আমরা যাদের উত্তরসূরী
সাহাবা জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়
নাসীম আরাফাত
কিশোরদের জিহাদ
ধূলিঝড় উড়িয়ে মক্কা থেকে সশস্ত্র এক হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী এগিয়ে আসছে। জিঘাংসার অগ্নিস্ফূলিঙ্গ তাদের চোখের তারায় তারায়। তীর গতিতে এগিয়ে আসছে তারা। তাদের ইচ্ছা, মুসলমানদের নির্মল করবে। অরক্ষিত শহর মদীনাকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করবে। মক্কার সর্দার, সাক্ষাৎ ইবলিসের দোসর আবু জাহেল ইবনে হিসাম তাদের সেনাপতি।
বাতাসের পিঠে চড়ে সংবাদটি চোখের পলকে গোটা মদীনায় ছড়িয়ে পড়ল। নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার কানে কানে গিয়ে পৌঁছল। শিশু কিশোররাও শুনল। সবার মুখে মুখে এ খবর। নানা জল্পনা-কল্পনা এসে এ সংবাদে যোগ দিল। কিন্তু এসব কিছু সত্ত্বেও কারো চেহারায় কোন ভয়, কোন ভীতি, কোন আতঙ্কের চিহ্ন নেই। মদীনার লোকেরা মৃত্যুকে ভয় করে না। বরং মৃত্যুর সন্ধানে ছুটে যায় তারা। পরম উল্লাসে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। মৃত্যুর অমীয় সুধা পানে তারা পাগলপারা। কারণ এই মৃত্যু সেতুর অপর তীরেই তো মুমিনের গন্তব্য। চোখ বুজে একবার সেই মৃত্যু-সেতু পাড়ি দিলেই ব্যস, আর কোন চিন্তা নেই। আর কোন কষ্ট নেই। আর কোন ঝক্কি- ঝামেলা নেই। সেখানে রয়েছে আল্লাহ্র চির সান্নিদ্ধ, হুর-গেলমান, আর অফুরন্ত আনন্দ। আরো কত কি?
তাই মদীনার কিশোর-বালকদেরও আজ আনন্দের শেষ নেই। উল্লাসের কমতি নেই। কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অদূরে দাঁড়িয়ে তারা যুদ্ধ করবে। আল্লাহর দুশমনদের শিরে আঘাত হানবে। বাতিলের কণ্ঠ চির স্তব্ধ করবে। হকের আওয়াজ বুলন্দ করবে। বুকে তাদের অনন্ত আশা। চোখে তাদের রঙিন স্বপ্ন। চলাফেরা আর পদক্ষেপে বীর বীর ভাব। জিহাদের ডাকে তারাও ছুটে এলো। হাতে তলোয়ার। পিঠে তীরাধার। চোখে শাহাদাতের অনন্ত পিয়াসা।
কারো কাছে বলা নেই। কারো কাছে কওয়া নেই। এসেই মসজিদে নববীর চত্বরে সাহাবীদের সারির ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে পড়ল। জিহাদে তারা যাবেই। যুদ্ধ তারা করবেই। এমন একটি বিশ্বাস এমন একটি ভাব তাদের চোখে মুখে ওষ্ঠাধরে।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাইরে বেরিয়ে এলেন। তিনি আজ অন্য বেশে। অন্য পোশাকে। একজন বীর সেনাপতির বেশে। মাথায় শিরস্ত্রাণ। হাতে ঢাল-তলোয়ার। মুখভাব দারুণ কঠিন। আঘাতে আঘাতে তিনি আজ বাতিলের শিরকে অবনমিত করবেন-ই। এই তার প্রতিজ্ঞা। দৃঢ় তার পদক্ষেপ, রহস্যময় তার চাউনী। কঠিন তার হৃদয়।
মসজিদে নববীর চত্বর, চারদিকে থমথমে পরিবেশ। কোন সাড়া শব্দ নেই। নীরব নিস্তব্ধ। রাসূলের দৃষ্টি এক পলকে চার দিক ঘুরে এল। নিখুঁত সন্ধানী দৃষ্টি। সেনাপতির সতর্ক দৃষ্টি। সারির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চোখ বুলালেন। সাহাবীদের হৃদয়ের প্রতিজ্ঞা, স্পৃহা, আর জিহাদের জযবা অনুভব করলেন। তার মাথাটি একটু দুলে উঠল। বললেন, হ্যাঁ এদের নিয়েই জিহাদে যাব। ঈমানের আলোয় উজ্জ্বল এদের হৃদয়। শাহাদাতের তামান্নায় অস্থির এদের অন্তর। এরাই আল্লাহর প্রতিশ্রুত বাহিনী। এরাই আল্লাহর রাহের সৈনিক।
পরক্ষণেই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেহারা আনন্দে আলোকময় হয়ে উঠল। যেন দিবসের আগমনী বার্তা নিয়ে পূর্বাকাশ সুবহে সাদেকের আলোয় ফক্ফক্ করে উঠেছে। বিস্ময় বিমুগ্ধতায় যেন তিনি তন্ময় হয়ে গেলেন। আচ্ছা, কিশোর-বালকরাও বুঝি জিহাদে যাবে! ঐ তো সারির ফাঁকে ফাঁকে অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। এরা তো শক্ত করে তলোয়ারও ধরতে পারে না। আহ্ কি নির্মল পবিত্র এদের মন। কি কুসুম-কোমল এদের হৃদয়। নব কিশলয়ের কচি কান্ডের মতই তো এদের শরীর। তবুও আকাশ ছুঁই ছুঁই এদের আশা। ইস্পাত-কঠিন এদের প্রতিজ্ঞা। এরা বাতিলের উদ্ধত শিরকে পদানত করবে। ইসলামের বিজয় ঢংকা নিয়ে পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে।
কিন্তু এখনো যে এদের সময় আসেনি। এরা তো ভবিষ্যতের সৈনিক। এরা অনাগত দিনের দুর্দম নির্ভিক সৈনিক। এরা রিজার্ভ ফোর্স। ভবিষ্যতে এরা ইসলামের মানচিত্রকে সুদূর দিগন্তে নিয়ে যাবে। শান্তির অমীয় বাণী প্রচার করবে পৃথিবীর সব দেশে। চির শৃঙ্খলিত মানবতাকে মুক্ত করবে। স্বাধীন করবে।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন। ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হলেন। কিশোরদের কাছে ডাকলেন। খুব আদর করলেন। সে আদরে কোন খাঁদ নেই। কোন খুঁত নেই। মুঠি মুঠি স্নেহ-মমতা তাদের মাথায় ঢেলে দিলেন। মায়াময় মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, তোমরা তো এখনো অনেক ছোট। আর জিহাদ তো বড়দের কাজ। বড়রা জিহাদ করবে। যুদ্ধ করবে। তোমরা বড় হলে তোমাদেরকেও জিহাদে নিয়ে যাব। যুদ্ধে নিয়ে যাব ----।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোমল মোলায়েম কথাগুলো তাদের কচি হৃদয় আলিঙ্গন করল। তারা তাদের মাথা দুলালো, সত্যই তো আমরা অনেক ছোট। তলোয়ার নিয়ে জিহাদের শক্তি আমাদের নেই। তাহলে বড় হলেই আমরা রাসূলের সাথে জিহাদে যাব।
প্রত্যাশার ঝলমলে আনন্দ রেখা তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠল। তারা আবার যার যার বাড়িতে ফিরে চলল। এখন হরিণ ছানার মত উল্লসিত, আনন্দিত, উৎফুল্ল তারা। কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের বলেছেন, তোমরাই আগামী দিনের সৈনিক, সিপাহসালার। আনন্দে উতলা তাদের মন- প্রাণ।