দেশে দেশে ইসলাম
চার কোটি মুসলমান লাপাত্তাঃ পূর্ব তুর্কিস্তানের অতীত ও বর্তমান
নাসীম আরাফাত
====================================================================
সবুজ শ্যামল চারণভূমি, তরল সােনা, মহামূল্যবান খনিজ সম্পদ, তাকলা মাকান মরুভূমি, তিয়েন শান পর্বত মালা, তারিম নদী, আর লপনর হ্রদের দেশ পূর্ব তুর্কিস্তান।
প্রকৃতির এই উদার দানে ভরা দেশটি পর্যটন প্রেমিকদের কাছে অতিপ্রিয়াহৃদয়াকর্ষী। যুগ যুগ ধরে এদেশে বিভিন্ন বংশের, বিভিন্ন গােত্রের বিভিন্ন অঞ্চলের লােক উষ্ণ সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করে আসছে। ৭০ লাখ আলগুর, ১০ লাখ কাজিক, ৭ লাখ হুই, ১ লাখ ২৫ হাজার কিরঘিজ, ১ লাখ মানসু, ১৫ হাজার উজবেক, ৫ হাজার তাতার এবং বেশ কিছু তাজিক বংশােদ্ভূত লােক বসবাস করে। এখানে প্রাচীনকাল থেকে প্রায় ৬৫ লাখ লােক এখন এই ভূখণ্ডের আদি বাসিন্দা। বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেও বহুলোক এখানে বসবাস করছে।
১৬ লাখ ৪৬ হাজার ৮ শত বর্গ কিলােমিটার বিস্তৃত এই ভূখণ্ডটি মঙ্গোলিয়া, পাকিস্তান ও চীনের তিনটি প্রদেশ তিব্বত, সিংগাট ও কানসুর ঘেষে অবস্থিত। যা এখন চীনের একটি প্রদেশ মাত্র। যার নাম সিংকিয়াং উইগুর (Si Kiang Uighur) । পূর্ব তুর্কিস্তানের ভূগর্ভ অত্যন্ত সমৃদ্ধ-খনিজ সম্পদ ও তরল সােনায় ভরপুর। গােটা চীনের তৈল চাহিদার এক তৃতীয়াংশ পূর্ব তুর্কিস্তানের তৈল দ্বারা পূরণ করা হয়। তার ভূপৃষ্ঠের সুবিস্তৃত-বিশাল শ্যামল চারণভূমিতে তিন কোটিরও বেশী পশু বিচরণ ও প্রতিপালিত হতে পারে।
পূর্ব তুর্কিস্তানে মুসলমানদের আগমন
হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষার্ধে মুসলমানরা বিজয়ী বেশে চীনে আগমন করে। খলীফা অলীদ ইবনে আব্দুল মালেকের শাসনামলে (৭০৫ খৃঃ ৭১৫ খৃঃ) সেনাপতি কোতাইবা ইবনে মুসলিম মধ্য এশিয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। তাঁরা সমরকন্দ, ফারগানা পদানত করে চীনের সীমানায় পৌঁছে যান। এবং পূর্ব তুর্কিস্তানের রাজধানী কাশগড়ে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করেন। তার পর থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলমানরা পূর্ব তুর্কিস্তানে বসবাস করে আসছে। কালের বিপর্যয়, সাম্রাজ্যবাদীদের শকুনি থাবা ও শাসকগােষ্টীর ষ্টীমরােলারের নির্মম নিষ্পেষণ ও অত্যাচার সয়েও তারা এখনাে শির উঁচু করে দাড়িয়ে আছে।
রুশ-চীনাদের ঐক্যবদ্ধ ষড়যন্ত্রের শিকার
সমৃদ্ধশালী এই অঞ্চলটি সেকাল থেকে চীন ও রুশ সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির খেয়ালীপনার শিকার হয়ে আসছে। তাই বীর তুর্কিস্তানীদের বারবার এই সাম্রাজ্যবাদীদ্বয়ের লােলুপ ও হিংস্র তৎপরতা প্রতিহত করতে হয়েছে। ১৭৫৫ সালে চীন সম্রাট চিনলং হঠাৎ এক শক্তিশালী বাহিনী প্রেরণ করে পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করে নেয়। কিন্তু বীর তুর্কিস্তানীরা মাত্র দু' বছর পরই ১৭৫৭ সালে ক্ষমতালােভী চীনাদের তাড়িয়ে দেয়। ১৭৫৮ সালে চীনারা প্রতিরােধ গড়ে তুললে দীর্ঘ দু’ বছর পর্যন্ত সশস্ত্র লড়াই চলতে থাকে এবং ১৭৬০ সালে আবার তা চীনাদের কব্জায় চলে যায়। দু' বছরের এই প্রতিরােধ যুদ্ধে ১২ লাখ তুর্কিস্তানী শহীদ হয়। যুদ্ধের পর ২২ হাজার মুসলিম পরিবারকে বিশাল চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়ে অত্যন্ত জঘন্য কায়দায় তুর্কিস্তানীদের সংগঠিত হওয়া এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের বিস্তার রােধ করা হয়। কিন্তু তুর্কি মুসলমানদের দাবিয়ে রাখা ছিলাে অসম্ভব। তাই ১৮৬১ সালে তুর্কিস্তানে আবার জিহাদী আন্দোলন শুরু হয় এবং তারা ক্ষমতাসীন চীনাদের নির্মমভাবে পরাজিত করে। কোজার, গুলজার, খতন, কাশগড়, ইয়ারকন্দ প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে একটি স্বাধীনভাবে নতুন মুসলিম রাষ্ট্রের পত্তন হয়।
১৮৬৩ সালে তুমর খান পূর্ব তুর্কিস্তানের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন এবং এর দু’বছর পর সেনাপতি ইয়াকুব বেগ পূর্ব তুর্কিস্তানের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হয়ে পার্শ্ববর্তী সকল ছােট ছােট শাসককে পরাজিত করে এক বিশাল ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে তুলেন এবং কাশগড়কে রাজধানী ঘােষণা করে সুন্দরভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন।
১৮৭৬ সালে আবার চীনারা ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে। ইয়াকুব বেগের মৃত্যু বরণের ফলে পূর্ব তুর্কিস্তানে চরম নেতৃত্বের শূন্যতা বিরাজ করতে থাকে। এই সুযােগে মাঞ্চু রাজবংশ আবার পূর্ব তুর্কিস্তানে আক্রমণ চালায়। তারা মাদ্রাসা মসজিদগুলােকে বিধ্বস্ত করে। মুসলমানদের ধন সম্পদ লুটে নেয়। নারীদের ইজ্জত আবরু হয় ধূলায় ধূসরিত। নির্মমভাবে হত্যা করে তারা দশ লাখ নিরপরাধ নিরস্ত্র মুসলমানকে। বিজয়ী চীনারা তখন পূর্ব তুর্কিস্তানের নাম রাখে সিং কিয়াং এবং পূর্ব তুর্কিস্তানকে আবহমান কাল ধরে পদানত রাখার বদমতলবে সেখানে তারা ব্যাপকভাবে নিজস্ব বস্তি গড়ে তােলে। জনগণের মাঝে প্রচার করতে থাকে চীনাদের সভ্যতা, ধর্মীয় বিশ্বাস, শিক্ষা ও সংস্কৃতি। ফলে অসংখ্য চীনাদের ভীরে ক্রমে সেখানে মুসলিম শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি ম্লান হয়ে যেতে থাকে। মুসলমানদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দেয়াই ছিলাে তাদের এসব করার উদ্দেশ্য।
তবে ১৯১১ সালে মাঞ্চু রাজ বংশের পতনের পর চীনাদের কেন্দ্রীয় শক্তিও দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলমানরা আবার শক্তি ফিরে পায়। এই সুযােগে সংগঠিত হতে থাকে মুজাহিদরা। আবার জাগ্রত হয় বীর তুর্কিস্তানীরা। ১৯৩২ সালে গােটা পূর্ব তুর্কিস্তানে মুজাহিদদের এক সফল বিপ্লবের মাধ্যমে চীনাদের ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। মুসলমানরা সেখানে ইসলামী হুকুমত কায়েম করে এবং খাজা নিয়াজকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করা হয়।
আল কুফরু মিল্লাতুম ওয়াহেদা
ইতিমধ্যে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হয়। পতন হয় জার রাজ বংশের। এ সময় চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব না হলেও পূর্ব তুর্কিস্তানী মুসলমানদের ধ্বংসের লক্ষ্যে রুশ চীনারা একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করে। ১৯৩৩ সালের ২৭শে ডিসেম্বর মুসলমানদের হাতে বন্দী চীনা গভর্নরকে উদ্ধারের অজুহাতে রুশ কমিউনিস্টদের বিমান ও ট্যাঙ্ক বহর পূর্ব তুর্কিস্তানে আক্রমন চালায়। চীন-রাশিয়ার যৌথ আক্রমণের মােকাবেলা করতে না পেরে মাত্র এক বছর বয়সী ইসলামী সরকারের পতন ঘটে। ১৯৩৪ সালে আবার পূর্ব তুর্কিস্তান পরাধীনতার কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। শুরু হয় অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতার এক লােমহর্ষক অধ্যায়। চীনা ও রুশ বাহিনী যৌথভাবে পূর্ব তুর্কিস্তানের ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক, ইমাম, গােত্রীয় নেতা, গুনী ও বুদ্ধিজীবী সহ মােট পাঁচ লক্ষ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিক্ষেপ করে কারাগারের নিচ্ছিদ্র অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। নির্মম অত্যাচার ও অসহনীয় নির্যাতনে তাদের অধিকাংশ কারাগারেই প্রাণ ত্যাগ করে।
শহীদ করা হয় রাষ্ট্র প্রধান খাজা নিয়াজকে। ওরা পবিত্র কুরআন সহ সকল ধর্মীয় কিতাবগুলাে পুড়ে ফেলে। ভবিষ্যতে যেন কেউ ওদের মুকাবিলায় দাড়াতে না পারে এ লক্ষে ওরা জবাই করে নিষ্পাপ কচি কিশাের- কিশােরীদেরকে। নারীদের সম্ভ্রম চাদর ওদের পৈশাচিক থাবায় হয় ছিন্ন-ভিন্ন। এবার ওরা কলেজ সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে পুরােদমে শুরু করে কমিউনিজমের শিক্ষা। তবুও কমিউনিস্টদের নির্যাতনে কুঁকরে যাওয়া কাজিক মুসলমানরা জিহাদের শপথ নিয়ে আবারও অগ্রসর হয়। ১৯৪৪ সালের ১০ই নভেম্বর পূর্ব তুর্কিস্তানে এক সফল জিহাদী বিপ্লব সংঘটিত হয়। বিজয় শেষে আহমদ ইশানকে রাষ্ট্র প্রধান নিযুক্ত করে। একটি স্বাধীন রাজ্য ঘােষণা করা হয়। বিপ্লবীদের ঈসানের মত এরকম গাদ্দারকে রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয়। এই গাদ্দার বিপ্লবীদের চোখের আড়ালে রূশ অপশক্তির নিকট থেকে সুবিধা লাভের আশায় তাদের ক্রীড়াণকে পরিণত হয়। ফলে একটি বিপ্লব ঘটার পরেও পূর্বে যারা ক্ষমতায় ছিলাে তাদেরই এক দোসরকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত দেখা যায়।
এ দিকে ১৯৪৯ সালের ১২ নভেম্বর মাও সেতুং-এর এক বিরাট বাহিনী অতর্কিতে অবৈধভাবে তুর্কিস্তানে প্রবেশ করে। কিন্তু রাশিয়া রহস্যজনক নিরবতা পালন করে তুর্কিস্তানের সরকার ও মুসলমানদেরকে চীনা মাও-বাহিনীর দয়ার উপর ছেড়ে দেয়। উপরন্তু মুসলিম নেতাদেরকে আপতিত কমিউনিস্ট শক্তিকে সমর্থন দানের জন্য প্রবল চাপ দিতে থাকে। ঐ এক পর্যায়ে মাও সেতুং ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নে আহমদ ইসান সহ তুর্কিস্তানী অন্যান্য এ নেতাদের পিকিংয়ে এক গোল টেবিল বৈঠকে যােগদানের আমন্ত্রণ জানায়। আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বিমানে মুসলিম নেতারা পিকিংয়ের পথে যাত্রা করলে পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে আকাশেই বিমানটিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। পাইলট ছাড়া সবাই মৃত্যু বরণ করে। পরে এ পরিকল্পিত হত্যাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। একটি দেশের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা এভাবে আগুনে জ্বালিয়ে ভস্ম করা হয়। এর পর থেকে আভিভাবকহীন পূর্ব তুর্কিস্তানীদের উপর চীনা কমিউনিস্টদের নতুন ভাবে সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। ১৮ থেকে ৪০ বছরের সকল পুরুষদের শ্রমদানে বাধ্য করা হয়। মুসলিম নারীদের অস্ত্রের মুখে পরিচারিকা ও দেহপশারিনী রূপে ব্যবহার করা হয়। আরবী হস্তাক্ষরের পরিবর্তে চীনা হস্তাক্ষরের লেখা ও পড়ার প্রচলন করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে চীনা ভাষা বাধ্যতামূলক করা হয়। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়, পরিবারিক পরিবেশেও আরবী শিক্ষা ও শিক্ষাদান অমার্জনীয় অপরাধ বলে ঘােষিত হয়। মাদ্রাসা ও মসজিদের ওয়াকফকৃত সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
১৯৬৬ সালে পূর্ব তুর্কিস্তানে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে ঘােষণা দেয়া হয় যে, “চীন থেকে ইসলামকে চিরতরে নিঃশেষ করে দিতে হবে। তাই সকল মসজিদের ইমাম, ধর্মীয় ব্যক্তি ও শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে নিপীড়ন -অত্যাচারের নিশানা বানানাে হয়। গ্রেফতারকৃত নির্দোষ মুসলমানদের উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হয় অনেককেই। লাখ লাখ মুসলমানকে মাতৃভূমি পূর্ব তুর্কিস্তান থেকে চীনের দুর্গম প্রত্যন্ত পাহাড়ী অঞ্চলে নির্বাসিত করা হয়। আর মুসলমানদের পরিত্যক্ত ভিটেবাড়ি চীনাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। আজ পশ্চিম তুর্কিস্তানে মুসলমানদের স্বাধীনতা লাভ, আফগানিস্তানে শ্বেতহস্তি রাশিয়ার নির্মম পরাজয় ও দেশে দেশে মুসলমানদের জাগরণে পূর্ব তুর্কিস্তানী মুসলমানরাও স্বাধীনতার হারানো সূর্যের ঝিলিক দেখতে পায়। চীন আজ একথা ভেবে শংকিত, হয়তাে পূর্ব তুকিস্তানী মুজাহিদদের এ হাতে এসে পড়বে আফগানিস্তান বা পাকিস্তান হতে কোন অস্ত্রের চালান। তাই ১৯৯০ সালের বিদ্রোহের পর চীনা সামরিক বাহিনীর উর্ধ্বতন অফিসাররা পূর্ব তুর্কিস্তান পরিদর্শন করার সময় প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে যায়, “কোন ব্যক্তিকে যদি চীনের ঐক্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযােগ পাওয়া যায়, তবে তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে।”
পূর্ব তুর্কিস্তানী মুসলমানদের সংখ্যালঘু জাতিতে পরিণত করার এক ঘৃণ্য প্রয়াস
অত্যাচার আর অনাচারের পরও দুর্দমনীয় পূর্ব তুর্কিস্তানী মুসলমানদের বাগে না আনতে পেরে এবার চীনা কর্তৃপক্ষ প্রজন্ম ধ্বংসের মত রাক্ষুসী তৎপরতায় মেতে উঠেছে!
১৯৫৩ সালে পূর্ব তুর্কিস্তানে সর্বমােট জনসংখ্যা ৪৪,২০,০০০-এর মধ্যে শতকরা ৯০% জন মুসলমান ছিলাে, আর অমুসলিম ছিলাে ৪,৫৪,০০০। অমুসলিম দের মধ্যে চীনারাই ছিলো বেশী। ১৯৫৩ সালে পূর্ব তুকিস্তানে চীনাদের বসতি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে চীনাদের সংখ্যা অভাবনীয় ভাবে বেড়ে যায়। ১৯৬৪ সালে পূর্ব তুর্কিস্তানে লােক সংখ্যা ছিলাে ৮০ লাখ। যাদের ৫৭,০০,০০০ জন মর্থাৎ ৭১% ছিলাে মুসলমান। আর অবশিষ্ট ২৩,০০,০০০ লাখ ছিলাে অমুসলিম। ১৯৮২ সালে জনসংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখে গিয়ে পৌছে। যার মধ্যে মাত্র ৯০ লাখ মুসলমান। অর্থাৎ ৫৩ সালে যাদের সংখ্যা ছিলাে চার লক্ষ চুয়ান্ন হাজার মাত্র, ত্রিশ বছরে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় পয়ত্রিশ লক্ষে। সে হারে মুসলমানদের সংখ্যা এখন পাঁচ কোটিতে পৌঁছার কথা। ত্রিশ বছরে মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র দ্বিগুণ। হয়েছে আর চীনাদের সংখ্যা বেড়েছে সাত গুন। প্রশ্ন জাগে, গেলাে কোথায় এই চার কোটি মুসলমান? জবাব হলো, তাদের হত্যা অথবা নির্বাসিত করা হয়েছে। চার কোটি মুসলমানের জীন ওরা ধ্বংস করেছে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে।
বিগত ৪৪ বছরে বহু মুসলমানদের পূর্ব তুর্কিস্তান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ১৯৪৯ সালে ৪০০৫১০ জন কাজিক মুসলমানকে বাধ্যতামূলক পাঠিয়ে দেয়া হয় ভারতে। তাদের অধিকাংশই পথে শাহাদাত বরণ করে। ১৯৫৯-৬২ সালে ২০০০০০ কাজিক ও আলগীর মুসলমান দেরকে সােভিয়েত ইউনিয়নে তাড়িয়ে দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালে পূর্ব তুর্কিস্তানীয় বহু তাতার পরিবারকে হংকং ও অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাসিত করা হয়। ১৯৮২ সালে সর্বমােট ২৫০০০০ জন মুসলমানকে পূর্ব তুর্কিস্তান থেকে বের করে দেয়া হয়। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা আমরা জানি না। নির্যাতিত মুসলমানরা বিভিন্ন সময়ে ২২০০০০ সােভিয়েত ইউনিয়নে, ১০,০০০ তুরস্কে, ২,০০০ পাকিস্তানে, ১,০০০ আফগানিস্তানে ও ভারতে আশ্রয় নেয়। গত ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত কারেন্ট ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, ১৯৫৩ সালে পূর্ব তুর্কিস্তানে মুসলিম আলঘুরী ছিলাে ৭৫%, আর চীনারা ছিলাে ৬%। কিন্তু ১৯৯০ সালে আরঘুর জনসংখ্যা এসে দাড়ায় ৪০%, আর চীনাদের সংখ্যা ৫৩% গিয়ে পৌঁছে। সেখানের মুসলমানরা কি পরিমাণ নির্যাতিত ও শহীদ হয়েছে তা এর দ্বারা কিছুটা অনুমান করা যায়।
অবশিষ্ট পূর্ব-তুর্কিস্তানী মুসলিম কৃষকরা এখনও নিপীড়িত হচ্ছে বিভিন্ন ভাবে। রাষ্ট্রীয় সকল সুযােগ-সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। তাদের চাষের জমি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক টানাপােড়েনে ৮৫% ভাগ কৃষকই ইতিমধ্যে অভাবে-ক্ষুধার যন্ত্রণায় মাটির সাথে মিশে গেছে। হাজার হাজার কৃষক এখনও আকাশের নিচে বসবাস করছে। অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আজ হাজার হাজার মুসলমান ধুকে ধুকে মরছে। তাদের খবর কে রাখে?
আজ পর্যন্ত অসহায় পূর্ব তুর্কিস্তানী মুসলমানরা বর্হিবিশ্বের কোন দেশ থেকে সাহায্য পায়নি। বার বার বিদ্রোহ, আন্দোলন করে তারা আজ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। তবে আশার কথা হলাে, জিহাদ ও স্বাধীনতার যে আগুন পূর্ব তুর্কিস্তানী মুসলমানদের অন্তরে ধিকি ধিকি জ্বলছিলাে তা মাও সেতুং-এর মৃত্যুর পর আবার ধূমায়িত হয়ে ওঠে। তারা আবার সােচ্চার হয়। ফলে ১৯৯০ সালে পূর্ব তুর্কিস্তানে মার্শাল'ল জারী করা হয়। মুসলিম নেতাদের তৎপরতার উপর কঠোরতা আরােপ করা হয়। তবুও তারা হতাশ নয়। যদিও স্বাধীনতার সংগ্রাম ও জিহাদী স্পৃহা সাময়িক ভাবে চাপা পড়েছে। এ আগুন শত শিখায় জ্বলে উঠবেই-ইনশা আল্লাহ। সােভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর পশ্চিম তুর্কিস্তান স্বাধীনতা ঘােষণা করে এবং আপামর জনসাধারণ নির্বিঘ্নে ধর্ম কর্ম পালনের সুযােগ পেয়েছে। চীনা কমিউনিস্ট সরকার পূর্ব তুর্কিস্তান নিয়ে দারুন চিন্তিত। গােয়েন্দা বাহিনীকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নতুন কোন মসজিদ নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে তুর্কিস্তানী মুসলমানদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
যে কোন সময় তা বিস্ফোরিত হয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৯০ সালের এপ্রিল মাসে কাশগড়ে মুসলমানরা বিদ্রোহ করলে কমিউনিস্ট সরকার নির্মমভাবে তা প্রতিহত করে। ঘটনাস্থলে ২২ জন শহীদ হয়। গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার মুসলমানকে। ১২ হাজার মুসলমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী করা হয়। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও পূর্ব-তুর্কিস্তানী মুসলমানরা বীর শ্রেষ্ঠ মুজাহিদ ঈসা ইউসুফের নেতৃত্বে এক দুর্বার আন্দোলনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। হয়তাে অদূর ভবিষ্যতে তাদের এ বিপ্লবের আগুনে জ্বলে ভস্মিভূত হবে সাম্রাজ্যবাদী চীন। আজকের বিলুপ্ত সােভিয়েত ইউনিয়নই এর প্রকৃষ্ট নজীর। পূর্ব তুর্কিস্তানের নীলাভ আকাশে কবে উড়বে আজাদীর রক্ত লাল সবুজ পতাকা- আমরা সেই শুভক্ষনের অপেক্ষায়। আল্লাহর সাহায্য ও আমাদের সকল চেষ্টা-সহানুভূতি তাদের সাথে থাকবে অবশ্যই।
═──────────────═