JustPaste.it

ভাষা আন্দোলন ও ইসলামী জাগরণ

 

প্রেরণার উৎসঃ ইসলামী জাগরণ

 

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখা-লেখির মাধ্যমে বুদ্ধিজীবি পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হয়। এ সময় প্রখ্যাত পন্ডিত মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটি নিবন্ধে বাংলা ভাষার পক্ষে যুক্তি পেশ করা যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নতুন করে প্রশ্নটি দেখা যায়। শাসক শ্রেণী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দিলেই শুরু হয় আন্দোলন। এ আন্দোলন আত্মত্যাগী বীর সন্তানদের প্রেরণার উৎস কী ছিল, তা আমাদের সামনে স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, এই প্রেরণার মূল উৎস ছিল মুসলমানদের ঈমানী চেতনা বা ইসলামী জাগরণ। যে ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান হয়ে এদেশবাসী বেঈমান বৃটিশ শক্তিকে বিতাড়িত করেছিল, সেই ঈমানী বলে বলিয়ান ছিল আমাদের ভাষা সৈনিকেরা। তাদের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত ছিল ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত রক্তধারা। ক্ষমতার মোহান্ধে দিশেহারা পশ্চিমা সরকার যখন বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও রাজী হল না, তখন ঈমানী চেতনায় উদ্দীপ্ত তাওহীদ বিশ্বাস দামাল ছেলেদের হৃদয় মর্মে ধ্বনিত হলো আল-কুরআনের বাণী-

    "আমি প্রত্যেক নবীকে তাঁর মাতৃভাষায় পয়গাম দিয়ে পাঠিয়েছি।"

এ আয়াত তাদেরকে বলে দিল, মাতৃভাষা কথা বলার অধিকার শুধু জন্মগত নয়, বরং মাতৃভাষা আল্লাহ্ প্রদত্ত একটি বিশেষ নিয়ামত ও এ ভাষায় কথা বলা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। এতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আল্লাহ্ কাউকে দেননি। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এমনই এক জঘন্য অপরাধ করে বসল। এর  সাথে সাথে একথাও স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ইসলামের সাথে এ সরকারের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামের নামে ইসসলাম বিরোধী আচরণ ও ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান লংঘন এ সরকারের প্রকৃতি। তখনই আমাদের ভাষা সৈনিকেরা রাজপথে নেমে এসেছিল মাতৃভাষার দাবি নিয়ে, রুখে দাঁড়িয়েছিল স্বৈরাচারী সরকারের অবৈধ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। বস্তুতঃ মাতৃভাষা রক্ষার এ আন্দোলন ছিল ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এ পথে যারা আত্মদান করেছেন, আল্লাহ্ তাদের ভাগ্যে জান্নাত নসীব করুন।

ভাষা আন্দোলনের প্রেরণার মৌল উৎসকে একটি অশুভচক্র ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত করছে। তারা নানাভাবে বাঁকা পথে ইতিহাসের ব্যাখা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের প্রেরণার মূল উৎস এ দেশের মানুষের ধর্মীয় চেতনা ও ইসলামী জাগরণ।

বিংশ শতাব্দির এই ক্রান্তিলগ্নে এসে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, আমাদের ভাইয়েরা যে ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার মহান দাবীতে আত্মদান করেছিল, তাদের সে প্রাণের দাবী আজও কি আমরা পূরণ করতে পেরেছি? আজও আমাদের অফিসিয়াল ভাষা ইংরেজী রয়ে গেছে। আদালতে তো ইংরেজী ছাড়া কিছুই চলে না। যদিও সরকারীভাবে নির্দেশ জারী করা হয়েছে সর্বক্ষেত্রে বাংলার প্রচলন ঘটাতে। কিন্তু এই নির্দেশ বাস্তবায়নে কোন মাথা ব্যথা বা দায়িত্ব-কর্তব্য আমাদের নেতা-নেত্রীদের আছে বলে মনে হয় না। অত্যন্ত দুঃখ হয়, যে ভাষার জন্য আমাদের ভাইয়েরা রক্ত দিলেন, আত্মদান করলেন, সে ভাষা-যুদ্ধের বিজয়ের তারিখ বাঙলা ৮ই ফাল্গুন উপেক্ষা করে আমরা তাদের স্মরণ করি দু'শ বছরের গোলামীর ক্লেদযুক্ত ইংরেজী তারিখ ২১শে ফেব্রুয়ারীতে। অফিসের সাহেবকে বস, আর আপাকে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করা কি বাংলার ফ্যাশন? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, মাতৃভাষার সাথে সাথে বড় কর্তাদের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনও বুঝি আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য। তাই বাংলা ভাষার জন্যে গাওয়া হচ্ছে একুশের গান।

কোন ব্রাহ্মণ ঠাকুর মারা গেলে তার শেষকৃত্যে জানাযার নামাজ পড়া হয়েছে বা বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে বলে কোথাও শোনা যায়নি। কিন্তু আমাদের কী হয়েছে? আব্দুল জাব্বার, আব্দুস সালাম, বরকতুল্লাহর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাদের প্রতিমূর্তি নির্মাণ করে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও পূজা-অর্চনার মহড়া করছি কেন? রাত দুপুরে শহীদ মিনারে গিয়ে তরুণ-তরুণীরা সমবেত কন্ঠে সঙ্গীতের সুর তুলে, খালি পায়ে প্রভাতফেরী চালিয়ে, আমরা তাদের জন্য কোন জান্নাতের  দ্বার উন্মুক্ত করছি? শহীদ মিনারে পুজার বেদীর মত ফুলে ফুলারণ্য করে সাজিয়ে তোলা, শহীদ স্মৃতির কালো ব্যাজ ধারণ করা এগুলো কি আমাদের তথা মুসলিম সংস্কৃতি?

এ সব মূলতঃ শহীদের আত্মার প্রতি উপহাস ও বিদ্রূপের নামান্তর। প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এটা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সাংস্ক্রৃতিক আগ্রাসন। এই আগ্রাসনের পেছনে একটি অশুভ চক্রের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। শতকরা নব্বইজন মুসলমানের এই দেশে ইসলামী সংস্কৃতির উপর এহেন আগ্রাসী চক্রান্ত কখনো মেনে নেয়া যায় না। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এরা যেহেতু মুসলমানদের সন্তান, সেহেতু তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এমন একটি নিয়ম গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়, যা ইসলামসম্মত। দুআ-দুরূদ, কুরআন তেলাওয়াত ও মাহফিলের আয়োজনের মাধ্যমে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করাই হচ্ছে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রদর্শনের সর্বোৎকৃষ্ট প্রক্রিয়া। ভাষা শহীদদের উত্তরসূরী বাঙ্গলী মুসলমান বারবার সেই প্রক্রিয়া অবলম্বনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৮৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে তাওহীদ বিশ্বাসী মানুষেরা চেয়েছিল শহীদ মিনারে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন পাঠ করবে, ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবে, কিন্তু কিছু  নাস্তিক ও মুরতাদের ষড়যন্ত্রে তা ব্যর্থ হয়েছে।

আজ সময় এসেছে, আমাদের মিনারগুলোকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত করার। আগ্রাসীদের চক্রান্ত প্রতিহত করে মাতৃভাষা ও ইসলামী সংস্কৃতিতে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন একটি কাংক্ষিত ইসলামী জাগরণ তথা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিপ্লব। ভাষা আন্দোলনের সঠিক প্রেরণার উৎস-ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত আজকের তরুণ ছাত্র সমাজকে এই দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। শহীদানের রেখে যাওয়া বাকী কাজটুকু পূর্ণ করার দায়িত্ব আমাদের। তাই আসুন, আজ আর একুশের গান নয়, ৮ই ফাল্গুন উদযাপন করি। সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলনের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলি। তাহলেই আমাদের শহীদানের আত্মা শান্তি পাবে এবং  এ আন্দোলন সার্থক হবে। অফিস-আদালতে, কল-কারখানায়, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় সর্বক্ষেত্রে সবার মুখে যেদিন কেবল মাতৃভাষা বাংলা উচ্চারিত ও লিখিত হবে, সেদিনই হবে বাংলাভাষা ও ভাষা আন্দোলনের যথার্থ মূল্যায়ন।

 

  -হাফেজ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম