মুজাহিদের আত্মশুদ্ধি - ০৮
‘দোয়া’- মুমিনের হাতিয়ার
উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিযাহুল্লাহ
*****************
উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিযাহুল্লাহঃ বিসমিল্লাহ ওয়াস সালাতু ওয়াস সালাম আলা রাসুলিল্লাহ। সবাই কেমন আছেন ভাই?
উপস্থিত এক ভাইঃ আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন ভাই?
উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিযাহুল্লাহঃ জী ভাই আলহামদুলিল্লাহ।
আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই মজলিসে আবার বসার তাওফিক দিয়েছেন। এটি একমাত্র আল্লাহ তাআলার মেহেরবানি ও দয়া। অন্যান্য দিন শুরুতেই জিজ্ঞেস করি যে, কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়। আজ ভাবছি জিজ্ঞেস করবো না। আজ আমি নিজ থেকে একটি বিষয় ঠিক করেছি। আজ ওটা নিয়েই কিছু কথা আলোচনা করতে চাচ্ছি। আমি কি আলোচনার বিষয়টা বলবো ভাই?
উপস্থিত এক ভাইঃ জী ভাই।
উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিযাহুল্লাহঃ আজ আমরা খুব প্রিয় একটি বিষয় নিয়ে কথা বলবো ইনশাআল্লাহ। তা হল দোয়া। আপনারা কী বলেন ভাই?
উপস্থিত অপর এক ভাইঃ জী ভাই।
উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিযাহুল্লাহঃ একটি মজার ঘটনা দিয়ে আজকের আলোচনাটা শুরু করি। একবার আমি এক মসজিদে নামাজ পড়তে যাই। গিয়ে দেখি জামাত শেষ। তখন একাই নামাজ পড়তে শুরু করি। আমাকে নামায পড়তে দেখে, আরও কয়েকজন এসে আমার পিছনে ইকতিদা করল। নামাজ শেষে কিছুক্ষণ বসে থেকে যখন উঠতে শুরু করি হঠাৎ এক মুরুব্বি আমাকে প্রায় ধমক দিয়ে বললেন, এ কি! দোয়া ধরলেন না যে? দোয়া ধরেন। জানেন না, দোয়া হচ্ছে নামাজের মাথা (?)। তাঁর কথায় আমি খুব লজ্জায় পড়ে যাই। তখন দোয়া করি। তখন আসলে বুঝতামই না, দোয়া আসলে কী জিনিস? দোয়া যে নামাজের অংশ না, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ইবাদত, নামাজের পর দোয়া করা যে জরুরি না, জরুরি মনে করাটা যে বরং ভুল, এ সব কিছু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আল্লাহ তাআলা বুঝার তাওফিক দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।
মুজাহিদদের উমুমি কারামত
দোয়ার ব্যাপারে উস্তাদ আহমাদ ফারুক রহ. চমৎকার একটি কথা বলেছিলেন। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মুজাহিদদের কিছু কারামত বলুন। তখন তিনি বলেছিলেন, মুজাহিদদের সবচেয়ে বড় উমুমি কারামত হচ্ছে ‘দোয়া’।
ভাই এখানে একটি কথা একটু বলে নিই, আমি নিজে সব দিক দিয়েই খুব দুর্বল। দোয়ার ব্যাপারে কথা বলতে আমার মনে খুবই সংকোচ লাগছে। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ .
হে মুমিনগণ, তোমরা এমন কথা কেন বল যা তোমরা করো না? সূরা সাফ : ২
কিন্তু তারপরও একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে আজ এ বিষয়ে কিছু কথা আরজ করার ইচ্ছা করেছি।
উদ্দেশ্যটা কী, তা শেষে বলবো ইনশাআল্লাহ।
এটি আল্লাহর শিখানো দোয়া
দোয়ার ব্যাপারে প্রথম কথা হল, কোরআনে কারীমের একদম শুরুতে যে সূরাটি রয়েছে, যা আমরা প্রতিদিন বহুবার তেলাওয়াত করি এ সূরাটি মূলত আল্লাহ তাআলার শিখানো একটি দোয়া। আল্লাহ নিজে আমাদেরকে এ দোয়া শিখিয়েছেন এবং আমাদেরকে প্রতিদিন বহু বার এ দোয়া করার নির্দেশও দিয়েছেন। নামাজের প্রতি রাকাতে এ সুরাটি একবার অবশ্যই পড়তে হয়। এ থেকে এ সূরাটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা কিছুটা অনুমান করা যায়।
হাদিসে এসেছে,
عن أَبي سَعِيدٍ رَافِعِ بن الْمُعَلَّى رضي الله عنه قال: قَالَ لي رسولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم:أَلا أُعَلِّمُكَ أَعْظَمَ سُورَةٍ في القُرْآن قَبْلَ أنْ تَخْرُجَ مِنَ الْمَسْجِدِ ؟ فَأخَذَ بِيَدِي، فَلَمَّا أرَدْنَا أنْ نَخْرُجَ، قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، إنَّكَ قُلْتَ: لأُعَلِّمَنَّكَ أعْظَمَ سُورَةٍ في القُرْآنِ؟ قَالَ: الحَمْدُ للهِ رَبِّ العَالَمِينَ، هِيَ السَّبْعُ المَثَانِي وَالقُرْآنُ العَظِيمُ الَّذِي أُوتِيتُهُ رواه البخاري.
আবূ সাঈদ বিন মুআল্লা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন আমি মসজিদে নামায পড়ছিলাম। এমতাবস্থায় নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে ডাকলেন। আমি সাড়া দিলাম না। অতঃপর নামায শেষ করে তাঁর নিকট এসে বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি নামায পড়ছিলাম।’ তিনি বললেন, “আল্লাহ কি বলেননি যে,
তোমরা আল্লাহ ও রসূলের আহ্বানে সাড়া দাও যখন তোমাদেরকে (রসূল) ডাকে---?” (সূরা আনফাল ২৪ আয়াত)
অতঃপর তিনি বললেন, “মসজিদ থেকে তোমার বের হয়ে যাওয়ার পূর্বেই তোমাকে কুরআনের মধ্যে মহত্তম সূরাটি শিখিয়ে দেব না কি?” অতঃপর তিনি আমার হাত ধরলেন। তারপর আমরা যখন বের হওয়ার ইচ্ছা করলাম তখন আমি বললাম, ‘হে আল্লার রসূল! আপনি বলেছিলেন “আমি তোমাকে কুরআনের মহত্তম সূরাটি শিখিয়ে দেব।” তিনি বললেন, “আলহামদু লিল্লাহ রাব্বিল আ-লামীন।” এটাই হল সেই সপ্তপদী (সূরা) যা নামাযে পুনঃপুনঃ আবৃত্ত হয়, আর সেটাই হল মহা কুরআন, যা আমাকে দান করা হয়েছে।” (আহমদ ১৭৮৫১, বুখারী ৪৪৭৪, ৪৬৪৭, ৪৭০৩, ৫০০৬, আবূ দাউদ ১৪৬০, নাসাঈ ৯১৩, ইবনে মাজাহ ৩৭৮৫নং)
অন্য হাদিসের এসেছে,
والذي نفسي بيدهِ ما أنزلتْ في التوراةِ، ولا في الإنجيلِ، ولا في الزبور، ولافي الفرقانِ مثلها. وإنها سبعٌ من المثانِي، والقرآنُ العظيمُ الذي أُعْطيتهُ.
উবাই বিন কা’ব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ একদা আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বলেন, “তুমি নামাযে কীভাবে পড়?” তিনি সূরা ফাতিহা পাঠ করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “উম্মুল কুরআন (কুরআনের জননী সূরা ফাতিহা)র মত আল্লাহ আয্যা ওয়া জাল্লা তাওরাতে ও ইঞ্জিলে কোন কিছুই অবতীর্ণ করেননি। এই (সূরাই) হল (নামাযে প্রত্যেক রাকআতে) পঠিত ৭টি আয়াত এবং মহা কুরআন, যা আমাকে দান করা হয়েছে।” (আহমাদ ৯৩৪৫, তিরমিযী ২৮৭৫, নাসাঈর কুবরা ১১২০৫, হাকেম ৩০১৯, মিশকাত ২১৪২ নং)
আমি তো কাছেই রয়েছি
এবার দোয়ার ব্যাপারে আরেকটি কথা বলি, আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ .
আমার বান্দারা যখন আপনাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে (যে, আমি তাদের কাছে, না দূরে?) আমি তো (তাদের) কাছেই রয়েছি। আমি আহবানকারীর আহবানে সাড়া দেই যখন সে আমাকে আহবান করে সুতরাং তারাও যেন আমার আহবানে সাড়া দেয় এবং আমার ওপর ঈমান আনে। তাহলেই তারা সরল পথ প্রাপ্ত হবে। সূরা বাকারা : ১৮৬
একটি বিষয় একটু লক্ষ্য করুন ভাই, এখানে আল্লাহ তাআলা উত্তরটা কীভাবে দিচ্ছেন?
আল্লাহ তাআলা কুরআনের বেশ কিছু জায়গায় বিভিন্ন প্রশ্নের কথা উল্লেখ করে তার উত্তর দিয়েছেন। যেমন,
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ .
তারা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন, দুটোর মধ্যেই আছে মহাপাপ এবং আছে মানুষের জন্য উপকারও; তবে এ দুটোর পাপ উপকারের চেয়ে অনেক বড়। আর তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে? বলুন, যা উদ্বৃত্ত। সূরা বাকারা : ২১৯
وَيَسْئَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّى.
তারা আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, বলুন, রূহ আমার রবের আদেশ ঘটিত। সূরা ইসরা : ৮৫
وَيَسْئَلُونَكَ عَن ذِى الْقَرْنَيْنِ قُلْ سَأَتْلُوا عَلَيْكُم مِّنْهُ ذِكْرًا.
তারা আপনাকে যুলকারনাইন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে; বলুন, আমি তোমাদের নিকট তার বিষয়টি বর্ণনা করব। সূরা কাহাফ : ৮৩
লক্ষ্য করুন, প্রশ্নগুলোর উত্তর আল্লাহ তাআলা সরাসরি না দিয়ে বলেছেন, আপনি বলে দিন। এবার ওপরে উল্লেখিত সূরা বাকারার আয়াতটির দিকে লক্ষ্য করুন, আল্লাহ তাআলা বলছেন, আমার বান্দারা যখন আপনাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে (যে, আমি তাদের কাছে, না দূরে?) আমি তো (তাদের) কাছেই রয়েছি। সূরা বাকারা : ১৮৬
এখানে দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ তাআলা এভাবে বলেননি যে, আপনি বলে দিন। বরং বলছেন, আমি তো কাছেই আছি। উত্তরটা সরাসরি তিনি নিজেই দিচ্ছেন। আল্লাহু আকবার।
আমি তার সঙ্গে থাকি
হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন,
أنا مع عبدي إذا هو ذكرني وتحرَّكت بي شفتاه.
বান্দা যখন (দোয়া বা যিকিরের মাধ্যমে) আমাকে স্মরণ করে এবং আমার স্মরণে তার ঠোঁট নড়ে তখন আমি তার সঙ্গে থাকি। আত তারগীব ওয়াত তারহীব : ২/৩২৫
দোয়া মুমিনের হাতিয়ার
আরেকটি হাদিসে এসেছে,
الدُّعاءُ سلاحُ المؤمنِ –
দোয়া মুমিনের হাতিয়ার।
আত তারগীব : ২/৩৯০; মুসনাদে আবু ইয়া’লা : ৪৩৯; মুসতাদরাকে হাকেম : ১৮১২ (হাদিসটি সহী কিংবা হাসান)
এ কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হল, আমরা যেন দোয়ার গুরুত্বটা বুঝতে পারি। পাশাপাশি এও বুঝতে পারি যে, আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়ার কী মূল্য? এবার চলুন, দোয়ার কিছু উসুল বা মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করি।
দোয়ার কিছু উসুল-মূলনীতি
দোয়ার বেশ কিছু উসুল বা মূলনীতি আছে। যেগুলোকে দোয়া কবুল হওয়ার শর্তও বলা যায়। দোয়া করার সময় অবশ্যই ওই মূলনীতিগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। তা না হলে দোয়া কবুল হবে না।
১ম মূলনীতি : আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও কাছে দোয়া করা যাবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন,
وَأَنَّ الْمَسٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا .
নিশ্চয় মসজিদসমূহ কেবলই আল্লাহর। কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না। সূরা জিন : ১৮
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছেন,
إِذَا سَألْتَ فَاسأَلِ الله، وإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ باللهِ.
যখন প্রার্থনা করবে তখন শুধু আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করবে। যখন সাহায্য চাইবে তখন শুধু আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে।-জামে তিরমিযী ২৫১৬; (হাদিসটি সহী)
এটাই হল আল্লাহ তাআলার পূর্বোক্ত বাণীর মর্মার্থ। দোয়ার শর্তগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এ শর্ত পূরণ না হলে কোন দোয়াই কবুল হবে না।
২য় মূলনীতি : শরিয়ত অনুমোদন করে এমন কোনো ওসিলা বা মাধ্যম দিয়ে (যেমন, নিজের কোনো নেক আমল) আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করা। এটি জরুরি নয়। হলে ভালো। এতে দোয়া কবুল হওয়ার বেশি আশা করা যায়। সহী বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত গুহায় আটকে পড়া তিন ব্যক্তির ঘটনায় এসেছে, সেখানে তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ নেক আমলের কথা উল্লেখ করে ওই নেক আমলের ওসিলা দিয়ে আল্লাহর কাছে বিপদ থেকে মুক্তির জন্য দোয়া করেছিল। তারা প্রত্যেকেই বলেছিল,
اللَّهُمَّ إنْ كُنْتُ فَعَلْتُ ذلِكَ ابْتِغاءَ وَجْهِكَ فافْرُجْ عَنَّا مَا نَحْنُ فيهِ.
হে আল্লাহ! আমি যদি এ আমলটি একমাত্র আপনার সন্তুষ্টি লাভের আশায় করে থাকি তাহলে (তার ওসিলায়) এ বিপদ থেকে আমাদেরকে উদ্ধার করুন।-সহী বুখারী : ২২১৫; সহী মুসলিম : ২৭৪৩
৩য় মূলনীতি : দোয়ার ফলাফল প্রাপ্তির ব্যাপারে তাড়াহুড়া না করা। ‘তাড়াহুড়া করা’ দোয়া কবুল হওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট বাধা। হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
يُسْتَجَابُ لأَحَدِكُمْ مَا لَمْ يَعْجَلْ: يقُولُ: قَدْ دَعْوتُ رَبِّي، فَلَمْ يسْتَجب لِي .
তোমাদের কারো দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাড়াহুড়া করে বলে যে, আমি দোয়া করেছি; কিন্তু আমার দোয়া কবুল হয়নি।-সহী বুখারী : ৬৩৪০; সহী মুসলিম : ২৭২৯
৪র্থ মূলনীতি : কোনো পাপ কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে দোয়া না করা। হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لا يَزالُ يُسْتَجَابُ لِلعَبْدِ مَا لَمْ يَدْعُ بإثْمٍ، أَوْ قَطيعَةِ رحِمٍ، مَا لَمْ يَسْتَعْجِلْ، قيل : يَا رسولَ اللهِ مَا الاستعجال؟ قَالَ : يقول : قَدْ دَعوْتُ، وَقَدْ دَعَوْتُ، فَلَمْ أرَ يسْتَجِيبُ لي، فَيَسْتحْسِرُ عِنْدَ ذَلِكَ وَيَدَعُ الدُّعَاءَ .
বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে কোনো পাপ কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে দোয়া করে। তার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ফলাফল প্রাপ্তির ব্যাপারে তাড়াহুড়া করে। জিজ্ঞেস করা হল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! তাড়াহুড়া বলতে কী বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন, এ কথা বলে যে, আমি দোয়া করেছি, আমি দোয়া করেছি; কিন্তু আমার দোয়া কবুল হয়নি। তখন সে উদ্যম হারিয়ে ফেলে এবং দোয়া করা ছেড়ে দেয়।-সহী বুখারী : ৬৩৪০; সহী মুসলিম : ২৭২৯
৫ম মূলনীতি : আল্লাহর প্রতি সুধারণা এবং দোয়া কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস (একীন) নিয়ে দোয়া করা। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي.
আমার বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা করে আমি তেমনই (আচরণ তার সাথে করে থাকি) সহী বুখারী : ৭৪০৫; সহী মুসলিম : ৪৬৭৫
অন্য হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
ادعُوا اللهَ وأنتم مُوقِنُون بالإجابةِ واعلَموا أنَّ اللهَ لا يَستَجيبُ دُعاءً مِن قلبٍ غافِلٍ لاهٍ.
তোমরা আল্লাহর কাছে দোয়া কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস (একীন) নিয়ে দোয়া করো। আর জেনে রেখো, আল্লাহ তাআলা কোনো গাফেল উদাসীন অন্তরের দোয়া কবুল করেন না। জামে তিরমিযী : ৩৪৭৯; (হাদিসটি হাসান) আত তারগীব : ২/২৯৭; মুসনাদে আহমদ : ৬৬৫৫
৬ষ্ঠ মূলনীতি : দোয়া করার সময় অন্তর উপস্থিত থাকা। মনোযোগ সহকারে দোয়া করা এবং অন্তরে আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ত্ব জাগ্রত রাখা। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
واعلَموا أنَّ اللهَ لا يَستَجيبُ دُعاءً مِن قلبٍ غافِلٍ لاهٍ.
তোমরা জেনে রেখো, আল্লাহ তাআলা কোনো গাফেল উদাসীন অন্তরের দোয়া কবুল করেন না। জামে তিরমিযী : ৩৪৭৯; (হাদিসটি হাসান)
৭ম মূলনীতি : খাবার দাবার হালাল হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ.
আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকীদের থেকেই কবুল করেন। সূরা মায়েদা : ২৭
হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إنَّ اللهَ طَيِّبٌ لا يَقْبَلُ إلا طَيِّبًا، وإنَّ اللهَ تَعَالَى أَمَرَ المُؤمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ المُرْسَلِينَ.
আল্লাহ তাআলা পবিত্র। তিনি কেবল পবিত্র জিনিসই কবুল করেন। তিনি রসূলদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা মুমিনদেরকেও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا.
হে রসূলগণ! আপনারা পবিত্র জিনিস আহার করুন এবং নেক আমল করুন। সূরা মুমিনূন : ৫১
তিনি আরও বলেছেন,
يَا أيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ.
হে মুমিনগণ! আমি তোমাদেরকে যে পবিত্র রিযিক দিয়েছি তা থেকে আহার করো। সূরা বাকারা : ১৭২
হযরত আবু হুরাইরা রাযি. বলেন,
ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أشْعثَ أغْبَرَ يَمُدُّ يَدَيْهِ إلَى السَّمَاءِ: يَا رَبِّ يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، ومَلبسُهُ حرامٌ، وَغُذِّيَ بالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟
এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন এক ব্যক্তির কথা বললেন যে দীর্ঘ সফরে বের হয়েছে। যার চুল এলোমেলো এবং গায়ের পোশাক ধুলোবালিতে একাকার হয়ে গেছে। সে তার দুহাত আকাশের দিকে তুলে বলতে থাকে, হে আমার প্রতিপালক, হে আমার প্রতিপালক! (আমার প্রতি দয়া করুন, আমাকে বিপদাপদ থেকে রক্ষা করুন ইত্যাদি ইত্যাদি) অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোষাক হারাম, হারাম খাদ্য দিয়েই সে লালিত পালিত হয়েছে, এ অবস্থায় কীভাবে তার দোয়া কবুল হবে! সহী মুসলিম : ১০১৫
৮ম মূলনীতি : দোয়ার ক্ষেত্রে কোনও ধরণের সীমালঙ্ঘন না করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً ۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ .
তোমরা তোমাদের রবকে ডাকো কাকুতি মিনতি সহকারে এবং গোপনে; নিশ্চয় তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না। সূরা আরাফ : ৫৫
দোয়াতে কাকুতি মিনতির অনুপস্থিতি এবং অতি উচ্চস্বরে দোয়া করা সীমালঙ্ঘন করার শামিল।
এগুলো হল দোয়ার কিছু মূলনীতি, যাকে দোয়া কবুল হওয়ার শর্তও বলা যায়।
এবার চলুন একটু আলোচনা করি, দোয়া কবুল হওয়ার ধরন কেমন হয়, আল্লাহ তাআলা আমাদের দোয়া কবুল করলে তা কয় ভাবে হতে পারে?
দোয়া কবুল হওয়ার ধরন
عن عُبَادَةَ بنِ الصامت رضي الله عنه أنَّ رسولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ: مَا عَلَى الأرْضِ مُسْلِمٌ يَدْعُو الله تَعَالَى بِدَعْوَةٍ إِلا آتَاهُ اللهُ إيَّاها، أَوْ صَرفَ عَنْهُ مِنَ السُّوءِ مِثْلَهَا، مَا لَمْ يَدْعُ بإثْمٍ، أَوْ قَطِيعَةِ رَحِمٍ، فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ القَومِ: إِذًا نُكْثِرُ قَالَ: اللهُ أكْثَرُ. وفي رواية أَوْ يَدخِرَ لَهُ مِن الأَجْرِ مثْلَها .
হযরত উবাদাহ বিন সামেত রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পৃথিবীতে যে কোনো মুসলমান আল্লাহর কাছে দোয়া করে তা বৃথা যায় না। হয় আল্লাহ তাআলা তাকে তাই দেন (যা সে চেয়েছে) অথবা অনুরূপ কোনো বিপদ তার উপর থেকে দূর করে দেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে কোনো গুনাহ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার দোয়া করবে। এক লোক বলল, ‘তাহলে তো আমরা বেশি বেশি দোয়া করব। তিনি বললেন, “আল্লাহ সর্বাধিক অনুগ্রহশীল”। অন্য বর্ণনার এসেছে, কিংবা এর পুরষ্কার (পরকালের জন্য) সঞ্চয় করে রাখেন। জামে তিরমিযী ৩৫৭৩
এ হাদিস থেকে বুঝা যায়, দোয়া কবুল হওয়ার ধরন হল তিনটি।
এক। আপনি যা চেয়েছেন তাই পাবেন তবে তা আল্লাহর নির্ধারিত সময়ে। তিনি যখন দেয়া সমীচীন মনে করবেন তখন দেবেন।
দুই। আপনি যা চেয়েছেন তা পাবেন না তবে এর বিনিময়ে আল্লাহ আপনাকে অন্য কিছু দিবেন কিংবা আপনার ওপর থেকে কোনো বিপদ দুর করে দিবেন।
তিন। আপনি এই দুনিয়াতে কিছুই পাবেন না। তবে এর বিনিময়ে আল্লাহ আপনাকে আখিরাতে সওয়াব দেবেন।
হায়! যদি আমার একটা দোয়াও কবুল না হত!
কিছু কিছু লোক আখিরাতে তার সওয়াবের পরিমাণ দেখে হতবাক হয়ে যাবে। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করবে, হে আল্লাহ! আমার আমলনামায় এতো সওয়াব কোত্থেকে এল? দুনিয়াতে এত সওয়াবের কাজ তো আমি করিনি। তখন আল্লাহ বলবেন, হে আমার বান্দা! তুমি উমুক সময়ে উমুক বিষয়ে দোয়া করেছিলে না? বান্দা বলবে, হ্যাঁ, করছিলাম। আল্লাহ বলবেন, আমি তোমার ওই দোয়ার ফল দুনিয়াতে দেইনি বরং আজকের জন্য রেখে দিয়েছিলাম। এখন তুমি ওগুলোই দেখতে পাচ্ছো। একথা শুনে বান্দা আফসোস করবে আর বলবে, হায়! দুনিয়াতে যদি আমার একটা দোয়াও কবুল না হত!
এ থেকে আমরা কী বুঝতে পারি ভাই? আমরা যত দোয়াই করি তার কোনোটাই বৃথা যায় না। দোয়ার ফল যদি দুনিয়াতে দেখতে পাই তাহলে তো ভালো। যদি না দেখতে পাই তাহলে আরও বেশি ভালো। দেখুন, ভাই! আমাদের দ্বীন কত সুন্দর!
দোয়ার ব্যাপারে এ কথাগুলো যদি কারো অন্তরে বসে যায় তাহলে বলুন, সে কি কখনো দোয়া করা ছাড়তে পারে? কিছুতেই ছাড়তে পারে না। কারণ, দোয়া করলে তার লাভই লাভ। দুনিয়াতে পেলে তো আলহামদুলিল্লাহ। না পেলেও আলহামদুলিল্লাহ।
সর্বশেষ ধরনটাই সবচেয়ে উত্তম
এ বিষয়ে সম্ভবত হযরত হাসান বসরী রহ.র একটি কথা আছে, তিনি বলেন, দোয়া কবুল হওয়ার সর্বশেষ ধরনটাই তোমার জন্য সবচেয়ে উত্তম ও কল্যাণকর। অর্থাৎ আল্লাহ যদি দোয়ার বিনিময়ে দুনিয়ায় কিছু না দিয়ে আখেরাতে এর প্রতিদান দেন তবে সেটাই হবে তোমার জন্য সবচেয়ে উত্তম পাওনা!
দোয়ার ওসিলায় বিপদ থেকে উদ্ধার করেন
দোয়া এমন একটি আমল যা আপনার অনেক কিছুই পরিবর্তন করে দিতে পারে। দোয়া আপনাকে সম্মানিত করতে পারে, কঠিন থেকে কঠিন বিপদ থেকে আপনাকে উদ্ধার করতে পারে।
কেউ বিপদে পড়ে যখন দেখে তার সামনে সব রাস্তা বন্ধ তখনও তার জন্য একটি রাস্তা খোলা থাকে। আর তা হল, দোয়ার রাস্তা। দোয়াই হয় তখন তার একমাত্র সম্বল। আল্লাহ তাআলা তখন তাকে তার দোয়ার ওসিলায়ই ওই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।
দেখুন, আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত ইউনুস আ. যখন মাছে পেটে চলে গেলেন তখন তিনি বুঝতে পারলেন, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তাঁকে ওই বিপদ থেকে আর কেউ উদ্ধার করতে পারবে না।
তখন তিনি আল্লাহকে ডাকতে শুরু করেন।
لا إِلٰهَ إِلَّآ أَنتَ سُبْحٰنَكَ إِنِّى كُنتُ مِنَ الظّٰلِمِينَ.
আপনি ছাড়া আর কোনও ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র ও মহান আর আমি তো সীমালংঘনকারী। সূরা আম্বিয়া : ৮৭
আল্লাহ তাআলা তাঁকে তার ওই দোয়ার ওসিলায় মাছের পেট থেকে মুক্ত করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَاسْتَجَبْنَا لَهُۥ وَنَجَّيْنٰهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذٰلِكَ نُۨجِى الْمُؤْمِنِينَ.
তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হতে উদ্ধার করেছিলাম এবং এভাবেই আমি মুমিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি। সূরা আম্বিয়া : ৮৮
فَلَوْلَآ أَنَّهُۥ كَانَ مِنَ الْمُسَبِّحِينَ . لَلَبِثَ فِى بَطْنِهِۦٓ إِلٰى يَوْمِ يُبْعَثُونَ.
যদি তিনি আল্লাহর তসবীহ পাঠ না করতেন তাহলে তাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত মাছের পেটেই থাকতে হত। সূরা সাফফাত : ১৪৩, ১৪৪
এটাই হল দোয়ার শক্তি
‘আফগানিস্তানে আমি আল্লাহকে দেখেছি’ বইয়ে একটি ঘটনা আছে। একবার রাশিয়ান সৈন্যরা এক হাফেজে কোরআনকে গ্রেফতার করে তাদের অফিসারের কাছে নিয়ে যায়। তখন ওই অফিসার তাকে বলল, তোরা নাকি কুরআন/দোয়া পরে ফু দিয়ে সব করতে পারিস। আজ দোয়া পড়ে এই ট্যাঙ্ক জালিয়ে দে, তা না হলে তোকে মেরে ফেলব। ওই হাফেজ বললো, আমাকে দুই রাকাত নামাজ পড়ার সুযোগ দিন। দুই রাকাত নামাজ পড়ে সে আল্লাহর কাছে দোয়া করল, হে আল্লাহ, আপনি জানেন, আমার কাছে আমার জীবনের তেমন কোন মূল্য নাই। আমি বাঁচি-মরি তাতে কিছু যায় আসে না! কিন্তু হে আল্লাহ, তারা আপনার কালামকে চ্যালেঞ্জ করেছে। আর আপনার কালামের শান রক্ষার দায়িত্ব আপনারই। এই বলে দোয়া পড়ে সে এক মুঠো বালি নিয়ে ট্যাঙ্কয়ের দিকে ছুড়ে মারে। সেখানে ৬০ টিরও বেশি ট্যাঙ্ক দাঁড়ানো ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সবগুলোতে দাউ দাউ করে আগুন ধরে যায়। এটাই হল দোয়ার শক্তি।
তিনি অবশ্যই দিবেন
দোয়া করার সময় এমনভাবে দোয়া করতে হবে যেন আপনি একদমই শেষ। আপনার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। একদম মিসকিনের হালাতে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে। আমার আপনার অনুনয় বিনয় দেখে আল্লাহ অত্যন্ত খুশি হন। আপনি একটু চিন্তা করুন, আপনি যদি এভাবে আপনার মায়ের কাছে চাইতেন তাহলে আপনার মা কি আপনাকে দিতেন না? আপনার মা যদি দেন তাহলে নিশ্চিত থাকেন আল্লাহও দিবেন। কারণ, আল্লাহ আপনাকে আপনার মায়ের চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসেন। তিনি তো অল্পতেই আমার আপনার উপর খুশি হয়ে যান।
আল্লাহর কাছে খুবই অনুনয় বিনয়ের সাথে দোয়া করা চাই। আল্লাহর সামনে নিজেকে একজন ফকির-মিসকিন হিসেবে হাজির পেশ করা চাই। হে আল্লাহ! আপনি তো জানেন আমি মিসকিন। আমি ভিখারি। আমি ফকির। হে আল্লাহ! আপনি ছাড়া আমাকে আশ্রয় দেয়ার আর কেউ নাই। আমাকে নিরাপত্তা দেয়ার কেউ নাই। আপনার মতো আপন আমার আর কেউ নাই। আমাকে আপনার মতো কেউ ভালোবাসে না। আমার জন্য কেউ আপনার মতো দয়ালু না, অনুগ্রহশীল না। সবাই যখন ঘুমিয়ে যায় এমন কি আমিও, তখনও আপনি আমাকে ডাকতে থাকেন। হে আল্লাহ! আমাকে এটা দেন, ওটা দেন। এভাবে বারবার চাইতেই থাকা। আমরা যদি আল্লাহর কাছে এভাবে চাইতে পারি তাহলে ইনশাআল্লাহ তিনি অবশ্যই দিবেন। কারণ, তিনি তো দিতেই চান। তাঁর তো কোনও অভাব নেই। আমরা তাঁর কাছে চাই এটাই তিনি পছন্দ করেন। না চাইলে বরং রাগ করেন।
তিনিই হলেন আমার আপনার আল্লাহ। তিনি আমাদেরকে এত মহব্বত করেন, এত ভালোবাসেন যা কারো পক্ষে বলে বুঝানোও সম্ভব না। এ জন্যই বলছি ভাই, দোয়া করার সময় দিল উজাড় করে দোয়া করুন। কলিজাটা খুলে দোয়া করুন। দোয়া করার সময় চোখ থেকে কিছু অশ্রু ফেলুন। আল্লাহ তাআলার কাছে বান্দার চোখের পানি বড়ই প্রিয়।
আল্লাহ কাছে পছন্দনীয় দু’টি ফোঁটা
عن أَبي أُمَامَة صُدَيِّ بن عجلان الباهلي رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قَالَ: لَيْسَ شَيْءٌ أحَبَّ إِلى اللهِ تَعَالَى مِنْ قطْرَتَيْنِ وَأثَرَيْنِ: قَطَرَةُ دُمُوع مِنْ خَشْيَةِ اللهِ، وَقَطَرَةُ دَمٍ تُهَرَاقُ في سَبيلِ اللهِ. وَأَمَّا الأَثَرَانِ: فَأَثَرٌ في سَبيلِ اللهِ تَعَالَى، وَأَثَرٌ في فَريضةٍ مِنْ فَرائِضِ الله تَعَالَى.
হযরত আবূ উমামাহ সুদাই বিন আজলান বাহেলী রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন দুইটি ফোঁটা এবং দু’টি চিহ্ন আল্লাহ তাআলার কাছে অত্যাধিক প্রিয়। এক. আল্লাহর ভয়ে প্রবাহিত অশ্রুর ফোঁটা। দুই. আল্লাহর পথে প্রবাহিত মুজাহিদের রক্তের ফোঁটা। আর চিহ্ন দুটি হল, এক. আল্লাহর পথের চিহ্ন (যা মুজাহিদের গায়ে লাগে) দুই. আল্লাহর কোনো ফরয আদায়ের চিহ্ন (যা কারো গায়ে লেগে থাকে। যেমন, কপালে সেজদায় চিহ্ন) জামে তিরমিযী : ১৬৬৯ (হাদিসটি হাসান)
সে আরশের নিচে স্থান পাবে
অন্য হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেয়ামতের দিন যখন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না সে দিন সাত শ্রেণির লোকদেরকে আল্লাহ তাআলা তাঁর আরশের নিচে স্থান দিবেন। ওই সাত শ্রেণির একটি হল,
رَجُلٌ ذَكَرَ الله خَالِيًا ففاضت عَيْنَاهُ.
যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহর কথা স্মরণ করে চোখ থেকে (আল্লাহর ভয়ে) অশ্রু ঝরায়। সহী বুখারী : ৬৬০; সহী মুসলিম : ১০৩১
তোমার সব কিছু আমার কাছেই চাও
হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন,
يَا عِبَادي، إنِّي حَرَّمْتُ الظُلْمَ عَلَى نَفْسي وَجَعَلْتُهُ بيْنَكم مُحَرَّمًا فَلا تَظَالَمُوا، يَا عِبَادي، كُلُّكُمْ ضَالّ إلا مَنْ هَدَيْتُهُ فَاستَهدُوني أهْدِكُمْ، يَا عِبَادي، كُلُّكُمْ جَائِعٌ إلا مَنْ أطْعَمْتُهُ فَاستَطعِمُوني أُطْعِمْكُمْ، يَا عِبَادي، كُلُّكُمْ عَارٍ إلا مَنْ كَسَوْتُهُ فاسْتَكْسُونِي أكْسُكُمْ، يَا عِبَادي، إنَّكُمْ تُخْطِئُونَ باللَّيلِ وَالنَّهارِ وَأَنَا أغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا، فَاسْتَغْفِرُوني أغْفِرْ لَكُمْ، يَا عِبَادي، إنَّكُمْ لَنْ تَبْلُغوا ضُرِّي فَتَضُرُّوني، وَلَنْ تَبْلُغُوا نَفعِي فَتَنْفَعُوني، يَا عِبَادي، لَوْ أنَّ أوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أتْقَى قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مِنْكُمْ مَا زَادَ ذلِكَ في مُلكي شيئًا، يَا عِبَادي، لَوْ أنَّ أوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أفْجَرِ قَلْبِ رَجُلٍ وَاحِدٍ مَا نَقَصَ ذلِكَ من مُلكي شيئًا، يَا عِبَادي، لَوْ أنَّ أوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجنَّكُمْ قَامُوا في صَعِيدٍ وَاحِدٍ فَسَألُوني فَأعْطَيتُ كُلَّ إنْسَانٍ مَسْألَتَهُ مَا نَقَصَ ذلِكَ مِمَّا عِنْدِي إلا كما يَنْقصُ المِخْيَطُ إِذَا أُدْخِلَ البَحْرَ، يَا عِبَادي، إِنَّمَا هِيَ أعْمَالُكُمْ أُحْصِيهَا لَكُمْ ثُمَّ أوَفِّيكُمْ إِيَّاهَا، فَمَنْ وَجَدَ خَيرًا فَلْيَحْمَدِ الله وَمَنْ وَجَدَ غَيْرَ ذلِكَ فَلا يَلُومَنَّ إلا نَفْسَهُ . قَالَ سعيد : كَانَ أَبُو إدريس إِذَا حَدَّثَ بهذا الحديث جَثا عَلَى رُكبتيه . رواه مسلم
হে আমার বান্দারা! আমি জুলুম করাকে নিজের ওপর হারাম করেছি এবং তোমাদের ওপরও তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অন্যের ওপর জুলুম করো না। হে আমার বান্দারা! আমি যাকে সঠিক পথে পরিচালিত করি সে ছাড়া তোমরা সবাই পথভ্রষ্ট। অতএব আমার কাছেই সঠিক পথ কামনা করো। আমি তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করবো। হে আমার বান্দারা! আমি যাকে খাদ্য দেই সে ছাড়া তোমরা সবাই ক্ষুধার্ত। অতএব আমার কাছেই খাদ্য চাও আমি তোমাদেরকে খাদ্য দেবো। হে আমার বান্দারা! আমি যাকে বস্ত্র দেই সে ছাড়া তোমরা সবাই বস্ত্রহীন। অতএব আমার কাছেই বস্ত্র চাও। আমি তোমাদেরকে বস্ত্র দেবো। হে আমার বান্দারা! তোমরা দিন-রাত পাপ করে থাকো আর আমি সমস্ত পাপ ক্ষমা করে থাকি। সুতরাং তোমরা আমার কাছেই ক্ষমাপ্রার্থনা করো আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবো। হে আমার বান্দারা! তোমরা কখনও আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এবং কখনও কোনো উপকারও করতে পারবে না।
হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের পূর্বের-পরের সকল মানুষ ও জিন তোমাদের মধ্যকার সবচেয়ে পরহেযগার লোকটির অন্তরের মতো অন্তরের অধিকারী হয়ে যায় তবুও আমার রাজত্বের কিছুই বৃদ্ধি পাবে না। হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের পূর্বের-পরের সকল মানুষ ও জিন তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ লোকটির অন্তরের মতো অন্তরের অধিকারী হয়ে যায় তবুও আমার রাজত্বের কিছুই হ্রাস পাবে না। হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের পূর্বের-পরের সকল মানুষ ও জিন একটি খোলা ময়দানে একত্রিত হয়ে আমার কাছে প্রার্থনা করে আর আমি তাদের প্রত্যেককে তার প্রার্থিত জিনিস দান করি তাহলে এর দ্বারা আমার কাছে যা আছে তা থেকে ততটুকুই কমবে যতটুকু কোনো সমুদ্রে সূঁচ ডুবালে কমে। হে আমার বান্দারা! আমি তোমাদের আমলগুলো সংরক্ষণ করে রাখছি। আমি তোমাদেরকে তার পূর্ণ প্রতিদান দেবো। সুতরাং যে ব্যক্তি কল্যাণকর কিছু পাবে সে যেন আল্লাহর প্রশংসা করে। আর যে অন্য কিছু (অর্থাৎ অকল্যাণকর কিছু) পাবে সে যেন নিজেকেই তিরস্কার করে। সহী মুসলিম : ২৫৭৭
দোয়া করার তাওফিক লাভ করাই অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়
হযরত ওমর রাযি. বলতেন, আমার দোয়া কবুল হবে কি না, এ চিন্তা আমি করি না। আমি চিন্তা করি, দোয়া করার তাওফিক পাবো কি না।
উপস্থিত এক ভাইঃ কথাটা একদমই বাস্তব। আল্লাহর কাছে দোয়া করার তাওফিক লাভ করাই অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়।
উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিযাহুল্লাহঃ আপনার কোন ছাত্র যদি সব সময় আপনার সামনে নিজেকে ছোট করে রাখে তাহলে আপনি তাকে কী পরিমাণ মুহাব্বত করবেন? ঠিক তেমনিভাবে আমরা যখন আল্লাহর সামনে নিজেদেরকে ছোট করি, তাঁর কাছে অনুনয় বিনয় করি তখন আল্লাহও আমাদেরকে মুহাব্বত করেন। বরং আল্লাহর মুহাব্বতের তো কোনো তুলনাই হয় না। আমরা আল্লাহর সামনে নিজেকে যত ছোট করতে পারবো তিনি আমাদেরকে তত বেশি মুহাব্বত করবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর মুহাব্বতের পাত্র হওয়ার তাওফিক দান করেন।
অন্য ভাইদের জন্য দোয়া করা
দোয়া আমরা নিজেদের জন্য যেমন করবো অন্য ভাইদের জন্যও করবো। বরং অন্য ভাইদের জন্য আরও বেশি করে দোয়া করবো। কারণ, আপনি আপনার কোনো ভাইয়ের জন্য যে দোয়া করবেন তা তাঁর জন্য যেমন কবুল হবে আপনার জন্যও কবুল হবে। আমাদের সালাফদের কেউ কেউ কোনো দোয়া নিজের জন্য কবুল করাতে চাইলে তা অন্যের জন্য বেশি বেশি করতে শুরু করতেন। এতে তাঁর নিজের জন্যও ওই দোয়া কবুল হতো। আমরাও এটি করতে পারি ইনশাআল্লাহ। দেখুন, হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
دَعْوَةُ المَرْءِ المُسْلِمِ لأَخيهِ بِظَهْرِ الغَيْبِ مُسْتَجَابَةٌ، عِنْدَ رَأسِهِ مَلَكٌ مُوَكَّلٌ كُلَّمَا دَعَا لأَخِيهِ بِخَيْرٍ قَالَ المَلَكُ المُوَكَّلُ بِهِ: آمِينَ، وَلَكَ بِمِثْلٍ.
কোন মুসলমান তার ভাইয়ের অবর্তমানে তার জন্য কোনো দোয়া করলে তা কবুল হয়। তার মাথার কাছে একজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকে। যখনি সে তার ভাইয়ের জন্য দোয়া করে ওই ফেরেশতা বলেন – “আমিন। তোমার জন্যও তাই হোক”। সহী মুসলিম : ২৭৩২, ২৭৩৩
দেখুন, আল্লাহ তাআলা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দিচ্ছেন,
وَاسْتَغْفِرْ لِذَنۢبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنٰتِ.
আপনি নিজের জন্যে এবং মুমিন নারী-পুরুষদের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করুন।
সূরা মুহাম্মাদ : ১৯
হযরত ইবরাহীম আ. কীভাবে সকল মুমিনদের জন্য দোয়া করেছেন,
رَبَّنَا اغْفِرْ لِى وَلِوٰلِدَىَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ.
হে আমাদের পালনকর্তা, আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং সব মুমিনকে ক্ষমা করুন, যেদিন হিসাব কায়েম হবে। সূরা ইবরাহীম : ৪১
সাহাবায়ে কেরামের পর যারা তাঁদের সত্যিকারের অনুসারী হবে তাদের বৈশিষ্ট বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
وَالَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوٰنِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمٰنِ وَلَا تَجْعَلْ فِى قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ ءَامَنُوا رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ.
আর এই সম্পদ তাদের জন্যে, যারা তাদের পরে আগমন করেছে। তারা বলেঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে এবং ঈমানে আগ্রহী আমাদের ভ্রাতাগণকে ক্ষমা কর এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের পালনকর্তা, আপনি দয়ালু, পরম করুণাময়। সূরা হাশর : ১০
‘জাযাকাল্লাহু খাইরান’ও একটি দোয়া
এই যে আমরা কাউকে ‘জাযাকাল্লাহু খাইরান’ বলি, এটিও একটি দোয়া। কোনো ভাই যদি আমাদের কোনো উপকার করেন -হোক তা যতই ছোট- সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে লক্ষ্য করে ‘জাযাকাল্লাহু খাইরান’ বলা চাই। বলার সময় এর অর্থের প্রতি খেয়াল রেখে বলা চাই। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। আর যখন কোনো ভাই আমাদেরকে ‘জাযাকাল্লাহু খাইরান’ বলবেন তখন আমরা একে মোটেই ছোট করে দেখবো না। বরং এ দোয়ার মাধ্যমে ওই ভাই আমাদেরকে বিরাট প্রতিদান দিয়ে দিয়েছেন। দেখুন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী বলছেন,
مَنْ صُنِعَ إِلَيْهِ مَعْرُوفٌ، فَقَالَ لِفاعِلهِ: جَزَاكَ اللهُ خَيرًا، فَقَدْ أَبْلَغَ فِي الثَّنَاءِ.
কেউ কাউকে কোন উপকার করলে সে যদি ওই উপকারকারীকে “জাযাকাল্লাহ খাইরান (আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন)” বলে দোয়া দেয় তাহলে সে তার পূর্ণাঙ্গরূপে প্রশংসা করল। জামে তিরমিযী : ২০৩৫ (হাদিসটি সহী)
দোয়ার বিশেষ বিশেষ কিছু সময়
দোয়া যেকোনো সময়ই করা যায় তবে দোয়ার বিশেষ বিশেষ কিছু সময় আছে, ওই সময়গুলোতে খুব গুরুত্ব সহকারে দোয়া করা চাই। হাদিসে এসেছে,
শেষ রাতে এবং ফরয নামাযের পর
عن أَبي أمامة رضي الله عنه قَالَ: قيل لِرسولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم: أيُّ الدُّعاءِ أَسْمَعُ؟ قَالَ: جَوْفَ اللَّيْلِ الآخِرِ، وَدُبُرَ الصَّلَواتِ المَكْتُوباتِ.
হযরত আবূ উমামাহ রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, একবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল- কোন সময়ের দোয়া সবচেয়ে বেশি কবুল হয়? তিনি বললেন- শেষ রাতের দোয়া এবং ফরয নামাযসমূহের পরের দোয়া। জামে তিরমিযী : ৩৪৯৯ (হাদিসটি হাসান)
জুমআর দিন
অন্য হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ فِي الْجُمُعَةِ سَاعَةً لاَ يَسْأَلُ اللَّهَ الْعَبْدُ فِيهَا شَيْئًا إِلاَّ آتَاهُ اللَّهُ إِيَّاهُ .
জুমআর দিন এমন একটি সময় আছে, যে সময়ে বান্দা আল্লাহর কাছে যা-ই চায় আল্লাহ তাকে তা-ই দেন। জামে তিরমিযী : ৪৯০
জুমআর দিনের বিশেষ সেই মুহূর্তটি কখন এ ব্যাপারে দু ধরণের হাদিস আছে।
এক।
هِيَ مَا بَيْنَ أَنْ يَجْلِسَ الإِمَامُ إِلَى أَنْ تُقْضَى الصَّلاَة .
জুমআর দিনের বিশেষ মুহূর্তটি হচ্ছে, ইমাম মিম্বরে বসা থেকে শুরু করে নামায শেষ করা পর্যন্ত৷-সহী মুসলিম : ১৮৬০
দুই।
الْتَمِسُوا السَّاعَةَ الَّتِي تُرْجَى فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ بَعْدَ الْعَصْرِ إِلَى غَيْبُوبَةِ الشَّمْسِ .
জুমআর দিনের যে মুহুর্তটিতে (দোআ কবুল হওয়ার) আশা করা যায় তাকে আসরের পর হতে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত তালাশ করো। জামে তিরমিযী : ৪৮৯
অতএব দুটো সময়ই দোয়ার প্রতি মনোযোগী হওয়া কাম্য। উলামায়ে কেরাম বলেছেন, ইমাম মিম্বরে বসার পর মুখে দোয়া করা যাবে না। মনে মনে করা যাবে। তবে ইমাম খুতবায় দোয়া করলে আমীন বলা যাবে।
নফল সালাতের সেজদায়
আরেকটি হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أقْرَبُ مَا يكونُ العَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ، فَأكْثِرُوا الدُّعَاءَ.
বান্দা সেজদায় তার প্রতিপালকের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। অতএব তখন বেশি বেশি দোয়া করো। সহী মুসলিম : ৪৮২
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরাম বলেছেন, নফল সালাতে সেজদায় গিয়ে কোরআন-হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলো করা দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম একটি উপায়। ফরয সালাতে এমন করা হবে না। দোয়াগুলোও হতে হবে আরবিতে, নিজের ভাষায় না।
নিজের সন্তানাদির ওপর বদ দোয়া করবেন না
দোয়ার ব্যাপারে সর্বশেষ একটি কথা না বললেই নয়। আমরা অনেক সময় দেখি, আমাদের অনেক সাধারণ ভাই না জেনে নিজের সন্তানাদির ওপর বা অন্য কারো ওপর রাগ করে তাদের জন্য বদ দোয়া করে বসেন। এটি মারাত্নক ভুল। আমরা এটি কখনোই করবো না। কারণ, হাদিসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لا تَدْعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ؛ وَلا تَدعُوا عَلَى أوْلادِكُمْ، وَلا تَدْعُوا عَلَى أموَالِكُمْ، لا تُوافِقُوا مِنَ اللهِ سَاعَةً يُسألُ فِيهَا عَطَاءً فَيَسْتَجِيبَ لَكُمْ.
তোমরা নিজের ওপর এবং নিজের সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদের ওপর বদ দোয়া করো না। হতে পারে তোমরা এমন একটি সময়ে দোয়া করে বসবে যখন তা কবুল হয়ে যাবে। সহী মুসলিম : ৩০০৯
আমার আলোচনা আজকের মতো এখানেই শেষ। আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম, একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে এ আলোচনাটা করেছি। এবার সেই উদ্দেশ্যটা বলি। উদ্দেশ্যটা হল, আপনাদের কাছে দোয়ার আবেদন করা, আল্লাহ যেন এ গুনাহগারকে নিজ অনুগ্রহে ক্ষমা করেন। আমার ইসলাহ করে দেন। দুনিয়া-আখেরাত উভয় জায়গায় যেন আমাকে সাহায্য করেন। আল্লাহ তাআলা যেন একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হিজরত করার তাওফিক দান করেন এবং তাঁর পথে শাহাদাত লাভ করার মহা সৌভাগ্য দান করেন। এখানে উপস্থিত আমাদের সকল ভাইদের ক্ষেত্রেও আল্লাহ যেন এ দোয়াগুলো কবুল করেন। আমীন। আপনারা দোয়া করবেন তো ভাই?
উপস্থিত এক ভাইঃ জি, ইনশাআল্লাহ অবশ্যই করব ভাই। অবশ্যই করব।
উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিযাহুল্লাহঃ আলহামদুলিল্লাহ।
তিনি দিবেন বলেই তা চাওয়ার তাওফিক দিয়েছেন
হযরত হাসান বসরী রহ. খুব চমৎকার একটি বলতেন। তিনি বলতেন, আমার মনে হয় না যে, কোনো বান্দা ইস্তেগফার করবে আর তাকে ক্ষমা করা হবে না। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, তাকে ইস্তেগফার করার তাওফিক কে দিল? ইস্তেগফার করার ইচ্ছাটা কে তার মনে জাগিয়ে দিল? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা তাকে ক্ষমা করতে চেয়েছেন বিধায়ই তাকে ইস্তেগফার করার তাওফিক দিয়েছেন। (অতএব আল্লাহ তাকে ইস্তেগফার করার তাওফিক দিয়ে ক্ষমা করবেন না, এটা কীভাবে হবে?)
মনে রাখবেন ভাই, আল্লাহর কাছে আপনি যা চাইতে পারছেন দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন, আল্লাহ নিজে আপনাকে তা দিতে চাচ্ছেন এজন্যই তিনি আপনাকে ওই জিনিসটি তাঁর কাছে চাওয়ার তাওফিক দিয়েছেন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সবাইকে সাআদাতের (সৌভাগ্যের) জীবন এবং শাহাদাতের মরণ দান করুন।
আজকের আলোচনা এই পর্যন্তই। এবার আপনারা কেউ কিছু চাইলে শেয়ার করতে পারেন।
এতক্ষণ তো শুধু আমিই বলে গেলাম।
উপস্থিত এক ভাইঃ আলহামদুলিল্লাহ আপনার কথাগুলো ভাই শুনতে খুবই ভালো লাগে। আল্লাহ আপনাকে উত্তম জাযা দান করেন। আমীন।
এ জীবনের হাজারো কুরবানি কিছুই না
উস্তাদ আহমাদ যাকারিয়া হাফিযাহুল্লাহঃ বারাকাল্লাহ। যা কিছু সুন্দর সবই একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে। কারণ, আল্লাহ সুন্দর আর যত সুন্দর আছে তা সব আল্লাহরই। হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম ছিলেন সুন্দর। তিনি আল্লাহরই বান্দা। আল্লাহরই সৃষ্টি। কুরআন সবচেয়ে সুন্দর গ্রন্থ। তা আল্লাহরই কালাম। জান্নাত সুন্দর। জান্নাতের সব কিছু সুন্দর। তা সবই আল্লাহর সৃষ্টি। আর সবচেয়ে সুন্দর হলেন আমার আপনার আল্লাহ নিজে। জান্নাতে আল্লাহকে একবার দেখার সাথে সাথে আল্লাহর সৌন্দর্যের সামনে ওখানকার সব নেয়ামত ফ্যাকাসে মনে হবে। আল্লাহু আকবর!
জান্নাতে বান্দা আল্লাহকে এক বার দেখার পর বার বার শুধু এ আকাঙ্ক্ষাই করতে থাকবে যে, আবার কখন আল্লাহকে দেখতে পারবো! আল্লাহর শপথ, আল্লাহকে দেখার জন্য এ জীবনের হাজারো কুরবানি কিছুই না ভাই! একদম কিছুই না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে জান্নাতুল ফিরদাউসে তাঁর দীদার লাভ করার সৌভাগ্য দান করেন।
আজ তাহলে এখানেই শেষ করি ভাই, আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মাফ করুন এবং আমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। আমার কথায় যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে তাহলে তা আমার পক্ষ থেকে আর তাতে কল্যাণকর কিছু থাকলে তা একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে।
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله واصحابه اجمعين
وآخر دعوانا ان الحمد لله رب العالمين
-------------