পদে পদে আল্লাহর নুসরত:
জম্মু-কাশ্মীর ফ্রন্টে কমাণ্ডার শামশীর খানের
ঈমান-দীপ্ত দাস্তান
জনাব আহসান ডারের সঙ্গে আমার বিভিন্ন এলাকার মুজাহিদ ও সাধারণ জনগণের সাথে সাক্ষাৎকার গ্রহণের এক পর্যায়ে পালওয়ামা নামক গ্রামে পৌঁছি। সেখানে এক হিন্দু পণ্ডিতের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ আলাপ হয়। গ্রামবাসী ও স্থানীয় মুজাহিদরা পূর্বেই আমাদের আসার সংবাদ পেয়েছিলেন। ফলে পথেই বহু লোক আমাদের অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। গ্রামের নিকটে পৌঁছতেই এক হিন্দু পণ্ডিত দৌড়ে আমাদের দিকে আসে। নিকটে আসলে আমরা জিজ্ঞেস করলাম, 'ব্যাপার কি, দৌড়াচ্ছেন কেন? উত্তরে বললেন, আজকে আমার ছেলের বিবাহ। তাই আপনাদেরকে বিবাহ অনুষ্ঠানে নিতে এসেছি। একজন হিন্দুর এরূপ ব্যবহারে আমি বিস্মিত হলাম। আমরা ব্যস্ততা দেখিয়ে বললাম, আমাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা।
শেষ পর্যন্ত তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করতেই হলো। স্থানীয় মুজাহিদরা তার সম্পর্কে বললো যে, তিনি কোন সন্দেহজনক ব্যক্তি নন।
হিন্দু পণ্ডিত আমাদের সামনে রকমারী খাদ্য পরিবেশন করেন। যে খাবারের ব্যাপারে পূর্ণ বিশ্বাস হলো যে, এটা হালাল, আমরা শুধু সেগুলাই গ্রহণ করলাম। এক ফাঁকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি মুজাহিদদের ভয়ে এ নিমন্ত্রণ করেছেন? বেশীর ভাগ হিন্দুই তো কাশ্মীর ছেড়ে জম্মু চলে গেছে। আর আপনি এখানে রয়ে গেলেন কেন?
বললেন, প্রথমে ভয় ছিল । সরকার আমাদের জানায় যে, মুসলিম উগ্রবাদীরা তোমাদের হত্যা করবে। ওরা খুব অত্যাচারী। তাই কাশ্মীর ছেড়ে চলে যাও। আমার আত্মীয়-স্বজন সবাই এ ভয়ে কাশ্মীর থেকে পালিয়ে যায়। আমি কিছু সমস্যার কারণে যেতে পারি নি। কদিন পর মুজাহিদরা এ গ্রাম দখল করে নেয়। তারা আমার নিরাপত্তা দানের সাথে সাথে পালিয়ে যাওয়া হিন্দুদের সকল সম্পত্তি হেফাযতের দায়িত্বও গ্রহণ করে। এখন আমি এখানে নির্ভয়ে বসবাস করছি। এখন পূর্বের চেয়ে বেশী নিরাপত্তাবোধ করছি। পক্ষান্তরে, মুজাহিদদের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া হিন্দুদের সহায় সম্পত্তি জম্মুতে ভারতীয় সেনা ক্যাম্পে লুট হচ্ছে।
মনে মনে বললাম, কিন্তু পণ্ডিতজী! তোমার ভারত সরকার কি করছে, তা দেখছ?
এক পর্যায় পণ্ডিত মশাই খুব আবেগাপ্লুত হয়ে বলে উঠলেনঃ
“ভারত আর তার সৈন্যদের সাথে এখন আমাদের কোনরূপ সম্পর্ক নেই। আমাদের সহমর্মিতা আর সহযোগিতা সব মুজাহিদদের সাথে। অস্ত্র ধারী বীর যুবকদের জন্য আমাদের দরজা উন্মুক্ত। মুজাহিদদের চরিত্র মাধুর্যে আমরা..."
আমি তাকে কিছুটা অপ্রকৃতস্থ করে বললাম, এ সব কিছু বলছেন জীবনের ভয়ে।' একথা শুনে বললেন, "ভগবানের দোহাই! যা কিছু বলেছি সবটাই আমার মনের কথা, এটাই বাস্তব এবং সত্য। আপনি স্থানীয় মুসলমানদের জিজ্ঞেস করে দেখুন।
বাস্তবপক্ষে, ভারতীয় নির্মম উৎপীড়ন সত্ত্বেও মুজাহিদগণ কঠোর ভাবে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলছেন। তারা কেবল হিন্দুদের মাথা গোপনজার ঠাই নয় পূর্ণ হিফাজতের দায়িত্বও কাঁধে নিয়েছেন। কাশ্মীরের সর্বত্রই আমি এ চিত্রটি দেখেছি।"
ফের'জম্মুর পথেঃ পুনরায় ইসলামাবাদ পৌঁছলাম । ভাই আহসান ডার আমাকে এবং ওহীদ শেখকে বললেন, 'আমার সাথে বানেহাল চলো'। বানেহাল শহরে ক'দিন পূর্বে মুজাহিদরা ভারতীয় সেনাদের যোগাযোগ কেন্দ্রে প্রচণ্ড হামলা চালিয়েছিল। যার ফলে কাশ্মীর আন্তর্জাতিক বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে জম্মুর গত প্রোগ্রাম সফল হয়নি। তাই এবার জম্মু যাওয়ার সুসংবাদ শুনে সব ক্লান্তি নিমিষে মিলিয়ে যায়। আহসান ডারকে বললাম, জম্মু গমনকারী এ কাফেলায় আমরা বিশ জন সাথী। অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে সড়ক পথে যাওয়াটা নিরাপদ নয়। তাই পাহাড় জঙ্গল নদী-নালা পেরিয়ে আমরা চলতে লাগলাম।
পরদিন রাতের অন্ধকারে আমরা বানেহাল পৌঁছলাম। রাতে শুয়ে পড়লাম। সুমধুর আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার আযান ধ্বনীতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ক্লান্ত শ্রান্ত মুজাহিদরা উঠে বসে। গভীর ঘুম আর হীম শীতল পানি কোনটাই মুজাহিদকে নামাজ হতে বিরত রাখতে পারে না। ঐক্য ও সংহতীর সুন্দরতম বিকাশ একমাত্র আল্লাহর সামনে নতমস্তকে দাঁড়ানোর মধ্যেই ঘটে। নামায আল্লাহর সাথে বান্দার সেতু বন্ধন। এ বন্ধন সুদৃঢ় হলেই মুজাহিদদের প্রতি আল্লাহর নুসরত নেমে আসে। এ বন্ধনই প্রচণ্ড ক্ষুৎপিপাসা সত্ত্বেও আমাদেরকে সদা কর্ম তৎপর করে রাখে। এ বন্ধনই টর্চার সেলের অমানবিক নিপীড়ন অম্লান বদনে সয়ে যাওয়ার শক্তি যোগায় খোদার সৈনিকদেরকে।
নামায শেষ হতেই দলে দলে মুজাহিদ আসতে থাকে। মিটিংয়ে সকলের একটাই দাবী, আমাদের একশন শুরু করার অনুমতি দিন। আহসান ভাই খুব কষ্টে তাদের বুঝালেন, জম্মুর তৎপরতা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। তাই মযবুত নেটওয়ার্ক তৈরী না হওয়া পর্যন্ত একশন হতে বিরত থাকতে হবে। তাদের দায়িত্ব দেয়া হল , আপনারা গ্রামে গ্রামে জনমনে জিহাদ ও আযাদীর অগ্নি শিখা প্রজ্জ্বলিত করুন। আপাতত এটাই আপনাদের কাজ।
ফিরতি পথে পালওয়ামা জেলার এক গ্রামে পৌঁছলাম। রাত হয়ে যাওয়ায় এ গ্রামে ঘুমিয়ে পড়লাম। এ কাফেলায় আমার বন্ধু শওকত ভাই ও ছিলেন। একটানা দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি। তাই বিছানায় যেতেই ঘুমিয়ে পড়ি। সম্ভবত রাত তিনটা হবে। কেউ আমাকে ঝাঁকি দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু আমি পার্শ্ব বদল করে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। আমি এখানে গভীর ঘুমে অচেতন আর বাইরে ঘটে যাচ্ছে মহা প্রলয়। সৈন্যরা আমাদের রাতের গোপন মিটিংয়ের সংবাদ পেয়েছিল। বহু বিশিষ্ট মুজাহিদ নেতৃবৃন্দ সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। এছাড়া ছিলো দ্বিতীয় সারির অর্ধশতাধিক মুজাহিদ। এরূপ মোক্ষম সুযোগটি সৈন্যরা লুফে নিতে চাইল। মাঝরাতে ইসরাঈলী আর্মী 'মোসাদের হাতে ট্রেনিং প্রাপ্ত ভারতীয় ব্ল্যাক ক্যাট (কালো বিড়াল) সারা গ্রাম ঘেরাও করে নেয়। বাইরে ক্লাশিনকভ আর রকেট লাঞ্চারের প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। আর আমি তখনও ঘুমে অচেতন।
ব্ল্যাক ক্যাট সৈন্যদের সাথে পাহারারত মুজাহিদদের প্রথম সংঘর্ষ হয়। একজন মুজাহিদ ফাঁক পেয়ে দৌড়ে এসে বিশ্রামরত মুজাহিদদের সংবাদ দেন যে, ভারতীয় সেনারা চারিদিক হতে আমাদের ঘিরে ফেলেছে। তাই যে কোন ভাবে বেষ্টনী ভেঙ্গে বের হয়ে যান। সংবাদ পেয়ে সকলেই তড়িঘড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ে। আমি ভিন্ন কামরায় শোয়াতে তারা আমাকে জাগাতে পারল না। বাড়ীর মালিকও আমার কামরায় ঘুমিয়ে ছিলেন। তিনি জেগে উঠে আমাকে জাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এত গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছিলাম যে, গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দও কানে যাচ্ছিলো না। আমার সাথী মুজাহিদরা সংঘর্ষের ফাঁকে ফাঁকে ব্ল্যাক ক্যাটের ঘেরাও ভেঙ্গে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন। ঘেরাওয়ের বাইরে গিয়ে সাথীদের গণনা করার পর খবর হয় যে, শামশীর খান তো বেরোতে পারে নি। বাড়ীর মালিক তাদের বলেন, আমি তো তাকে জাগিয়ে হামলার সংবাদ দিয়েছিলাম। সে এখনও কেন আসছে না!
ব্ল্যাক ক্যাটরা পা পা করে ওই ঘরের দিকে অগ্রসর হয়, যেখানে আমি অচেতন ভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম। আমি পিছনে পড়ে যাওয়ায় সবাই শঙ্কিত হন। তবে শওকত ভাই শঙ্কিত হন সবার চেয়ে বেশী। তিনি আহসান ডারকে বললেন, আমি ঐ ঘরে গিয়ে শামশীর ভাইকে নিয়ে তবে ফিরবো। আহসান ডার বললেন, পাগল হলে নাকি? শামশীর তো এতক্ষণে শহীদ হয়ে গেছে। আর না হয় কমাণ্ডারদের হাতে বন্দী অবস্থায় রয়েছে। এখন গিয়ে কোন লাভ নেই। সারা গ্রাম কমাণ্ডোদের দখলে। এর ভিতর তাদের বেষ্টনী ভেঙ্গে মুজাহিদরা বের হয়ে এসেছেন। পুনরায় তাদের ফাঁকি দিয়ে যাওয়া আবার ফিরে আসা খেলা কথা নয়।
আহসান ডার শওকত ভাইকে কঠোর ভাবে নিষেধ করলেন, ভিতরে যেয়ো না। কমাণ্ডার ইন চিফের একথা শুনে শওকত ভাই বল্লেন, নিশ্চয়ই আপনি আমাদের চীফ কমাণ্ডার, আপনার আদেশ পালন করা আমাদের কর্তব্য। তবে আপনিই তো আমাকে শামশীর ভাইয়ের বডী গার্ডের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তাই তার হেফাজত এবং শত্রুর ঘেরাও থেকে তাকে নিয়ে আসার দায়িত্বও আমার। জীবনের বিনিময়ে হলেও আমি এ কর্তব্য পালন করতে চাই। আপনি আমাকে বাঁধা দিবেন না। আমি যাবই এবং শামসীর ভাইকে নিয়ে তবে ফিরব। অন্যরাও শওকত ভাইকে বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল। সকলের বাধা উপেক্ষা করে তিনি ক্লাশিনকভ হাতে গ্রামের দিকে চললেন।
তিনি ব্ল্যাক ক্যাট কমাণ্ডোর দুর্ভেদ্য বেষ্টনী ভেঙ্গে তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমার কক্ষে পৌঁছলেন। ফায়ারের প্রচণ্ড শব্দ তখনও আমার ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি। আর শওকত ভাই ‘শামশীর ভাই' বলে মৃদু শব্দে ডাকতেই আমি জেগে উঠি। এটা সম্ভবত শওকত ভাইয়ের ভালবাসা ও হৃদ্যতারই আকর্ষণ। আমি জেগে উঠে বেরিয়ে আসলাম। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, 'শামশীর ভাই! কি মহা বিপদ ডেকে আনলেন আপনি-- কমাণ্ডোরা ঘেরাও করে আছে। আর আপনি ঘুমোচ্ছেন। সবাই তো চলে গেছে। জলদী করুন, কমাণ্ডোরা এক্ষুণি ঘরে ঢুকবে।'
আমি মনে করলাম, হয়ত কোন সাধারণ ক্রেক ডাউন হবে। সহজেই বেরিয়ে পড়তে পারবো। বললাম, 'এত শঙ্কিত দেখাচ্ছে কেন?' শওকত ভাই বললেন, "ভাই ব্যাপার খুব গুরুতর।এরা সাধারণ আর্মী নয় । ব্ল্যাক ক্যাট । তাও হাজার হাজার। জলদী বের হয়ে যাও।"
ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পরই অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পারলাম । কমাণ্ডোরা বেধড়ক ফায়ার করে চলছে। মুজাহিদদের বেরিয়ে যাওয়ার কোন খবর এখনও তারা পায় নি। তারা কয়েকশ মিটার দূর থেকে সোজা আমাদের দিকেই গুলি ছুঁড়ছিল।ঘরের অদূরেই জঙ্গল ও বাগান।শওকত সেদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, 'আপনি ওদিকে চলে যান আমি অন্য দিক হতে কমাণ্ডোদের উপর ফায়ার করি'। আমি বললাম, 'তুমি ওদিকে যাবে কেন বরঞ্চ আমরা একত্রে যাই।' আমার কথা শুনে শওকত রেগে বললো, 'বুঝছেন না কেন, চুপচাপ আমার কথা শুনুন। নাকের ডগায় দুশমন দাঁড়িয়ে আছে। আর আপনি অযথা সময় নষ্ট করছেন। প্রতি মূহুর্তে বেষ্টনী সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে।' তখনই দৌড়ে বাগানে ঢুকলাম । শওকত ভাই এক দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে তিনটি ফায়ার করলেন। এটা ছিল আমার প্রতি সাঙ্কেতিক নির্দেশ। আমি দৌড়ে গাছ পালার আড়ালে পৌঁছে গেলাম। তখনও আমার দিকে গুলি আসছিল। আমি পাঁচ মিনিট কমাণ্ডোদের দিকে ফায়ার করলাম, যাতে এ ফাঁকে শওকত ভাই বেরিয়ে আসতে পারেন। পনের মিনিট অপেক্ষার পর শওকত ভাই আসলেন না দেখে আমি ক্ষেতের মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকি।
এক মসজিদের ইমামের সাক্ষাৎ
অনেক পথ চলার পরও সাথীদের কারোর সাক্ষাৎ পেলাম না। সবাই আমাদের দু'জনের জন্য অপেক্ষা করে নিরাপদ স্থানে চলে গেছে। কোন দিকে যাচ্ছি তার ঠিক নেই। ক্ষণিক পর ভোরের আলো ফুটে উঠে। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি। পা চলছিল না। তার উপর উভয় পা ক্ষত বিক্ষত। কারণ কে যেন ভুলে আমার জুতা নিয়ে গেছে। সূর্য ওঠার পূর্বেই এক গ্রামে পৌঁছলাম। একটি মসজিদ দেখে আমি দাঁড়ালাম। শুভ্র সুশ্রী মন্ডিত ইমাম সাহেব বাচ্চাদের কুরআন পড়াচ্ছেন। মসজিদে ঢুকে তাকে মুজাহিদদের সংবাদ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি প্রথমে আমার দিকে সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কে? বললাম, 'আমি বহিরাগত মুজাহিদ। মিলিটারী আমার পিছু নিয়েছে। আমার সাথী মুজাহিদদেরও সন্ধান পাচ্ছি না।' আমার রক্তাক্ত ক্ষত পায়ের উপর দৃষ্টি পড়তেই তার ভাব পাল্টে গেল। সোহাগ ভরা কণ্ঠে বলেন, 'বেটা! তোমার জুতা কোথায়?
'বললাম, 'এক মুজাহিদ সাথী ভুলে আমার জুতা পরে নিয়েছেন।' একথা শুনে তিনি নিজের জুতা দু'টি খুলে বারংবার আবদার করে আমাকে পরিয়ে দিলেন। এরপর বললেন, 'মুজাহিদরা এ পথেই গিয়েছেন। সামনে একটা নালা দেখবে, তা পার হয়ে হাঁটলে তুমি মুজাহিদদের খোঁজ পাবে।'
তার কথামত অগ্রসর হলাম। নালা পার হয়ে দেখি, আমার মুজাহিদ সাথীরা বসে আছেন। আমাকে সামনে দেখেও তাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, আমি এখনও জীবিত। তারা পরস্পর বলতে লাগল, আহসান ভাইতো তখন শওকত ভাইকে যেতে দিতে চাচ্ছিলেন না। এখন দেখ! আমাদের বীর শওকত কিভাবে শামশীর ভাইকে দুশমনের পাঞ্জা থেকে মুক্ত করে এনেছেন। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, বীর শওকত নিজেই আবার শত্রুর খপ্পরে পড়ে যাননি তো। আহসান ডার আমার পূর্ণ বিবরণ শুনে শওকত ভাইয়ের জন্য পেরেশান হয়ে পড়েন।
ব্ল্যাক ক্যাট কমাণ্ডো বনাম ভারতীয় ইঁদুর সেনা
ক্ষণিক না যেতেই দেখি, কালো বিড়ালরা আবার আমাদের নাকের ডগায় এসে উপস্থিত। আমি আহসান ভাইকে বললাম, এরা সাধারণ আর্মী নয়। অত সহজে ওরা আমাদের পিছু ছাড়বে না। তাই আমাদেরকে সাধারণ গেরীলা পদ্ধতি ছেড়ে সম্মুখ সমরে লড়তে হবে। সবাই এতে ঐকমত্য প্রকাশ করে।
সমস্ত মুজাহিদদেরকে দু'দু'জন করে ভাগ করে দেয়া হলে সবাই স্ব স্ব পজিশনে পৌঁছে যায়। ব্ল্যাক ক্যাট সতর্ক পদে অগ্রসর হচ্ছিল। তারা ফায়ার শুরু করে দেয়। আমরা নীরব থাকি। সৈন্যরা আরও ক্ষণিক অগ্রসর হলে তাদের অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য আমরা কয়েক রাউন্ড গুলি করলাম। এরপর উভয় দিক হতে ফায়ারিং শুরু হয়ে যায়। ব্ল্যাক ক্যাট মনে করেছিল, তাদের ভয়ে আমরা পজিশন ছেড়ে পালাব। তখন আমাদেরকে খতম করবে। তারা খুব জোশের সাথে আরও অগ্রসর হলে আমাদের মাপা মাপা ব্রাশ ফায়ার তাদের যেন অভ্যর্থনা জানায়। এতেই বেশক'টি ব্লাক ক্যাট চিত পটাং হয় এবং বাকীরা সতর্ক পদক্ষেপে পিছিয়ে যায়। তাদের ভুল ভাঙ্গে যে, প্রতিপক্ষ দুর্বল নয়।
এভাবে দু'ঘন্টা অতিবাহত হয়। এসময় আশপাশের সব এলাকায় দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, আহসান ডার ও ওহীদ শেখকে ব্ল্যাক ক্যাটরা ঘেরাও করে রেখেছে। তাই যে মুজাহিদই এ সংবাদ পায় সে দৌড়ে এসে আমাদের সাথে মিলিত হতে থাকে।
ব্ল্যাক ক্যাট কমাণ্ডোর উপর ভারত বেশ গর্বিত। এক ঘন্টা পর্যন্ত ভারতের এ গর্বের ধন সেনা মানিকেরা আমাদের বেষ্টনীতে আঁটকা পড়লে ফাঁক ফোকর দিয়ে ইঁদুরের মত পালানোর চেষ্টা শুরু করে। কমাণ্ডোরা ওয়ারল্যাসের মাধ্যমে ক্যাম্পে যোগাযোগ পূর্বক জরুরী সাহায্য তলব করে। অপরদিকে আমাদের ওপর নেমে আসে অদৃশ্য সাহায্য।
সেনা বহর ধ্বংসঃ খালিদ ভাই ও এজায ভাই সহ এক গ্রুপ মুজাহিদ রণাঙ্গনের মাইল কয়েক দূর দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তারা দেখতে পেলেন, চল্লিশটি কনভয় বোঝাই এক সেনা বহর রাস্তা দিয়ে আসছে। এ সেনা বহর যাচ্ছিল ব্ল্যাক ক্যাট কমাণ্ডোর সাহায্যে। ওই মুজাহিদরা দূর থেকেই তাদের আসতে দেখে ওঁত পেতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ক্লাশিনকভ, রকেট লাঞ্চার সহ অত্যাধুনিক অস্ত্র মুজাহিদদের হাতে ছিল। তারা পজীশন নিয়ে নেন। গাড়ী খুব দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিলো। তারা কল্পনা করতে পারেনি যে, প্রতিপদে তারা মৃত্যুর পানে এগিয়ে চলছে।
সেনা বহর গুলীর আওতায় আসতেই মুজাহিদদের অস্ত্র গর্জে উঠে। রকেট লাঞ্চারের আঘাতে বেশ কয়টি গাড়ীর ছাদ উড়ে যায়। তার সাথে কয়েক জন সৈন্যও খতম হয়। ক্ষনিক সংঘর্ষের পর বহরের সব গাড়ী বিধস্ত হয়ে পড়ে। বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা এবার দৌড়ে পিছন দিকে ভাগতে থাকে।
ব্ল্যাক ক্যাট কমাণ্ডো ওয়ারল্যাসের মাধ্যমে এ সংবাদ পাওয়ায় তারা আমাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। এতক্ষণে সারা এলাকায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। স্থানে স্থানে মুজাহিদ ও কমাণ্ডোদের মাঝে প্রচণ্ড ফায়ারিং চলতে থাকে। সন্ধ্যা পাঁচটা পর্যন্ত লড়াই চলে। এ সময় আমাদের চিন্তা হল, ব্ল্যাক ক্যাটের সাহায্যে আরও সৈন্যরা এসে পড়বে। ফলে আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বন্দী বা শহীদ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
সিদ্ধান্ত হল, সংঘর্ষ বন্ধ করে আমরা এলাকা ছেড়ে চলে যাবো। আমরা ফায়ার বন্ধ করে পিছনে সরে আসতে শুরু করলে ব্ল্যাক ক্যাট কমাণ্ডোর আত্মায় পানি আসে। ব্ল্যাক ক্যাট কমাণ্ডো মৃত সৈন্যদের লাশ ফেলে ইঁদুরের চেয়েও ভিরুতার প্রমাণ দিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে যায়। পরে জানতে পারি যে, ব্ল্যাক ক্যাটের সাহায্যে প্রেরিত সৈন্যরা রণাঙ্গণের অদূরে অন্য এক মুজাহিদ গ্রুপের হাতে পরাজিত হয়।
হৃদয় বিদারক সংবাদ
সন্ধ্যার সময় এক ব্যক্তি এসে এ মর্মান্তিক সংবাদ দিল যে, শওকত ভাই শহীদ হয়ে গেছেন। আমাকে বিদায় দেয়ার পর কমাণ্ডোদের সাথে সংঘর্ষের সময় ব্রাশ ফায়ারে তার দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তার গুলীতে নিহত তিন কমাণ্ডো সেনার লাশ তার পাশেই পড়ে থাকে। শওকত ভাইয়ের শাহাদাতের সংবাদে আমাদের বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুবর নির্ভীক মুজাহিদ আমাকে মুক্ত করে স্বয়ং খোদার পথে জীবন বিলিয়ে দিলেন। মুজাহিদরা সবাই শওকত ভাইয়ের জন্য ছিল পাগলপারা। আমার জন্য তার ত্যাগ ও কুরবানী চীর জীবন হৃদয় ফলকে অঙ্কিত থাকবে।
শওকত ভাইয়ের পরিবার শেখ আবু আব্দুল্লাহর ন্যাশনাল কনফারেন্সের সমর্থক। তবে জিহাদের আহ্বান শুনে শওকত ভাই অস্ত্র হাতে তুলে নেন। তখন তার আব্বা কাশ্মীর আযাদী আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। শওকত ভাই বার কয়েকআমাকে বলেছিলেন, আমার আব্বা ইসলামী জিহাদের বিরোধী--- তাই তকে গুলী করে মারব।'
শওকত ভাইকে দাফন করা হলো। এ যুদ্ধে ওদের ১৫০ জন সৈন্য নিহত ও ৪০টি গাড়ী সম্পূর্ণ রূপে বিধ্বস্ত হয়। অল ইণ্ডিয়া রেডিও সরকারের প্রেস নোটের বরাতে প্রচার করে যে, এ যুদ্ধে সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর আমাদের এক সাথী শাহাদাতের সৌভাগ্য লাভ করেন।
দ্বিতীয় মর্মান্তিক সংবাদ হলো, যে ইমাম সাহেব আমাকে তার জুতা পরিয়ে পথ দেখিয়ে সাহায্য করেছিলেন তাকেও গুলি করে শহীদ করা হয়েছে। আমি চলে আসার পর কমাণ্ডোরা সে গ্রামে এসে ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করে, সন্ত্রাসীরা এদিক দিয়ে তো যায়নি? ইমাম কিছু জানিনা বললে, তার উপর চরম নির্যাতন করা হয়। এরপর ঐ নরপশুরা কুরআন পাঠকারী নিষ্পাপ শিশুদের মারতে মারতে জিজ্ঞেস করে, বল সন্ত্রাসীরা কোনদিকে গেছে? শিশুরাও বলতে অস্বীকার করে। শেষে তারা ছোট্ট একটি শিশুর চুলের মুঠি ধরে শূন্যে তুলে বলে, মুজাহিদরা কোন দিকে গেছে না বললে তোকে আছড়িয়ে মারব। অসহ্য বেদনায় নীল হয়ে যায় শিশুটির ফুল পাপড়ীর মত কোমল চেহারা খানি।প্রাণভয়ে সে বলে দেয়, এক অস্ত্রধারী এখান দিয়ে গেলে উস্তাদজী তাকে জুতা পরিয়ে দেন । এ কথা শুনে কমাণ্ডোরা ইমাম সাহেবের উপর ব্রাশ ফায়ার করে। খোদার এ প্রিয় বান্দা মসজিদ চত্ত্বরেই রক্তাক্ত বদনে লুটিয়ে পড়েন।
এ এলাকা আর নিরাপদ নয় দেখে আমরা তখনই শোপিয়া শহর রওয়ানা দেই। পরে সৈন্যরা এসে শুধু তাদের বিধ্বস্ত গাড়ী ও মৃত সৈন্যদের লাশ ছাড়া কিছুই পায়নি। (চলবে)
অনুবাদঃ আসাদ মাহমুদ