান হয়ে দাড়াতে না পারে। দরিদ্র, অসচ্ছলতা, আর অর্থনৈতিক দূর্দশা যেন সামাজিক ও ধর্মীয় অধঃপতনের অন্যতম কারণ হয়ে থাকে।
═──────────────═