JustPaste.it

tazkiyah--7.jpg

 

মুজাহিদের আত্মশুদ্ধি - ০৭

 

কুরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব

ও রামাদানের প্রস্তুতি

 

উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিযাহুল্লাহ

 

*****************

 

উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিযাহুল্লাহঃ বিসমিল্লাহি ওয়াস সালাতু ওয়াস সালাম আলা  রাসুলিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আবার আমাদেরকে আরেকটি তাযকিয়া মজলিসে বসার তাওফিক দান করেছেন। ভাই! আপনারা সবাই কেমন আছেন?  উপস্থিত এক ভাইঃ আলহামদুলিল্লাহ সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে খুব ভালো রেখেছেন। ভাই! আপনি কেমন আছেন?

উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিযাহুল্লাহঃ আমিও আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি।

ভাই সবাই মাশোয়ারা দেন, আজকে আমরা কি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারি?

উপস্থিত এক ভাইঃ কোরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা হতে পারে।

উপস্থিত আরেক ভাইঃ সামনে রমজান আসছে। তাই আমরা নিজেদেরকে কীভাবে পরিশুদ্ধ করতে পারি, এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। আমাদের অন্তরে আল্লাহ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কেমন মহব্বত ও ভালোবাসা থাকা চাই, এ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হতে পারে।

উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিজাহুল্লাহঃ আর কোনো ভাই কি কিছু বলবেন?

উপস্থিত আরেক ভাইঃ রমজানে আমাদের আমলের পরিমাণ যেন বৃদ্ধি পায় এবং রমজানে আমরা কী কী আমল করতে পারি, এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিজাহুল্লাহঃ আজ তাহলে আমরা প্রথমে কুরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু আলোচনা করি। এরপর রমজানের আমল সম্পর্কেও কিছু আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।

মাত্র একটি সওয়াবের জন্য

ভাই আমরা সবাই জানি যে, কুরআন তেলাওয়াত করলে প্রতিটি হরফে কমপক্ষে দশটি করে নেকি পাওয়া যায়। আমরা কি কখনো গুনে দেখেছি, সুরা ফাতিহাতে কয়টি হরফ? হয়তো কেউই দেখিনি। আসলে গুনতে যে সময় লাগবে তার আগে পুরো সুরাটি একবার তেলাওয়াত করে ফেলা যাবে। এর অর্থ হচ্ছে, আমলটির সওয়াব হিসাব করার আগেই আমলটি করে  ফেলা যায়। এত সহজ হওয়া সত্ত্বেও আমরা সাধারণত তেলাওয়াতের আমলকে খুব একটা গুরুত্ব দেই না। হাশরের ময়দানে আল্লাহ তাআলা যখন আমাদের ছোট বড় সকল আমলের হিসাব নেয়া শুরু করবেন তখন দেখা যাবে, কেউ কেউ মাত্র একটি সওয়াবের জন্য ধরা পড়ে যাবে। সে একটি সওয়াবের জন্য বহু জনের কাছে ছোটাছুটি করবে। কিন্তু সেদিন কেউ কি দিবে একটি সওয়াব? কেউই দিবে না। না মা, না বাবা, না স্ত্রী, না সন্তান, কেউই দিবে না। একটু ভাবুন তো, মাত্র একটি সওয়াবের জন্য কারো কারো নেকির পাল্লা হালকা হয়ে যাবে আর এ কারণে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। মাত্র একটি আলিফের সওয়াবের জন্য,  মাত্র একটি লামের সওয়াবের জন্য অথবা মাত্র একটি মীমের সওয়াবের জন্য। আল্লাহু আকবার! কী ভয়াবহ অবস্থা হবে সেদিন! অথচ আল্লাহ এখন আমাদেরকে কত সুযোগ দিচ্ছেন, সারা জীবনই সুযোগ। এখন আমরা চাইলে যত ইচ্ছা সওয়াব অর্জন করতে পারি কিন্তু আমরা এর প্রতি কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি! যখন সুযোগ থাকবে না তখন আফসোস করবো কিন্তু এখন সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাচ্ছি না।

তারা কত বড় হতভাগা!

একবার এক শাইখের লেকচার শুনছিলাম। লেকচারের এক পর্যায়ে শাইখ বললেন, কেউ যখন জাহান্নামি হবে তখন ‘সে কেন জাহান্নামি হল? এ জন্য আল্লাহ তার ওপর খুব রাগ করবেন। সে নিজে নিজের ওপরে যতটা রাগ করবে আল্লাহর রাগটা হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। কথাটা আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। একটু পর শাইখ নিজেই কথাটি বুঝিয়ে বললেন যে, আল্লাহ রাগ করবেন এ জন্য যে, সে কেন আল্লাহর কাছে থেকে নিজের অপরাধ মাফ করিয়ে নিতে পারল না। যে লোক আল্লাহর কাছ থেকে মাফ করিয়ে নিতে পারলো না সে আর কার কাছ থেকে মাফ করাতে পারবে?!

আসলে ভাই! আল্লাহ সব সময় তাঁর বান্দাদেরকে মাফ করার জন্য ওসিলা খুঁজেন। কখনো সামান্য সামান্য ওসিলাতেই মাফ করে দেন। এরপরও যারা জাহান্নামে যাবে তারা কত বড় হতভাগা!

এটি একমাত্র আল্লাহর কালামের বৈশিষ্ট

তো কথা হচ্ছিল কুরআন তেলাওয়াত সম্পর্কে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَنْ قَرَأَ حَرْفاً مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لاَ أَقُولُ: {الم} حَرْفٌ، وَلَكِنْ: أَلِفٌ حَرْفٌ، وَلاَمٌ حَرْفٌ، وَمِيْمٌ حَرْفٌ

যে ব্যক্তি কোরআন শরীফের একটি হরফ পাঠ করে সে এর বিনিময়ে একটি সওয়াব লাভ করে আর একটি সওয়াব দশটি সওয়াবের সমান। আমি বলছি না যে, الم ‘আলিফ লাম মীম’ একটি হরফ। বরং ‘আলিফ’ একটি হরফ, ‘লাম’ একটি হরফ এবং ‘মীম’ একটি হরফ। (জামে’ তিরমিযী, হাদিস : ২৯১০)

হাদিসে একটি বিষয় লক্ষ্য করুন, এখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের প্রতি হরফে একটি নেকি, এ কথাটিকে বুঝানোর জন্য এমন একটি শব্দ দিয়ে উদাহরণ দিয়েছেন যে শব্দটির কোনো অর্থ নেই, এ থেকে বুঝা যায়, কেউ যদি অর্থ না বুঝেও কুরআন তেলাওয়াত করে তবুও সে এ নেকি পাবে। আর যদি কেউ অর্থ বুঝে পড়ে তাহলে তার  নেকির পরিমাণ যে কত বেশি হবে তা আল্লাহই ভালো জানেন। তাই আমরা চেষ্টা করবো, যেন অর্থ বুঝে বুঝে তেলাওয়াত করতে পারি। তবে যত দিন তা পারবো না তত দিন অর্থ বুঝা ছাড়াই তেলাওয়াত করে যাবো। তেলাওয়াতের আমল কোনো ভাবেই যেন বন্ধ না থাকে।  

দেখুন ভাই! আল্লাহ কত বড় মেহেরবান! আমরা যদি তাঁর কালাম না বুঝেও পড়ি তবুও তিনি আমাদেরকে এর জন্য পুরষ্কার দেন। আমরা আল্লাহর কালামের মধ্যে যে কারো নাম উচ্চারণ করি, যে কারো ঘটনা পড়ি আল্লাহ আমাদেরকে এর জন্য পুরষ্কার দেন। এর কারণ হল, এটি যে মহান আল্লাহর কালাম!

এক শাইখ তাঁর এক লেকচারে বলছিলেন, আপনি দুনিয়াতে এমন কাউকে পাবেন না যে আপনাকে তার শত্রুর নাম নিলে, তার কথা আলোচনা করলে পুরস্কার দিবে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর যে সব শত্রুদের কথা বলেছেন, (যেমন ফেরাউন, হামান, কারুন) এবং তাদের ঘটনাবলী উল্লেখ করেছেন এখন আমরা যদি তাদের নামগুলো উচ্চারণ করি, তাদের ঘটনা সম্বলিত আয়াতগুলো তেলাওয়াত করি তাহলে প্রতি হরফের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এক একটি করে নেকি দেন, যা কিনা একটিই দশটি নেকির সমান। দেখুন, কুরআনে উল্লেখিত ফেরাউন শব্দটি উচ্চারণ করলে কমপক্ষে পঞ্চাশটি নেকি হয়। অথচ সে আল্লাহর কত বড় অবাধ্য ছিল। এটি একমাত্র আল্লাহর কালামেরই বৈশিষ্ট।

এবার আমরা কুরআন তেলাওয়াতের ফযিলত সম্পর্কে আরও কয়েকটি হাদিস শুনি,

উঁচু কুঁজবিশিষ্ট উষ্ট্রী

১ম হাদিসঃ হযরত উকবা বিন আমের রাযি. বলেন,

خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ   صلى الله عليه وسلم  وَنَحْنُ فِي الصُّفَّةِ، فَقَالَ  أَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنْ يَغْدُوَ كُلَّ يَوْمٍ إِلَى بُطْحَانَ، أَوْ إِلَى  الْعَقِيقِ، فَيَأْتيَ مِنْهُ بِنَاقَتَيْنِ كَوْمَاوَيْنِ فِي غَيْرِ إِثْمٍ وَلاَ قَطِيعَةِ رَحِمٍ ؟ فَقُلْنَا : يَا رَسُولَ اللَّهِ نُحِبُّ ذَلِكَ . قَالَ :  أَفَلاَ يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى المَسْجِدِ فَيَعْلَمَ، أَوْ يَقْرَأَ آيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ اللَّهِ عز وجل  خَيْرٌ لَهُ مِنْ نَاقَتَيْنِ، وَثَلاثٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ ثَلاَثٍ، وَأَرْبَعٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَرْبَعٍ، وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنَ الإِبِلِ .

একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (নিজ ঘর থেকে) বের হলেন। আমরা তখন সুফ্‌ফায় (মসজিদের আঙ্গিনায়) অবস্থান করছিলাম। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আছে  যে প্রতিদিন সকালে বুতহান বা আকীক উপত্যকায় গিয়ে সেখান থেকে কোনো প্রকার পাপ বা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ছাড়া উঁচু কুঁজবিশিষ্ট দু’টি উষ্ট্রী নিয়ে আসতে পছন্দ করে? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা সবাই তা পছন্দ করি। তিনি বললেন : তোমাদের কেউ কি এরূপ করতে পার না যে, সকালে মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কিতাব থেকে দুটো আয়াত শিখবে বা পড়বে, এটা তার জন্য দু’টি উষ্ট্রীর চে’ উত্তম। আর তিনটি আয়াত তিনটি উষ্ট্রীর চে’। চারটি আয়াত চারটি উষ্ট্রীর চে’ এবং সমসংখ্যক উটের চেয়েও উত্তম।

(সহী মুসলিম : ৮০৩)

এ হাদিস থেকে আমরা যে শিক্ষাটি পাই তা হল, আমরা প্রতিদিন সকালে যখন ফজরের সালাত আদায় করার জন্য মসজিদে যাবো তখন অবশ্যই কিছু না কিছু তেলাওয়াত করবো। যত ব্যস্ততাই থাক। একদমই না পারলে অন্তত দু’তিনটি আয়াত হলেও যেন তেলাওয়াত করা হয়।

তেলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে

২য় হাদিসঃ  হযরত আবু উমামা রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

اقْرَؤُوا القُرْآنَ؛ فَإنَّهُ يَأتِي يَوْمَ القِيَامَةِ شَفِيعًا لأَصْحَابِهِ

তোমরা কুরআন তেলাওয়াত কর। কেননা কিয়ামতের দিন কুরআন তার তেলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে। (সহী মুসলিম-৮০৪)

বলুন ভাই! কুরআন যদি কারো জন্য সুপারিশ করে তাহলে সে কি জাহান্নামে যেতে পারে?

তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই

৩য় হাদিসঃ হযরত উসমান রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ

তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হল ওই ব্যক্তি যে নিজে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শেখায়।

(সহী বুখারী ৫০২৭)

তার জন্য রয়েছে দুটি সওয়াব

৪র্থ হাদিসঃ হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

الَّذِي يَقْرَأُ القُرْآنَ وَهُوَ مَاهِرٌ بِهِ مَعَ السَّفَرَةِ الكِرَامِ البَرَرَةِ، وَالَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ لَهُ أجْرَانِ

কুরআনের ইলমের অধিকারী, ভাল তিলাওয়াতকারী ও লিপিকার পুণ্যবান সম্মানিত ফেরেশতাদের সঙ্গী হবে। (তেলাওয়াতে পাকা না হওয়াই) অতি কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও যে বারবার কুরআন মাজীদ পাঠ করে, সে দ্বিগুণ পুরস্কার লাভ করবে।

(সহী বুখারী- ৪৯৩৭, সহী মুসলিম- ৭৯৮)    

বলুন ভাই! আমাদের মধ্যে কোনো ভাই যদি খুব ভালো করে তেলাওয়াত করতে না জানেন তাঁর জন্য কি তেলাওয়াত ছেড়ে দেয়ার সুযোগ আছে? কিছুতেই না। তিনি তো বরং দিগুণ সওয়াব পাবেন।

কুরআন তেলাওয়াতকারী হল কমলা লেবুর মতো

৫ম হাদিসঃ হযরত আবু মুসা আশআরী রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِي يَقْرَأُ القُرْآنَ مَثَلُ الأُتْرُجَّةِ: رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا طَيِّبٌ، وَمَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِي لا يَقْرَأُ القُرْآنَ كَمَثَلِ التَّمْرَةِ: لا رِيحَ لَهَا وَطَعْمُهَا حُلْوٌ، وَمَثلُ المُنَافِقِ الَّذِي يقرأ القرآنَ كَمَثلِ الرَّيحانَةِ: ريحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ، وَمَثَلُ المُنَافِقِ الَّذِي لا يَقْرَأُ القُرْآنَ كَمَثلِ الحَنْظَلَةِ: لَيْسَ لَهَا رِيحٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ

কুরআন পাঠকারী মু’মিনের দৃষ্টান্ত কমলালেবুর ন্যায়, যার ঘ্রাণও উত্তম স্বাদও উত্তম। যে মু’মিন কুরআন পাঠ করে না, তার দৃষ্টান্ত খেজুরের ন্যায়, যার কোন সুঘ্রাণ নেই তবে এর স্বাদ মিষ্টি। আর যে মুনাফিক কুরআন পাঠ করে তার দৃষ্টান্ত রায়হানার ন্যায়, যার সুঘ্রাণ আছে তবে স্বাদ তিক্ত। আর যে মুনাফিক কুরআন পাঠ করে না তার দৃষ্টান্ত হন্‌যালাহ্ ফলের ন্যায়, যার সুঘ্রাণও নাই, স্বাদও তিক্ত। (সহী বুখারী ৫০২০; সহী মুসলিম ৭৯৭)

আমরা নিজেরাই একটু চিন্তা করি, আমরা কি খেজুরের মতো হতে চাই? না, কমলা লেবুর মতো।

ওপরে উঠতে থাকো

৬ষ্ঠ হাদিসঃ হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

يُقَالُ لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ: اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ في الدُّنْيَا، فَإنَّ مَنْزِلَتَكَ عِنْدَ آخِرِ آية تَقْرَؤُهَا

(কিয়ামতের দিন)পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতকারী পাঠক, হাফেয ও তার উপর আমলকারীকে  বলা হবে, ‘তুমি কুরআন কারীম পড়তে থাক ও উপড়ে উঠতে থাকো। আর দুনিয়াতে যেভাবে তারতীলের সাথে অর্থাৎ ধীরে ধীরে স্পষ্ট ভাবে তেলাওয়াত করতে ঠিক ওভাবে তেলাওয়াত করতে থাকো। কেননা, জান্নাতে তোমার স্থান ঠিক সেখানে হবে যেখানে তুমি শেষ আয়াতটি তেলাওয়াত করবে। (সুনানে আবু দাউদ ১৪৬৪; জামে তিরমিযী ২৯১৪)

দেখুন ভাই, এ হাদিস থেকে আমরা কুরআন তেলাওয়াতের পদ্ধতি শিখতে পারছি। কুরআনের তেলাওয়াত হবে ধীরে ধীরে। প্রতিটি হরফকে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে হবে। অর্থ জানা থাকলে অর্থের প্রতিও খেয়াল রাখতে হবে। এরই নাম হল তারতীলের সাথে তেলাওয়াত।

কুরআন তেলাওয়াত করার পদ্ধতি

হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউস রাযি. বলতেন, কুরআন তেলাওয়াতের সময় (বিষয় বস্তুর প্রতি লক্ষ্য করে) তোমরা নিজের অন্তরকে নাড়া দাও। তাড়াহুড়া করো না। সূরা শেষ করাই যেন তোমাদের লক্ষ্য না হয়।

কুরআন তেলাওয়াত করার পদ্ধতি হল, তেলাওয়াত করতে হবে ধীরে ধীরে। তেলাওয়াতের সময় জান্নাতের আলোচলা এলে তেলাওয়াত থামিয়ে জান্নাতের জন্য দোয়া করা, জাহান্নামের আলোচনা এলে জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাওয়া, নেককার বান্দাদের আলোচনা এলে তাদের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার জন্য দোয়া করা, বদকার বান্দাদের আলোচনা এলে তাদের অন্তর্ভূক্ত না হওয়ার জন্য দোয়া করা, করণীয় কাজের আদেশ এলে তা করার সংকল্প করা এবং বর্জনীয় কাজের আলোচনা এলে তা ছাড়ার সংকল্প করা।   

আরেকটি বিষয় হল, নফল সালাতে কুরআন তেলাওয়াত করার অভ্যাস বানানো চাই। আমরা যে যতটুকু কুরআন মুখস্থ করেছি তা-ই নফল সালাতে পড়ি। সালাতেও পড়বো এ পদ্ধতিতেই।

কারো মাত্র দশটি সূরা মুখস্থ থাকলে এই দশটি সূরাই প্রতি রাকাতে পড়তে পারেন। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, রাকাত সংখ্যা বেশি হওয়ার চেয়ে কেরাত দীর্ঘ করে কিয়াম দীর্ঘ করার মর্যাদা অনেক বেশি।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীগণ এভাবেই তেলাওয়াত করতেন। তাদের অধিকাংশ তেলাওয়াত সালাতের মধ্যেই হতো। তখন তো ভাই দেখে দেখে কুরআন তেলাওয়াত করার তেমন একটা রেওয়াজই ছিল না। তখন মুসহাফই তো ছিল না। কারো কাছে গাছের পাতাতে, কারো কাছে হাড্ডিতে, কারো কাছে চামড়ার ওপর কুরআন লেখা ছিল। এ জন্য আমরা ধীরে ধীরে চেষ্টা করি, সালাতের বাইরে যেমন তেলাওয়াত করি সালাতের ভিতরেও যেন করতে পারি ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফিক দান করেন।

কুরআন তেলাওয়াতের পূর্বে মিসওয়াক করা

ভাই! কুরআন তেলাওয়াতের পূর্বে করণীয় বেশ কিছু আদব আছে। তার মধ্যে একটি হল মিসওয়াক করা। যেন মুখে কোনও প্রকার দুর্গন্ধ না থাকে। কারণ, তেলাওয়াতের সময় ফেরেশতারা উপস্থিত হন। মুখে দুর্গন্ধ থাকলে তারা কষ্ট পান। হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম আমাকে মিসওয়াক করার ব্যাপারে এত বেশি তাকিদ দিয়েছেন যে, আমার আশংকা হচ্ছে, আমি মিসওয়াক করতে করতে মাড়িই ছিলে ফেলবো।

তাছাড়া আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

السواك مطهرة للفم مرضاة للرب

মিসওয়াক মুখ পবিত্র রাখার এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার উপায়।

(সুনানে নাসায়ী ৫)

রমজানে ছোট ছোট আমলের প্রতি বেশি নজর দেই

এবার আমরা রমজান নিয়ে কিছু কথা আলোচনা করি ইনশাআল্লাহ। এখন রমজান চলছে। রমজানে কী কী আমল করা যায়? এ বিষয়ে আমি বলবো, কিছু আমল তো ভাই আমাদের  সবারই জানা, আমরা আলহামদুলিল্লাহ করিও। যেমন, সারা দিন সিয়াম রাখা, রাতে তারাবীর সালাত, শেষ রাতে কিয়ামুল লাইল, বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি। এগুলোর পাশাপাশি আমাদের সবার উচিৎ, রমজান উপলক্ষ্যে বিশেষ ভাবে আরও কিছু আমল করা। যদিও ওই আমলগুলো সারা বছরই করার মতো তবে রমজানে বিশেষ গুরুত্বের সাথে করা। এ জাতীয় আমলগুলো একেক জনের জন্য একেক রকম হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আমি মৌলিক ভাবে একটি কথা বলে দেই, এতেই আপনার বুঝে নিতে পারবেন ইনশাআল্লাহ। রমজানে আমরা বিশেষ ভাবে ছোট ছোট আমলগুলোর প্রতি বেশি নজর দিবো ইনশাআল্লাহ্‌। যে আমলগুলোর প্রতি অন্য সময় তেমন একটা খেয়াল করা হয় না ওই আমলগুলোর প্রতি একটু বেশি গুরুত্ব দিবো ইনশাআল্লাহ্‌।

রমজানে ব্যক্তিগত আমল করবো, না জিহাদের কাজ করবো?

উপস্থিত এক ভাইঃ ভাই! রমজানে ব্যক্তিগত আমল করবো, না জিহাদের কাজ করবো?

উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিজাহুল্লাহঃ জিহাদ তো ভাই আমার আপনার ব্যক্তিগত আমলেরই অন্তর্ভূক্ত। আমরা তো ভাই আমাদের নিজের লাভের জন্যই জিহাদ করি। হ্যাঁ, এর দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা, তা ঠিক। তবে এর লাভ তো ভাই দুনিয়াতে এবং আখেরাতে আমরা নিজেরাই পাবো, তাই না ভাই?

এক ভাইয়ের একটি স্বপ্ন

এ প্রসঙ্গে আমাদের এক ভাইয়ের একটি স্বপ্ন বলি। তিনি দেখেন যে, তিনি অপারেশনে বের হচ্ছেন। তখন দেখেন, তাঁর আহলিয়ার মনটা একটু খারাপ। তিনি বললেন, মন খারাপ করছো কেন? আমি তো আমাদের সবার জন্যই জিহাদে যাচ্ছি ( মানে আমি, তুমি, আমাদের সন্তান সবার জন্যই জিহাদে যাচ্ছি) পরক্ষণেই ভাবলেন, হায়! আমি একি বললাম? আমার  জিহাদ তো সবার আগে আল্লাহর জন্য হওয়া উচিৎ। তো তিনি আবার বললেন, আরে আমি তো আল্লাহর জন্য এবং আমাদের সবার জন্যই যাচ্ছি। এরপর তিনি দেখেন, জিহাদ থেকে  ফিরে এসেছেন। এসে দেখেন, ঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে। তিনি তাঁর আহলিয়াকে লক্ষ্য করে বলছেন, তুমি শুধু শুধুই চিন্তা করছিলে। এই দেখ, আমি মৃত্যু বরণ করেছি কিন্তু আমার  কোনও কষ্ট হয়নি। ভাই দেখলেন, তাঁর আহলিয়া তাঁর কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। তখন তাঁর মনে হল, আরে আমি না মারা গেছি, আমার কথা সে শুনবে কীভাবে?

তিনি এও বলেন যে, আমি দেখলাম, আমার গোটা শরীর আলোকিত হয়ে আছে কিন্তু ঘরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। ভাই নিজেই বলেন, আমার মনে হয় এটা এজন্য যে, ঘর মানে হল দুনিয়া। আর দুনিয়াতো আসলেই অন্ধকার। আল্লাহু আলাম।

আমরা দোয়া করি, আল্লাহ তাআলা যেন ওই ভাইকে শাহাদাত নসিব করেন। সঙ্গে আমাদেরকেও।

একটি উসুল বা মূলনীতি

রমজানে ব্যক্তিগত আমল করবো, না জিহাদের কাজ করবো? সংক্ষেপে এর উত্তর হচ্ছে, দুটো আসলে একই। দুটোই আমাদের ব্যক্তিগত আমল। তবে হ্যাঁ, একটি উসুল আছে যা আমি এই মাত্র কদিন আগে শিখলাম আলহামদুলিল্লাহ। উসুলটি হল, আপনি যখন কুরআন তেলাওয়াত করেন তখন যদি আযান শুনতে পান কী করেন? একটু সময়ের জন্য তেলাওয়াত বন্ধ করে আযানের উত্তর দেন তাই না ভাই? এর অর্থ কি তেলাওয়াত অপেক্ষা আযানের উত্তর দেয়ার সাওয়াব বেশি? না। বরং এখানে বিষয়টা হল, কোনো আমল মর্যাদার দিক দিয়ে বড় ঠিক তবে তা একটু পরেও করার সুযোগ আছে কিন্তু আরেকটি আমল যা মর্যাদার দিক দিয়ে যদিও ছোট কিন্তু আমলটি পরে আর করা যাবে না এমন হলে ছোট আমলটিই আগে করা হবে এরপর বড় আমলটি পরে করা হবে। যেমনটি আমরা করে থাকি, আগে আযানের উত্তর দেই এরপর আবার তেলাওয়াত শুরু করি। এটাই হল উসূল। এ থেকেই ওই ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া যায়। রমজানে আমরা আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত আমলে একটু বেশি জোর দেই। কারণ রমজানে স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের অফিশিয়াল কাজ কমিয়ে দেয়া হয়। এ সুযোগে আমরা একান্ত ব্যক্তিগত কিছু আমল করে নিতে পারি ইনশাআল্লাহ।

তো একটু পূর্বে বলছিলাম যে, রমজানে ছোট ছোট আমলগুলো বেশি বেশি করা এবং যে আমলগুলোর প্রতি অন্য সময় তেমন একটা খেয়াল করা হয় না ওগুলোর প্রতি একটু বেশি গুরুত্ব দেয়া।

অসহায় মুসলমাদেরকে সাহায্য করা

রমজানে আমরা যেসব আমলগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে পারি তার মধ্যে আসতে পারে অসহায় মুসলমাদেরকে সাহায্য করা।

দেখুন ভাই! আল্লাহ তাআলা সকল নবীদেরকে মৌলিক যে সব হুকুম দিয়েছেন তার মধ্যে এক আল্লাহর ইবাদত করা এবং শিরক থেকে বেঁচে থাকার পাশাপাশি আরও যে সব হুকুম দিয়েছেন তার মধ্যে অসহায়কে সাহায্য করার হুকুমটিও ছিল। নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্ব থেকেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে এ গুণটি ছিল। যা আমরা হযরত খাদিজা রাযি.র থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানতে পারি। তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,

আল্লাহ কিছুতেই আপনাকে ধ্বংস করবেন না। এরপর তিনি তাঁর বেশ কয়েকটি গুণের কথা উল্লেখ করেন। ওই গুণগুলোর মধ্যে একটি ছিল, আপনি অসহায়দেরকে সাহায্য করেন। (সহী বুখারী)

এ আমলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভাই। রমজানে আমরা এ আমলটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে পারি ইনশাআল্লাহ।

দেখুন ভাই! আমরা যখন জিহাদ বিষয়ক কোন আয়াত শুনি যেমন ধরুন আমরা যখন এ আয়াতটি শুনি যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন,

 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن تَنصُرُوا اللَّهَ يَنصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ

হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো তবে আল্লাহও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা দৃঢ় রাখবেন। (সূরা মুহাম্মাদ-৭)

 

আয়াতটি শুনলে আমরা জিহাদের প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠি কিনা?

উপস্থিত এক ভাইঃ জি ভাই।

উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিজাহুল্লাহঃ তাহলে এবার দেখুন, হাদিসে কুদসীতে এসেছে,

কেয়ামতের দিন আমাদেরকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তাআলা বলবেন, হে আমার বান্দা! আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম তুমি তো আমাকে খাবার দাওনি। উত্তরে বান্দা বলবে, হে আল্লাহ! আমি আপনাকে কীভাবে খাবার দেবো? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা ক্ষুধার্ত ছিল তুমি যদি তাকে খাবার দিতে তাহলে তার কাছে আমাকে পেতে। অর্থাৎ তাকে খাবার দিলে মূলত আমাকেই দেয়া হত। (সহী মুসলিম ২৫৬৯)

লক্ষ্য করুন ভাই! আল্লাহ তাআলার প্রথম আহবান ‘তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর তাহলে আমিও তোমাদের সাহায্য করব’ এতে আমরা যেভাবে সাড়া দেই ‘আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম তুমি তো আমাকে খাবার দাওনি’ এর প্রতি তো আমরা সেভাবে সাড়া দেই না?

আরেকটি উদাহরণ দেই। এক হাদিসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ

তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হল ওই ব্যক্তি যে নিজে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শেখায়।

(সহী বুখারী-৫০২৭)

অন্য হাদিসে বলেছেন,

خِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ

তোমাদের মধ্যে সেই সব চেয়ে ভালো যে তার স্ত্রীর কাছে ভালো। (জামে তিরমিযী-১১৬১)

লক্ষ্য করুন ভাই! হাদিস দুটোর মধ্যে প্রথমটির প্রতি আমরা যতটা গুরুত্ব দেই দ্বিতীয়টির প্রতি সাধারণত ততটা দেই না। অথচ দুটো হাদিসের প্রথম অংশ একই।

আরও একটি উদাহরণ দেই। এক হাদিসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

كَلِمَتَانِ خَفِيفَتَانِ عَلَى اللِّسَانِ، ثَقِيلَتَانِ فِي المِيزَانِ، حَبِيبَتَانِ إِلَى الرَّحْمنِ: سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ، سُبْحَانَ اللهِ العظيمِ .

এমন দুটি বাক্য আছে, যা বলতে সহজ তবে মীযানের পাল্লায় ভারী এবং করুণাময় আল্লাহর নিকট অতি প্রিয়। তা হচ্ছে, سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ، سُبْحانَ اللَّهِ الْعَظِيمِ ।

(সহী বুখারী : ৬৪০৪; সহী মুসলিম : ২৬৯৪)

হাদিসের শব্দগুলো একটু খেয়াল করুন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এমন দুটি বাক্য আছে, যা বলতে সহজ তবে মীযানের পাল্লায় ভারী, কতটুকু ভারী! আমি আপনি যত ভারী কল্পনা করতে পারি তার চেয়েও অনেক অনেক ভারী। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাকে ভারী বলছেন তা যে কত ভারী হবে, তা কি আমি আপনি কল্পনা করতে পারবো?

হাদিসে আরেকটি শব্দ এসেছে, করুণাময় আল্লাহর নিকট অতি প্রিয়, আল্লাহু আকবার, এ বাক্যটিকে আল্লাহ পছন্দ করেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন কিন্তু তারপরও আমাদের মধ্যে কজন এ যিকিরটিকে গুরুত্বের সাথে করি? এর কারণ হল, যে সব আমল করা সহজ সে সব আমলকে আমরা ততটা গুরুত্ব দেই না। অথচ বাস্তবতা হল, যে সব আমল তুলনামূলক হালকা, সহজেই করে ফেলা যায় ওই আমলগুলোই হয়তো আমাদের নাজাতের ওসিলা হয়ে যেতে পারে।

এ বিষয়ে দুটি হাদিস শোনাই।

কুকুরকে পানি পান করিয়ে জান্নাত লাভ

হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

بَيْنَما كَلْبٌ يُطِيفُ بِرَكِيَّةٍ قَدْ كَادَ يقتلُهُ العَطَشُ إِذْ رَأَتْهُ بَغِيٌّ مِنْ بَغَايَا بَنِي إسْرَائِيل، فَنَزَعَتْ مُوقَها فَاسْتَقَتْ لَهُ بِهِ فَسَقَتْهُ فَغُفِرَ لَهَا بِهِ

একবার এক কুকুর একটি কূপের চারপাশে ঘোরাফেরা করছিল। পিপাসা তাকে মৃতপ্রায় করে তুলেছিল। এমতাবস্থায় হঠাৎ বনি ইসরাইলের এক বেশ্যা কুকুরটি দেখতে পায়। তখন সে নিজের চামড়ার মোজা খুলে তা দিয়ে(কূপ থেকে)পানি উঠিয়ে কুকুরটিকে পান করায়। তার এই একটি আমলের ওসিলায় আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দেন।

(সহী বুখারী ২৩৬৩; সহী মুসলিম ২২৪৪)

রাস্তা থেকে কাঁটা সরিয়ে জান্নাত চলে গেল

হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে এসেছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

بَيْنَمَا رَجُلٌ يَمْشي بِطَريقٍ وَجَدَ غُصْنَ شَوكٍ عَلَى الطريقِ فأخَّرَه فَشَكَرَ اللهُ لَهُ، فَغَفَرَ لَهُ

একবার এক লোক রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় একটি কাঁটা দেখতে পায়। তখন সে (এর দ্বারা মানুষ কষ্ট পাবে মনে করে) ওটাকে রাস্তা থেকে তুলে দূরে ফেলে দেয়। আল্লাহ তাআলার তার এই আমলটির ওসিলায় তাকে ক্ষমা করে দেন।

(সহী বুখারী ৬৫৪; সহী মুসলিম ৪৩৭)

হাদিস দুটি থেকে আমরা এ শিক্ষাই পেলাম যে, কোনো আমলকেই আমরা ছোট মনে করে ছেড়ে দেব না। আমরা হয়তো জানবোও না যে, হয়তো ওই আমলটিই আল্লাহ পছন্দ করে ফেলবেন এবং এর ওসিলায় আমার জন্য জান্নাতের ফায়সালা করে ফেলবেন।

ছোট আমলের একটি উদাহরণ

আমাদের আশপাশ থেকে ছোট আমলের একটি উদাহরণ দেই। ধরুন, আপনি একদিন কোনো বৃদ্ধ রিকশাচালককে দেখতে পেলেন। যার দাড়িগুলো একদম সাদা হয়ে গেছে।  আপনি তখন মনে মনে ভাবলেন, একজন মুসলমান তাও আবার বৃদ্ধ। দাড়িগুলোও সাদা হয়ে গেছে। না জানি আল্লাহর কাছে তাঁর এ বান্দার কত মূল্য! আপনি তখন একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়তে তাকে একটু সাহায্য করলেন। এরপর তা ভুলেও গেলেন। দেখবেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ আপনাকে এই আমলটির জন্য কী বিরাট প্রতিদান দেবেন  ইনশাআল্লাহ। কারণ, আমলটি ছোট হলেও তা একমাত্র আল্লাহর জন্যই করা হয়েছে।  আমাদের ছোট ছোট আমলগুলো সাধারণত ইখলাসের সাথেই হয়ে থাকে। ছোট আমল সাধারণত কেউ দুনিয়াবি উদ্দেশ্যে করে না। এ জন্য এ ধরনের আমলের মূল্য আল্লাহর কাছে অনেক অনেক বেশি। আল্লাহর কাছে আসলে আমাদের সব কিছুই ছোট, তাঁর কাছে আমাদের শুধু ওই আমলগুলোই বড় যা আমরা একমাত্র তাঁর জন্য করে থাকি

ছোট ছোট নেক আমলের কিছু নমুনা

তো ভাই! রমজানে আমরা কী কী আমল করতে পারি, সংক্ষেপে এর উত্তর হচ্ছে, আমরা আমাদের কুরআন তিলাওয়াত, কিয়ামুল লাইল ইত্যাদির পাশাপাশি নিচের আমলগুলোর প্রতিও গুরুত্ব দেবো ইনশাআল্লাহ

১. দান সাদাকা করা।

২. মুসলিম ভাইদেরকে যে কোনো উপায়ে কিছু সহায়তা করা।

৩. বাবা মাকে কিছু আন্তরিক সময় দেয়া।

৪. বৃদ্ধ ও অসুস্থদেরকে সাহায্য করা। সম্ভব হলে তাদেরকে কিছু সময় দেয়া এবং অন্যকেও এর প্রতি উৎসাহিত করা।

এক জায়গায় এ বিষয়ক একটি লেখা পেয়েছি। লেখাটা আপনাদেরকেও দিচ্ছি। আমরা  আমাদের প্রত্যেকের সাধ্য অনুযায়ী এই নেক আমলগুলোও করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ

১। পাঁচটি কুরআন শরীফ কিনে কোনো মাদ্রাসায় গিয়ে সেখানকার ওস্তাদের কাছে এ কথা বলে দিয়ে আসতে পারেন যে, ওগুলো যেন হিফয পড়ছে এমন ছাত্রদেরকে দেয়া হয়।   আপনি নিজ হাতে দিতে পারলে আরো ভালো। পাঁচটি কুরআন শরীফের হাদিয়া কত আর হবে? দুশ করে হলে মাত্র এক হাজার। আপনি হয়তো ঘুমিয়ে থাকবেন কিন্তু ছাত্ররা তাহাজ্জুদ পড়ে হিফজ করতে বসে যাবে। তাদের পড়া প্রতিটা অক্ষরের বিনিময়ে আপনিও কমপক্ষে দশটি করে নেকি পেতে থাকবেন। বিনা পরিশ্রমে আপনার নেকির অ্যাকাউন্টে  নেকি জমা হতে থাকবে ইনশাআল্লাহ।

২। আপনি যখন সালাত আদায় করতে মসজিদে যান তখন কাউকে দাওয়াহ দিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যান। বিশেষ করে ইশা ও ফজরের সালাতে। হাদিসে এসেছে, মানুষ যদি এই দুই সালাতের ফযিলত জানত তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও সালাতে শরিক হতো!

৩। একজন গরিব লোক খুঁজে বের করেন, যে আসলেই গরিব, যে কারো কাছে চায় না আবার কেউ তার প্রতি খেয়ালও করে না। তাকে হয়তো কেউ গরিবও ভাবে না তবে  আসলেই সে গরিব। এমন কাউকে এক প্যাকেট বিরিয়ানি, এক বোতল পানি, একটা শার্ট হাদিয়া দিন। সবমিলে কত আর হবে? খুব বেশি হলে ৫০০ টাকা। এরপর ভুলে যান। কিয়ামতের দিন আল্লাহ যখন বলবেন, আমি তো ক্ষুধার্ত ছিলাম তুমি আমাকে খাবার দাওনি, তখন আপনার একটা উত্তর থাকবে ইনশাআল্লাহ।

৪। বাসায় কাউকে একটা আয়াত মুখে মুখে মুখস্ত করিয়ে দিন। এরপর অর্থটাও শিখিয়ে দিন। হতে পারে এই একটি আয়াতের ওসিলায় আল্লাহ তাআলা তাকে হেদায়েতের পথে নিয়ে আসবেন।

৫। কাউকে একটি দোয়া শিখিয়ে দিন, হতে পারে তিনি সারা জীবন সেই দোয়াটি আমল করবেন আর আপনি তার সওয়াব পেতে থাকবেন ইনশাআল্লাহ।

৬। নিজের মা বাবার জন্য তাদের পছন্দের কোনো কিছু কিনে তাদেরকে হাদিয়া দিন।

৭। অপরিচিত কোন রুগিকে দেখতে যান। সম্ভব হলে কিছু ফলমুল নিয়ে যান। 

৮। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবাইকে মাফ করে দিন। ঝগড়া হয়েছে এমন কারো সাথে কিছু হাদিয়া (যেমন একটা আতর) নিয়ে দেখা করতে যান। হাদিসে এসেছে,

কোন বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার কোন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে বের হয় তখন ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকে।

এখানে উল্লিখিত সবগুলো আমলই সহজ। একটু চেষ্টা করলেই আমলগুলো আমরা করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে আমলগুলো করার তাওফিক দান করেন।

আজকের আলোচনা আপাতত এই পর্যন্তই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মাফ করুন এবং আমাদের উপরে সন্তুষ্ট হয়ে যান। আমার কথায় যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে তাহলে তা আমার পক্ষ থেকে আর তাতে কল্যাণকর কিছু থাকলে তা একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে।

وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله واصحابه اجمعين

وآخر دعوانا ان الحمد لله رب العالمين

 

--------------------------